দেবর্ষি নারদ শ্বেতদ্বীপ নামক মহাদ্বীপে উপস্থিত হয়ে চন্দ্রের সমানকান্তির শ্বেতবর্ণ মনুষ্যগণকে দেখতে পেলেন। পরবর্তীতে সেই শ্বেতদ্বীপের মানুষেরা মনে মনে নারদকে সম্মান করলে, নারদও মস্তকদ্বারা তাঁদের সম্মান করলেন। শ্বেতদ্বীপে নারদ ভগবান নারায়ণকে দেখবার ইচ্ছা করে কষ্টকর তপস্যা শুরু করলেন।তিনি ভগবান নারায়ণের মন্ত্রজপ শুরু করলেন।
ভূত্বৈকাম্প্রমনা বিপ্র উর্দ্ধবাহুঃ সমাহিতঃ।
স্তোত্রং জগৌ স বিশ্বায় নির্গুণায় গুণাত্মনে॥
(মহাভারত: শান্তিপর্ব, ৩২৪.৩)
"নারদ ঊর্দ্ধবাহু, একাগ্রচিত্ত, ধ্যাননিষ্ট হয়ে বিশ্বব্যাপী, নির্গুণ আবার গুণবান ভগবান নারায়ণের উদ্দেশ্যে স্তোত্র পাঠ করতে লাগলেন।"
নারদ ভগবান নারায়ণের উদ্দেশ্যে একটি স্তোত্রপাঠ করেন। সেই স্তোত্রটি মহাভারতের একটি বিখ্যাত স্তোত্র। সম্পূর্ণ স্তোত্রটি একটি শ্লোকেই রচিত। বিষয়টি মহাভারতসহ সনাতন শাস্ত্রে বিরল। সেই স্তোত্রে নারদ বলেন:
নারদ উবাচ।
ওঁ নমস্তে দেবদেবশ ! নিষ্ক্রিয় ! লোকসাক্ষিন! ক্ষেত্রজ্ঞ ! পুরুষোত্তম! অনন্ত ! পুরুষ ! মহাপুরুষ ! পুরুষোত্তম ! ত্রিগুণ ! প্রধান ! অমৃত! অমৃতাখ্য। অনন্তাখ্য। ব্যোম! সনাতন ! সদসদ্ব্যক্তব্যিক্ত! ঋতধামন্ ! আদিদেব ! বসুপ্রদ! প্রজাপতে !
সুপ্রজাপতে! বনম্পতে! মহাপ্রজাপতে। উর্জম্পতে। বাচস্পতে ! জগৎপতে ! মনস্পতে! দিবস্পতে। মরুৎপতে। সলিলপতে! পৃথিবীপতে! দিক্ পতে! পূর্বনিবাস! গুহ্য! ব্রহ্মপুরোহিত! ব্রহ্মকায়িক ! মহারাজিক! চাতুর্মহারাজিক। আভাসুর!
মহাভাসুর! সপ্তমহাভাগ! যাম্য! মহাযাম্য!
সংজ্ঞাসংজ্ঞ!
তুষিত! মহাভুষিত! প্রমৰ্দ্দন ! পরিনির্ম্মিত। অপরিনির্ম্মিত। বশবর্ত্তিন্ । অপরিনিন্দিত। অপরিমিত। বশবর্ত্তিম্। অবশবর্ত্তিন। যজ্ঞ। মহাযজ্ঞ ! যজ্ঞসম্ভব! যজ্ঞযোনে। যজ্ঞগর্ভ। যজ্ঞহৃদয়। যজ্ঞস্তুত ! যজ্ঞভাগহর । পঞ্চযজ্ঞ !পঞ্চকালকর্তৃপতে। পাঞ্চরাত্রিক। বৈকুণ্ঠ ! অপরাজিত। মানসিক। নামনামিক। পরস্বামিন্। সুস্নাত !
হংস ! পরমহংস ! মহাহংস। পরমযাজ্ঞিক! সাংখ্যযোগ! সাংখ্যমূর্তে! অমৃতেশয় । হিরণ্যেশয়! দেবেশয়! কুশেশয়! ব্রহ্মেশয় ! পদ্মেশয় ! বিশ্বেশ্বর !
বিষ্ককসেন ত্বং জগদন্বয়ঃ ত্বং জগৎপ্রকৃতিঃ, তবাগ্নিরাস্যং, বড়বামুখোঽগ্নিঃ ত্বমাহুতিঃ, সারথিঃ, ত্বং বষট্ কার, ত্বং ওঙ্কারঃ, ত্বং তপঃ, ত্বং মনঃ, ত্বং
চন্দ্রমাঃ, ত্বং চক্ষুরাজ্যং ত্বং সূৰ্যঃ, ত্বং দিশাং গজঃ, ত্বং দিগ্ ভানো, বিদিগ্ ভানো, হয়শিরঃ, প্রথমত্রিসৌপর্ণো, বর্ণধরঃ, পঞ্চাগ্নে! ত্ৰিণাচিকেত। ষড়ঙ্গনিধান ! প্রাগ্ জ্যোতিষ। জ্যেষ্ঠসামগ! সামিকব্রতধর ! অথর্বশিরাঃ। পঞ্চমহাকল্প ! ফেণপাচাৰ্য্য! বালখিল্য। বৈখানস! অভগ্নযোগ!
অভগ্মপরিসংখ্যান! যুগাদ্যে! যুগমধ্য!
যুগনিধন! আখগুল! প্রাচীনগর্ভ। কৌশিক !
পুরুষ্টত। পুরুহূত! বিশ্বকৃৎ! বিশ্বরূপ ! অনন্তগতে! অনন্তভোগ! অনন্ত! অনাদে! অমধ্য ! অব্যক্তমধ্য ! অধ্যক্তনিধন ! ব্রতাবাস ! সমুদ্ৰাধিবাস! যশোবাস ! তপোবাস !
দমাবাস ! লক্ষ্যাবাস। বিদ্যাবাস! কীর্ত্যাবাস ।
শ্রীবাস ! সর্বাবাস ! বাসুদেব! সৰ্বচ্ছন্দক!
হরিহয় ! হরিমেধ ! মহাযজ্ঞভাগহর !
বরপ্রদ! সুখপ্রদ! ধনপ্রদ ! হরিমেধ !
যমনিয়ম! মহানিয়ম ! কৃচ্ছ্র ! অতিকৃচ্ছ্র !
মহাকৃচ্ছ্র ! সৰ্বকৃচ্ছ্র ! নিয়মধর ! নিবৃত্তভ্রম!
প্রবচনগত! পৃশ্নিগর্ভপ্রবৃত! প্রবৃত্তবেদবিক্রম!
অঙ্গ। সৰ্বগতে! সর্বদর্শিন্। অগ্রাহ্য। অচল! মহাবিভূতে! মাহাত্ম্যশরীর! পবিত্র! মহাপবিত্ৰ। হিরণ্ময়! বৃহৎ ! অপ্রতর্ক্য। অবিজ্ঞেয় ! ব্ৰহ্মাগ্র্য! প্রজাসর্গকর! প্রজানিধনকর। মহামায়াধর। চিত্রশিখণ্ডিন্ ! বরপ্রদ!
পুরোডাসভাগহর! গতাধ্বর! ছিন্নতৃষ্ণ!
ছিন্নসংশয়। সর্বতোবৃত্ত ! নিবৃত্তরূপ।
ব্রাহ্মণরূপ ! ব্রাহ্মণপ্রিয়। বিশ্বমূর্তে।
মহামূর্তে ! বান্ধব ! ভক্তবৎসল। ব্রহ্মণ্যদেব !
ভক্তোঽহং ত্বাং দিদৃক্ষুরেকান্তদর্শনায় নমোনমঃ।।
(মহাভারত: শান্তিপর্ব, ৩২৪.৪)
" নারদ বললেন-হে নারায়ণ আপনি দেবতাদেরও দেবতা। আপনাকে নমস্কার, আপনি চিন্ময়, নিষ্ক্রিয় এবং নির্গুণ ; আপনি লোকের সাক্ষী, আপনি জীবাত্মা, আপনি পুরুষোত্তম, আপনি অনন্ত, আপনি পুরুষ, আপনি মহাপুরুষ; আপনি পুরুষোত্তম, আপনি সাকার অবস্থায় ত্রিগুণ, আপনি সর্বশ্রেষ্ঠ, আপনি নিত্যমুক্ত, আপনি জীবন্মুক্ত, আপনি বাসুকি, আপনি আকাশ, আপনি সনাতন, আপনি কারণরূপে সৎ ও কার্য্যরূপে অসৎ, আপনি সাকারভাবে ব্যক্ত ও নিরাকারভাবে অব্যক্ত, আপনি সত্যপ্রভাব, আপনি নারায়ণরূপে আদিদেব, আপনি ভক্তগণকে ধনদাতা, আপনি জগতের রাজা, আপনি দক্ষাদি প্রজাপতি, আপনি অশ্বত্থ বৃক্ষ, আপনি আদিপ্রজাপতি ব্রহ্মা, আপনি বলের অধিপতি, আপনি বৃহস্পতি, আপনি ঈশ্বর, আপনি মনের প্রেরক জীব, আপনি আকাশের পতি সূর্য, আপনি দেবপতি ইন্দ্র, আপনি জলপতি বরুণ, আপনি পৃথিবীপতি সম্রাট, আপনি দিক্ পাল, আপনি চিরকাল জগতের আধার, আপনি মন্ত্রময় বলে গোপনীয়, আপনি ব্রহ্মারও পুরোহিত, আপনি ব্রহ্মমূৰ্ত্তি, আপনি সাধ্য, (দেবযোনি বিশেষ) আপনি প্রধান সাধ্যচতুষ্টয়, আপনি সম্যক্ দীপ্তিশালী অগ্নি, আপনি মহাদীপ্তিশালী সূৰ্য্য, আপনি সপ্তর্ষিস্বরূপ, আপনি যোগাঙ্গযমের নিয়ামক, আপনি কৃতান্তের পরিচালক, আপনি চৈতন্যনামক, ভক্তগণ আপনাকে সন্তুষ্ট করে, আপনি সর্বদা সন্তোষরূপ, আপনি জগতের শাসনকর্তা, আপনি পরশুরামাদিরূপে অবতীর্ণ, আদিপুরুষরূপে অনুৎপাদিত, আপনি ভক্তগণের বশবর্ত্তী, আপনি সকলেরই অনিন্দিত, আপনি পরব্রহ্ম বলে অপরিমিত, আপনি পূজারূপে বশবর্ত্তী, আপনি রাজরূপে অবশবর্ত্তী,আপনি সামান্য পূজাস্বরূপ, আপনি অশ্বমেধাদিমহাযজ্ঞ, আপনি রামাদিরূপে যজ্ঞ সম্ভব আপনি বেদরূপে যজ্ঞের কারণ, আপনি জলদাধার বলে যজ্ঞগর্ভ আপনি যজ্ঞপ্রিয় বলে যজ্ঞহৃদয়, আপনি যজ্ঞেশ্বর বলে যজ্ঞস্তুত, আপনি নারায়ণ বলে যজ্ঞভাগহারী, আপনি অধ্যাপনতর্পণাদি পঞ্চযজ্ঞস্বরূপ, আপনি প্রাতঃ, মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ন ও সায়াহ্নরূপ পঞ্চকালের কর্ত্তা ও অধিপতি, আপনি পঞ্চরাত্র নামক বেদের স্তবার্হ, আপনি বৈকুণ্ঠবাসী, আপনি সর্বপ্ৰধান বলবান্ বলে অপরাজিত, আপনি মনোমাত্রবেদ্য, আপনি প্রত্যেকনামে রয়েছেন, অপনি জগতের প্রধান অধীশ্বর, আপনি যজ্ঞান্তে সমীচীনভাবে স্নান করেছেন, আপনি সন্ন্যাসী ও মহাসন্ন্যাসী, আপনি পরমযাজ্ঞিক, আপনি সাংখ্যযোগবেদ্য, আপনি বিরাটপুরুষ, আপনি নিত্যমুক্ত, আপনি কুবের, আপনি দেবগণের প্রভাবস্বরূপ, আপনি সমুদ্রজলশারী নারায়ণ, আপনি ব্রহ্মাণ্ডে অধিষ্ঠিত, আপনি পদ্মাসন ব্রহ্মা, আপনি বিশ্বের ঈশ্বর, আপনি জগতের পরিপালক, আপনি জগতের সম্বন্ধী, আপনি জগতের আদিকর্তা, অগ্নি আপনার মুখ, আপনি বাড়বানল, আপনি আহুতি, আপনি জগতের পরিচালক, আপনি বষট্ কার, আপনি ওঙ্কার, আপনি তপস্যা আপনি ইন্দ্রিয়শ্রেষ্ঠ মন, আপনি শীতল আলোক চন্দ্র, আপনি চক্ষুর দীপ্তি, আপনি সূর্য্য আপনি দিগ্ গজ, আপনি দিকপ্রকাশক, আপনি বিদিক্প্রকাশক, আপনি হয়শির, গরুড়, তাঁর পুত্র ও তাঁর পৌত্র আপনার বাহন, আপনি ব্রাহ্মণাদিবর্ণ ধারণ করেন, আপনি পঞ্চাগ্নিস্বরূপ, আপনি ত্রিনাচিকেতনামক বহ্নিস্বরূপ, আপনি শিক্ষা-কল্পাদি প্রভৃতি ছয়টা বেদাঙ্গের আশ্রয়, আপনি সূর্য্যের ভর্গনামক তেজ, আপনি আদি সামগানকারী, আপনি সামবেদোক্ত ব্রতধারী, আপনি বেদান্ত, আপনি সৌর, শাক্ত,শৈব, বৈষ্ণব ও গাণপত্য উপাসনার উপাস্য, আপনি ফেনপ ও বালখিল্যমুনি, আপনি বাণগ্রস্থ, আপনি পূর্ণযোগ, আপনি পূর্ণবিচার, আপনি যুগের আদি, আপনি যুগের মধ্য, আপনি যুগের অন্ত, আপনি ইন্দ্র, আপনি প্রাচীনগর্ভ ও কৌশিকমুনি, সকলে আপনার প্রচুর স্তব করে ও বহুতর হোম করে থাকে, আপনি জগতের সৃষ্টিকর্তা আপনি বিশ্বরূপ, আপনার অবস্থার অন্ত নাই, আপনার ভোগের শেষ নাই, আপনার আদি, মধ্য ও অন্ত নাই, আপনার আদি মধ্য ও অবসান অস্পষ্ট, আপনি ব্রতের আধার আপনি সমুদ্রজলশায়ী, জাপনি যশের ও তপস্যার আশ্রয়, আপনি ইন্দ্রিয়দমনশীল, আপনি লক্ষ্মীর আবাস, বিদ্যার আশ্রয়, কীর্তির আধার ও সম্পদের আশ্রয়, এমন কি সকলেরই আশ্রয়, আপনি কৃষ্ণজন্মে বসুদেবের পুত্র, আপনি সমস্ত ভক্তের ইচ্ছা পূরণ করেন, রামজন্মে হনুমান আপনার বাহন ছিলেন, আপনি কাম্য অশ্বমেধযজ্ঞ, আপনি মহাযজ্ঞে অংশ গ্রহণ করেন, আপনি ভক্ত দিগকে বর, সুখ ও ধনদান করে থাকেন, আপনি নিষ্কাম অশ্বমেধযজ্ঞ, আপনি যোগাঙ্গ যম ও নিয়ম, আপনি ব্রহ্মচর্য্য, আপনি কৃচ্ছ্র ও অতিকৃচ্ছ্রব্রত, আপনি মহাকৃচ্ছ্রব্রত, আপনি সর্বকৃচ্ছ চান্দ্রায়ণব্রত, আপনি ব্রহ্মচর্য্যাদি নিয়ম ধারণ করেন, আপনার কোন ভ্রম নেই, আপনি বিস্তৃত বেদবাক্যের বিষয়, আপনি পৃশ্নিদেবীর গর্ভে অবতীর্ণ হয়েছেন, আপনার বিক্রম বেদে প্রকাশিত আছে, আপনি জন্মরহিত, আপনি সর্বব্যাপী ও সর্বদর্শী, আপনি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নন, আপনি অচল, আপনার ঐশ্বর্য্য অসাধারণ, আপনার দেহের অশেষ মাহাত্ম্য, আপনি পবিত্ৰ ও মহাপবিত্র, আপনি লোকের নিকটে ধনস্বরূপ, আপনি ব্রহ্ম, আপনি তর্ক ও জ্ঞানের অবিষয়, আপনি বেদশ্রেষ্ঠ গায়ত্রী, আপনি লোকের সৃষ্টি ও সংহার করেন, আপনি মহামায়াকে ধারণ করেন, আপনার শিখণ্ডযুগল ( চুলের জুলপি) বিচিত্র, আপনি ভক্ত দিগকে বরদান করে থাকেন, আপনি যজ্ঞে পুরোভাগ গ্রহণ করেন, আপনি বামনাবতারে বলির যজ্ঞে গিয়েছিলেন, আপনার তৃষ্ণা ও সংশয় নেই, আপনি সকলদিকে রয়েছেন, আপনি নিরাকার, আপনি ব্রহ্মজ্ঞস্বরূপ, আপনি ব্রহ্মজ্ঞপ্রিয়, আপনি বিশ্বমূৰ্ত্তি, আপনি মহামূর্তি, আপনি জগতের বন্ধু, আপনি ভক্তবৎসল, আপনি ব্রহ্মণ্যদেব, আমি আপনার ভক্ত, আমি আপনাকে দেখতে ইচ্ছা করি, নির্জ্জন স্থানে আপনার দর্শন পাওয়া যায়, আমি আপনাকে বার বার নমস্কার করি।"
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
ফেসবুক পোস্ট লিঙ্ক : দেবর্ষি নারদের, শ্রীনারায়ণস্তোত্র।