-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

"পরোক্ষপ্রিয়া ইব হি দেবাঃ"; দৈবী জগতের ভাষা পরোক্ষ ।

"পরোক্ষপ্রিয়া ইব হি দেবাঃ";  দৈবী জগতের ভাষা পরোক্ষ  আমাদের এ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের ঊর্ধ্বে এক অন্য জগত আছে, সেই জগতের নাম দৈবীজগত। সে জগতের ভাষাও দৈবী। তাই আমরা সেই জগতের অধিকাংশ ভাষাই বুঝতে পারি না। এ দৈবীভাষা বীজের আবরণের মত। আবরণকে উন্মোচিত করেই বীজকে পেতে হয়। এই ভাষাটি আলো আঁধারী হওয়ায়, কখনো বোঝা যায় অথবা কখনো শুধুই অন্ধকার। পরমেশ্বরের বাণী বেদ এই দৈবী ভাষায় রচিত। তাই সকলেই বেদমন্ত্রের অন্তর্নিহিত অর্থ উপলব্ধি করতে পারে না। মন্ত্রের বাহ্যিক দৃষ্টিতে বিভ্রান্ত হয়ে যায়। পরমেশ্বরের বাণী বেদের দৈবী ভাষাটি পরোক্ষনির্ভর। অর্থাৎ বেদ পরোক্ষ ভাষায় রচিত। তাই বেদের সকল মন্ত্রেরই আভিধানিক বা আক্ষরিক অর্থ হবে না। অধিকাংশ মন্ত্রেরই পরোক্ষ বা আধ্যাত্মিক অর্থ হবে। বিষয়টি ঋগ্বেদের ঐতরেয় উপনিষদের মধ্যেই বলা হয়েছে। পরমেশ্বর সৃষ্টির প্রথমেই জীবদেহে প্রবিষ্ট হয়ে নিজেকে অপরোক্ষ দর্শন করেছিলেন। তাই তিনি 'ইদন্দ্র' নামে অভিহিত। পরমেশ্বরের নাম 'ইদন্দ্র' হলেও ব্রহ্মজ্ঞ ঋষিগণ তাঁকে পরোক্ষভাবে 'ইদন্দ্র' নামে অবিহিত না করে 'ইন্দ্র' নামে অভিহিত করেন। কারণ দেবতারা পরোক্ষবাক্য পছন্দ করেন। তস্মাদিদন্দ্রো নাম, ইদন্দ্রো হ বৈ নাম। তমিদন্দ্রং সন্তমিন্দ্র ইত্যাচক্ষতে পরোক্ষেণ,   পরোক্ষপ্রিয়া ইব হি দেবাঃ,  পরোক্ষপ্রিয়া ইব হি দেবাঃ।। (ঐতরেয় উপনিষদ: ১.৩.১৪) "যেহেতু পরমাত্মা জীবদেহে প্রবিষ্ট হয়ে নিজেকে অপরোক্ষ দর্শন করেছিলেন। তাই সেই পরমাত্মা 'ইদন্দ্র' নামে অভিহিত। তিনি 'ইদন্দ্র' নামে খ্যাত হলেও ব্রহ্মজ্ঞগণ তাঁকে পরোক্ষভাবে 'ইন্দ্র' নামে অভিহিত করেন। কারণ দেবগণ পরোক্ষপ্রিয়। অর্থাৎ দেবগণ পরোক্ষবাক্য পছন্দ করেন।" এই পরোক্ষবাক্যের গভীরতা আমরা বুঝতে পারিনা বলেই বেদমন্ত্রের অন্তর্নিহিত অর্থও আমরা উপলব্ধি করতে পারি না। ঋগ্বেদ সংহিতার চতুর্থ মণ্ডলে একটি শব্দ আছে, "নিণ্যা বচাংসি"(ঋগ্বেদ সংহিতা:৪.৩.১৬)। অর্থাৎ গোপনীয় আধ্যাত্মিক সত্যবচন। যাস্কের নিরুক্ত অনুসারে 'নিণ্য' শব্দের অর্থ আড়াল করে রাখা অথবা গোপন করে রাখা (নিরুক্ত:৩.২৫)। তাই পরোক্ষপ্রিয় দেবতাদের গোপনীয় আধ্যাত্মিক নিগূঢ়তম বাণী সকলেই বুঝতে পারে না। তখনই বেদমন্ত্রকে উপলব্ধি করতে না পারা ব্যক্তিটি বিভ্রান্ত হয়ে নিজের মনোমত বেদমন্ত্রের কদর্যরূপ অর্থ তৈরি করে।কখনো এ কাজটি সচেতনভাবে করে, অথবা অসচেতনভাবে করে। মধ্যযুগের বিখ্যাত বাঙালি কবি চণ্ডীদাস বলেছেন, সকল কথা সকল স্থানে চলে না। আধ্যাত্মিক দৈবী জগতের ভাব, জাগতিক জগতে চলে না। মানুষ বুঝতেও সর্বদা পারে না। তখই বিভ্রান্ত হয়ে মর্মাহত হয়। এ এক অচেনা জগত, যে জগতে প্রবেশ করতে পারলে জীবন মধুময় হয়ে উঠে।  "সে দেশের কথা এ দেশে কহিলে  লাগিবে মরমে ব্যাথা।।"  বেদ তো বটেই, ভারতবর্ষীয় অধিকাংশ সাহিত্যই এমনি পরোক্ষভাবে পরোক্ষ ভাষায় রচিত। তাই বেদমন্ত্র সহ ধর্মশাস্ত্রের অধিকাংশ তত্ত্বের মধ্যেই দ্ব্যর্থবোধকতা পাওয়া যায়। যেন যোগ্য অধিকারী বিহীন কেউ সেই তত্ত্বকে উপলব্ধি করতে না পারে। কারণ অধিকারী বিহীন বিদ্যা কখনও ফলবতী হয় না। সনাতন ধর্মের লক্ষ্য ছলে বলে কৌশলে শুধু সংখ্যা বৃদ্ধি নয়। সনাতন ধর্ম এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ধর্ম। জগতে মানুষ সহ প্রাণীকুল না থাকলেও এ ধর্ম স্বমহিমায় প্রবাহমান থাকবে। সনাতনের লক্ষ্য হলো জীবকে জন্মজন্মান্তরের আবর্তন থেকে মুক্ত করে মুক্তির পথে নিয়ে যাওয়া। এই পরোক্ষ বা দ্ব্যর্থবোধক শব্দের ব্যবহারের জন্যে আমাদের বেশি দূরে যেতে হবে না। বৈদিক এবং লৌকিক সংস্কৃত ভাষার পরম্পরায় আমরা বাংলাভাষাতেও এর অসংখ্য দৃষ্টান্ত পাই। অর্থাৎ আপাতদৃষ্ট আভিধানিক অর্থ থেকে মূল আধ্যাত্মিক অর্থ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এক্ষেত্রে আমরা মধ্যযুগের কবি ভারতচন্দ্র রায়ের 'অন্নদামঙ্গল' কাব্যের উল্লেখ করতে পারি। সেই কাব্যে ঈশ্বরী পাটুনী নামক মাঝির সাথে দেবী অন্নপূর্ণার কথোপকথন সম্পূর্ণভাবে দ্ব্যর্থবোধক পরোক্ষ ভাষায় রচিত। তাই মাঝি প্রথমে কথার অন্তর্নিহিত অর্থ উপলব্ধি করতে পারে নি। পপরবর্তীতে যখন উপলব্ধি করতে পারে, তখন তার চোখ দিয়ে আনন্দাশ্রু বয়ে যেতে থাকে। আমরা সেই কাব্যের কয়েকটি পঙক্তি তুলে ধরছি। "অতি বড় বৃদ্ধ পতি সিদ্ধিতে নিপুণ। কোন গুণ নাহি তাঁর কপালে আগুন।।  কুকথায় পঞ্চমুখ কন্ঠভরা বিষ। কেবল আমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ।। " "অতি বড় বৃদ্ধ পতি" দেবীর মুখে এই বাক্য শুনে ঈশ্বরী পাটনী ভেবেছে তাঁর স্বামী বুঝি বয়সে অনেক বৃদ্ধ। কিন্তু দেবী বলেছেন অন্য কথা।শিব যেহেতু আদিনাথ, আদিযোগী এবং সৃষ্টির পূর্ব থেকেই তিনি বর্তমান। তাই জগতে শিবের থেকে বৃদ্ধ আর কে বা থাকবে? তিনিই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সকলের থেকই বৃদ্ধ। দেবীর মুখে ঈশ্বরী পাটনী "সিদ্ধিতে নিপুণ" বাক্যটি শুনে ভেবেছে, সারাদিন বিভিন্ন সিদ্ধি ভাং খেয়ে তাঁর স্বামী মাতলামি করে বেড়ায়। কিন্তু দেবী অন্নপূর্ণা এখানে বলেছেন, শিব জীবের সকল অভীষ্ট সিদ্ধি প্রদান করে, তাই তিনি সিদ্ধিদানে নিপুণ। শিব সাত্ত্বিক, রাজসিক এবং তামসিক এ ত্রিগুণের অতীত। তিনি সাধারণ মনুষ্যের মত ত্রিগুণ দ্বারা আছন্ন নন। তাই দেবী বলেছেন, তাঁর কোন গুণ তো নেই। কপালে আগুনের কথা শুনে পাটুনী ভেবেছে তাঁর স্বামী বুঝি সর্বদা সকলের সাথে দুর্ব্যবহার করে বেড়ায়। কিন্তু দেবী অন্নপূর্ণা কপালে আগুন বলতে শিবের অগ্নিরূপ ললাটনেত্রকে বুঝিয়েছেন। "কুকথায় পঞ্চমুখ" এই কথা শুনে পাটুনী ভেবেছে তাঁর স্বামী সর্বদা কুকথা এবং অশ্লীল কথা বলে বেড়ায়। কিন্তু 'কু' শব্দের অর্থ পৃথিবী, অর্থাৎ পৃথিবী যাঁর কথায় পঞ্চমুখ। কুকথা শব্দটির আরেকটি অর্থ হয় যে, আগম-নিগম প্রতিপাদ্য বিদ্যা। অর্থাৎ বেদ-বেদাঙ্গ শাস্ত্র যাঁর কথায় পঞ্চমুখ হয়ে থাকে তিনিই তাঁর স্বামী সদাশিব। পুরুষ এবং প্রকৃতির মিলনেই জগতের উৎপত্তি।"আমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ" বলতে সৃষ্টি প্রক্রিয়ার দ্বন্দ্ব এবং মিলনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পাটুনী ভেবেছে, দিনরাত্রি বুঝি তাদের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বিভিন্ন প্রকারের দ্বন্দ্ব সংঘাত হয়।  ঋগ্বেদ সংহিতার প্রথম মণ্ডলের একটি মন্ত্রে বলা হয়েছে, বেদমন্ত্রের মাঝে নিগূঢ়তম সত্য লুকিয়ে রয়েছে। সেই অমৃতময় সত্য এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে অব্যক্ত হয়ে আছে। বেদমন্ত্রের দৈবী ভাষায় সেই অমৃতময় সত্যকে পাওয়া যায়। বেদমন্ত্র সেই পথে পাওয়ার উপায়। বেদমন্ত্রের অক্ষরে অক্ষরে সকল দেবতা অধিষ্ঠান করে আছেন। কারণ দেবতারা মন্ত্রময়। সেই দৈবী ভাষার পরম রহস্য সকলেই জানতে পারে না। শুধু বেদপাঠ করেই তাঁকে জানা যায় না। সেই পরমেশ্বর যাঁকে কৃপা করেন, তিনিই তাঁকে কিঞ্চিৎ জানতে পারেন।তবে যারা এ নিগূঢ় তত্ত্ব কিছুটা হলেও জানে তারা ব্রহ্মের আনন্দঘন স্বরূপকে প্রাপ্ত হন। ঋচো অক্ষরে পরমে ব্যোমন্যা- স্মিন্দেবা অধি বিশ্বে নিষেদুঃ যস্তন্ন বেদ কিমৃচা করিষ্যতি  য ইত্তদ্বিদুস্ত ইমে সমাসতে৷৷ (ঋগ্বেদ সংহিতা:১.১৬৪.৩৯) "বেদমন্ত্রের নিগূঢ় সত্য লুকিয়ে রয়েছে, পরম ব্যোমের অব্যক্ত ঋকের অক্ষরে। সেই লোকে সকল দেবতা অধিষ্ঠান করে আছেন। সেই পরম রহস্য যে জানে না, সে বেদ পাঠ করে কি করবে? তবে এ নিগূঢ় তত্ত্ব যারা জানে তারা সুখে অবস্থান করেন।" শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ। ফেসবুক পোস্ট লিঙ্ক :   "পরোক্ষপ্রিয়া ইব হি দেবাঃ";  দৈবী জগতের ভাষা পরোক্ষ । ফেসবুক পেজ লিঙ্ক :  Shri Kushal Baran Chakraborty | Facebook
আমাদের এ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের ঊর্ধ্বে এক অন্য জগত আছে, সেই জগতের নাম দৈবীজগত। সে জগতের ভাষাও দৈবী। তাই আমরা সেই জগতের অধিকাংশ ভাষাই বুঝতে পারি না। এ দৈবীভাষা বীজের আবরণের মত। আবরণকে উন্মোচিত করেই বীজকে পেতে হয়। এই ভাষাটি আলো আঁধারী হওয়ায়, কখনো বোঝা যায় অথবা কখনো শুধুই অন্ধকার। পরমেশ্বরের বাণী বেদ এই দৈবী ভাষায় রচিত। তাই সকলেই বেদমন্ত্রের অন্তর্নিহিত অর্থ উপলব্ধি করতে পারে না। মন্ত্রের বাহ্যিক দৃষ্টিতে বিভ্রান্ত হয়ে যায়। পরমেশ্বরের বাণী বেদের দৈবী ভাষাটি পরোক্ষনির্ভর। অর্থাৎ বেদ পরোক্ষ ভাষায় রচিত। তাই বেদের সকল মন্ত্রেরই আভিধানিক বা আক্ষরিক অর্থ হবে না। অধিকাংশ মন্ত্রেরই পরোক্ষ বা আধ্যাত্মিক অর্থ হবে। বিষয়টি ঋগ্বেদের ঐতরেয় উপনিষদের মধ্যেই বলা হয়েছে। পরমেশ্বর সৃষ্টির প্রথমেই জীবদেহে প্রবিষ্ট হয়ে নিজেকে অপরোক্ষ দর্শন করেছিলেন। তাই তিনি 'ইদন্দ্র' নামে অভিহিত। পরমেশ্বরের নাম 'ইদন্দ্র' হলেও ব্রহ্মজ্ঞ ঋষিগণ তাঁকে পরোক্ষভাবে 'ইদন্দ্র' নামে অবিহিত না করে 'ইন্দ্র' নামে অভিহিত করেন। কারণ দেবতারা পরোক্ষবাক্য পছন্দ করেন।
তস্মাদিদন্দ্রো নাম, ইদন্দ্রো হ বৈ নাম।
তমিদন্দ্রং সন্তমিন্দ্র ইত্যাচক্ষতে পরোক্ষেণ,
পরোক্ষপ্রিয়া ইব হি দেবাঃ,
পরোক্ষপ্রিয়া ইব হি দেবাঃ।।
(ঐতরেয় উপনিষদ: ১.৩.১৪)
"যেহেতু পরমাত্মা জীবদেহে প্রবিষ্ট হয়ে নিজেকে অপরোক্ষ দর্শন করেছিলেন। তাই সেই পরমাত্মা 'ইদন্দ্র' নামে অভিহিত। তিনি 'ইদন্দ্র' নামে খ্যাত হলেও ব্রহ্মজ্ঞগণ তাঁকে পরোক্ষভাবে 'ইন্দ্র' নামে অভিহিত করেন। কারণ দেবগণ পরোক্ষপ্রিয়। অর্থাৎ দেবগণ পরোক্ষবাক্য পছন্দ করেন।"
এই পরোক্ষবাক্যের গভীরতা আমরা বুঝতে পারিনা বলেই বেদমন্ত্রের অন্তর্নিহিত অর্থও আমরা উপলব্ধি করতে পারি না। ঋগ্বেদ সংহিতার চতুর্থ মণ্ডলে একটি শব্দ আছে, "নিণ্যা বচাংসি"(ঋগ্বেদ সংহিতা:৪.৩.১৬)। অর্থাৎ গোপনীয় আধ্যাত্মিক সত্যবচন। যাস্কের নিরুক্ত অনুসারে 'নিণ্য' শব্দের অর্থ আড়াল করে রাখা অথবা গোপন করে রাখা (নিরুক্ত:৩.২৫)। তাই পরোক্ষপ্রিয় দেবতাদের গোপনীয় আধ্যাত্মিক নিগূঢ়তম বাণী সকলেই বুঝতে পারে না। তখনই বেদমন্ত্রকে উপলব্ধি করতে না পারা ব্যক্তিটি বিভ্রান্ত হয়ে নিজের মনোমত বেদমন্ত্রের কদর্যরূপ অর্থ তৈরি করে।কখনো এ কাজটি সচেতনভাবে করে, অথবা অসচেতনভাবে করে। মধ্যযুগের বিখ্যাত বাঙালি কবি চণ্ডীদাস বলেছেন, সকল কথা সকল স্থানে চলে না। আধ্যাত্মিক দৈবী জগতের ভাব, জাগতিক জগতে চলে না। মানুষ বুঝতেও সর্বদা পারে না। তখই বিভ্রান্ত হয়ে মর্মাহত হয়। এ এক অচেনা জগত, যে জগতে প্রবেশ করতে পারলে জীবন মধুময় হয়ে উঠে।
"সে দেশের কথা এ দেশে কহিলে
লাগিবে মরমে ব্যাথা।।"
বেদ তো বটেই, ভারতবর্ষীয় অধিকাংশ সাহিত্যই এমনি পরোক্ষভাবে পরোক্ষ ভাষায় রচিত। তাই বেদমন্ত্র সহ ধর্মশাস্ত্রের অধিকাংশ তত্ত্বের মধ্যেই দ্ব্যর্থবোধকতা পাওয়া যায়। যেন যোগ্য অধিকারী বিহীন কেউ সেই তত্ত্বকে উপলব্ধি করতে না পারে। কারণ অধিকারী বিহীন বিদ্যা কখনও ফলবতী হয় না। সনাতন ধর্মের লক্ষ্য ছলে বলে কৌশলে শুধু সংখ্যা বৃদ্ধি নয়। সনাতন ধর্ম এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ধর্ম। জগতে মানুষ সহ প্রাণীকুল না থাকলেও এ ধর্ম স্বমহিমায় প্রবাহমান থাকবে। সনাতনের লক্ষ্য হলো জীবকে জন্মজন্মান্তরের আবর্তন থেকে মুক্ত করে মুক্তির পথে নিয়ে যাওয়া। এই পরোক্ষ বা দ্ব্যর্থবোধক শব্দের ব্যবহারের জন্যে আমাদের বেশি দূরে যেতে হবে না। বৈদিক এবং লৌকিক সংস্কৃত ভাষার পরম্পরায় আমরা বাংলাভাষাতেও এর অসংখ্য দৃষ্টান্ত পাই। অর্থাৎ আপাতদৃষ্ট আভিধানিক অর্থ থেকে মূল আধ্যাত্মিক অর্থ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এক্ষেত্রে আমরা মধ্যযুগের কবি ভারতচন্দ্র রায়ের 'অন্নদামঙ্গল' কাব্যের উল্লেখ করতে পারি। সেই কাব্যে ঈশ্বরী পাটুনী নামক মাঝির সাথে দেবী অন্নপূর্ণার কথোপকথন সম্পূর্ণভাবে দ্ব্যর্থবোধক পরোক্ষ ভাষায় রচিত। তাই মাঝি প্রথমে কথার অন্তর্নিহিত অর্থ উপলব্ধি করতে পারে নি। পপরবর্তীতে যখন উপলব্ধি করতে পারে, তখন তার চোখ দিয়ে আনন্দাশ্রু বয়ে যেতে থাকে। আমরা সেই কাব্যের কয়েকটি পঙক্তি তুলে ধরছি।
"অতি বড় বৃদ্ধ পতি সিদ্ধিতে নিপুণ।
কোন গুণ নাহি তাঁর কপালে আগুন।।
কুকথায় পঞ্চমুখ কন্ঠভরা বিষ।
কেবল আমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ।। "
"অতি বড় বৃদ্ধ পতি" দেবীর মুখে এই বাক্য শুনে ঈশ্বরী পাটনী ভেবেছে তাঁর স্বামী বুঝি বয়সে অনেক বৃদ্ধ। কিন্তু দেবী বলেছেন অন্য কথা।শিব যেহেতু আদিনাথ, আদিযোগী এবং সৃষ্টির পূর্ব থেকেই তিনি বর্তমান। তাই জগতে শিবের থেকে বৃদ্ধ আর কে বা থাকবে? তিনিই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সকলের থেকই বৃদ্ধ। দেবীর মুখে ঈশ্বরী পাটনী "সিদ্ধিতে নিপুণ" বাক্যটি শুনে ভেবেছে, সারাদিন বিভিন্ন সিদ্ধি ভাং খেয়ে তাঁর স্বামী মাতলামি করে বেড়ায়। কিন্তু দেবী অন্নপূর্ণা এখানে বলেছেন, শিব জীবের সকল অভীষ্ট সিদ্ধি প্রদান করে, তাই তিনি সিদ্ধিদানে নিপুণ। শিব সাত্ত্বিক, রাজসিক এবং তামসিক এ ত্রিগুণের অতীত। তিনি সাধারণ মনুষ্যের মত ত্রিগুণ দ্বারা আছন্ন নন। তাই দেবী বলেছেন, তাঁর কোন গুণ তো নেই। কপালে আগুনের কথা শুনে পাটুনী ভেবেছে তাঁর স্বামী বুঝি সর্বদা সকলের সাথে দুর্ব্যবহার করে বেড়ায়। কিন্তু দেবী অন্নপূর্ণা কপালে আগুন বলতে শিবের অগ্নিরূপ ললাটনেত্রকে বুঝিয়েছেন। "কুকথায় পঞ্চমুখ" এই কথা শুনে পাটুনী ভেবেছে তাঁর স্বামী সর্বদা কুকথা এবং অশ্লীল কথা বলে বেড়ায়। কিন্তু 'কু' শব্দের অর্থ পৃথিবী, অর্থাৎ পৃথিবী যাঁর কথায় পঞ্চমুখ। কুকথা শব্দটির আরেকটি অর্থ হয় যে, আগম-নিগম প্রতিপাদ্য বিদ্যা। অর্থাৎ বেদ-বেদাঙ্গ শাস্ত্র যাঁর কথায় পঞ্চমুখ হয়ে থাকে তিনিই তাঁর স্বামী সদাশিব। পুরুষ এবং প্রকৃতির মিলনেই জগতের উৎপত্তি।"আমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ" বলতে সৃষ্টি প্রক্রিয়ার দ্বন্দ্ব এবং মিলনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পাটুনী ভেবেছে, দিনরাত্রি বুঝি তাদের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বিভিন্ন প্রকারের দ্বন্দ্ব সংঘাত হয়।
ঋগ্বেদ সংহিতার প্রথম মণ্ডলের একটি মন্ত্রে বলা হয়েছে, বেদমন্ত্রের মাঝে নিগূঢ়তম সত্য লুকিয়ে রয়েছে। সেই অমৃতময় সত্য এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে অব্যক্ত হয়ে আছে। বেদমন্ত্রের দৈবী ভাষায় সেই অমৃতময় সত্যকে পাওয়া যায়। বেদমন্ত্র সেই পথে পাওয়ার উপায়। বেদমন্ত্রের অক্ষরে অক্ষরে সকল দেবতা অধিষ্ঠান করে আছেন। কারণ দেবতারা মন্ত্রময়। সেই দৈবী ভাষার পরম রহস্য সকলেই জানতে পারে না। শুধু বেদপাঠ করেই তাঁকে জানা যায় না। সেই পরমেশ্বর যাঁকে কৃপা করেন, তিনিই তাঁকে কিঞ্চিৎ জানতে পারেন।তবে যারা এ নিগূঢ় তত্ত্ব কিছুটা হলেও জানে তারা ব্রহ্মের আনন্দঘন স্বরূপকে প্রাপ্ত হন।
ঋচো অক্ষরে পরমে ব্যোমন্যা-
স্মিন্দেবা অধি বিশ্বে নিষেদুঃ
যস্তন্ন বেদ কিমৃচা করিষ্যতি
য ইত্তদ্বিদুস্ত ইমে সমাসতে৷৷
(ঋগ্বেদ সংহিতা:১.১৬৪.৩৯)
"বেদমন্ত্রের নিগূঢ় সত্য লুকিয়ে রয়েছে, পরম ব্যোমের অব্যক্ত ঋকের অক্ষরে। সেই লোকে সকল দেবতা অধিষ্ঠান করে আছেন। সেই পরম রহস্য যে জানে না, সে বেদ পাঠ করে কি করবে? তবে এ নিগূঢ় তত্ত্ব যারা জানে তারা সুখে অবস্থান করেন।"
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁