সনাতন মূলধারার ধর্ম, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যে এবং সদাচারের প্রত্যকটি বিষয় বৈদিক পরম্পরায় আগত। মোটামুটি এমন কোন বিষয় নেই, যার উৎস বেদে নেই। বেদ সম্পর্কে আমাদের সম্যক ধারণা না থাকার কারণে আমরা বুঝতে পারিনা। এ কারণেই বেদের বহুল প্রচার প্রসারের প্রয়োজন। তবে ইদানীং অনেকে বেদকে খণ্ডিতভাবে অঙ্গহানি করে প্রচার করছে। বিষয়টি অত্যন্ত ঔদ্ধত্যপূর্ণ এবং পাপকর্মের। বেদের অখণ্ড বেদ ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ এবং অথর্ববেদ এ চার প্রকারে বিন্যস্ত। এর মধ্যে যজুর্বেদ দুই প্রকারে বিভক্ত, শুক্ল যজুর্বেদ এবং কৃষ্ণ যজুর্বেদ। ঋগ্বেদ, সামবেদ, শুক্ল যজুর্বেদ এবং কৃষ্ণ যজুর্বেদ এবং অথর্ববেদ- এ সকল প্রকার আবার চারটি অংশে বিভক্ত। সেই চারটি অংশ হলো: মন্ত্র বা সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক এবং উপনিষদ। সকল বেদেরই এই চারটি অংশ রয়েছে। এর মধ্যে অথর্ববেদের আরণ্যক অংশ পাওয়া যায় না।
বেদমন্ত্রেই বলা হয়েছে ব্রহ্ম এবং তাঁর শক্তি অভেদ। সেই তত্ত্বটিই আমরা বিস্তৃতভাবে রামায়ণ, মহাভারত সহ বিবিধ পুরাণে পাই। জগতের কারণ যিনি ব্রহ্ম, তিনিই শক্তি। যাকে আমরা আদ্যাশক্তি মহামায়া নামে অবিহিত করি।ঈশ্বর যখন সৃষ্টি করেন, তখন তিনি নিজে সরাসরি সৃষ্টিতে জড়ান না; তাঁর শক্তি কাজ করে। যিনি ব্রহ্ম, তিনিই শক্তি। ব্রহ্ম এবং ব্রহ্মের অভেদ শক্তি -এ বৈদিক তত্ত্বকে দেবীভাগবত, মহাপুরাণ, কালিকাপুরাণ, দেবীপুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ সহ বিবিধ শাক্তমতের পুরাণে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। মার্কণ্ডেয় পুরাণের ৮১ থেকে ৯৩ এ ত্রয়োদশ অধ্যায় 'শ্রীচণ্ডী' নামে খ্যাত। এই ত্রয়োদশ অধ্যায়টি মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্ভুক্ত হলেও, বর্তমানে একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থের মর্যাদায় ভূষিত। গ্রন্থটিকে 'দেবীমাহাত্ম্য' এবং 'দুর্গাসপ্তশতী' বলা হয়। গ্রন্থটিতে ৫৭৮ টি শ্লোক। এ ৫৭৮ টি শ্লোকের মধ্যেই সাতশত মন্ত্র রয়েছে, যে মন্ত্রগুলো আদ্যাশক্তি মহামায়ার পূজা হোমে ব্যবহৃত হয়।
ঋগ্বেদ সংহিতার দশম মণ্ডলের ১২৫ সূক্ত সূক্ত 'দেবীসূক্ত'। বৈদিক এ সূক্তে আদ্যাশক্তি মহামায়ার মহিমা বর্ণিত হয়েছে। আটটি ঋগ্বেদীয় দেবীসূক্তের মন্ত্রদ্রষ্ট্রী ঋষি হলেন অম্ভৃণ মহর্ষির কন্যা বাক্। তিনি ধ্যানযোগে সমাধি অবস্থায় নিজের মধ্যেই আদ্যাশক্তি মহামায়াকে উপলব্ধি করে এ মন্ত্রটি দর্শন করেছিলেন। সূক্তের মন্ত্রগুলোতে উপলব্ধি করা যায় যে, অম্ভৃণ মহর্ষির কন্যা বাক্ জগতের পরমেশ্বরী আদ্যাশক্তি মহামায়ার সাথে একাকার হয়ে গিয়েছিলেন। এ অবস্থানেই সাধকের মুক্তি ঘটে। এ সূক্তে শুধু দ্বিতীয় মন্ত্রটিই জগতীছন্দে রচিত, অন্য অবশিষ্ট সাতটি মন্ত্রই ত্রিষ্টুচ্ছন্দে রচিত। পরব্রহ্মময়ী আদ্যাশক্তি জগন্মাতার প্রীতির জন্য এ সূক্তটির বিনিয়োগ করা হয়।সপ্তশতী শ্রীচণ্ডী পাঠ করার পরে দেবীসূক্ত-পাঠের বিধান রয়েছে।
অহং রুদ্রেভির্বমুভিশ্চরা-
ম্যহমাদিত্যেরুত বিশ্বদেবৈঃ।
অহং মিত্রাবরুণোভা বিভ-
র্ম্যহমিদ্ৰাগ্নী অহমশ্বিনোভা॥ ১
"আমি একাদশ রুদ্ররূপে, অষ্টবসুরূপে, দ্বাদশ আদিত্যরূপে এবং সর্বদেবরূপে জগতে বিচরণ করি।আমি মিত্র ও বরুণ, উভয় দেবতাকে ধারণ করি। আমি ইন্দ্র, অগ্নি এবং অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে ধারণ করি। "
দেবীসূক্তে সুস্পষ্টভাবে তাঁর মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন। দেবীসূক্তে দেবীর মাহাত্ম্যকথাই গল্পের মাধ্যমে সুবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে দেবীমাহাত্ম্য বা শ্রীচণ্ডীতে। একাদশ রুদ্ররূপে, অষ্টবসুরূপে, দ্বাদশ আদিত্যরূপে এবং সর্বদেবরূপে ঈশ্বরের অনন্ত শক্তি, অনন্ত রূপে, অনন্ত নামে, অনন্ত দেবতা নামে প্রকাশিত। এ সকল রূপ, নাম এবং প্রকাশের উৎস আদ্যাশক্তি মহামায়া। তিনিই সূর্য হয়ে আলো প্রদান করেন। তিনিই বরুণ সকল জলের উৎস। সকল দেবতাকে ধারণ করে আছেন। তাঁরই অচিন্ত্য উৎসের শক্তি থেকেই ইন্দ্র, অগ্নি, অশ্বিনীকুমারদ্বয় ক্রিয়াশীল। দেবতারা বিবিধ নামে অভিহিত হলেও, তাঁরা কেউ ব্রহ্মের শক্তি স্বরূপা আদ্যাশক্তি থেকে ভিন্ন নয়। সকলেই অভেদ। এই মন্ত্রে
'চরামি' এবং 'বিভর্মি' ক্রিয়াপদদুটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। 'চরামি' ক্রিয়াপদটির স্বাভাবিক অর্থ- "বিচরণ করি"। কিন্তু এ শব্দটির অর্থ আরও গভীরে। এর অর্থ হবে চরিয়ে বেড়াই বা পরিচালিত করি। এই বৈদিক 'চরামি' শব্দটি বাংলাভাষায় 'চড়িয়ে বেড়াই' অর্থে এখনো প্রচলিত আছে। যেমন: গরু চড়ানো, অর্থাৎ পরিচালিত করা নিয়ন্ত্রিত করা। একাদশ রুদ্র, অষ্টবসু, দ্বাদশ আদিত্য এবং সর্বদেব জগতে আদ্যাশক্তি মহামায়ার শক্তিতেই শক্তিমান। আদ্যাশক্তিই তাদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে চরিয়ে বেড়ান বা পরিচালিত করেন। 'বিভর্মি' ক্রিয়াপদটি, ধারণ করা এই সাধারণ অর্থ থেকেও ব্যাপকতর। মিত্র, বরুণ, ইন্দ্র, অগ্নি এবং অশ্বিনীকুমার সহ সকল শক্তির উৎস আদ্যাশক্তি মহামায়া। মায়ার আবরণে তাঁদের আলাদা আলাদা বলে প্রতীতি হলেও, তাঁরা কেউ আলাদা নয়। সকলেই অচিন্ত্য আদ্যাশক্তির বিবিধ শক্তির প্রকাশ।
অহং সোমমাহনসং বিভ-
র্ম্যহং ত্বষ্টারমুত পূষণং ভগম্ ।
অহং দধামি দ্রবিণং হবিষ্মতে
স্থপ্রাব্যে যজমানায় সুন্বতে ॥ ২
"আমি শত্রুহন্তা দেবতারূপী সোমদেবকে ধারণ করি। আমি ত্বষ্টাকে, পূষা এবং ভগকে ধারণ করি। যে যজমান হবিযুক্ত এবং যে উত্তম হবিঃ দ্বারা দেবগণকে তৃপ্ত করেন; বিধিপূর্বক সোমরস দ্বারা দেবতাগণের তর্পণকারী যজমানকে যজ্ঞফলরূপ ধন আমিই প্রদান করি।"
দেবী শত্রু বিনাশকারী। তিনি অমৃতের প্রতীক চন্দ্রকে ধারণ করে রাত্রিকে আলোকিত করেন।তিনি ত্বষ্টা বা বিশ্বকর্মা নামে জগতের কর্ম প্রবাহকে সচল রাখেন। তিনি পূষা হয়ে জীবকে পরিপোষণ করেন। ভগ বা জগতের সকল ঐশ্বর্যকে তিনি ধারণ করে আছেন। যজ্ঞ বা পূজায় যজমান উত্তম হবিঃ এবং সোমরস দেবগণকে বিধিপূর্বক শ্রদ্ধার সাথে সমর্পণ করেন। সেই দেবতাগণের তর্পণকারী উত্তম হবিঃ, সোমরস এবং পূজার নৈবেদ্য সেই সকলই আদ্যাশক্তি মহামায়ার কাছে যায়। তিনিই পরম সন্তুষ্ট হয়ে যজমানকে যজ্ঞফলরূপ ধন সম্পদ প্রদান করেন।
অহং রাষ্ট্রী সংগমনী বসুনাং
চিকিতুষী প্রথমা যজ্ঞিয়ানাম্ ।
তাং মা দেবা ব্যদধুঃ পুরুত্রা
ভূরিস্থাত্রাং ভূর্যাবেশয়ন্তীম্ ॥ ৩
"আমি রাষ্ট্রী অর্থাৎ সমগ্র জগতের ঈশ্বরী। আমি উপাসকগণের ধন প্রদাত্রী। আমি পরব্রহ্মকে আত্মস্বরূপে অভিন্নরূপে প্রত্যক্ষ জেনেছি। আমি যজ্ঞিয় দেবতাগণের প্রধানা। জগৎপ্রপঞ্চরূপে আমি অনন্তভাবে অবস্থান করি এবং জীবাত্মা হয়ে জীবের মধ্যে প্রবিষ্টা। আমাকেই সর্বদেশে সুরনরাদি যজমানগণ বিবিধভাবে আরাধনা করে।"
আমি রাষ্ট্রী অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের চালিকা শক্তি ঈশ্বরী। যে সকল সাধক তাঁর উপাসনা করে, সেই সকল উপাসকদের তিনি মুক্তিরূপ নিঃশ্রেয়স ধন এবং জাগতিক আভ্যুদয়িক ধন প্রদান করেন। প্রত্যেকটি জীবের হৃদয়ের মাঝেই দেবী বিরাজিতা। তিনি যজ্ঞের অধিষ্ঠাত্রী, সকল দেবতাগণের তিনি শক্তিস্বরূপা এবং অগ্রগণ্যা। বিবিধ রূপে প্রকাশিত হলেও তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। তিনিই জগৎপ্রপঞ্চরূপে অনন্তভাবে, অনন্তরূপে নিমিত্ত এবং উপাদান কারণ হয়ে বিরাজ করেন। তিনিই নিমিত্ত কারণ হয়ে জগতকে পরিচালনা করেন, আবার তিনিই উপাদান কারণ হয়ে এই জগতের জড় চেতন সকল কিছুতেই বিরাজ করেন। তিনিই জীবাত্মা হয়ে জীবের মধ্যে প্রবিষ্টা জীবের প্রাণকে সচল রাখেন । রূপ থেকে রূপান্তরে সর্বদেশে, সর্বকালেই তিনি পূজিতা। প্রাণীকুল থেকে দেবতা সকলেই বিবিধভাবে তাঁকে আরাধনা করে। তিনি যেহেতু অনন্য এবং অনন্ত ; তাই তাঁর উপাসনা পদ্ধতিও অনন্ত।
ময়া সো অন্নমত্তি যো বিপশ্যতি
যঃ প্রাণিতি য ঈং শৃণোত্যুক্তম্ ।
অমন্তবো মাং ত উপক্ষিয়ন্তি
শ্ৰুধি শ্রুত শ্রদ্ধিবং তে বদামি ॥ ৪
"আমার দ্বারাই সকলে আহার ভোজন করে; কারণ আমি ভোক্তৃশক্তিরূপা। প্রত্যেকটি জীব যে দর্শন করে, সে আমার শক্তিতেই দেখে; কারণ আমি
দ্রষ্টৃশক্তিস্বরূপা। জীব যে যে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে প্রাণধারণ করে থাকে, তা আমার শক্তিতেই করে।প্রত্যেকটি জীব যে একে অন্যের কথা শ্রবণ করে, তা আমার শক্তিতেই করে। যারা আমাকে অন্তর্যামিনীরূপে জানে না, জ্ঞানরহিত ব্যক্তিরাই জন্মমরণাদি ক্লেশ প্রাপ্ত হয়ে সংসারে হীন হয়। হে কীর্তিমান! আমি তোমাকে পরম কল্যাণকর শ্রদ্ধালভ্য ব্রহ্মতত্ত্বের স্বরূপ বলছি, তা শ্রবণ কর।"
আদ্যাশক্তি মহামায়ার দ্বারাই সকল জীব আহার ভোজন করে; কারণ তিনিই ভোক্তৃশক্তিরূপা। তিনিই প্রত্যকটি জীবের শরীরে জঠরাগ্নি রূপে থেকে খাদ্য পরিপাক করে। জগতের প্রত্যেকটি জীব যে দর্শন করে, তা তাঁর শক্তিতেই দর্শন করে। প্রাণীকুলের সকল ইন্দ্রিয় পরিচালিত হয় দেবীর ইচ্ছায়। দেবীই প্রাণস্বরূপা হয়ে প্রত্যেকটি জীবের অভ্যন্তরে বিরাজিতা। তাই সকল জীব শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকে। জগতের সকল কর্মই দেবীর শক্তিতে সম্পন্ন হয়।প্রত্যেকটি জীব যে একে অন্যের কথা শ্রবণ করে, তা আদ্যাশক্তি মহামায়ার শক্তিতেই করে। তার শক্তিবিহীন সকলই নিস্পন্দিত নিথর। তিনিই অন্তর্যামিনীরূপে সর্বত্র বিরাজিতা। যোগ্য অধিকারী না হওয়ায় অজ্ঞানে আচ্ছন্ন জ্ঞানরহিত মূঢ় ব্যক্তিরা দেবীর এ নিগূঢ়তম তত্ত্ব জানতে পারে না। তাই তারা জন্মমরণাদি ক্লেশ প্রাপ্ত হয়ে সংসারের আবর্তে ঘুরতে থাকে। একমাত্র কীর্তিমান, শ্রদ্ধাযুক্ত অধিকারী সাধকই দেবীকে জানতে পারে। দেবীর তত্ত্ব পরম কল্যাণকর।
অহমেব স্বয়মিদং বদামি
জুষ্টং দেবেভিরুত মানুষেভিঃ ।
যং কাময়ে তং তমুগ্ৰং কৃণোমি
তং ব্রহ্মাণং তমৃষিং তং সুমেধাম্ ॥ ৫
"ইন্দ্রাদি দেবগণ এবং মনুষ্যগণের প্রার্থিত ব্রহ্মতত্ত্ব উপদেশ করছি। আমিই স্বয়ং সেই ব্রহ্মস্বরূপিণী।আমার ইচ্ছাতেই যোগ্য অধিকারী বীরত্ব এবং শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে। আমার ইচ্ছাতেই জগতের সৃষ্টির জন্যে ব্রহ্মার আবির্ভাব হয়। আমার ইচ্ছাতেই মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিগণের সৃষ্টি হয়।আমার ইচ্ছাতেই অতীন্দ্রিয়জ্ঞানশালী সুমেধাবান করে দেই। কারণ, আমিই সর্ব জগতের নিয়ন্তা। "
মনুষ্য বা প্রাণী তো বটেই ইন্দ্রাদি দেবগণও জীবের চির আকাঙ্ক্ষিত ব্রহ্মতত্ত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে জানতে পারে না । দেবী স্বয়ং সেই ব্রহ্মস্বরূপিণী তাঁর ইচ্ছাতেই জগতে যোগ্য অধিকারী তাঁর কর্মফলে বীরত্ব এবং শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে। দেবী কাউকে ঈপ্সিত ফললাভে বঞ্চিত করেন না। তাঁর মধ্যে যখন সৃষ্টির ইচ্ছা জাগে তখনই, জগতের সৃষ্টির জন্যে ব্রহ্মার আবির্ভাব হয়। তিনিই তখন ব্রহ্মার ব্রহ্মাণী শক্তি হয়ে জগতের সকল সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেন। সকল বেদজ্ঞান তাঁর কাছেই সঞ্চিত থাকে, সৃষ্টির প্রারম্ভে সেই বেদজ্ঞান তিনি প্রদান করেন। তাই তাকে বেদমাতা বলা হয়। তাঁর ইচ্ছাতেই মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিগণ অতীন্দ্রিয় বেদমন্ত্র দর্শন করেন। দর্শনকৃত বেদমন্ত্র শ্রুতিতে ধরে রাখেন। তিনিই জীবনে স্মরণ করিয়ে দেন, আবার তিনিই বিস্মরণ করিয়ে দেন।জগতের সকল সৃষ্টি তাঁর ইচ্ছাতে, তাই তাঁকে লীলাময়ী বলা হয়। তাঁর ইচ্ছাতে বোবাও বাকপটু হয় এবং পঙ্গুও পর্বত অতিক্রম করতে পারে। একজন জ্ঞানহীন মূর্খ ব্যক্তিও দেবীর ইচ্ছা এবং করুণাধারায় অতীন্দ্রিয়জ্ঞানশালী সুমেধাবান হতে পারে।
অহং রুদ্রায় ধনুরাতনোমি
ব্রহ্মদ্বিষে শরবে হন্তবা উ।
অহং জনায় সমদং কৃণো
ম্যহং দ্যাবাপৃথিবী আ বিবেশ ৷৷ ৬
"আমি বেদবিদ্বেষী তমগুণ সম্পন্ন হিংস্র অশুভ শক্তিকে বধ করার জন্য, রুদ্রের ধনুকে জ্যা সংযুক্ত করি। আমি জগতের শুভশক্তির রক্ষার্থে এবং কল্যাণার্থে যুদ্ধ করি। আমিই অন্তর্যামিরূপে সমগ্র দ্যাবাপৃথিবীতে প্রবিষ্টা হয়ে আছি৷"
পরমেশ্বর ব্রহ্মা রূপে সৃষ্টি করেন, বিষ্ণুরূপে পালন করেন এবং রুদ্ররূপ মহাকাল হয়ে প্রলয় বা ধ্বংস করেন। তিনিই রুদ্ররূপ মহাকাল হয়ে প্রলয়কালে সকল সৃষ্টিকে গ্রাস করেন। এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি- প্রলয় এবং প্রলয়ের পরে পুনরায় সৃষ্টি এভাবে চক্রাকারে আবর্তিত হচ্ছে। পরমেশ্বরের সৃষ্টি, পালন এবং লয়ের কর্তা হিসেবে ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বর এ ত্রিমূর্তির শক্তির উৎস আদ্যাশক্তি মহামায়া। তিনি বেদবিদ্বেষী তমগুণ সম্পন্ন হিংস্র অশুভ আসুরিক শক্তিকে কখনো অদৃশ্য শক্তিরূপে অথবা কখন মূর্তিমান হয়ে বিনাশ করেন। মহাকাল মহাদেব রুদ্রের ধনুকে জ্যা তিনিই সংযুক্ত করেন। অর্থাৎ তাঁর শক্তিতেই রুদ্র ক্রিয়াশীল। এ কারণেই কালী প্রতিমার পদতলে রুদ্র শিবকে পাওয়া যায়। এ মাহাত্ম্য হলো, দেবীর শক্তি ছাড়া শিব শব হয়ে দেবীর পদতলে বিরাজ করে। অর্থাৎ শক্তিবিহীন শিব শব হয়ে যায়। জগতের সকল শুভশক্তির রক্ষার্থে এবং কল্যাণার্থে আবির্ভূত হন। অশুভ শক্তি সর্বদা তাঁর পদতলে বিরাজমান। সমগ্র পৃথিবী থেকে স্বর্গ পর্যন্ত সকল লোকেই সকল স্থানেই দেবী কখনো সাকারা অথবা কখনো নিরাকারা শক্তিরূপে প্রবিষ্টা হয়ে আছেন। তিনিই সব, তিনি বই আর কিছুই নেই।
অহং সুবে পিতরমস্ত্য মূর্ধন্
মম যোনিরপ্ স্বন্তঃ সমুদ্রে।
ততো বিতিষ্ঠে ভুবনানু বিশ্বো-
তামূং দ্যাং বষ্মণোপস্পৃশামি ৷৷ ৭
"আমি এই পৃথিবীর উপরিভাগে আকাশকে সৃষ্টি করি। অর্থাৎ জগতের সৃষ্টিকর্তা আমার শক্তিতেই ক্রিয়াশীল। জগত সমুদ্রের চৈতন্যস্বরূপা বুদ্ধিরূপ নিমিত্ত কারণ আমি। স্বৰ্গলোক সহ আমিই সকল জগত পরিব্যাপ্ত করে অবস্থিতা আছি। সকল প্রকার সৃষ্ট বস্তুর কারণরূপে, আমি বিবিধ মায়াময় দেহ দ্বারা সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ব্যাপিয়া আছি।"
আদ্যাশক্তি মহামায়াই পৃথিবী, আকাশ সহ সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছেন। তাঁর শক্তিতেই সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ক্রিয়াশীল। জগত সমুদ্রের চৈতন্যস্বরূপা বুদ্ধিরূপ নিমিত্ত কারণ তিনি। স্বৰ্গলোক সহ সকল সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে পরিব্যাপ্ত হয়ে তিনিই একমাত্র অবস্থিতা। সকল প্রকার সৃষ্ট বস্তুর উৎস এবং কারণ তিনি। তিনিই মায়াশক্তিতে বিবিধ মূর্তিতে সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ব্যাপিয়া আছেন। তিনি এক হলেও মায়ার আবরণে বদ্ধ হওয়ার আমরা তাঁকে বহু বলে সংশয় প্রকাশ করি। সাধকের মনে যতক্ষণ এই বহুর আবরণ থাকে, সে ততকালই মুক্তি থেকে দূরে থাকে। অজ্ঞানজাত বহুত্ব থেকে সাধক দূর থেকে বহুদূরে চলে যায়। পক্ষান্তরে সাধকের মধ্যে যখন একত্বের অদ্বৈতবোধ আসে তখনই সাধক মুক্তির পথে অগ্রসর হয়। এই অগ্রসর হওয়া সাধকের মধ্য থেকে কদাচিৎ কোন সুকৃতিবান সাধক আদ্যাশক্তিকে উপলব্ধি করেন। তাই বলা হয়, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে এক অদ্বিতীয় শক্তির উপলব্ধি বিহীন সাধকের মুক্তিলাভ হয় না।
অহমেব বাত ইব প্রবা-
ম্যারভমাণা ভুবনানি বিশ্বা।
পরো দিবা পর এনা পৃথি-
ব্যৈতাবতী মহিনা সংবভূব ॥ ৮
"আমিই সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কারণরূপে সৃষ্টি করে বায়ু মত স্বচ্ছন্দে স্বয়ং সকল সৃষ্টির অন্তরে বাহিরে সর্বত্র বিচরণ করি। আমি আকাশ এবং পৃথিবীকে অতিক্রম করে ব্রহ্মরূপে আমি বর্তমানা। আমার নিজ মহিমাতেই আমি অদ্বিতীয়া জগতের অধিশ্বরী।"
আদ্যাশক্তি মহামায়াই সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আদি কারণ। তিনি এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি করে, তাঁর সৃষ্টির মধ্যে বায়ু মত স্বচ্ছন্দে স্বয়ং নিজেই বিচরণ করেন। তিনি সকল সৃষ্টির মধ্যে বিরাজিতা। অন্তরে বাহিরে সর্বত্রই বিচরণ করেন। তিনি একাধারে তাঁর জড় চেতন সকল সৃষ্টির মধ্যে সক্রিয় হয়ে আছেন। আবার পক্ষান্তরে আকাশ এবং পৃথিবীকে অতিক্রম করে অব্যয় ব্রহ্মরূপে বর্তমানা। তিনি তাঁর নিজ মহিমাতেই অদ্বিতীয়া জগতের অধিশ্বরী।এ জগতে তাঁর তুল্য কেউ নেই, তাঁর দ্বিতীয় কেউ নেই। তিনিই এক, তিনিই মায়ার প্রভাবে বহু। সর্বত্রই সেই একেরই খেলা, বহু কেবল আমাদের বুদ্ধির কলুষতায়।
দেবীর কৃপা লাভের জন্য বৈদিককাল থেকেই দেবীসূক্ত পাঠের পরচলন রয়েছে। এই দেবীসূক্ত পাঠে প্রবৃত্তি এবং নিবৃত্তি উভয়ই লাভ হয়। অর্থাৎ জাগতিক আভ্যুদয়িক সমৃদ্ধির সাথে সাথে মুক্তিও লাভ হয়। যে যে কামনা করে দেবীসূক্ত পাঠ করেন, দেবী তার মনবাঞ্ছা পূর্ণ করেন। শ্রীচণ্ডীতে পাওয়া যায় সুরথ রাজা এবং সমাধি বৈশ্য উভয়ই দেবীসূক্ত পাঠ করে দেবীর আরাধনা করেন। দেবী তাদের দর্শন দিয়ে বরদান করলেন। সুরথ রাজা শত্রুনাশ করে পুনরায় নিজরাজ্য লাভ করলেন এবং সাথে সার্বণি নামক অষ্টম মনুর বর লাভ করলেন। সংসার বিরক্ত সমাধি বৈশ্য পেলেন জীবের পরম আকাঙ্ক্ষিত ব্রহ্মজ্ঞান ও মুক্তি। তাই দেবীর আরাধনায় জাগতিক সমৃদ্ধি এবং মুক্তি উভয়ই লাভ হয়।
স চ বৈশ্যস্তপস্তেপে দেবীসূক্তং পরং জপন্।
তৌ তস্মিন্ পুলিনে দেব্যাঃ কৃত্বা মূর্তিং মহীমহীম্।।
(শ্রীচণ্ডী: ত্রয়োদশ অধ্যায়,১০)
"সুরথ রাজা এবং সমাধি বৈশ্য জগন্মাতার প্রত্যক্ষ দর্শন লাভের জন্য নদীতীরে বসে বৈদিক দেবীসূক্ত জপ করতে করতে একাগ্রভাবে তপস্যারত হলেন।"
শ্রীচণ্ডীর এ বর্ণনায় আমরা জানতে পারি, দেবীসূক্ত পাঠ করাকে তপস্যা বলে। দেবীসূক্ত পাঠে আদ্যাশক্তি মহামায়া অত্যন্ত প্রসন্ন হন।ঋষি শৌণকের ‘বৃহদ্দেবতা’ গ্রন্থে বাগ্দেবীকে রাত্রি, সরস্বতী, অদিতি ও দুর্গা বলা হয়েছে (২.৭৪-৭৭)। কাজেই সিদ্ধান্ত করা যায়, বাক্, রাত্রি, কালী, দুর্গা, সরস্বতী প্রভৃতি একই আদ্যাশক্তি মহামায়ার রূপভেদমাত্র।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
ফেসবুক পোস্ট লিঙ্ক : ঋগ্বেদের 'দেবীসূক্তে', আদ্যাশক্তি দুর্গার মাহাত্ম্য ।
ফেসবুক পেজ লিঙ্ক : Shri Kushal Baran Chakraborty | Facebook