১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ, ১২৮০ বঙ্গাব্দের ১৩ জৈষ্ঠ্য ফলহারিণী কালী পূজার রাত্রিটি শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সাধন জীবনে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি তিথি। সেদিন আঠেরো বছরের সারদা দেবীকে আদ্যাশক্তি মহামায়ার দশমহাবিদ্যার অন্যতম ষোড়শী রূপে পূজা করেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। দেবী পূজার মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে শ্রীরামকৃষ্ণদেব সমাধিমগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন। কিছুটা সংবিৎ ফিরলে ঠাকুর প্রণাম করলেন সারদা দেবীকে । অর্পণ করলেন নিজের সারা জীবনের সাধনার ফল এবং জপের মালা।শ্রীরামকৃষ্ণ ও মা সারদা ছিলেন এক অন্য জগতের মানুষ। এদের ভাব অধিকাংশ মানুষই বুঝতে পারবে না। তাঁদের দাম্পত্যজীবন কোন সাধারণ দাম্পত্য জীবন ছিলো না। তাঁরা উভয়েই ছিলেন এক অলৌকিক দাম্পত্য সঙ্গী । সমাজের আর পাঁচটা মানুষের নিক্তিতে তাঁদের অলৌকিক জীবন পরিমাপ করা দুঃসাধ্য। বা কিছু কিছু ক্ষেত্রে অসাধ্যই বলা চলে। পবিত্র যুগলের স্বতন্ত্র এই দাম্পত্য জীবন কথার অলৌকিক বিভাটুকু আজও আমাদের আচ্ছন্ন করে। এ কারণেই চণ্ডীদাস বলেছেন:
"মরম না জানে ধরম বাখানে
এমন আছয়ে যারা ।
কাজ নাই সখি তাদের কথায়
বাহিরে রহুন তারা ॥"
ফলহারিণী কালী পূজার দিনে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে শ্রীজগদম্বা কালীকে পূজো করার জন্য বিশেষ আয়োজন করেছেন । এ পূজার বর্ণনাটি 'শ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ' গ্রন্থে অত্যন্ত সুন্দর করে বর্ণিত হয়েছে। দেবী পূজার আয়োজনটি দক্ষিণেশ্বরের মায়ের মন্দিরে নয়। আয়োজনটি হয় তাঁর মন্দির সংলগ্ন ছোট্ট ঘরে। অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালে গুপ্তভাবে । সারদা দেবীকে আলপনা দেওয়া আসনে বসানো হয়। অমাবস্যার অন্ধকার রজনীতে রাত্রি ক্রমে ৯ টা বেজে যায়। অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকারে আশেপাশের পরিবেশ নিস্তব্ধ হয়ে যায় । রাধাগোবিন্দ মন্দিরের রাত্রিকালীন পূজা শেষ করে এসে দিনু পূজারী ঠাকুরকে এই বিশেষ পূজায় সাহায্য করতে লাগলেন । সারদা দেবী এসে উপস্থিত হলেন । শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ষোড়শী পূজায় বসলেন। ঠাকুরের ইঙ্গিতে আলপনা দেওয়া আসনে সারদা দেবী উপবেশন করলেন। তাঁর অনেকটা অর্ধবাহ্যদশা অবস্থা। ঠাকুর মন্ত্রপূত জল দিয়ে সারদা দেবীকে অভিষিক্তা করলেন । তারপর প্রার্থনা মন্ত্র উচ্চারণ করলেন "হে বালে , হে সর্বশক্তির অধীশ্বরী মাতঃ ত্রিপুরাসুন্দরী , সিদ্ধিদ্বার উন্মুক্ত কর , এর ( সারদা দেবীর ) শরীর মনকে পবিত্র করে এতে আবির্ভূত হয়ে সর্বকল্যাণ সাধন করো" । যথাবিধানে ন্যাস করে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব সাক্ষাৎ দেবীজ্ঞানে সারদা দেবীকে ষোড়শোপচারে পূজা করে ভোগ নিবেদন করলেন। দেবী কালিকার দশমহাবিদ্যার অন্যতম দেবী ষোড়শীর ধ্যানমন্ত্রটি হল:
বালার্কমগুলাভাসাং চতুৰ্বাহুং ত্রিলোচনাম্।
পাশাঙ্কু শশরাংশ্চাপং ধারয়ম্ভীং শিবাং শ্রয়ে।।
"উদিত সূর্যের মতো দেবীর গাত্রবর্ণ। ইনি চতুৰ্বাহু, ত্রিলোচনসম্পন্না। চার হাতে পাশ-অঙ্কুশ-শর ও চাপ।"
নিবেদিত ভোগের কিছুটা শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নিজে হাতে স্ত্রী সারদার মধ্যে আহ্বানকৃত ষোড়শীর মুখে দিলেন । বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে সারদা দেবী সম্পূর্ণভাবে সমাধিস্থা হলেন। অর্ধ বাহ্য দশায় মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবও সমাধিস্থ হলেন । এভাবে দীর্ঘক্ষণ কেটে গেল। ধীরেধীরে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবেদের বাহ্যজ্ঞান ফিরে এলো। তিনি নিজের সাধনার সমস্ত ফল এবং জপের মালা প্রভৃতি ষোড়শী দেবীর পাদপদ্মে চিরকালের অর্পণ করলেন। সমাপ্ত হল দেবীপূজা। যিনি আমাদের কর্মফল হরণ করেন এবং মোক্ষ দান করেন তিনিই ফলহারিণী কালী। তিনি জীবের সকল প্রকারের কর্মফল হরণ করে, সাধকের হৃদয়কে সকল কলুষতা এবং পঙ্কিলতা থেকে মুক্তি প্রদান করেন। জীবনের সকল বিপদাপদ, দুঃখ, দৈন্য, ব্যাধি ও সকল অশুভ শক্তিকে বিনাশ করেন তিনি। সাধককে ঐশ্বর্য্য, আরোগ্য, বল, পুষ্টি, কীর্তি, গৌরব ইত্যাদি প্রদান করেন দেবী। ফলহারিণী কালী পূজায় সাধকের আধ্যাত্ম্য চেতনার দ্রুত বিকাশ ঘটে এবং মুক্তি লাভ হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ষোড়শী পূজা এর বড় দৃষ্টান্ত।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
ফেসবুক পোস্ট লিঙ্ক : শ্রীরামকৃষ্ণের ষোড়শীপূজা।