-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

"জীবো জীবস্য জীবনম্" জীবই জীবের খাদ্য ও জীবন ।

"জীবো জীবস্য জীবনম্"   জীবই জীবের খাদ্য ও জীবন  সনাতন জৈবধর্ম সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষেরই ধারণা নেই। তারা জানে না যে, জীবই জীবের জীবন। একটি জীবকে ভক্ষণ করেই অন্য জীব বেঁচে থাকে। প্রতিনিয়ত জ্ঞাত অথবা অজ্ঞাতসারে না চাইলেও বৃহৎজীব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবের মৃত্যুর কারণ হচ্ছে। শাস্ত্রে অহেতুক প্রাণীহত্যা নিষেধ করা হয়েছে। ভক্ষ্য প্রাণীকে ভক্ষক প্রাণীরা জীবন ধারণের জন্য খেতে পারে। মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, প্রতিদিন ভক্ষ্য প্রাণিসকল ভক্ষণ করে ভোক্তা প্রাণী কোন প্রকারের পাপভাগী হয় না। কারণ বিধাতাই এ জগতে একই সাথে ভক্ষ্য ও ভক্ষককে সৃষ্টি করেছেন। নাত্তা দূষ্যত্যদন্নাদ্যান্ প্রাণিনোহহন্যহন্যপি ।  ধাত্রৈব সৃষ্টা হ্যাদ্যাশ্চ প্রাণিনোঽত্তার এব চ ৷৷ (মনুসংহিতা:৫.৩০) "প্রতিদিন ভক্ষ্য প্রাণিসকল ভক্ষণ করে ভোক্তা দোষভাগী হয় না। বিধাতাই ভক্ষ্য প্রাণী ও ভক্ষকগণকে সৃষ্টি করেছেন ।" শ্রীমদ্ভাগবতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, "জীবো জীবস্য জীবনম্"। জীবই জীবের জীবন তত্ত্বটি আধুনিক জীববিজ্ঞানের প্রধানতম সূত্র।যে সূত্রের উপরে ভিত্তি করে পরবর্তীতে বহুসূত্র তৈরি হয়ে জীব বিজ্ঞান বিকশিত হয়েছে। ভাবতে অবাক লাগে যে আধুনিক জীববিজ্ঞানের এই খাদ্যশৃঙ্খল তত্ত্বটি শ্রীমদ্ভাগবতের প্রথম স্কন্ধেই রয়েছে: কালকর্মগুণাধীনো দেহোঽয়ং পাঞ্চভৌতিকঃ। কথমন্যাংস্তু গোপায়েৎ সর্বগ্রস্তো যথা পরম্ ৷৷  অহস্তানি সহস্তানামপদানি চতুষ্পদাম্। ফল্গূনি তত্র মহতাং জীবো জীবস্য জীবনম্॥ তদিদং ভগবান্ রাজন্নেক আত্মাঽত্মনাং স্বদৃক্।  অন্তরোঽনন্তরো ভাতি পশ্য তং মায়য়োরুধা৷৷  সোঽয়মদ্য মহারাজ ভগবান্ ভূতভাবনঃ। কালরূপোঽবতীর্ণোঽস্যামভাবায় সুরদ্বিষাম্॥ ( শ্রীমদ্ভাগবত: ১ ১৩.৪৫-৪৮) "অজগর যাকে গ্রাস করেছে সে যেমন অন্যকে রক্ষা করতে পারে না, তেমনি কাল, কর্ম ও ত্রিগুণের অধীন পাঞ্চভৌতিক এই দেহের পক্ষে অন্য কাউকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। ভগবানই সকলের উপযুক্ত জীবিকা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। হাতযুক্ত মানুষ হাত নেই এমন প্রাণীদের খেয়ে বেঁচে থাকে। চতুষ্পদ পশুরা পা নেই এমন খাদ্য অর্থাৎ তৃণ-লতাপাতা খায়। এভাবে বড় প্রাণীরা ছোট প্রাণীদের খেয়ে বেঁচে থাকে। এইভাবে এক জীবই অন্য জীবের খাদ্য - এই নিয়ম। এ জগৎ ভগবানই। তিনিই সর্বজীবের আত্মা, অথচ অদ্বিতীয়, ঐভাবে স্বপ্রকাশ। তিনিই অন্তরস্থ, তিনিই বহিঃস্থ। এক ঈশ্বরই মায়াপ্রভাবে দেব, মানুষ প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রতীয়মান হচ্ছেন। তুমি কেবল তাঁরই ধ্যান কর। হে মহারাজ! সেই মহামায়াময় প্রাণীগণের জীবনদানকারী সেই ভগবান বর্তমানে এ পৃথিবীতে দেবদ্রোহীদের নিধনের জন্য কালরূপে অবতীর্ণ হয়েছেন।" এখানে বলা হয়েছে, ভগবানই সকলের উপযুক্ত জীবিকা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তাই হাতযুক্ত মানুষ হাত নেই এমন প্রাণীদের খায়, পা যুক্ত পশুরা পা নেই এমন খাদ্য অর্থাৎ ঘাস-লতাপাতা খায়। এভাবে বড় প্রাণীরা ছোট প্রাণীদের খেয়ে বেঁচে থাকে। এ খাদ্য শৃঙখলের বিষয়টি অত্যন্ত স্বাভাবিক। অর্থাৎ আমরা চাই বা না চাই ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক আমরা প্রাণীহত্যা করছি। হয়ত নিজেরা টেরও পাচ্ছি না। আধ্যাত্মিক অথবা মানবিক মূল্যবোধের দৃষ্টিতে জগতে অনেকেই নিরামিষ আহার করে। নিরামিষ আহার স্বাস্থ্যের জন্য কল্যাণের। কারণ এ খাবারটি সহজপাচ্য। কে কি খাবে তা নিয়ে জোরজবরদস্তি না করে সে বিষয়টি যার যার ব্যক্তিগত রুচি এবং খাদ্যাভ্যাসের উপরেই ছেড়ে দেয়া মঙ্গল। ব্যক্তিই তার নিজস্ব রুচিবোধ অনুসারে খাদ্য এবং খাদ্যাভ্যাস নির্বাচন করে নিবেন। তাই অহেতুকী খাদ্যাভ্যাস নিয়ে বিশেষ করে অমিষ নিরামিষ নিয়ে অত্যন্ত আলোচনা সমালোচনার প্রয়োজন নেই। অবশ্য যে আমিষ এবং নিরামিষ নিয়ে এত কথা বলা হল, ভালো করে তলিয়ে দেখলে দেখা যায় নিরামিষ বলতে আসলে কিছুই নেই। জগতের প্রায় সকল খাবারেই আমিষ আছে। তাই বাক্যটি হওয়া উচিত উদ্ভিজ্জ আমিষ এবং প্রাণীজ আমিষ। নিরামিষভোজীগণ কোন প্রাণী হত্যা করেন না বলে তারা উদ্ভিজ্জ আমিষ গ্রহণ করেন। কিন্তু তারা অনেকেও ভেবে দেখেন না যে, নিরামিষ বলতে আমরা চিনি সেই ধান, গম, জব, ভুট্টাসহ বিবিধ প্রকারের শাকসবজি বৃক্ষের প্রাণ রয়েছে। হয়ত মনুষ্যের মত বুদ্ধিসত্ত্বা না থাকলেও তাদের প্রাণ রয়েছে এবং চেতনা রয়েছে। এরাও অনেক কিছুই বুঝতে পারে। উদ্ভিদের যে প্রাণ রয়েছে এ বিষয়টি আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু আবিষ্কার করেছেন। বিষয়টি সমগ্র পৃথিবীর জন্য নতুন তত্ত্ব হলেও ভারতবর্ষের জন্যে নতুন নয়। উদ্ভিদের যে প্রাণ রয়েছে, এ বিষয়টি বেদ-পুরাণাদি শাস্ত্রে সৃষ্টির শুরু থেকেই রয়েছে। সেই পুরাতন তত্ত্বই শুধু আধুনিক বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় প্রকাশ করেছিলেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু।  বিবিধ শাস্ত্রে বিষয়টি রয়েছে। এরমধ্যে অষ্টাদশ পুরাণের অন্যতম ভবিষ্যপুরাণে সৃষ্টি অংশে আমরা দেখতে পাই, অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে সকল প্রকারের জীব কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে, তা বলা হয়েছে।জরায়ুজ, অণ্ডজ, স্বেদজ এবং উদ্ভিজ্জ এই চারপ্রকার সৃষ্টি বর্ণিত হয়েছে। সেখানে উদ্ভিদ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তারা নিজের মধ্যে অল্পজ্ঞান রাখার জন্য জড় সৃষ্টি বলে পরিচিত কিন্তু এদেরও সুখ এবং দুঃখের অনুভব রয়েছে। অর্থাৎ একটি ছাগল, ভেড়াকে হত্যা করলে যে অনুভব হয়, সেই অনুভব একটি বৃক্ষ, গুল্মলতাকে করলেও হয়। শুধু কম আর বেশি। ছাগল, ভেড়াকে হত্যা করলে তার কষ্ট যাতনা দৃশ্যমান হয়, পক্ষান্তরে বৃক্ষ, গুল্মলতার কষ্ট যাতনা দৃশ্যমান নয়। তবে তাদের কষ্ট যাতনা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে উপলব্ধি করা যায়। ভবিষ্যপুরাণ অনুসারে পরমেশ্বর সৃষ্টির ইচ্ছায় প্রথমত তিনি দশজন মহর্ষি প্রজাপতির সৃষ্টি করেলেন। দশজন প্রজাপতি মহর্ষিরা হলেন- নারদ, ভৃগু, কম্, প্রচেতস, পুলহ, ঋতু পুলস্ত্য, অত্রি, অঙ্গিরস এবং মরীচি। মরীচি হলেন প্রথম প্রজাপতি। এঁকে এবং অন্যদের প্রচুর তেজ দ্বারা তিনি সৃষ্টি করেছিলেন।এরপরে পর্যায়ক্রমে তিনি দেবতা, ঋষি, দৈত্য, রাক্ষস, যক্ষ, পিশাচ, গন্ধর্ব, অপ্সরা এবং অসুরদের সৃষ্টি করেন। মনুষ্যানাং পিতৃণাংশ্চ সর্পাণাং চৈব ভারত। নগানাং চ মহাবাহো সসৰ্জ বিবিধান্ গণান্।।  ক্ষণরুচোহশনিগণাত্রৌহিতেন্দ্ৰধনুংষি চ ।  ধূমকেতূং স্তথাচৌল্কানির্বাতা জ্যোতিষাংগণান্।।  মনুষ্যাক্নিন্নরান্ মস্ত্যান্বরাহাংশ্চ বিহংগ মান্।  গজানশ্চানথ পশুন মৃগান্ব্যালাংশ্চ ভারত।। কৃমিকীর্তপতংগাংশ্চ মুকালিক্ষকমৎকুণান। সর্ব চ দংশমশকং স্থাবরংচ পৃথগ্বিধম্।। এবং স ভাস্করো দেব সসর্জ ভুবনত্রয়ম্। যেযাং তু যাদৃশং কর্ম ভূতানামিহ কীৰ্তিতম্।।  কথয়িষ্যামি তৎ‍সর্বং ক্রমযোগং চ জন্মনি। গজা ব্যালা মৃগাস্তাত পশবয়চ পৃথগ্বিধাঃ।। পিশাচা মানুষা তাত রক্ষাংসি চ জরায়ুজাঃ। দ্বিজাস্ত্য অণ্ডজাঃ সৰ্পা ণক্রা মৎস্যাঃ সকচ্ছপাঃ।। এবং বিধানি মানীহ স্থলজান্যৌদকানি চ। স্বেদজং দংশমংশকং কালিক্ষ কমৎকুণাঃ।। উষ্মণা চোপজায়ন্তে সচ্চান্যক্তিচিদীদশম্।  উদ্ভিজ্জাঃ স্থাবরাঃ সর্বে বীজকাণ্ড প্ররোহিণঃ।। ঔষধ্যঃ ফলপাকান্তা নানাবিধফলোপগাঃ ।  অপুষ্পাঃ ফলবন্তৌ যে তে বনস্পতয়ঃ সমৃতাঃ।।  পুষ্পিণঃ ফলিণশ্চৈব বৃক্ষাস্তূভয়তঃ সমৃতাঃ।  গুচ্ছগুল্মং তু বিবিধং তথৈব তৃণজাতয়ঃ।।  বীজকাণ্ডরু হান্যেব প্রতানা বল্লয় এব চ ।  তমসা বহুরূপেন বেষ্টিতাঃ কর্মহেতুনা।। অন্তঃ সংজ্ঞা ভবন্ত্যে তে সুখদুঃখসমন্বিতাঃ।  এতাবত্যস্তু গতয়ঃ প্রোদ্ভূতাঃ কুরুনন্দন।।  তসমাদ্দেবাদ্দীপ্তি-মন্তৌ ভাস্করচ্চ মহাত্মনঃ।  ঘোরেসিমংস্তাত সংসারে নিত্যং সততয়ায়িনি।৷  এবং সর্বং সসৃষ্ট্রেদং রাজল্লেঁকগুরুং পরম্।  তিরোভূতঃ স ভূতাত্মা কালং কালেন পীড্যণ্।। (ভবিষ্যপুরাণ: ব্রাহ্মপর্ব, সৃষ্টি, ৬৪-৭৮) "হে ভারত! মহাবাহ মনুষ্য, পিতৃগণ, সর্পবর্গ, নাগ এবং বিবিধগণেরসৃষ্টি করেছেন।। বিদ্যুৎ, অশনি, রেহিতেন্দ্র ধনু, ধূমকেতু, উল্কা নিপাত, জ্যোতিগণ, মানুষ, কিন্নর, মৎস্য, বরাহ এবং বিহঙ্গের সৃষ্টি করেছেন। হাতি, ঘোড়া, পশু, মৃগ এবং হিংস্র জন্তুর সৃষ্টি করেছেন।। কৃমি, কীট, পতঙ্গ, জোঁক, লিক্ষা এবং ছারপোকা সৃষ্টি করেছেন। দংশ (ডাঁশ) এবং বিবিধ মশার সৃষ্টি করেছেন।। এই ভাবেই সূৰ্য্যদেব এই ভুবনত্রয় নির্মাণ করেছেন, যেখানে প্রাণীদের বিভিন্ন কর্ম নির্দেশ করা হয়েছে। এরপর ভবিষ্যজন্মের সব ক্রমযোগ বলা হবে, হে পিতা! হস্তি, হিংস্র জন্তু, মৃগ এবং অন্য প্রকারের পশুবর্গ, পিশাচ, মানুষ, রাক্ষস সব কিছু জরায়ুজ। পক্ষী, সর্প, মৎস্য এবং কচ্ছপ হল অণ্ডজ। জরায়ুতে উৎপন্ন হলে জরায়ুজ এবং অণ্ড (ডিম) থেকে উৎপন্ন হলে সেই জীবকে বলা হয় অণ্ডজ। কিছু জীব আছে যারা স্থলভাগে জন্মায় এবং কিছু জীব আছে যারা জলে জন্মায়। দংশনকারী মশা, জোঁক, লিক্ষা এবং ছারপোকা এদের স্বেদজ বলা হয়। কারণ এরা স্বেদ থেকে উৎপন্ন হয় আর এক প্রকারের জীব আছে যাদের উদ্ভিজ্জ বলা হয় কারণ এরা ভূমিতে সৃষ্ট হয় এবং বীজ কাণ্ড পরিণত হয়। এইভাবে জরায়ুজ, অণ্ডজ, স্বেদজ এবং উদ্ভিজ্জ এই চারপ্রকার সৃষ্টি হয়েছে। ওষধি, ফল অন্তে পক্ব হয়, নানাপ্রকার ফলযুক্ত এবং পুষ্প রহিত, তাকে বনস্পতি বলা হয়।। বৃক্ষ দুই প্রকারের হয়। কিছু বৃক্ষ আছে শুধুমাত্র যাতে ফুল হয় এবং কিছুবৃক্ষ আছে যার ফুল ও ফল দুই-ই হয়। গুচ্ছ, গুল্ম অনেক প্রকারের হয়। এভাবে তৃণেরও বিভিন্ন জাতি উৎপন্ন হয়। বীজ এবং কাণ্ডতে প্ররোহণ প্রাপ্ত বৃক্ষকে বল্লী বলে। অনেকপ্রকার কর্মস্বরূপ হেতুর অন্ধকারে সব বেষ্টিত হয়ে আছে।। এরা নিজের মধ্যে অল্পজ্ঞান রাখার জন্য জড় সৃষ্টি বলে পরিচিত কিন্তু এদেরও সুখ এবং দুঃখের অনুভব অবশ্যই থাকে। অতএব এরা সুখ-দুঃখ সমন্বিত হয়। হে কুরুনন্দন! এই গতি উদ্ভূত হয়। মহান আত্মা সূর্য্যদেবের আলোয় দীপ্ত হয় এবং নিরন্তর গমনশীল এই ঘোর সংসারে প্রকট হয়। এইভাবে তিনি জগত সৃষ্টি করে একসময় থেকে অন্য সময়কে পীড়িত করেন এবং তিনি ভূতাত্মা পরমলোকে তিরোভূত হয়ে যান।" ভবিষ্য পুরাণের সৃষ্টি বর্ণনের ৭১ থেকে ৭৬ শ্লোকে সম্পূর্ণ বৃক্ষ, গুল্মসহ উদ্ভিদ সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। এবং সেই উদ্ভিদদের সুখ-দুঃখ সমন্বিত জীব হিসেবে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে। মহর্ষী বেদব্যাস কোন প্রকার এসকোনোগ্রাফার ছাড়াই বলেছেন যে, উদ্ভিদের উপর বিভিন্ন প্রকার বাহ্যিক প্রভাবকের প্রভাবে ইলেক্ট্রন প্রবাহের ঘটনা ঘটতে পারে। ফলে উদ্ভিদও সুখ দুঃখের আবর্তনে প্রবাহিত হয়। ভবিষ্য পুরাণে আরও সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে যে, সূর্যের বিকিরণের কারণেই উদ্ভিদের মধ্যে ইলেক্ট্রনের প্রাবাহ ঘটে। বর্তমান বায়োকেমিস্ট বিজ্ঞানীরাও স্বীকার করেছেন বৃক্ষের কোষ মেমব্রেন বিভবের পরিবর্তন ও ইলেক্ট্রন প্রবাহের জন্য বেশি দায়ী সূর্যের রশ্মি।  "জীবো জীবস্য জীবনম্" এ শাস্ত্রীয় এবং বৈজ্ঞানিক তত্ত্বটি আমরা মহাভারতের বনপর্বেও পাই। সেখানে ধর্মব্যাধ ব্রাহ্মণ কৌশিককে বিবিধ উদাহরণে মাধ্যমে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বিষয়টি বলেন। অনেকে কৃষিকাজকে উত্তম বলে মনে করেন, তাদের ধারণা কৃষিকাজে কোন জীব হিংসা নেই। কিন্তু তারা হয়ত জানেন না যে কৃষিকাজেও গুরুতর হিংসা রয়েছে। কৃষিকাজ করার সয়য়ে  কারণ, মানুষ লাঙ্গলের দ্বারা ভূমি কর্ষণ করার সময়ে অজ্ঞাতসারে ভূমির মধ্যে অবস্থিত বহু প্রকারের ক্ষুদ্র জীব হত্যা করে। এ সকল অধিকাংশ ক্ষুদ্র জীবকে খালি চোখে দেখা যায় না। তাই তাদের হত্যায় কেউ বিচলিত হয় না। শাস্ত্রীয়ভাবে উদ্ভিদ তো জীব বটেই, এমনকি ধান, গম, জব প্রভৃতি  শস্যের বীজও। কারণ এই বীজ থেকে নতুন উদ্ভিদের জন্ম হয়। অথচ সেই ধানকে খাদ্যশস্য হিসেবে নির্দ্বিধায় খেয়ে যাই। মানুষেরা প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে বৃক্ষ-লতা ছেদন করে। এতেও জীব হত্যা হয়। কারণ তাদেরও চেতনসত্ত্বা আছে। বৃক্ষে যেমন প্রাণ রয়েছে, তেমনি বৃক্ষের ফলেও প্রাণ রয়েছে। একারণেই ফল থেকে আরেকটি বৃক্ষের জন্ম হয়। বীজের ভেতরে ফলের ভেতরে চেতন সৃষ্টি প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকায় তাদের থেকে নতুন উদ্ভিদের সৃষ্টি হয়। ভাবতে অবাক লাগে যে, অণুবীক্ষণযন্ত্রসহ আধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে বর্তমান আমরা জানতে পেরেছি যে জলের মধ্যে অসংখ্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীব রয়েছে। প্রতি গ্লাস জল খাওয়ায় সাথে সাথে আমরা এ অসংখ্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবকেও দৃষ্টির অজান্তে মনের অজান্তে খেয়ে ফেলছি। ভাবতে অবাক লাগে যে, জলে যে বহু প্রকারের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীব রয়েছে, এ অত্যন্ত আধুনিক তত্ত্বটি মহাভারতে রয়েছে। যা সত্যি অত্যন্ত বিস্ময়ের। আমাদের শাস্ত্রগ্রন্থাদি ত্রিকালদর্শী মুনি ঋষিদের প্রণীত। তাঁরা ছিলেই সেই কালের সর্বশ্রেষ্ঠ তত্ত্বদ্রষ্টা এবং বৈজ্ঞানিক বিষয় আজ বহুক্ষেত্রেই পশ্চিমা বৈদেশিক বিজ্ঞানীদের দ্বারা প্রমাণিত। এ সমগ্র জগত প্রাণিভোজী প্রাণিগণদ্বারাই পরিব্যাপ্ত। জ্ঞানত অথবা অজ্ঞাতসারে প্রাণী ভক্ষণ করেই সকল প্রাণী বেঁচে আছে। এমনকি জলের মধ্যে একই মৎস্য বংশের হওয়ার পরেও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মৎস্যদেরকে বৃহত্তর মৎস্যরা ভক্ষণ করে তাদের জীবন নির্বাহ করে। নিজ প্রকারের প্রাণীদের ভক্ষণের এই যে স্বভাব মৎস্যদের। এর জন্যে তারা নিজেরা দায়ি নয়, তারা জন্মগতভাবে এই খাদ্যাভ্যাস পেয়েছে। প্রাণীকুলে এমন অনেক প্রাণী রয়েছে, যারা  অন্য প্রাণীদের আত্মসাৎ করেই জীবিত থাকে। মানুষ এবং বিভিন্ন প্রকারের পশুপাখি ইত্যাদি  জঙ্গম প্রাণীরা, চলাফেরা করতে পারে। তারা যখন ভূতলে অনবরত বিচরণ করে, তখন তাদের পায়ের আঘাতে বহু ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীব নিহত হয়। এমনকি অনেক জ্ঞানী এবং মহান ব্যক্তিরাও, যাদের হৃদয়ে সমগ্র জীবের প্রতি করুণার ভাব প্রবল; তারাও তাদের অজান্তেই চলাফেরা, উপবেশন এবং শয়নসহ বিবিধ প্রকারের কর্ম করার সময়ে অসংখ্য প্রাণীকে বিনাশ করে থাকেন। এই সমগ্র আকাশ এবং পৃথিবী প্রাণীদ্বারাই ব্যাপ্ত রয়েছে। জ্ঞানত বা অজ্ঞানত প্রাণীরাই প্রাণীদের হিংসা বা বধ করে বেঁচে থাকে। তাই প্রাণী হত্যা না করে একদণ্ডও কোন প্রাণী বেঁচে থাকতে পারবে না। কোন প্রাণী যখন জীবন ধারণের জন্য নিঃশ্বাস গ্রহণ করে, তখনও অসংখ্য প্রাণী নিঃশ্বাসের সাথে সেই প্রাণীর শরীরে প্রবেশ করে মৃত্যুবরণ করে। কৃষিং সাধ্বিতি মন্যন্তে তত্র হিংসা পরা স্মৃতা। কর্ষন্তো লাঙ্গলৈর্মত্যা ঘ্নন্তি ভূমিশয়ান বহূন্। জীবানন্যাংশ্চ বহুশস্তত্র কিং প্রতিভাতি তে ॥ ধান্যবীজানি যান্যাহুর্ব্রীহ্যাদীনি দ্বিজোত্তম।  সর্বাণ্যেতানি জীবানি তত্র কিং প্রতিভাতি তে ॥ অধ্যাক্রম্য পশুংশ্চাপি ঘ্নন্তি বৈ ভন্নয়ন্তি চ। বৃক্ষাংস্তথৌষধীশ্চাপি ছিন্দন্তি পুরুষা দ্বিজ ॥ জীবা হি বহুবো ব্ৰহ্মণ বৃক্ষেষু চ ফলেষু চ । উদকে বহবশ্চাপি তন্ত্র কিং প্রতিভাতি তে ॥ সবং ব্যাপ্তমিদং ব্ৰহ্মন্ প্রাণিভিঃ প্রাণিজীবনৈঃ । মৎস্যান্ গ্রসন্তে মৎস্যাশ্চ তত্র কিং প্রতিভাতি তে।। সত্ত্বৈঃ-সত্ত্বানি জীবন্তি বহুধা দ্বিজসত্তম। প্রাণিনোঽন্যোন্যভক্ষ্যাশ্চ তত্র কিং প্রতিভাতি তে।। চংক্রম্যমাণান্ জীবাংশ্চ ধরণীসংশ্রিতান্ বহূন্ । পদ্ভ্যাং ঘ্নন্তি নরা বিপ্র তত্র কিং প্রতিভাতি তে ॥ উপবিষ্টাঃ শয়ানাশ্চ ঘ্নন্তি জীবাননেকেশঃ। জ্ঞানবিজ্ঞানবন্তশ্চ তত্র কিং প্রতিভাতি তে ॥ জীবৈর্গ্রস্তমিদং সর্বমাকাশং পৃথিবী তথা।  অবিজ্ঞানাচ্চ হিংসন্তি তত্র কিং প্রতিভাতি তে ॥ (মহাভারত: বনপর্ব,৭৬.২৩-৩১) "অনেকে কৃষিকাৰ্য্যটাকে উত্তম বলে মনে করেন; কিন্তু তাতেও গুরুতর হিংসা রয়েছে। কারণ, মানুষ লাঙ্গলের দ্বারা ভূমি কর্ষণ করার সময়ে অজ্ঞাতসারে ভূমিস্থিত বহুতর জীব হত্যা করে ; সে বিষয়ে আপনার কি মনে হয়? হে ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ! ধান্য প্রভৃতি যে সকল বস্তুকে শস্যের বীজ বলে, সে সমস্তও ত জীব; সে বিষয়ে আপনার কি মনে হয়?  হে ব্রাহ্মণ! ধাৰ্ম্মিক মনুষ্যেরাও আক্রমণপূর্ব্বক পশু বধ করে ও তা ভক্ষণ করে এবং বৃক্ষ-লতা ছেদন করে থাকে।  হে ব্রাহ্মণ ! বৃক্ষ, ফল এবং জলেও বহু প্রকারের জীব রয়েছে, সে বিষয়েই বা আপনার কি মনে হয়? প্রাণিভোজী প্রাণিগণদ্বারাই এই জগৎ ব্যাপ্ত রয়েছে এবং মৎস্যগণ অপর মৎস্যদেরকে ভক্ষণ করে; সে বিষয়েই বা আপনার কি মনে হয়?  হে ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ। বহুতর দ্রব্য অপর দ্রব্যসমূহকে আত্মসাৎ করেই জীবিত থাকে এবং প্রাণীরা পরস্পর পরস্পরকে ভক্ষণ করে, সে বিষয়েই বা আপনার কি মনে হয়? হে ব্রাহ্মণ ! বহুতর প্রাণী ভূতলে অনবরত বিচরণ করে; কিন্তু মানুষেরা চরণযুগলদ্বারা তাদেরকে বধ করে থাকে; সুতরাং সে বিষয়ে আপনার কি মনে হয় ? এর এপর, জ্ঞানবান্, ও বিজ্ঞানবান্ লোকেরাও উপবেশন এবং শয়ন করে অনেক প্রাণী বিনাশ করে থাকেন; সেই বিষয়েই বা আপনার কি মনে হয়? এই সমগ্র আকাশ এবং পৃথিবী প্রাণীদ্বারাই ব্যাপ্ত রয়েছে, অথচ অজ্ঞানতঃ অপর প্রাণীরা তাদেরকে হিংসা বা বধ করছে; সে সম্পর্কেই বা আপনার কি মনে হয়?" জীব বেঁচে থাকতে জীব হত্যা স্বাভাবিক একটি বিষয়।  শুধু বড় প্রাণী যাদের বুদ্ধি এবং অনুভূতি প্রবল; তাদের অহেতুক  হত্যায় সংস্কার এবং বিবেকে বাঁধে। এবং বিবেকে বাঁধা উচিতও। একথা যেমন সত্য যে, "জীবই জীবের খাদ্য ও জীবন"। আবার পক্ষান্তরে সকলের যথাসম্ভব প্রচেষ্টা করা উচিত বুদ্ধি এবং অনুভূতি প্রবল জীবদের হত্যা না করে বেঁচে থাকা।আগুনে ধুপ দিলে ধুপের ঘ্রাণ যেমন আসবে, ঠিক একইভাবে খাদ্যাভ্যাস মানুষের দেহমনের উপরে অত্যধিক প্রভাব বিস্তার করে এতে কোন সন্দেহ নেই। ধান্যাদিসহ শাকসবজীরও চেতনা রয়েছে। তবে স্থাবর জীব ধান্যাদি শাকসবজীর চেতনার বিপরীতে জঙ্গমজীব মৎস্য, মুরগি, পাখি, গরু এবং সর্বোপরি মনুষ্যের চেতনা এক নয়। যার বুদ্ধি এবং চেতনা যত বেশি বিকশিত, তার বেদনাও তত বেশি। যখন কোন জীবকে হত্যা করা হয়, তখন তার বেদনা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। বেদনা ছড়িয়ে পড়া দেহের  মাংসটি যখন ভক্ষণ করা হয়; তখন মনুষ্য অবচেতনভাবেই সেই বেদনার অংশীদার হয়ে যায়। তাই যারা বেদাদি শাস্ত্রচর্চা, বিদ্যাচর্চা, মেধাচর্চায় নিয়োজিত, তাদের প্রাণীজ আমিষ ভক্ষণ না করাই সর্বোত্তম। জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য উদ্ভিদ আমিষ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং ফলদায়ক।পক্ষান্তরে যারা, সেনাবাহিনী সহ দেশরক্ষার কায়িকশ্রমে নিয়োজিত, তাদের জন্যে প্রাণীজ আমিষ প্রয়োজনীয় বলে সমাজে স্বীকৃত। অর্থাৎ এ বিষয়টি স্মর্তব্য যে, জগতে সকলের এক খাদ্য নয়। এ বৈশ্বিক সর্বজনীন বৈজ্ঞানিক বিষয়টি সনাতন শাস্ত্রে বহু পূর্বেই বলা হয়েছে। শাস্ত্রে যেমন একদিকে বলা হয়েছে,  প্রাণীই প্রাণীর খাদ্য ও জীবন; ঠিক তেমনি মনুষ্যের ভক্ষণের অযোগ্য অমেধ্য তালিকাও দেয়া রয়েছে। সে অনুসারে মনুষ্যমাংস, গোমাংস,কৃমি, বিষ্ঠা ইত্যাদি অমেধ্য; তাই সে সকল ভক্ষণ নিষিদ্ধ। শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।  (লেখাটি সমাপ্ত হয়নি,  তাই কপি না করে শেয়ার দিবেন)  ফেসবুক পোস্ট লিঙ্ক : Facebook ফেসবুক পেজ লিঙ্ক :  Shri Kushal Baran Chakraborty | Facebook
সনাতন জৈবধর্ম সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষেরই ধারণা নেই। তারা জানে না যে, জীবই জীবের জীবন। একটি জীবকে ভক্ষণ করেই অন্য জীব বেঁচে থাকে। প্রতিনিয়ত জ্ঞাত অথবা অজ্ঞাতসারে না চাইলেও বৃহৎজীব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবের মৃত্যুর কারণ হচ্ছে। শাস্ত্রে অহেতুক প্রাণীহত্যা নিষেধ করা হয়েছে। ভক্ষ্য প্রাণীকে ভক্ষক প্রাণীরা জীবন ধারণের জন্য খেতে পারে। মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, প্রতিদিন ভক্ষ্য প্রাণিসকল ভক্ষণ করে ভোক্তা প্রাণী কোন প্রকারের পাপভাগী হয় না। কারণ বিধাতাই এ জগতে একই সাথে ভক্ষ্য ও ভক্ষককে সৃষ্টি করেছেন।
নাত্তা দূষ্যত্যদন্নাদ্যান্ প্রাণিনোহহন্যহন্যপি ।
ধাত্রৈব সৃষ্টা হ্যাদ্যাশ্চ প্রাণিনোঽত্তার এব চ ৷৷
(মনুসংহিতা:৫.৩০)
"প্রতিদিন ভক্ষ্য প্রাণিসকল ভক্ষণ করে ভোক্তা দোষভাগী হয় না। বিধাতাই ভক্ষ্য প্রাণী ও ভক্ষকগণকে সৃষ্টি করেছেন ।"
শ্রীমদ্ভাগবতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, "জীবো জীবস্য জীবনম্"। জীবই জীবের জীবন তত্ত্বটি আধুনিক জীববিজ্ঞানের প্রধানতম সূত্র।যে সূত্রের উপরে ভিত্তি করে পরবর্তীতে বহুসূত্র তৈরি হয়ে জীব বিজ্ঞান বিকশিত হয়েছে। ভাবতে অবাক লাগে যে আধুনিক জীববিজ্ঞানের এই খাদ্যশৃঙ্খল তত্ত্বটি শ্রীমদ্ভাগবতের প্রথম স্কন্ধেই রয়েছে:
কালকর্মগুণাধীনো দেহোঽয়ং পাঞ্চভৌতিকঃ।
কথমন্যাংস্তু গোপায়েৎ সর্বগ্রস্তো যথা পরম্ ৷৷
অহস্তানি সহস্তানামপদানি চতুষ্পদাম্।
ফল্গূনি তত্র মহতাং জীবো জীবস্য জীবনম্॥
তদিদং ভগবান্ রাজন্নেক আত্মাঽত্মনাং স্বদৃক্।
অন্তরোঽনন্তরো ভাতি পশ্য তং মায়য়োরুধা৷৷
সোঽয়মদ্য মহারাজ ভগবান্ ভূতভাবনঃ।
কালরূপোঽবতীর্ণোঽস্যামভাবায় সুরদ্বিষাম্॥
( শ্রীমদ্ভাগবত: ১ ১৩.৪৫-৪৮)
"অজগর যাকে গ্রাস করেছে সে যেমন অন্যকে রক্ষা করতে পারে না, তেমনি কাল, কর্ম ও ত্রিগুণের অধীন পাঞ্চভৌতিক এই দেহের পক্ষে অন্য কাউকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। ভগবানই সকলের উপযুক্ত জীবিকা নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
হাতযুক্ত মানুষ হাত নেই এমন প্রাণীদের খেয়ে বেঁচে থাকে। চতুষ্পদ পশুরা পা নেই এমন খাদ্য অর্থাৎ তৃণ-লতাপাতা খায়। এভাবে বড় প্রাণীরা ছোট প্রাণীদের খেয়ে বেঁচে থাকে। এইভাবে এক জীবই অন্য জীবের খাদ্য - এই নিয়ম।
এ জগৎ ভগবানই। তিনিই সর্বজীবের আত্মা, অথচ অদ্বিতীয়, ঐভাবে স্বপ্রকাশ। তিনিই অন্তরস্থ, তিনিই বহিঃস্থ। এক ঈশ্বরই মায়াপ্রভাবে দেব, মানুষ প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রতীয়মান হচ্ছেন। তুমি কেবল তাঁরই ধ্যান কর। হে মহারাজ! সেই মহামায়াময় প্রাণীগণের জীবনদানকারী সেই ভগবান বর্তমানে এ পৃথিবীতে দেবদ্রোহীদের নিধনের জন্য কালরূপে অবতীর্ণ হয়েছেন।"
এখানে বলা হয়েছে, ভগবানই সকলের উপযুক্ত জীবিকা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তাই হাতযুক্ত মানুষ হাত নেই এমন প্রাণীদের খায়, পা যুক্ত পশুরা পা নেই এমন খাদ্য অর্থাৎ ঘাস-লতাপাতা খায়। এভাবে বড় প্রাণীরা ছোট প্রাণীদের খেয়ে বেঁচে থাকে। এ খাদ্য শৃঙখলের বিষয়টি অত্যন্ত স্বাভাবিক। অর্থাৎ আমরা চাই বা না চাই ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক আমরা প্রাণীহত্যা করছি। হয়ত নিজেরা টেরও পাচ্ছি না। আধ্যাত্মিক অথবা মানবিক মূল্যবোধের দৃষ্টিতে জগতে অনেকেই নিরামিষ আহার করে। নিরামিষ আহার স্বাস্থ্যের জন্য কল্যাণের। কারণ এ খাবারটি সহজপাচ্য। কে কি খাবে তা নিয়ে জোরজবরদস্তি না করে সে বিষয়টি যার যার ব্যক্তিগত রুচি এবং খাদ্যাভ্যাসের উপরেই ছেড়ে দেয়া মঙ্গল। ব্যক্তিই তার নিজস্ব রুচিবোধ অনুসারে খাদ্য এবং খাদ্যাভ্যাস নির্বাচন করে নিবেন। তাই অহেতুকী খাদ্যাভ্যাস নিয়ে বিশেষ করে অমিষ নিরামিষ নিয়ে অত্যন্ত আলোচনা সমালোচনার প্রয়োজন নেই। অবশ্য যে আমিষ এবং নিরামিষ নিয়ে এত কথা বলা হল, ভালো করে তলিয়ে দেখলে দেখা যায় নিরামিষ বলতে আসলে কিছুই নেই। জগতের প্রায় সকল খাবারেই আমিষ আছে। তাই বাক্যটি হওয়া উচিত উদ্ভিজ্জ আমিষ এবং প্রাণীজ আমিষ। নিরামিষভোজীগণ কোন প্রাণী হত্যা করেন না বলে তারা উদ্ভিজ্জ আমিষ গ্রহণ করেন। কিন্তু তারা অনেকেও ভেবে দেখেন না যে, নিরামিষ বলতে আমরা চিনি সেই ধান, গম, জব, ভুট্টাসহ বিবিধ প্রকারের শাকসবজি বৃক্ষের প্রাণ রয়েছে। হয়ত মনুষ্যের মত বুদ্ধিসত্ত্বা না থাকলেও তাদের প্রাণ রয়েছে এবং চেতনা রয়েছে। এরাও অনেক কিছুই বুঝতে পারে। উদ্ভিদের যে প্রাণ রয়েছে এ বিষয়টি আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু আবিষ্কার করেছেন। বিষয়টি সমগ্র পৃথিবীর জন্য নতুন তত্ত্ব হলেও ভারতবর্ষের জন্যে নতুন নয়। উদ্ভিদের যে প্রাণ রয়েছে, এ বিষয়টি বেদ-পুরাণাদি শাস্ত্রে সৃষ্টির শুরু থেকেই রয়েছে। সেই পুরাতন তত্ত্বই শুধু আধুনিক বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় প্রকাশ করেছিলেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু।
বিবিধ শাস্ত্রে বিষয়টি রয়েছে। এরমধ্যে অষ্টাদশ পুরাণের অন্যতম ভবিষ্যপুরাণে সৃষ্টি অংশে আমরা দেখতে পাই, অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে সকল প্রকারের জীব কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে, তা বলা হয়েছে।জরায়ুজ, অণ্ডজ, স্বেদজ এবং উদ্ভিজ্জ এই চারপ্রকার সৃষ্টি বর্ণিত হয়েছে। সেখানে উদ্ভিদ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তারা নিজের মধ্যে অল্পজ্ঞান রাখার জন্য জড় সৃষ্টি বলে পরিচিত কিন্তু এদেরও সুখ এবং দুঃখের অনুভব রয়েছে। অর্থাৎ একটি ছাগল, ভেড়াকে হত্যা করলে যে অনুভব হয়, সেই অনুভব একটি বৃক্ষ, গুল্মলতাকে করলেও হয়। শুধু কম আর বেশি। ছাগল, ভেড়াকে হত্যা করলে তার কষ্ট যাতনা দৃশ্যমান হয়, পক্ষান্তরে বৃক্ষ, গুল্মলতার কষ্ট যাতনা দৃশ্যমান নয়। তবে তাদের কষ্ট যাতনা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে উপলব্ধি করা যায়।
ভবিষ্যপুরাণ অনুসারে পরমেশ্বর সৃষ্টির ইচ্ছায় প্রথমত তিনি দশজন মহর্ষি প্রজাপতির সৃষ্টি করেলেন। দশজন প্রজাপতি মহর্ষিরা হলেন- নারদ, ভৃগু, কম্, প্রচেতস, পুলহ, ঋতু পুলস্ত্য, অত্রি, অঙ্গিরস এবং মরীচি। মরীচি হলেন প্রথম প্রজাপতি। এঁকে এবং অন্যদের প্রচুর তেজ দ্বারা তিনি সৃষ্টি করেছিলেন।এরপরে পর্যায়ক্রমে তিনি দেবতা, ঋষি, দৈত্য, রাক্ষস, যক্ষ, পিশাচ, গন্ধর্ব, অপ্সরা এবং অসুরদের সৃষ্টি করেন।
মনুষ্যানাং পিতৃণাংশ্চ সর্পাণাং চৈব ভারত।
নগানাং চ মহাবাহো সসৰ্জ বিবিধান্ গণান্।।
ক্ষণরুচোহশনিগণাত্রৌহিতেন্দ্ৰধনুংষি চ ।
ধূমকেতূং স্তথাচৌল্কানির্বাতা জ্যোতিষাংগণান্।।
মনুষ্যাক্নিন্নরান্ মস্ত্যান্বরাহাংশ্চ বিহংগ মান্।
গজানশ্চানথ পশুন মৃগান্ব্যালাংশ্চ ভারত।।
কৃমিকীর্তপতংগাংশ্চ মুকালিক্ষকমৎকুণান।
সর্ব চ দংশমশকং স্থাবরংচ পৃথগ্বিধম্।।
এবং স ভাস্করো দেব সসর্জ ভুবনত্রয়ম্।
যেযাং তু যাদৃশং কর্ম ভূতানামিহ কীৰ্তিতম্।।
কথয়িষ্যামি তৎসর্বং ক্রমযোগং চ জন্মনি।
গজা ব্যালা মৃগাস্তাত পশবয়চ পৃথগ্বিধাঃ।।
পিশাচা মানুষা তাত রক্ষাংসি চ জরায়ুজাঃ।
দ্বিজাস্ত্য অণ্ডজাঃ সৰ্পা ণক্রা মৎস্যাঃ সকচ্ছপাঃ।।
এবং বিধানি মানীহ স্থলজান্যৌদকানি চ।
স্বেদজং দংশমংশকং কালিক্ষ কমৎকুণাঃ।।
উষ্মণা চোপজায়ন্তে সচ্চান্যক্তিচিদীদশম্।
উদ্ভিজ্জাঃ স্থাবরাঃ সর্বে বীজকাণ্ড প্ররোহিণঃ।।
ঔষধ্যঃ ফলপাকান্তা নানাবিধফলোপগাঃ ।
অপুষ্পাঃ ফলবন্তৌ যে তে বনস্পতয়ঃ সমৃতাঃ।।
পুষ্পিণঃ ফলিণশ্চৈব বৃক্ষাস্তূভয়তঃ সমৃতাঃ।
গুচ্ছগুল্মং তু বিবিধং তথৈব তৃণজাতয়ঃ।।
বীজকাণ্ডরু হান্যেব প্রতানা বল্লয় এব চ ।
তমসা বহুরূপেন বেষ্টিতাঃ কর্মহেতুনা।।
অন্তঃ সংজ্ঞা ভবন্ত্যে তে সুখদুঃখসমন্বিতাঃ।
এতাবত্যস্তু গতয়ঃ প্রোদ্ভূতাঃ কুরুনন্দন।।
তসমাদ্দেবাদ্দীপ্তি-মন্তৌ ভাস্করচ্চ মহাত্মনঃ।
ঘোরেসিমংস্তাত সংসারে নিত্যং সততয়ায়িনি।৷
এবং সর্বং সসৃষ্ট্রেদং রাজল্লেঁকগুরুং পরম্।
তিরোভূতঃ স ভূতাত্মা কালং কালেন পীড্যণ্।।
(ভবিষ্যপুরাণ: ব্রাহ্মপর্ব, সৃষ্টি, ৬৪-৭৮)
"হে ভারত! মহাবাহ মনুষ্য, পিতৃগণ, সর্পবর্গ, নাগ এবং বিবিধগণেরসৃষ্টি করেছেন।।
বিদ্যুৎ, অশনি, রেহিতেন্দ্র ধনু, ধূমকেতু, উল্কা নিপাত, জ্যোতিগণ, মানুষ, কিন্নর, মৎস্য, বরাহ এবং বিহঙ্গের সৃষ্টি করেছেন। হাতি, ঘোড়া, পশু, মৃগ এবং হিংস্র জন্তুর সৃষ্টি করেছেন।।
কৃমি, কীট, পতঙ্গ, জোঁক, লিক্ষা এবং ছারপোকা সৃষ্টি করেছেন। দংশ (ডাঁশ) এবং বিবিধ মশার সৃষ্টি করেছেন।।
এই ভাবেই সূৰ্য্যদেব এই ভুবনত্রয় নির্মাণ করেছেন, যেখানে প্রাণীদের বিভিন্ন কর্ম নির্দেশ করা হয়েছে।
এরপর ভবিষ্যজন্মের সব ক্রমযোগ বলা হবে, হে পিতা! হস্তি, হিংস্র জন্তু, মৃগ এবং অন্য প্রকারের পশুবর্গ, পিশাচ, মানুষ, রাক্ষস সব কিছু জরায়ুজ। পক্ষী, সর্প, মৎস্য এবং কচ্ছপ হল অণ্ডজ। জরায়ুতে উৎপন্ন হলে জরায়ুজ এবং অণ্ড (ডিম) থেকে উৎপন্ন হলে সেই জীবকে বলা হয় অণ্ডজ।
কিছু জীব আছে যারা স্থলভাগে জন্মায় এবং কিছু জীব আছে যারা জলে জন্মায়। দংশনকারী মশা, জোঁক, লিক্ষা এবং ছারপোকা এদের স্বেদজ বলা হয়। কারণ এরা স্বেদ থেকে উৎপন্ন হয় আর এক প্রকারের জীব আছে যাদের উদ্ভিজ্জ বলা হয় কারণ এরা ভূমিতে সৃষ্ট হয় এবং বীজ কাণ্ড পরিণত হয়।
এইভাবে জরায়ুজ, অণ্ডজ, স্বেদজ এবং উদ্ভিজ্জ এই চারপ্রকার সৃষ্টি হয়েছে। ওষধি, ফল অন্তে পক্ব হয়, নানাপ্রকার ফলযুক্ত এবং পুষ্প রহিত, তাকে বনস্পতি বলা হয়।।
বৃক্ষ দুই প্রকারের হয়। কিছু বৃক্ষ আছে শুধুমাত্র যাতে ফুল হয় এবং কিছুবৃক্ষ আছে যার ফুল ও ফল দুই-ই হয়। গুচ্ছ, গুল্ম অনেক প্রকারের হয়। এভাবে তৃণেরও বিভিন্ন জাতি উৎপন্ন হয়।
বীজ এবং কাণ্ডতে প্ররোহণ প্রাপ্ত বৃক্ষকে বল্লী বলে। অনেকপ্রকার কর্মস্বরূপ হেতুর অন্ধকারে সব বেষ্টিত হয়ে আছে।।
এরা নিজের মধ্যে অল্পজ্ঞান রাখার জন্য জড় সৃষ্টি বলে পরিচিত কিন্তু এদেরও সুখ এবং দুঃখের অনুভব অবশ্যই থাকে। অতএব এরা সুখ-দুঃখ সমন্বিত হয়। হে কুরুনন্দন! এই গতি উদ্ভূত হয়। মহান আত্মা সূর্য্যদেবের আলোয় দীপ্ত হয় এবং নিরন্তর গমনশীল এই ঘোর সংসারে প্রকট হয়।
এইভাবে তিনি জগত সৃষ্টি করে একসময় থেকে অন্য সময়কে পীড়িত করেন এবং তিনি ভূতাত্মা পরমলোকে তিরোভূত হয়ে যান।"
ভবিষ্য পুরাণের সৃষ্টি বর্ণনের ৭১ থেকে ৭৬ শ্লোকে সম্পূর্ণ বৃক্ষ, গুল্মসহ উদ্ভিদ সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। এবং সেই উদ্ভিদদের সুখ-দুঃখ সমন্বিত জীব হিসেবে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে। মহর্ষী বেদব্যাস কোন প্রকার এসকোনোগ্রাফার ছাড়াই বলেছেন যে, উদ্ভিদের উপর বিভিন্ন প্রকার বাহ্যিক প্রভাবকের প্রভাবে ইলেক্ট্রন প্রবাহের ঘটনা ঘটতে পারে। ফলে উদ্ভিদও সুখ দুঃখের আবর্তনে প্রবাহিত হয়। ভবিষ্য পুরাণে আরও সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে যে, সূর্যের বিকিরণের কারণেই উদ্ভিদের মধ্যে ইলেক্ট্রনের প্রাবাহ ঘটে। বর্তমান বায়োকেমিস্ট বিজ্ঞানীরাও স্বীকার করেছেন বৃক্ষের কোষ মেমব্রেন বিভবের পরিবর্তন ও ইলেক্ট্রন প্রবাহের জন্য বেশি দায়ী সূর্যের রশ্মি।
"জীবো জীবস্য জীবনম্" এ শাস্ত্রীয় এবং বৈজ্ঞানিক তত্ত্বটি আমরা মহাভারতের বনপর্বেও পাই। সেখানে ধর্মব্যাধ ব্রাহ্মণ কৌশিককে বিবিধ উদাহরণে মাধ্যমে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বিষয়টি বলেন। অনেকে কৃষিকাজকে উত্তম বলে মনে করেন, তাদের ধারণা কৃষিকাজে কোন জীব হিংসা নেই। কিন্তু তারা হয়ত জানেন না যে কৃষিকাজেও গুরুতর হিংসা রয়েছে। কৃষিকাজ করার সয়য়ে কারণ, মানুষ লাঙ্গলের দ্বারা ভূমি কর্ষণ করার সময়ে অজ্ঞাতসারে ভূমির মধ্যে অবস্থিত বহু প্রকারের ক্ষুদ্র জীব হত্যা করে। এ সকল অধিকাংশ ক্ষুদ্র জীবকে খালি চোখে দেখা যায় না। তাই তাদের হত্যায় কেউ বিচলিত হয় না। শাস্ত্রীয়ভাবে উদ্ভিদ তো জীব বটেই, এমনকি ধান, গম, জব প্রভৃতি শস্যের বীজও। কারণ এই বীজ থেকে নতুন উদ্ভিদের জন্ম হয়। অথচ সেই ধানকে খাদ্যশস্য হিসেবে নির্দ্বিধায় খেয়ে যাই। মানুষেরা প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে বৃক্ষ-লতা ছেদন করে। এতেও জীব হত্যা হয়। কারণ তাদেরও চেতনসত্ত্বা আছে। বৃক্ষে যেমন প্রাণ রয়েছে, তেমনি বৃক্ষের ফলেও প্রাণ রয়েছে। একারণেই ফল থেকে আরেকটি বৃক্ষের জন্ম হয়। বীজের ভেতরে ফলের ভেতরে চেতন সৃষ্টি প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকায় তাদের থেকে নতুন উদ্ভিদের সৃষ্টি হয়। ভাবতে অবাক লাগে যে, অণুবীক্ষণযন্ত্রসহ আধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে বর্তমান আমরা জানতে পেরেছি যে জলের মধ্যে অসংখ্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীব রয়েছে। প্রতি গ্লাস জল খাওয়ায় সাথে সাথে আমরা এ অসংখ্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবকেও দৃষ্টির অজান্তে মনের অজান্তে খেয়ে ফেলছি। ভাবতে অবাক লাগে যে, জলে যে বহু প্রকারের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীব রয়েছে, এ অত্যন্ত আধুনিক তত্ত্বটি মহাভারতে রয়েছে। যা সত্যি অত্যন্ত বিস্ময়ের। আমাদের শাস্ত্রগ্রন্থাদি ত্রিকালদর্শী মুনি ঋষিদের প্রণীত। তাঁরা ছিলেই সেই কালের সর্বশ্রেষ্ঠ তত্ত্বদ্রষ্টা এবং বৈজ্ঞানিক বিষয় আজ বহুক্ষেত্রেই পশ্চিমা বৈদেশিক বিজ্ঞানীদের দ্বারা প্রমাণিত। এ সমগ্র জগত প্রাণিভোজী প্রাণিগণদ্বারাই পরিব্যাপ্ত। জ্ঞানত অথবা অজ্ঞাতসারে প্রাণী ভক্ষণ করেই সকল প্রাণী বেঁচে আছে। এমনকি জলের মধ্যে একই মৎস্য বংশের হওয়ার পরেও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মৎস্যদেরকে বৃহত্তর মৎস্যরা ভক্ষণ করে তাদের জীবন নির্বাহ করে। নিজ প্রকারের প্রাণীদের ভক্ষণের এই যে স্বভাব মৎস্যদের। এর জন্যে তারা নিজেরা দায়ি নয়, তারা জন্মগতভাবে এই খাদ্যাভ্যাস পেয়েছে। প্রাণীকুলে এমন অনেক প্রাণী রয়েছে, যারা অন্য প্রাণীদের আত্মসাৎ করেই জীবিত থাকে। মানুষ এবং বিভিন্ন প্রকারের পশুপাখি ইত্যাদি জঙ্গম প্রাণীরা, চলাফেরা করতে পারে। তারা যখন ভূতলে অনবরত বিচরণ করে, তখন তাদের পায়ের আঘাতে বহু ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীব নিহত হয়। এমনকি অনেক জ্ঞানী এবং মহান ব্যক্তিরাও, যাদের হৃদয়ে সমগ্র জীবের প্রতি করুণার ভাব প্রবল; তারাও তাদের অজান্তেই চলাফেরা, উপবেশন এবং শয়নসহ বিবিধ প্রকারের কর্ম করার সময়ে অসংখ্য প্রাণীকে বিনাশ করে থাকেন। এই সমগ্র আকাশ এবং পৃথিবী প্রাণীদ্বারাই ব্যাপ্ত রয়েছে। জ্ঞানত বা অজ্ঞানত প্রাণীরাই প্রাণীদের হিংসা বা বধ করে বেঁচে থাকে। তাই প্রাণী হত্যা না করে একদণ্ডও কোন প্রাণী বেঁচে থাকতে পারবে না। কোন প্রাণী যখন জীবন ধারণের জন্য নিঃশ্বাস গ্রহণ করে, তখনও অসংখ্য প্রাণী নিঃশ্বাসের সাথে সেই প্রাণীর শরীরে প্রবেশ করে মৃত্যুবরণ করে।
কৃষিং সাধ্বিতি মন্যন্তে তত্র হিংসা পরা স্মৃতা।
কর্ষন্তো লাঙ্গলৈর্মত্যা ঘ্নন্তি ভূমিশয়ান বহূন্।
জীবানন্যাংশ্চ বহুশস্তত্র কিং প্রতিভাতি তে ॥
ধান্যবীজানি যান্যাহুর্ব্রীহ্যাদীনি দ্বিজোত্তম।
সর্বাণ্যেতানি জীবানি তত্র কিং প্রতিভাতি তে ॥
অধ্যাক্রম্য পশুংশ্চাপি ঘ্নন্তি বৈ ভন্নয়ন্তি চ।
বৃক্ষাংস্তথৌষধীশ্চাপি ছিন্দন্তি পুরুষা দ্বিজ ॥
জীবা হি বহুবো ব্ৰহ্মণ বৃক্ষেষু চ ফলেষু চ ।
উদকে বহবশ্চাপি তন্ত্র কিং প্রতিভাতি তে ॥
সবং ব্যাপ্তমিদং ব্ৰহ্মন্ প্রাণিভিঃ প্রাণিজীবনৈঃ ।
মৎস্যান্ গ্রসন্তে মৎস্যাশ্চ তত্র কিং প্রতিভাতি তে।।
সত্ত্বৈঃ-সত্ত্বানি জীবন্তি বহুধা দ্বিজসত্তম।
প্রাণিনোঽন্যোন্যভক্ষ্যাশ্চ তত্র কিং প্রতিভাতি তে।।
চংক্রম্যমাণান্ জীবাংশ্চ ধরণীসংশ্রিতান্ বহূন্ ।
পদ্ভ্যাং ঘ্নন্তি নরা বিপ্র তত্র কিং প্রতিভাতি তে ॥
উপবিষ্টাঃ শয়ানাশ্চ ঘ্নন্তি জীবাননেকেশঃ।
জ্ঞানবিজ্ঞানবন্তশ্চ তত্র কিং প্রতিভাতি তে ॥
জীবৈর্গ্রস্তমিদং সর্বমাকাশং পৃথিবী তথা।
অবিজ্ঞানাচ্চ হিংসন্তি তত্র কিং প্রতিভাতি তে ॥
(মহাভারত: বনপর্ব,৭৬.২৩-৩১)
"অনেকে কৃষিকাৰ্য্যটাকে উত্তম বলে মনে করেন; কিন্তু তাতেও গুরুতর হিংসা রয়েছে। কারণ, মানুষ লাঙ্গলের দ্বারা ভূমি কর্ষণ করার সময়ে অজ্ঞাতসারে ভূমিস্থিত বহুতর জীব হত্যা করে ; সে বিষয়ে আপনার কি মনে হয়?
হে ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ! ধান্য প্রভৃতি যে সকল বস্তুকে শস্যের বীজ বলে, সে সমস্তও ত জীব; সে বিষয়ে আপনার কি মনে হয়?
হে ব্রাহ্মণ! ধাৰ্ম্মিক মনুষ্যেরাও আক্রমণপূর্ব্বক পশু বধ করে ও তা ভক্ষণ করে এবং বৃক্ষ-লতা ছেদন করে থাকে।
হে ব্রাহ্মণ ! বৃক্ষ, ফল এবং জলেও বহু প্রকারের জীব রয়েছে, সে বিষয়েই বা আপনার কি মনে হয়?
প্রাণিভোজী প্রাণিগণদ্বারাই এই জগৎ ব্যাপ্ত রয়েছে এবং মৎস্যগণ অপর মৎস্যদেরকে ভক্ষণ করে; সে বিষয়েই বা আপনার কি মনে হয়?
হে ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ। বহুতর দ্রব্য অপর দ্রব্যসমূহকে আত্মসাৎ করেই জীবিত থাকে এবং প্রাণীরা পরস্পর পরস্পরকে ভক্ষণ করে, সে বিষয়েই বা আপনার কি মনে হয়?
হে ব্রাহ্মণ ! বহুতর প্রাণী ভূতলে অনবরত বিচরণ করে; কিন্তু মানুষেরা চরণযুগলদ্বারা তাদেরকে বধ করে থাকে; সুতরাং সে বিষয়ে আপনার কি মনে হয় ?
এর এপর, জ্ঞানবান্, ও বিজ্ঞানবান্ লোকেরাও উপবেশন এবং শয়ন করে অনেক প্রাণী বিনাশ করে থাকেন; সেই বিষয়েই বা আপনার কি মনে হয়?
এই সমগ্র আকাশ এবং পৃথিবী প্রাণীদ্বারাই ব্যাপ্ত রয়েছে, অথচ অজ্ঞানতঃ অপর প্রাণীরা তাদেরকে হিংসা বা বধ করছে; সে সম্পর্কেই বা আপনার কি মনে হয়?"
জীব বেঁচে থাকতে জীব হত্যা স্বাভাবিক একটি বিষয়। শুধু বড় প্রাণী যাদের বুদ্ধি এবং অনুভূতি প্রবল; তাদের অহেতুক হত্যায় সংস্কার এবং বিবেকে বাঁধে। এবং বিবেকে বাঁধা উচিতও। একথা যেমন সত্য যে, "জীবই জীবের খাদ্য ও জীবন"। আবার পক্ষান্তরে সকলের যথাসম্ভব প্রচেষ্টা করা উচিত বুদ্ধি এবং অনুভূতি প্রবল জীবদের হত্যা না করে বেঁচে থাকা।আগুনে ধুপ দিলে ধুপের ঘ্রাণ যেমন আসবে, ঠিক একইভাবে খাদ্যাভ্যাস মানুষের দেহমনের উপরে অত্যধিক প্রভাব বিস্তার করে এতে কোন সন্দেহ নেই। ধান্যাদিসহ শাকসবজীরও চেতনা রয়েছে। তবে স্থাবর জীব ধান্যাদি শাকসবজীর চেতনার বিপরীতে জঙ্গমজীব মৎস্য, মুরগি, পাখি, গরু এবং সর্বোপরি মনুষ্যের চেতনা এক নয়। যার বুদ্ধি এবং চেতনা যত বেশি বিকশিত, তার বেদনাও তত বেশি। যখন কোন জীবকে হত্যা করা হয়, তখন তার বেদনা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। বেদনা ছড়িয়ে পড়া দেহের মাংসটি যখন ভক্ষণ করা হয়; তখন মনুষ্য অবচেতনভাবেই সেই বেদনার অংশীদার হয়ে যায়। তাই যারা বেদাদি শাস্ত্রচর্চা, বিদ্যাচর্চা, মেধাচর্চায় নিয়োজিত, তাদের প্রাণীজ আমিষ ভক্ষণ না করাই সর্বোত্তম। জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য উদ্ভিদ আমিষ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং ফলদায়ক।পক্ষান্তরে যারা, সেনাবাহিনী সহ দেশরক্ষার কায়িকশ্রমে নিয়োজিত, তাদের জন্যে প্রাণীজ আমিষ প্রয়োজনীয় বলে সমাজে স্বীকৃত। অর্থাৎ এ বিষয়টি স্মর্তব্য যে, জগতে সকলের এক খাদ্য নয়। এ বৈশ্বিক সর্বজনীন বৈজ্ঞানিক বিষয়টি সনাতন শাস্ত্রে বহু পূর্বেই বলা হয়েছে। শাস্ত্রে যেমন একদিকে বলা হয়েছে, প্রাণীই প্রাণীর খাদ্য ও জীবন; ঠিক তেমনি মনুষ্যের ভক্ষণের অযোগ্য অমেধ্য তালিকাও দেয়া রয়েছে। সে অনুসারে মনুষ্যমাংস, গোমাংস,কৃমি, বিষ্ঠা ইত্যাদি অমেধ্য; তাই সে সকল ভক্ষণ নিষিদ্ধ।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।

(লেখাটি সমাপ্ত হয়নি, তাই কপি না করে শেয়ার দিবেন) ফেসবুক পোস্ট লিঙ্ক : "জীবো জীবস্য জীবনম্" জীবই জীবের খাদ্য ও জীবন । ফেসবুক পেজ লিঙ্ক : Shri Kushal Baran Chakraborty | Facebook
মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁