পৃথিবীতে বেদই বোধহয় একমাত্র ধর্মগ্রন্থ যেখানে মাতৃভূমির প্রতি কল্যাণের পথে, সত্যের পথে, থাকার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে একটি বৃহৎ অধ্যায়ই আছে। আমরা সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পৃথিবীর যে দেশেই থাকিনা কেন, আমরা আমাদের দেশকে ভালবাসি; মাতৃভূমিকে ভালবাসি।তাইতো বেদমন্ত্রে বলা আছে :
ভূমে মাতর্নি ধেহি মা ভদ্রয়া সুপ্রতিষ্ঠিতম।
সংবিদানা দিবা কবে শ্রিয়াং মা ধেহি ভূত্যাম।
( অথর্ববেদ : দ্বাদশ কাণ্ড, প্রথম অনুবাক)
"হে মাতৃভূমি, তুমি আমায় কল্যাণের পথে সদা সুপ্রতিষ্ঠিত কর। হে জ্ঞানস্বরূপা কাব্যময়ী মাতৃভূমি, তুমি দিনের আলোর ন্যায় আমায় উদ্ভাসিত করে সদা শ্রীযুক্ত এবং পশু-পাখি, মানব সহ পৃথিবীর সকল ভূতজগতের সাথে সদা যুক্ত রেখ।"
অথর্ববেদের ৬৩ টি মন্ত্রের এই অনুবাকে প্রত্যেকটি মন্ত্রের প্রত্যেকটি শব্দে শব্দে মাতৃভূমির প্রতি একবুক ভালবাসার ফল্গুধারা উৎসারিত হয়েছে। শুধুমাত্র বেদ নয়, আমাদের ধর্মগ্রন্থ রামায়ণে ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের মুখে উচ্চারিত হয়েছে স্বদেশপ্রেমের একটি হিরন্ময় উক্তি। রামায়ণের অসংখ্য শিক্ষার মধ্যে অন্যতম শিক্ষা হচ্ছে দেশপ্রেম। রামায়ণে আমরা দেখি যখন রাবন বধের পরে লঙ্কা যখন বিজিত হল তখন লক্ষ্মণ রামচন্দ্রকে বললেন, দাদা,এমন সুন্দর স্বর্ণময়ী লঙ্কা যখন বিজিত হয়েছে, তখন আমরা মাতৃভূমি অযোধ্যায় ফিরে না গিয়ে এখানেই রাজত্ব করতে পারি। লক্ষ্মণের কথার উত্তরে শ্রীরামচন্দ্র বলেন হীরকখচিত দীপ্তিময় এক উক্তি, যে উক্তি আজও আমাদের প্রদীপ্ত করে।
অপি স্বর্ণময়ী লঙ্কা ন মে রোচতে লক্ষণ।
জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী।।
"লক্ষণ এই লঙ্কাপুরী যদিও স্বর্ণময়ী অতীব সুন্দরী, তবুও তা আমার কাছে রূচিকর নয়; কারণ জননী এবং জন্মভূমি স্বর্গ থেকেও অধিকতর শ্রেষ্ঠ।"
তাইতো ১৯৭১ সালে একবুক রক্তস্নানের পরেও শুধুমাত্র হিন্দু সম্প্রদায়ের থেকেই কোন দেশদ্রোহী, আত্মঘাতী রাজাকারের জন্ম হয়নি।অন্যান্য সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষ থেকে ধর্মীয় নেতাদের বিশাল একটা অংশ সরাসরি দেশদ্রোহের সাথে যুক্ত ছিলো। শর্ষিণার পীর আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহের মত অনেক পীরেরাই সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন। ইসলামপন্থী রাজনৈতিক গোলাম আজম, নিজামী, মুজাহিদ, সাইদির কথা আর কিই বা বলবো; বিষয়টি দেশের প্রগতিশীল সকলেই অবহিত আছেন।
দেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা কমলাপুর বৌদ্ধবিহারের সংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরো সরাসরি ৭১ সালে পাকিস্তানীদের পক্ষে ছিলেন ( দৈনিক আজাদ, 'এই মীরজাফরদের ক্ষমা নেই': ২৪ জানুয়ারী, ১৯৭২)। এ বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত জানার জন্যে পড়তে পারেন, অধ্যাপক আহমদ শরীফ এবং শাহরিয়ার কবির সম্পাদিত "একাত্তরের ঘাতক দালালরা কে কোথায়?"-এ অমূল্য বইটি। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী বৌদ্ধদের সর্বোচ্চ নেতা চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় চৌধুরীও ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পক্ষে সকল কর্মকাণ্ড করে আমৃত্যু পাকিস্তানে থেকে বছর কয়েক আগে পাকিস্তানেই মারা গিয়েছেন।
খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের পাদ্রিদের একটা বিশাল অংশ নির্বিঘ্নে নিশ্চিন্তে খ্রিস্টান ধর্মপ্রচার করেছে ১৯৭১ সালের যুদ্ধবিধ্বস্ত পাকিস্তানে। পাকিস্তানের তৎকালীন সরকার এবং প্রশাসনের সাথে ছিলো তাদের গভীর সম্পর্ক। বরিশাল, খুলনাসহ দক্ষিণাঞ্চলের বহু হিন্দুকে তারা সেই সময়ে সুযোগে ধর্মান্তরিত করেছে। খ্রিস্টান পাদ্রিদের সেই অংশটা তখন বলে বেড়াতো, পাকিস্তান সরকারের পক্ষে যেহেতু আমেরিকা আছে, তাই পাকিস্তানি সৈন্যরা আমাদেরই লোক ; তোমরা হিন্দুরা যদি খ্রিস্টান হও তবে পাকিস্তানি সৈন্যরা তোমাদের একচুলও ক্ষতি করবে না। বরিশাল সহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের আমার বহু আত্মীয় স্বজনেরা ১৯৭১ সালে পাদ্রিদের এই প্রলুব্ধ ধর্মান্তরিতের শিকার হয়েছিলেন। এর অসংখ্য তথ্য-প্রমাণ আমাদের আত্মীয় স্বজনের কাছেই আছে। আমার মনে হয় ১৯৭১ সালে মানুষের বিপদের দিনে অসহায় মানুষদের সুযোগে ধর্মান্তরকরণ নিয়ে একটা পরিপূর্ণ গবেষণা হওয়া প্রয়োজন ; কারণ এই বিষয়টা আমাদের ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটা অনালোচিত অংশ। বিষয়টি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় খুব একটা আলোকপাত হয়নি বললেই চলে। অবশ্য ফাদার মারিনো রিগনের মতো কয়েকজন ছিলেন ব্যতিক্রম, তারা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মানুষকে যথাসম্ভব সেবা দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন।
১৯৭১ সালে ১০০ভাগ রাজাকার মুক্ত ছিলাম আমরা হিন্দু সম্প্রদায়। এই আমাদেরই ৭১ সালে লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিলো, অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমহানি হয়েছিলো এবং প্রায় ৯২ লক্ষের কাছাকাছি মানুষকে ঘর-বাড়ি ছেড়ে শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছিলো। যাদের অনেকেই শেষ পযর্ন্ত আর দেশে ফেরেনি। ৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনী দ্বারা সবচেয়ে বড় বড় গণহত্যাগুলি হয়েছে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায়; খুলনার চুকনগর গণহত্যা যার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। পাখির মতো গুলি করে করে হত্যা করা হয়েছিল চুকনগরে।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারতে রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আসা শরণার্থীর সংখ্যা ছিল ৯৮,৯৯,৩০৫ জন। এ শরণার্থীদের প্রায় ৯২% মতো ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী। ভারতের তৎকালীন ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে ১৯৭১ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত ভারতে প্রবেশ করা শরণার্থীদের মধ্যে ৭.২% ছিল অহিন্দু এবং বাকি সকলেই হিন্দু শরণার্থী। অর্থাৎ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতে যাওয়া শরণার্থীর অন্তত ৯২ লাখ শরণার্থী ছিলো হিন্দু। আমরা কি একবার ভেবে দেখেছি অধিকাংশ শরনার্থী কেন হিন্দু ছিলো? পাকিস্তানিদের নৃশংসতার তালিকায় প্রথমেই ছিলো হিন্দু, এরপরে বাদবাকি অন্যান্যরা।
একবুক রক্ত দিয়ে এদেশের স্বাধীনতার লাল সূর্যের পতাকা আনার পরেও, যদি এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমাদের আবারও শরণার্থী হতে হয়; তবে এর থেকে লজ্জার আর কিছুই নেই। তবে একবুক রক্তে স্নাতক হয়ে কি পেলাম আমরা ! ২০০১,২০০৩, ২০১০, ২০১২,২০১৪,২০১৬,২০১৭, ২০২০ সালগুলিতে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপরে দলমত নির্বিশেষে সাম্প্রদায়িক হামলা এবং সে হামলা পরবর্তীতে আজ পর্যন্ত হামলাকারীদের বিচার না হওয়া, কি ইঙ্গিত করে সংখ্যালঘু মনোজগতে ;তা আমি জানি না তা দেশের রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তিরা ঠিক জানেন কিনা?
২০১৬ সালে যেভাবে মন্দিরের পুরোহিত, ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবী সহ বিভিন্ন পেশার সংখালঘুদের প্রতিনিয়ত দেশত্যাগ অথবা ধর্মত্যাগের হুমকি দিয়ে চিঠি দেয়া হচ্ছিলো । তখন সত্যিই নিজের কাছে নিজেকে অনেক লজ্জিত মনে হচ্ছিলো। সারাদেশে তখন শহরের সাথে সাথে প্রত্যন্ত এলাকার হিন্দুদের মাঝে দেশত্যাগের আতংক বিরাজ করছিলো। তখন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলবাসী বহু মানুষের মাঝে দেশত্যাগের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছিল।
আজও সংখ্যালঘু অধিকাংশেরই মনে একটি প্রশ্ন নিয়মিত ঘুরপাক খায় - আমরা শেষপর্যন্ত এদেশে থাকতে পারবো তো?এর উত্তরে আমরা বলছি -পারবো, অবশ্যই পারবো। কারণ এ লড়াই বাচার লড়াই,তাই এই লড়াইয়ে আমাদের জিততেই হবে।চোরের উপরে রাগ করে তো আমরা মাটিতে ভাত খেতে পারিনা! এর জন্যে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে অস্তিত্বের সংগ্রামে যুক্ত হতে হবে এবং এর সাথে যুগপৎ রাষ্ট্র ও রাষ্টযন্ত্রেকেও আরো সক্রিয়ভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পাশে দাড়িয়ে তাদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে হবে; তবেই এই অমানিশার অন্ধকার কেটে গিয়ে নতুন অহনাকালে এক নতুন সূর্যোদয় হবে।এবং সেই নতুন সূর্যোদয়ের দিনে এদেশ শুধুমাত্র মুখে নয়, সত্যি সত্যিই ৭১ এর অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ফিরতে পারবে। তাই হবে আমাদের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের প্রকৃত প্রাপ্তি। আমরা তাই একবুক আশা এবং স্বপ্নাতুর চোখে তাকিয়ে আছি সেই দিনেরই প্রতিক্ষায়।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।