বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গানের বই, পাঁচালী, কথোপকথনের বই এবং চিঠিপত্রাদি সংকলনগ্রন্থকে যারযার ব্যক্তিগত বা সম্প্রদায়ের গুরুবাদী বিশ্বাস থেকে প্রধান ধর্মীয়গ্রন্থ মনে করেন। তারা নিজেরাও জানেন না যে, এ কাজের মাধ্যমে ধীরেধীরে তারা অজ্ঞাতসারে অজ্ঞানতার অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন । বেদবিদ্যা সম্পর্কে ধারণা না থাকায় তাদের জ্ঞানের দরজা তালাবন্ধ জড়তাগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে।
বেদের পরে রামায়ণ, মহাভারত এবং অষ্টাদশ পুরাণ এবং অষ্টাদশ উপপুরাণ আমাদের ধর্মগ্রন্থ। কিন্তু এ গ্রন্থগুলির একটিও প্রধান ধর্মগ্রন্থ নয়। বেদই আমাদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ। পুরাণগুলিকে আমাদের গ্রহণ বর্জনের মাধ্যমেই গ্রহণ করতে হবে। পুরাণে যেমন অনেক অসাধারণ অসাধারণ কথা আছে, তেমনি কিছু কিছু স্থানে বালখিল্য কথাও আছে। আবার পুরাণের সামান্য দুইএকটা বালখিল্য অসার উদাহরণ দেখিয়ে কিছুকিছু তার্কিক বিশেষ করে দয়ানন্দ সরস্বতীর অনুগামীরা সকল পুরাণকেই বাদ দেয়ার ধৃষ্টতা করেন।
পুরাণের জগতে ভাগবত, মার্কণ্ডেয়, ব্রহ্ম, বিষ্ণু, অগ্নি, শিব, স্কন্ধ এই অসাধারণ পুরাণগুলি যেমন আছে, তেমনি ব্রহ্মবৈবর্ত, পদ্ম, ভবিষ্য এই পুরাণগুলিও আছে। ব্রহ্মবৈবর্ত, পদ্ম, ভবিষ্য সহ এমন আরো কিছু পুরাণ আছে, যেগুলি পড়লে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় এই পুরাণগুলিতে বিভিন্ন সময়ে কিছু সাম্প্রদায়িক স্বার্থান্বেষী এবং তুর্কিশাসকদের সময়ে হাতের কাটাছেড়া হয়েছে। কাটাছেড়া হওয়ার পরেও, এ পুরাণগুলি সম্পূর্ণ বাদ না দিয়ে রাজহংস যেমন দুধেজলে মিশানো থাকলে
শুধুমাত্র জলের অংশকে পরিত্যাগ করে দুধটুকুই গ্রহণ করে; রাজহংসের মতো আমাদেরও পুরাণগুলি থেকে প্রয়োজনীয় সকল সারবস্তুগুলি নিয়ে অসার বস্তুগুলি পরিত্যাগ করতে হবে। একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না, ভারতবর্ষীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি পূর্ণতা পেয়েছে পুরাণগ্রন্থে। বৈদিক জ্ঞানই সাধারণের উপযোগী করে গল্পের ছলে পৌরাণিক কথাকাহিনীতে বোঝানো হয়েছে। তাই পুরাণ বর্ণাঢ্য হিন্দু সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
ইদানিং কিছু ভাগবত পাঠকেরা বিভিন্ন স্থানে ভাগবত পাঠ করতে এসে অযাচিতভাবে বলে, কলিযুগে বেদ নিষিদ্ধ। আমি ঠিক জানিনা, তারা এই কথাগুলি বুঝে বলে, নাকি নাবুঝে বলে? সেই সকল পণ্ডিতম্মন্য ব্যক্তিদের একটু শ্রীমদ্ভাগবতে বেদ সম্পর্কে কি কি বলা আছে তা একটু পড়ে দেখার অনুরোধ রইল:
"যে ব্যক্তি অকারণে বেদাচার ছেড়ে অনাচারে প্রবৃত্ত হয়, যমদূতেরা তাকে অসিপত্রবন নরকে নিয়ে গিয়ে কশা (চাবুক) দিয়ে মারতে থাকে। মার খেয়ে ছুটে পালাতে গেলে দুপাশে তালবনের অসিপত্রে ( তলোয়ারের মতো ধারাল পাতায়) সেই পাপির সর্বাঙ্গ ছিন্নভিন্ন হয় ; আর সে 'হা হতো অস্মি' ( আমি মরলাম) বলে দারুণ যন্ত্রণায় পদে পদে জ্ঞান হারায়। স্বধর্ম ত্যাগ করলে এমন শাস্তিই ভোগ করতে হয়।"
(শ্রীমদ্ভাগবত: ৫ম স্কন্ধ, ছাব্বিশ অধ্যায়)
(শ্রীমদ্ভাগবত: ৫ম স্কন্ধ, ছাব্বিশ অধ্যায়)
"বেদে যা কর্তব্য বলে বলা আছে একমাত্র তাই ধর্ম, এর বিপরীত যা অর্থাৎ বেদে যা নিষিদ্ধ তা সকলই অধর্ম। বেদ সাক্ষাৎ নারায়ণের নিঃশ্বাস থেকে স্বয়ং উদ্ভূত হয়েছে, তাই বেদ সাক্ষাৎ নারায়ণ এবং স্বয়ম্ভু।"
(শ্রীমদ্ভাগবত : ৬ষ্ঠ স্কন্ধ, প্রথম অধ্যায়)
(শ্রীমদ্ভাগবত : ৬ষ্ঠ স্কন্ধ, প্রথম অধ্যায়)
সামবেদীয় ছান্দোগ্য উপনিষদে নারদ সনৎকুমার সংবাদে (০৭.০১.০২) ইতিহাস পুরাণকে পঞ্চম বেদ বলা হয়েছে। মহাভারতকে ইতিহাস গ্রন্থ বলা হয়, তাই মহাভারতে মহাভারত নিজেকে পঞ্চমবেদ বলে পরিচয় দিয়েছে। শুধু মহাভারত এবং পুরাণই নয়, ভরতের নাট্যশাস্ত্রকেও পঞ্চম বেদ বলা হয়। বেদের বাইরে কাহিনী সর্বস্ব এ পঞ্চমবেদের দাবিদার অনেক গ্রন্থই।
বেদ গবেষক দয়ানন্দ সরস্বতী সহ অনেকেই পুরাণ বলতে বেদের ব্রাহ্মণ অংশকেই চিহ্নিত করেছেন। কারণ সেখানে মনুমৎস্য কথা সহ অসংখ্য শিক্ষামূলক গল্প আছে। তবে দয়ানন্দ সরস্বতীর মতবাদ বাদ দিলে, অধিকাংশ পণ্ডিতই পুরাণ বলতে ব্যাসদেব রচিত অষ্টাদশ পুরাণকেই বোঝে। এ অষ্টাদশ পুরাণের সাথে আছে আরো অষ্টাদশ উপপুরাণ। আপাতদৃষ্টিতে পুরাণের সংখ্যা (১৮+১৮) = ৩৬ টি হলেও, বর্তমানে পুরাণ নামে গ্রন্থ পাওয়া যায় ৩৬ সংখ্যাটির দ্বিগুণেরও বেশী।
এ পুরাণের অনেকগুলোই পরস্পর বিরোধী ভাব দ্বারা পূর্ণ। তাই লেখাগুলি একজনের লেখা কিনা, এটা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে বিস্তর মতভেদ। বিষ্ণুপুরাণে এবং দেবী ভাগবতে বিভিন্নকালে ২৮ জন পুরাণ রচয়িতা ব্যাসের কথা আছে। এ পুরাণগুলির মধ্যে পদ্মপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ সহ কয়েকটির বঙ্গ সংস্করণের সাথে দক্ষিণ ভারত, উত্তর ভারতের সংস্করণ মেলে না। শ্লোক পর্যন্ত মেলে না।
পঞ্চদশ ষোড়শ শতাব্দীর বিখ্যাত স্মৃতিশাস্ত্রকাররা তাদের স্মৃতির বচনে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ থেকে যে সকল শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন এর অধিকাংশই বর্তমান গ্রন্থে নেই। উদাহরণ হিসেবে স্মৃতিচন্দ্রিকা গ্রন্থের কথা বলা যায়। এ গ্রন্থটি সহ তৎকালীন স্মৃতি নিবন্ধকারগণ তাদের গ্রন্থে প্রায় ১৫০০ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন।
কিন্তু নিবন্ধকারদের সে ১৫০০ শ্লোক থেকে বর্তমানে প্রাপ্ত ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে মাত্র ৩০ টি শ্লোক পাওয়া যায়। এতেই সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় গ্রন্থটির প্রাচীনরূপ এবং বর্তমান রূপের বিস্তর পার্থক্য। দক্ষিণভারতে গ্রন্থটির নাম পর্যন্ত আলাদা,সেখানে নাম ব্রহ্মকৈবর্তপুরাণ।
বিভিন্ন কালের প্রভাবে এবং বিদেশি শাসনে এ গ্রন্থগুলোতে অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক কিছুই প্রবেশ করেছে। এ গ্রন্থগুলি ছিল হাতে লেখা পুঁথি। তাই লিপিকরদের দ্বারা সহজেই অনেক প্রক্ষেপণ হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। তাই মাঝেমধ্যেই শ্রুতি, স্মৃতি এবং পুরাণের বাক্যে বিরোধ দেখা যায়।
বিভিন্ন কারণে বেদ স্মৃতি এবং পুরাণের মধ্যে যদি আপাত কোন বাক্যে বিরোধ দেখা যায়। তবে এর সমাধানকল্পে শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর রচিত ব্যাস সংহিতায় বলেছেন। তিনি বলেছেন, সকল শাস্ত্রের বিরোধে একমাত্র বেদবাক্যই মান্য।
শ্রুতিস্মৃতিপুরাণানাং বিরোধো যত্র দৃশ্যতে।
তত্র শ্রৌতং প্রমাণন্তু তয়োর্দ্বৈধে স্মৃতির্ব্বরা।।
( ব্যাস সংহিতা : অধ্যায়-১, শ্লোক-৪)
তত্র শ্রৌতং প্রমাণন্তু তয়োর্দ্বৈধে স্মৃতির্ব্বরা।।
( ব্যাস সংহিতা : অধ্যায়-১, শ্লোক-৪)
"শ্রুতি, স্মৃতি এবং পুরাণের মধ্যে যদি বিরোধ দেখা যায়, তবে শ্রুতি বা বেদের বাক্যটিই প্রমাণ এবং যেখানে স্মৃতি ও পুরাণের মধ্যে বিরোধ দেখা যায়, সেখানে স্মৃতির বিধানই মান্য।"
বিষয়টি সুন্দর একটি উদাহরণ দিয়ে বলা যায়। যেমন বেদের মধ্যে বলা আছে, অন্নই ব্রহ্ম। বেদের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে তৈত্তিরীয় উপনিষদে সুস্পষ্টভাবে বিষয়টি আছে। সেখানে বলা আছে।
অন্নং ব্রহ্মেতি ব্যজানাৎ। অন্নাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে। অন্নেন জাতানি জীবন্তি।
(তৈত্তিরীয় উপনিষদ, ভৃগুবল্লী, দ্বিতীয় অনুবাক)
(তৈত্তিরীয় উপনিষদ, ভৃগুবল্লী, দ্বিতীয় অনুবাক)
"অন্নই ব্রহ্ম। অন্ন থেকেই সকল প্রাণীর উৎপত্তি এবং অন্নতেই সবাই বেঁচে থাকে।"
অন্নং ন পরিচক্ষীত। তদ্ ব্রতম্। আপো বা অন্নম্।
(তৈত্তিরীয় উপনিষদ, ভৃগুবল্লী, অষ্টম অনুবাক)
(তৈত্তিরীয় উপনিষদ, ভৃগুবল্লী, অষ্টম অনুবাক)
"অন্নের অবহেলা করবে না, পরিত্যাগ করবে না এটাই ব্রত। জলই অন্ন।"
অন্নং হি ভূতানাং জ্যেষ্ঠম্। তস্মাৎ সর্বৌষধমুচ্যতে। সবং বৈ তে অন্নমাপ্নুবন্তি যে অন্নং ব্রহ্মোপাসতে।
অন্নং হি ভূতানাং জ্যেষ্ঠম্। তস্মাৎ সর্বৌষধমুচ্যতে।
অন্নাদ্ভূতানি জায়ন্তে। জাতান্যন্নেন বর্ধন্তে
(তৈত্তিরীয় উপনিষদ:ব্রহ্মানন্দবল্লী, দ্বিতীয় অনুবাক)
অন্নং হি ভূতানাং জ্যেষ্ঠম্। তস্মাৎ সর্বৌষধমুচ্যতে।
অন্নাদ্ভূতানি জায়ন্তে। জাতান্যন্নেন বর্ধন্তে
(তৈত্তিরীয় উপনিষদ:ব্রহ্মানন্দবল্লী, দ্বিতীয় অনুবাক)
"অন্ন সমস্ত জীবের জ্যেষ্ঠ। তাই তাকে সর্ব ঔষধরূপ বলা হয়। অন্নকে ব্রহ্মভাবে যারা উপাসনা করেন, তারা অবশ্যই অন্নরূপ ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হন।অন্নতেই জগতের সকল জীব জন্মগ্রহণ করে এবং অন্নতেই বর্ধিত হয়।"
অন্নকে ব্রহ্ম বলে, অন্নতেই সকল প্রাণী জীবিত থাকে, তাই অন্নের নিন্দা করতে নিষেধ করা হয়েছে মন্ত্রগুলিতে। অন্নকে পরিত্যাগ করতে নিষেধ করা হয়েছে এবং অন্নের উপাসনা করতে বলা হয়েছে। কারণ অন্নতেই জগতের জীব জন্মগ্রহণ করে এবং অন্নতেই বর্ধিত হয়।
বৈদিক অন্ন সংক্রান্ত এ নির্দেশনা থাকার পরেও আমাদের কয়েকটি পুরাণে বিশেষ করে পদ্মপুরাণে বলা হয়েছে প্রতি ১৫ দিনে একাদশীর দিনে পাপ সকল অন্নে বা খাদ্যে প্রবেশ করে। পুরাণকার এ কথাগুলো বলে, পাপপুরুষের একটি কাহিনী বর্ণনা করেছেন। পদ্মপুরাণের কাহিনীটি হয়ত নেই, কিন্তু এ ধরণের বাক্য আমরা স্কন্ধ পুরাণেও দেখি।স্কন্দ পুরাণ মহাভারতের মত বৃহৎ একটি গ্রন্থ। এটি একটি বৃহত্তম পুরাণ।
এতে সারা ভারতবর্ষের তীর্থক্ষেত্রের মাহাত্ম্য বর্ণিত আছে। দুইএকটা ব্যতিক্রমী শ্লোককে বাদ দিলে এ পুরাণটি অসাধারণ। এ পুরাণটিকে পবিত্র তীর্থ সমুহের পূর্ণাঙ্গ একটি কোষগ্রন্থ বলা চলে। পুরাণটির বিষ্ণুখণ্ডে একাদশী প্রসঙ্গে বলা আছে-
যানি কানি চ পাপানি ব্রহ্মহত্যাদিকানি চ।।
অন্নমাশ্রিত্য তিষ্ঠন্তি সম্প্রাপ্তে হরিবাসরে।
স কেবলমঘং ভুঙেক্ত যো ভুঙেক্ত হরিবাসরে।।
(স্কন্দ পুরাণ, বিষ্ণুখণ্ড, কার্তিকমাসমাহাত্ম্য,
অধ্যায় ৩৩, শ্লোক ৩২-৩৩)
স কেবলমঘং ভুঙেক্ত যো ভুঙেক্ত হরিবাসরে।।
(স্কন্দ পুরাণ, বিষ্ণুখণ্ড, কার্তিকমাসমাহাত্ম্য,
অধ্যায় ৩৩, শ্লোক ৩২-৩৩)
"ব্রহ্মহত্যাদি যত পাপ আছে তা সকলই একাদশীর দিনে অন্নে আশ্রয় করে। সেদিন যারা অন্ন ভোজন করে তারা কেবল পাপই ভোজন করে।"
বিভিন্ন পুরাণে বর্ণিত একাদশী একটি শাস্ত্রীয় ব্রত। উপবাসই এর মুখ্যকর্ম। কিন্তু একাদশীকে কেন্দ্র করে এ পাপপুরুষের কাহিনী এবং তৎসংশ্লিষ্ট বাক্যগুলো প্রথমে শ্রুতি বাক্যকে লঙ্ঘন করেছে। এরপরে স্মৃতি প্রস্থান শ্রীমদ্ভগবদগীতাকে লঙ্ঘন করেছে। বেদে যেহেতু অন্নের নিন্দা করতে নিষেধ করা হয়েছে, অন্ন ব্রহ্মস্বরূপ। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, স্কন্দ পুরাণ, পদ্মপুরাণের পাপ প্রবেশের কথা বলে শ্রুতির বাক্যের অবহেলা করেছে। শ্রুতি এবং পুরাণের এ দুইপ্রকার বাক্য একসাথে গ্রহণ করা আমাদের সম্ভব নয়। কারণ, বাক্য দুটি বিপরীতধর্মী। বাক্যটি স্মৃতিকেও লঙ্ঘন করেছে, কারণ শ্রীমদ্ভগবদগীতাতে জগতের সকল খাদ্যকেই চারপ্রকার অন্ন বলা হয়েছে।
অহং বৈশ্বানরো ভূত্বা প্রাণিনাং দেহমাশ্রিতঃ।
প্রাণাপানসমাযুক্তঃ পচাম্যন্নং চতুর্বিধম্।।
( গীতা:১৫. ১৪)
"অামিই প্রাণিগণের উদরে বৈশ্বানর অগ্নিরূপে স্থিত হয়ে প্রাণ ও অপান বায়ুর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে চর্ব্য, চোষ্য, লেহ্য, এবং পেয় এ চতুর্বিধ অন্নকে পরিপাক করি।"
প্রাণাপানসমাযুক্তঃ পচাম্যন্নং চতুর্বিধম্।।
( গীতা:১৫. ১৪)
"অামিই প্রাণিগণের উদরে বৈশ্বানর অগ্নিরূপে স্থিত হয়ে প্রাণ ও অপান বায়ুর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে চর্ব্য, চোষ্য, লেহ্য, এবং পেয় এ চতুর্বিধ অন্নকে পরিপাক করি।"
জগতের সকল খাদ্যই এ চার প্রকার অন্নের মধ্যে পরে। অন্নে যদি প্রতি ১৫ দিন পরপর একাদশীর দিনে পাপ প্রবেশ করে, তাহলে একগ্লাস জলও খাওয়া যাবে না; কারণ গীতা বা বেদান্তের ভাষ্যানুসারে জলও চতুর্বিধ অন্নের মধ্যে পেয়রূপ অন্ন। জলের মধ্যেও পাপ প্রবেশ করবে। তাই ব্রহ্মবৈবর্ত, পদ্মপুরাণ, স্কন্দ পুরাণ অনুসারে সেদিন জলও পান করা যাবে না। সেক্ষেত্রে অন্ন বলতে উল্লেখ পুরাণগুলি জগতের সকল খাদ্যকে না বুঝিয়ে ধান, গম, ভুট্টা, ডাল, সরিষা এ পঞ্চ রবিশস্যকে বুঝিয়েছে। এতেই গীতার সাথে বিরোধ হয়েছে। কিন্তু ব্যাসদেব বলেছেন, শ্রুতি, স্মৃতি এবং পুরাণের মধ্যে যদি বিরোধ দেখা গেলে শ্রুতি বাক্যটিই প্রমাণ। এরপরে স্মৃতি ও পুরাণের মধ্যে বিরোধে স্মৃতিই বিধানই প্রমাণ ।
আমরা স্বাভাবিক সেন্সেও বিষয়টি নিয়ে একটু ভাবতে পারি, এই যে অন্নে প্রতি একাদশীর দিনে পাপপুরুষ প্রবেশ করে এই পাপ পৃথিবীর কোথা থেকে প্রবেশ শুরু করে? যদি আমাদের অপর গোলার্ধে আমেরিকার দিনেরবেলা প্রবেশ করে, তবে সময়টি আমাদের রাত্রিবেলা হয়ে যাবে; আর ভারতবর্ষের দিনেরবেলা প্রবেশ করলে আমেরিকার রাত্রিকাল হবে।পাপপুরুষ কতক্ষণ খাদ্যে থাকবেন, সুর্যোদয় থেকে সুর্যাস্ত, নাকি অষ্টপ্রহর ২৪ ঘন্টা? তিনি কি একজন না বহু? তিনি কি শুধু মানুষের খাবারেই প্রবেশ করে, নাকি মনুষ্যেতর জীবজন্তুর খাবারেও প্রবেশ করে? বিষয়গুলি উল্লেখ্য পুরাণগুলোতে ক্লিয়ার না।
শাস্ত্রীয় সিদ্ধান্ত নির্ণয় সম্পর্কে গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের প্রাণপুরুষ শ্রীচৈতন্যদেব বলেছেন,
প্রমাণের মধ্যে শ্রুতি প্রমাণ প্রধান।
শ্রুতি যেই অর্থ কহে সেই সে প্রমাণ।।
প্রণব সে মহাবাক্য ঈশ্বরের মূর্ত্তি।
প্রণব হইতে সর্ব্ববেদ জগৎ উৎপত্তি।।
(চৈতন্যচরিতামৃত : মধ্যলীলা, ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ)
শ্রুতি যেই অর্থ কহে সেই সে প্রমাণ।।
প্রণব সে মহাবাক্য ঈশ্বরের মূর্ত্তি।
প্রণব হইতে সর্ব্ববেদ জগৎ উৎপত্তি।।
(চৈতন্যচরিতামৃত : মধ্যলীলা, ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ)
অখিল ধর্মের মূল বেদই সনাতন ধর্মের মূল এবং বেদের উপরেই সনাতন ধর্ম ও সভ্যতা সংস্থাপিত। তাই সকল প্রকার শাস্ত্রীয় সিদ্ধান্ত নির্ণয়ে বেদবাণীই যে একমাত্র প্রমাণ- এ শিক্ষা শ্রীচৈতন্যদেবই আমাদের দিয়েছেন। এবং যুগপৎ দেখিয়েছেন ওঙ্কার (ওঁ) এ মহাবাক্যই ঈশ্বরের মূর্তিস্বরূপ। সেই ওঙ্কার হতেই সকল বৈদিক জ্ঞান এবং জগতের উৎপত্তি।
এ জাজ্বল্যমান রেফারেন্স দেখেও কিছু লোক না বুঝে কলিযুগে বেদ নিষিদ্ধ, পুরাণই সব -এ জাতীয় আকডুম, বাকডুম বকে যাচ্ছেন। তাদের উদ্দেশ্যে আমাদের প্রশ্ন, ভাই কলিযুগে যে বেদ নিষিদ্ধ এটা কি বেদে কোথাও ভগবান বলেছেন যে, আমার এ বৈদিক জ্ঞানটি সত্য, ত্রেতা এবং দ্বাপর যুগের জন্যে ; কলিযুগে তোমরা শুধুমাত্র তোমাদের যারযার কানে ফুশমন্ত্র দেয়া বাবা-গুরুদের গ্রন্থই একমাত্র পড়বে। পুরাণগুলিই পড়বে।না ভগবান এমন কথা বলেননি। তাহলে কলিযুগে বেদ নিষিদ্ধের কথাগুলি কোথায় আছে? আছে বিভিন্ন মানুষপূজারী বাবা,গুরু, তথাকথিত অবতার, ধর্মব্যবসায়ী এবং কিছু পেশাজীবী গীতা-ভাগবত পাঠকদের কথাবার্তা ও গ্রন্থে।
সনাতন ধর্ম একটি সুসংবদ্ধ ধর্ম। বেদের উপরেই এ ধর্মটি স্থাপিত। আপাতদৃষ্টিতে মত-পথের বিভিন্ন অলিগলি দেখে, হঠাৎ বিশৃঙ্খল মনে হয়। অনেকেই না বুঝে বিভ্রান্ত হয়ে যায়। ধৈর্য ধরে একটু চিন্তার অলিগলি পারি দিলেই পাওয়া যায় হিরন্ময় বৈদিক রাজপ্রাসাদ। নাটক-যাত্রাপালার কৃত্রিম রাজপ্রাসাদ দেখে মানুষ সাময়িক মুগ্ধ হলেও, তা ক্ষণস্থায়ী। এতে বসবাস করা যায় না।
শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ