-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

অকৃতজ্ঞতায় তিক্ত হয়ে বিদ্যাসাগর, শেষে আদিবাসীদের মাঝে ছিলেন।

অকৃতজ্ঞতায় তিক্ত হয়ে বিদ্যাসাগর,   শেষে আদিবাসীদের মাঝে ছিলেন  ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন, ভারতবর্ষের উনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণের অগ্রনায়ক। সমাজ থেকে বিধবাবিবাহ সহ বিভিন্ন কুসংস্কার দূরীকরণের পথিকৃৎ; বাংলা বর্ণ তাঁর হাতেই সংস্কৃত হয়ে বর্তমান রূপ পরিগ্রহ করে। আধুনিক সার্থক বাংলা গদ্যের ছিলেন তিনিই স্থপতি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮২০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর ;বাংলা ১২২৭ বঙ্গাব্দের ১২ আশ্বিন; মঙ্গলবার  পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ঈশ্বরচন্দ্রের পিতার নাম ছিল, ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি কলকাতায় একটি ছোট চাকরি করতেন। গ্রামে মা ভগবতী দেবীর কাছেই তিনি লালিত হন। তাই বিদ্যাসাগরের জীবনে তাঁর মা ভগবতী দেবীর প্রভাব ছিল অসীম। বলা হয়ে থাকে, তাঁর দৃঢচেতা স্বভাবটি তাঁর মায়ের থেকেই প্রাপ্ত। বিদ্যাসাগর নামে পরিচিত হলেও, প্রকৃতপক্ষে তাঁর   নাম ছিল, ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। বাঙালির জীবনে দেখা যায়, যে সকল মানুষেরা সবচেয়ে বেশী মানুষের সেবা করেছে,উপকার করেছে, লোককল্যাণ করেছে; অকৃতজ্ঞ বাঙালি তাদের পিছনেই পড়ে তাদের দুর্নাম রটিয়েছে। তাদের মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছে।এর অন্যতম বড় দৃষ্টান্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বাইরের মানুষের সাথে সাথে পরিবারের আপনজনেরাও তার সাথে অনৈতিকতা করেছে।একমাত্র পুত্র নারায়ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে বিদ্যাসাগর ১৮৭২ সালে বিদ্যাসাগর তাঁকে ত্যাজ্য ঘোষণা করেন। কিছু দিন পরেই মারা যায় স্ত্রী দীনময়ী দেবী। প্রচণ্ড নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন তখন বিদ্যাসাগর। ১৮৭৫ সালে ঈশ্বরচন্দ্র একটি উইল করেন। সে উইলে তাঁর সকল স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির সুষ্ঠ বণ্টন করে দেন। কিন্তু পুত্র নারায়ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে সম্পত্তির উত্তরসূরী হিসেবে বঞ্চিত করেন। উপলব্ধি করা যায় কতটা ব্যথিত হৃদয়ে তিনি এ কাজটি করেছিলেন।উইলের চৌম্বক অংশগুলো তুলে দেয়া হল : "শ্রীশ্রীহরিঃ শরণম্ ১। আপনি স্বেচ্ছাপ্রবৃত্ত হইয়া সচ্ছন্দচিত্তে আমার সম্পত্তির অন্তিম বিনিয়োগ করিতেছি। এই বিনিয়োগ দ্বারা আমার কৃত পূর্বান সমস্ত বিনিয়োগ নিরস্ত হইল । ২। চৌগাছানিবাসী শ্রীযুত কালীচরণ ঘোষ, পাথরানিবাসী শ্রীযুত ক্ষীরোদনাথ সিংহ, আমার ভাগিনেয় পসপুরনিবাসী শ্রীযুত বেণীমাধব মুখোপাধ্যায় এই তিন জনকে আমার এই অন্তিম বিনিয়োগপত্রের কার্যদর্শী নিযুক্ত করিলাম, তাঁহারা এই বিনিয়োগপত্রের অনুযায়ী যাবতীয় কার্য নির্বাহ করিবেন৷ ৩ । আমি অবিদ্যমান হইলে আমার সমস্ত সম্পত্তি নিযুক্ত কার্যদর্শীদিগের হস্তে যাইবেক।  ৪। এক্ষণে আমার যে সকল সম্পত্তি আছে কার্যদর্শীদিগের অবগতি নিমিত্ত তৎসমুদয়ের বিবৃতি এই বিনিয়োগপত্রের সহিত গ্রথিত হইল ।  ৫। কার্যদর্শীরা আমার ঋণ পরিশোধ ও আমার প্রাপ্য আদায় করিবেন। ...২৫। আমার পুত্র বলিয়া পরিচিত শ্রীযুত নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় যারপরনাই যথেচ্ছাচারী ও কুপথগামী। এজন্য ও অন্য অন্য গুরুতর কারণ বশতঃ আমি তাঁহার সংস্রব ও সম্পর্ক ত্যাগ করিয়াছি৷ সেই হেতু বশতঃ বৃত্তিনির্বন্ধস্থলে তাঁহার নাম পরিত্যক্ত হইয়াছে এবং এই হেতু বশতঃ তিনি চতুর্বিংশ ধারা নির্দিষ্ট ঋণপরিশোধকালে বিদ্যমান থাকিলেও আমার উত্তরাধিকারী বলিয়া পরিগণিত অথবা দ্বাবিংশ ও ত্রয়োবিংশ ধারা অনুসারে এই বিনিয়োগপত্রের কার্যদর্শী নিযুক্ত হইতে পারিবেন না। তিনি চতুর্বিংশ ধারা নির্দিষ্ট ঋণ পরিশোধকালে বিদ্যমান না থাকিলে যাঁহাদের অধিকার ঘটিত তিনি তৎকালে বিদ্যমান থাকিলেও তাঁহারা চতুর্বিংশ ধারার লিখিত মত আমার সম্পত্তির অধিকারী হইবেন। ইতি তাং ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১২৮২ সাল ইং ৩১শে ১৮৭৫ সাল । শ্রীঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মোকাম কলিকাতা।ইশাদী।" (তীর্থপতি দত্ত ২০০২ : ৩৯৯-৪০২) কলকাতা শহরের কৃত্রিম নাগরিক জীবন থেকে মুক্তি পেতে একটু নির্জনতার সান্নিধ্য তাঁকে টানছিল প্রচণ্ডভাবে। নানা বিরূপ অভিজ্ঞতা, অকৃতজ্ঞতা, ঘাত-প্রতিঘাতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে বিদ্যাসাগর চলে যান ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী সম্প্রদায়ের কাছে। প্রায় সতেরো বছর বসবাস করেন তাদের সাথে।ঝাড়খণ্ডের কার্মাটাঁড়ে স্টেশনের কাছে পাঁচশো টাকায় স্থানীয় এক ইংরেজ মহিলার কাছ থেকে আমবাগান সমেত প্রায় ১৪ বিঘা জায়গা কিনে বসবাস শুরু করেন বিদ্যাসাগর।এখানেই একটি ছোট বাড়ি তৈরি করেন বিদ্যাসাগর। নাম দেন স্বর্গের বাগানের নামে, 'নন্দনকানন।' এখানে একটি রাত্রিকালীন স্কুলও চালু করেন। সাঁওতাল অধ্যুষিত কার্মাটাঁড়ে বসেই তিনি ‘সীতার বনবাস’, ‘বর্ণপরিচয়’ এর তৃতীয় সংস্করণের প্রুফ দেখেছেন। কার্মাটাঁড়ে সাঁওতালদের সাথে বিদ্যাসাগরের শেষ জীবনের স্মৃতিচারণ করেছেন ভাই শম্ভুচন্দ্র। তিনি বলেছেন, ‘‘তিনি (বিদ্যাসাগর) প্রাতঃকাল হইতে বেলা দশ ঘটিকা পর্যন্ত সাঁওতাল রোগীদিগকে হোমিওপ্যাথি মতে চিকিৎসা করিতেন এবং পথ্যের জন্য সাগু, বাতাসা, মিছরি প্রভৃতি নিজে প্রদান করিতেন। অপরাহ্নে পীড়িত সাঁওতালদের পর্ণকুটিরে যাইয়া তত্ত্বাবধান করিতেন। তাহাদের কুটিরে যাইলে তাহারা সমাদরপূর্বক বলিত, ‘তুই আসেছিস!’ তাহাদের কথা অগ্রজের বড় ভালো লাগিত।’’ ভাই শম্ভুনাথকে কোলকাতার নাগরিক বিলাসী জীবন ছেড়ে গ্রামীণ আদিবাসীদের সাথে কাটানো প্রসঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বলেন, ‘‘বড়লোকের বাটিতে খাওয়া অপেক্ষা এ সকল লোকের কুটিরে খাইতে আমার ভালো লাগে, ইহাদের স্বভাব ভাল, ইহারা কখনো মিথ্যা কথা বলে না। ইত্যাদি কারণে এখানে থাকিতে ভালোবাসি।’’  আদিবাসীদের নিস্পাপ সারল্যে মুগ্ধ হয়ে বিদ্যাসাগর বাকি জীবনটা সেখানেই কাটাবেন স্থির করেছিলেন। কিন্তু তা অবশ্য হয়নি। কার্মাটাঁড়ের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের সম্পর্ক ছিল প্রায় সতেরো বছরের। শরীর-স্বাস্থ্যের ভগ্নদশার কারণে ১৮৯০ সালের শুরু থেকে আর কার্মাটাঁড়ে বাস করতে পারেননি বিদ্যাসাগর। চিকিৎসার জন্যে চলে আসতে হয়েছে কোলকাতা। এ কলকাতা শহরেই  ১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই ৭১ বছর বয়সে বিদ্যাসাগর দেহত্যাগ করেন। হৃদয় সাগরের মত বৃহত্তর না হলে, অত্যন্ত স্বচ্ছ না হলে সকলেই জগতের কল্যাণে কাজ করতে পারে না। বিদ্যাসাগরের মত এমন চারিত্রিক দৃঢ়তা, মানুষের জন্য কর্মস্পৃহা এবং বাক্যে স্পষ্টতা সকলের মাঝে থাকে না। এ সকল গুণাবলিই দৃশ্যমান ছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মধ্যে।তিনি এমন এক সময়ের প্রতিনিধি, যখন তার দূরদর্শী চিন্তা গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু সমাজের সাথে সরাসরি বিরোধে না গিয়ে, শাস্ত্রকে অবলম্বন করে সমাজ সংস্কারে এগিয়ে গিয়েছেন। তিনি আলো হয়ে সমাজকে পর্যায়ক্রমে সংস্কার করে প্রস্তুত করে তুলেছেন। সমাজের রুদ্ধ গতিপথ বদলে দিয়েছেন তিনি। বাংলা ভাষার লেখ্যরূপ পূর্ণতা পেয়েছে তাঁর অবদানে। বাংলায় উনবিংশ শতাব্দীর রেঁনেশায় তাঁর অবদান অনন্য। তিনি ছিলেন সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা এক আলোকদীপ্ত মহাপুরুষ। বিদ্যাসাগরের অবদান প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর' নামক একটি কবিতা রচনা করেন। কবিতাটি ২৪ ভাদ্র, ১৩৪৫ বঙ্গাব্দে 'প্রবাসী' পত্রিকার কার্তিক সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। কবি লেখেন: "বঙ্গসাহিত্যের রাত্রি স্তব্ধ ছিল তন্দ্রার আবেশে  অখ্যাত জড়ত্বভারে অভিভূত। কী পুণ্য নিমেষে  তব শুভ অভ্যুদয়ে বিকীরিল প্রদীপ্ত প্রতিভা,  প্রথম আশার রশ্মি নিয়ে এল প্রত্যুষের বিভা,   বঙ্গভারতীর ভালে পরালো প্রথম জয়টিকা। রুদ্ধভাষা আঁধারের খুলিলে নিবিড় যবনিকা, হে বিদ্যাসাগর, পূর্ব দিগন্তের বনে-উপবনে  নব উদ্‌বোধনগাথা উচ্ছ্বসিল বিস্মিত গগনে। যে বাণী আনিলে বহি নিষ্কলুষ তাহা শুভ্ররুচি,  সকরুণ মাহাত্ম্যের পুণ্য গঙ্গাস্নানে তাহা শুচি।  ভাষার প্রাঙ্গণে তব আমি করিব তোমারি অতিথি;   ভারতীর পূজাতরে চয়ন করেছি আমি গীতি  সেই তরুতল হতে যা তোমার প্রসাদসিঞ্চনে  মরুর পাষাণ ভেদি প্রকাশ পেয়েছে শুভক্ষণে।" (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৪০৭: ১৩) তথ্য সহায়তা: ১. তীর্থপতি দত্ত (সম্পা.), বিদ্যাসাগর রচনাবলী (১ম খণ্ড), তুলি-কলম, কলকাতা: মার্চ ২০০২ ২. রবীন্দ্র-রচনাবলী, অষ্টাদশ খণ্ড, ব্যক্তিপ্রসঙ্গ (কবিতা), বিশ্বভারতী, কলকাতা: ফাল্গুন ১৪০৭  শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন, ভারতবর্ষের উনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণের অগ্রনায়ক। সমাজ থেকে বিধবাবিবাহ সহ বিভিন্ন কুসংস্কার দূরীকরণের পথিকৃৎ; বাংলা বর্ণ তাঁর হাতেই সংস্কৃত হয়ে বর্তমান রূপ পরিগ্রহ করে। আধুনিক সার্থক বাংলা গদ্যের ছিলেন তিনিই স্থপতি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮২০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর ;বাংলা ১২২৭ বঙ্গাব্দের ১২ আশ্বিন; মঙ্গলবার পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ঈশ্বরচন্দ্রের পিতার নাম ছিল, ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি কলকাতায় একটি ছোট চাকরি করতেন। গ্রামে মা ভগবতী দেবীর কাছেই তিনি লালিত হন। তাই বিদ্যাসাগরের জীবনে তাঁর মা ভগবতী দেবীর প্রভাব ছিল অসীম। বলা হয়ে থাকে, তাঁর দৃঢচেতা স্বভাবটি তাঁর মায়ের থেকেই প্রাপ্ত। বিদ্যাসাগর নামে পরিচিত হলেও, প্রকৃতপক্ষে তাঁর নাম ছিল, ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।
বাঙালির জীবনে দেখা যায়, যে সকল মানুষেরা সবচেয়ে বেশী মানুষের সেবা করেছে,উপকার করেছে, লোককল্যাণ করেছে; অকৃতজ্ঞ বাঙালি তাদের পিছনেই পড়ে তাদের দুর্নাম রটিয়েছে। তাদের মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছে।এর অন্যতম বড় দৃষ্টান্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বাইরের মানুষের সাথে সাথে পরিবারের আপনজনেরাও তার সাথে অনৈতিকতা করেছে।একমাত্র পুত্র নারায়ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে বিদ্যাসাগর ১৮৭২ সালে বিদ্যাসাগর তাঁকে ত্যাজ্য ঘোষণা করেন। কিছু দিন পরেই মারা যায় স্ত্রী দীনময়ী দেবী। প্রচণ্ড নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন তখন বিদ্যাসাগর। ১৮৭৫ সালে ঈশ্বরচন্দ্র একটি উইল করেন। সে উইলে তাঁর সকল স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির সুষ্ঠ বণ্টন করে দেন। কিন্তু পুত্র নারায়ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে সম্পত্তির উত্তরসূরী হিসেবে বঞ্চিত করেন। উপলব্ধি করা যায় কতটা ব্যথিত হৃদয়ে তিনি এ কাজটি করেছিলেন।উইলের চৌম্বক অংশগুলো তুলে দেয়া হল :
"শ্রীশ্রীহরিঃ শরণম্
১। আপনি স্বেচ্ছাপ্রবৃত্ত হইয়া সচ্ছন্দচিত্তে আমার সম্পত্তির অন্তিম বিনিয়োগ করিতেছি। এই বিনিয়োগ দ্বারা আমার কৃত পূর্বান সমস্ত বিনিয়োগ নিরস্ত হইল ।
২। চৌগাছানিবাসী শ্রীযুত কালীচরণ ঘোষ, পাথরানিবাসী শ্রীযুত ক্ষীরোদনাথ সিংহ, আমার ভাগিনেয় পসপুরনিবাসী শ্রীযুত বেণীমাধব মুখোপাধ্যায় এই তিন জনকে আমার এই অন্তিম বিনিয়োগপত্রের কার্যদর্শী নিযুক্ত করিলাম, তাঁহারা এই বিনিয়োগপত্রের অনুযায়ী যাবতীয় কার্য নির্বাহ করিবেন৷
৩ । আমি অবিদ্যমান হইলে আমার সমস্ত সম্পত্তি নিযুক্ত কার্যদর্শীদিগের হস্তে যাইবেক।
৪। এক্ষণে আমার যে সকল সম্পত্তি আছে কার্যদর্শীদিগের অবগতি নিমিত্ত তৎসমুদয়ের বিবৃতি এই বিনিয়োগপত্রের সহিত গ্রথিত হইল ।
৫। কার্যদর্শীরা আমার ঋণ পরিশোধ ও আমার প্রাপ্য আদায় করিবেন।
...২৫। আমার পুত্র বলিয়া পরিচিত শ্রীযুত নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় যারপরনাই যথেচ্ছাচারী ও কুপথগামী। এজন্য ও অন্য অন্য গুরুতর কারণ বশতঃ আমি তাঁহার সংস্রব ও সম্পর্ক ত্যাগ করিয়াছি৷ সেই হেতু বশতঃ বৃত্তিনির্বন্ধস্থলে তাঁহার নাম পরিত্যক্ত হইয়াছে এবং এই হেতু বশতঃ তিনি চতুর্বিংশ ধারা নির্দিষ্ট ঋণপরিশোধকালে বিদ্যমান থাকিলেও আমার উত্তরাধিকারী বলিয়া পরিগণিত অথবা দ্বাবিংশ ও ত্রয়োবিংশ ধারা অনুসারে এই বিনিয়োগপত্রের কার্যদর্শী নিযুক্ত হইতে পারিবেন না। তিনি চতুর্বিংশ ধারা নির্দিষ্ট ঋণ পরিশোধকালে বিদ্যমান না থাকিলে যাঁহাদের অধিকার ঘটিত তিনি তৎকালে বিদ্যমান থাকিলেও তাঁহারা চতুর্বিংশ ধারার লিখিত মত আমার সম্পত্তির অধিকারী হইবেন। ইতি তাং ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১২৮২ সাল ইং ৩১শে ১৮৭৫ সাল ।
শ্রীঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মোকাম কলিকাতা।ইশাদী।"
(তীর্থপতি দত্ত ২০০২ : ৩৯৯-৪০২)
কলকাতা শহরের কৃত্রিম নাগরিক জীবন থেকে মুক্তি পেতে একটু নির্জনতার সান্নিধ্য তাঁকে টানছিল প্রচণ্ডভাবে। নানা বিরূপ অভিজ্ঞতা, অকৃতজ্ঞতা, ঘাত-প্রতিঘাতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে বিদ্যাসাগর চলে যান ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী সম্প্রদায়ের কাছে। প্রায় সতেরো বছর বসবাস করেন তাদের সাথে।ঝাড়খণ্ডের কার্মাটাঁড়ে স্টেশনের কাছে পাঁচশো টাকায় স্থানীয় এক ইংরেজ মহিলার কাছ থেকে আমবাগান সমেত প্রায় ১৪ বিঘা জায়গা কিনে বসবাস শুরু করেন বিদ্যাসাগর।এখানেই একটি ছোট বাড়ি তৈরি করেন বিদ্যাসাগর। নাম দেন স্বর্গের বাগানের নামে, 'নন্দনকানন।' এখানে একটি রাত্রিকালীন স্কুলও চালু করেন। সাঁওতাল অধ্যুষিত কার্মাটাঁড়ে বসেই তিনি ‘সীতার বনবাস’, ‘বর্ণপরিচয়’ এর তৃতীয় সংস্করণের প্রুফ দেখেছেন।
কার্মাটাঁড়ে সাঁওতালদের সাথে বিদ্যাসাগরের শেষ জীবনের স্মৃতিচারণ করেছেন ভাই শম্ভুচন্দ্র। তিনি বলেছেন, ‘‘তিনি (বিদ্যাসাগর) প্রাতঃকাল হইতে বেলা দশ ঘটিকা পর্যন্ত সাঁওতাল রোগীদিগকে হোমিওপ্যাথি মতে চিকিৎসা করিতেন এবং পথ্যের জন্য সাগু, বাতাসা, মিছরি প্রভৃতি নিজে প্রদান করিতেন। অপরাহ্নে পীড়িত সাঁওতালদের পর্ণকুটিরে যাইয়া তত্ত্বাবধান করিতেন। তাহাদের কুটিরে যাইলে তাহারা সমাদরপূর্বক বলিত, ‘তুই আসেছিস!’ তাহাদের কথা অগ্রজের বড় ভালো লাগিত।’’
ভাই শম্ভুনাথকে কোলকাতার নাগরিক বিলাসী জীবন ছেড়ে গ্রামীণ আদিবাসীদের সাথে কাটানো প্রসঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বলেন, ‘‘বড়লোকের বাটিতে খাওয়া অপেক্ষা এ সকল লোকের কুটিরে খাইতে আমার ভালো লাগে, ইহাদের স্বভাব ভাল, ইহারা কখনো মিথ্যা কথা বলে না। ইত্যাদি কারণে এখানে থাকিতে ভালোবাসি।’’
আদিবাসীদের নিস্পাপ সারল্যে মুগ্ধ হয়ে বিদ্যাসাগর বাকি জীবনটা সেখানেই কাটাবেন স্থির করেছিলেন। কিন্তু তা অবশ্য হয়নি। কার্মাটাঁড়ের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের সম্পর্ক ছিল প্রায় সতেরো বছরের। শরীর-স্বাস্থ্যের ভগ্নদশার কারণে ১৮৯০ সালের শুরু থেকে আর কার্মাটাঁড়ে বাস করতে পারেননি বিদ্যাসাগর। চিকিৎসার জন্যে চলে আসতে হয়েছে কোলকাতা। এ কলকাতা শহরেই ১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই ৭১ বছর বয়সে বিদ্যাসাগর দেহত্যাগ করেন। হৃদয় সাগরের মত বৃহত্তর না হলে, অত্যন্ত স্বচ্ছ না হলে সকলেই জগতের কল্যাণে কাজ করতে পারে না। বিদ্যাসাগরের মত এমন চারিত্রিক দৃঢ়তা, মানুষের জন্য কর্মস্পৃহা এবং বাক্যে স্পষ্টতা সকলের মাঝে থাকে না। এ সকল গুণাবলিই দৃশ্যমান ছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মধ্যে।তিনি এমন এক সময়ের প্রতিনিধি, যখন তার দূরদর্শী চিন্তা গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু সমাজের সাথে সরাসরি বিরোধে না গিয়ে, শাস্ত্রকে অবলম্বন করে সমাজ সংস্কারে এগিয়ে গিয়েছেন। তিনি আলো হয়ে সমাজকে পর্যায়ক্রমে সংস্কার করে প্রস্তুত করে তুলেছেন। সমাজের রুদ্ধ গতিপথ বদলে দিয়েছেন তিনি। বাংলা ভাষার লেখ্যরূপ পূর্ণতা পেয়েছে তাঁর অবদানে। বাংলায় উনবিংশ শতাব্দীর রেঁনেশায় তাঁর অবদান অনন্য। তিনি ছিলেন সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা এক আলোকদীপ্ত মহাপুরুষ। বিদ্যাসাগরের অবদান প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর' নামক একটি কবিতা রচনা করেন। কবিতাটি ২৪ ভাদ্র, ১৩৪৫ বঙ্গাব্দে 'প্রবাসী' পত্রিকার কার্তিক সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। কবি লেখেন:
"বঙ্গসাহিত্যের রাত্রি স্তব্ধ ছিল তন্দ্রার আবেশে
অখ্যাত জড়ত্বভারে অভিভূত। কী পুণ্য নিমেষে
তব শুভ অভ্যুদয়ে বিকীরিল প্রদীপ্ত প্রতিভা,
প্রথম আশার রশ্মি নিয়ে এল প্রত্যুষের বিভা,
বঙ্গভারতীর ভালে পরালো প্রথম জয়টিকা।
রুদ্ধভাষা আঁধারের খুলিলে নিবিড় যবনিকা,
হে বিদ্যাসাগর, পূর্ব দিগন্তের বনে-উপবনে
নব উদ্‌বোধনগাথা উচ্ছ্বসিল বিস্মিত গগনে।
যে বাণী আনিলে বহি নিষ্কলুষ তাহা শুভ্ররুচি,
সকরুণ মাহাত্ম্যের পুণ্য গঙ্গাস্নানে তাহা শুচি।
ভাষার প্রাঙ্গণে তব আমি করিব তোমারি অতিথি;
ভারতীর পূজাতরে চয়ন করেছি আমি গীতি
সেই তরুতল হতে যা তোমার প্রসাদসিঞ্চনে
মরুর পাষাণ ভেদি প্রকাশ পেয়েছে শুভক্ষণে।"
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৪০৭: ১৩)
তথ্য সহায়তা:
১. তীর্থপতি দত্ত (সম্পা.), বিদ্যাসাগর রচনাবলী (১ম খণ্ড), তুলি-কলম, কলকাতা: মার্চ ২০০২
২. রবীন্দ্র-রচনাবলী, অষ্টাদশ খণ্ড, ব্যক্তিপ্রসঙ্গ (কবিতা), বিশ্বভারতী, কলকাতা: ফাল্গুন ১৪০৭
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।

মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁