-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

অন্নপূর্ণার ভবানন্দ ভবনে যাত্রা (আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে)।

"আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে" "আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে" -এ সুবিখ্যাত পঙক্তিটির শোননি এমন বাঙালি হয়ত পাওয়া দুষ্কর। মোটামুটি শিক্ষিত অধিকাংশ বাঙালিই এই পঙক্তিটির সাথে পরিচিত। কিন্তু আমরা অধিকাংশ মানুষই জানি না এই পঙক্তিটি কার লেখা? এটি মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য ধারার খ্যাতিমান কবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের লেখা 'অন্নদামঙ্গল' কাব্যের একটি পঙক্তি। পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার পেঁড়ো গ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর সময়কাল ১৭১২-১৭৬০ খ্রিস্টাব্দ। তিনি ছিলেন নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সভাকবি।অন্নদামঙ্গল কাব্যটি রচনার জন্যে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় ভারতচন্দ্র রায়কে অত্যন্ত খুশি হয়ে মূলাজোড় গ্রাম ইজারা দেন। অন্নদামঙ্গল কাব্যে হিমালয় নন্দিনী উমা ভিক্ষুক রূপী শিবকে অন্ন দান করেন। জগতের পিতা মহেশ্বরকে অন্ন প্রদান করাতেই তিনি অন্নপূর্ণা রূপে পূজিতা। বেদে বলা আছে, অন্নই ব্রহ্ম। অন্নকে ত্যাগ করে কিছুই হয় না। এই অন্নব্রহ্মরূপেরই অধিশ্বরী হলেন দেবী অন্নপূর্ণা। ‘জীব স্বরূপতঃ শিব’- তাই জীবকে অন্ন প্রদান করাই হল শিবকে অন্নদানের সমতুল্য। অন্নহীনকে অন্নদানই অন্নপূর্ণার প্রকৃত পূজা।  কবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর তাঁর অন্নদামঙ্গল কাব্যে নাটকীয় ভঙ্গিতে অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী হিসেবে দেবী অন্নপূর্ণার মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন। এই বর্ণনা রীতিতে ভাষায় অসাধারণ প্রয়োগ করেছেন কবি। তিনি এই কাব্যে দেবীর আত্মপরিচিতি অংশে অত্যন্ত সফলতার সাথে দ্ব্যর্থবোধক শব্দের ব্যবহার করেছেন। সেখানে প্রত্যেকটি শব্দই দু'টি বা এর অধিক অর্থ প্রকাশ করে। শব্দশক্তি সাধারণত তিন প্রকার। যথা: অভিধা, ব্যঞ্জনা এবং লক্ষণা। অভিধা হলো কোন শব্দের আভিধানিক অর্থ। ব্যঞ্জনা হলো কাব্যে কোন বিশেষ আলঙ্কারিক প্রয়োগের মাধ্যমে যে শব্দের প্রয়োগ করা হয় তা। সর্বশেষ হলো লক্ষণা অলঙ্কার। অর্থাৎ বলা হয়েছে একটি বিষয়ে, কিন্তু সেই বলা বিষয়ের ঝোঁক অন্যদিকে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি সহজ হবে। কোন ঘোড়ার দৌড়ে বিভিন্ন রঙের অনেক ঘোড়া দৌড়াচ্ছে। এরমধ্যে সবচে এগিয়ে লাল রঙের ঘোড়াটি। তখন কেউ যদি বলে, "লালটির সাথে কেউ দৌড়ে পারবে না; লালটা নিশ্চিত দৌড়ে প্রথম হবে"। এখানে ব্যক্তিটি লাল বলতে শুধু লাল রঙকে বোঝায়নি। সে লাল বলতে, লাল ঘোড়াকে বুঝিয়েছে। কোন সাহিত্যকে সেই সাহিত্যের একটি নিজস্বতার আলোকেই দেখতে হবে। তবেই সেই সাহিত্য ফলপ্রসূ হবে। আমরা অধিকাংশই এদেশীয় সাহিত্য, সংস্কৃতিকে বিদেশীয় দৃষ্টিতে দেখি। তাই এদেশীয় সাহিত্যের অন্তর্নিহিত স্বভাবটি ধরতে পারি না। শুধুই মোটাদাগে বৃথাই আমরা প্রয়াস করি। দেবী অন্নপূর্ণা অচিন্ত্য আদ্যাশক্তি মহামায়া। তাঁর কোন সুনির্দিষ্ট মূর্তি নেই। এর পরেও সাধকের কল্যাণের জন্যে তিনি বিবিধ মূর্তিতে প্রকাশিত হয়ে রূপধারিণী হয়ে দৃশ্যমান হন। যোগ্য সাধক এবং যোগ্য অধিকারীকে কখনো কখনো মূর্তিমান হয়ে দর্শনই দেন। এ সকলই তাঁর লীলা। তিনিই মহামায়া হয়ে জীবকে মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ করেন, আবার তিনিই জীবকে মুক্ত করেন। তিনিই জীবকে অন্নপূর্ণা হয়ে অন্নদান করেন, এতে জীব বেঁচে থাকে। আবার তিনিই প্রলয়কালে কালীরূপে জীবকে গ্রাস করেন। সেই আদ্যাশক্তি মহামায়া ঈশ্বরী পাটনী এবং ভবানন্দ মজুমদারকে কৃপা করতে একজন নারীর রূপ ধারণ করে গঙ্গার তীরে উপস্থিত হন। তিনি গঙ্গার তীরে এসে উচ্চস্বরে আমাকে পার কর বলে চিৎকার করতে থাকেন। স্ত্রীকণ্ঠ শুনে খেয়াপাড়ের মাঝি ঈশ্বরী পাটনি এগিয়ে আসেন। তিনি দেখলেন একজন অসহায় নারী পাড় হতে, নদীতীরে উপস্থিত। তিনি সেই একাকী নারীকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনার বেশভূষা দেখে মনে হচ্ছে আপনি কোন সম্ভ্রান্ত কুলের বধূ। আপনি কে? যদি আপনি আপনার পরিচয় না দেন, তবে আপনাকে আমি নদী পাড় করতে পারবো না। ভয় হয় যে, উপকার করতে গিয়ে, পরবর্তীতে বিপদে পড়ে যেতে পারি। অন্নপূর্ণা উত্তরিলা গাঙ্গিনীর তীরে।  পার কর বলিয়া ডাকিলা পাটুনীরে।।  সেই ঘাটে খেয়া দেয় ঈশ্বরী পাটুনী।  ত্বরায় আনিল নৌকা বামাস্বর শুনি।।  ঈশ্বরীরে জিজ্ঞাসিল ঈশ্বরী পটলী।  একা দেখি কুলবধূ কে বট আপনি।।  পরিচয় না দিলে করিতে নারি পার। ভয় করি কি জানি কে দিবে ফেরফার।।  ঈশ্বরী দ্বিধাগ্রস্ত হলেন। দেবীতো সদা সত্যে প্রতিষ্ঠিত। তিনি তো কখনো মিথ্যার আশ্রয় নিতে পারবেন না। পক্ষান্তরে আবার তিনি মিথ্যা কথাও বলতে পারবেন না। দেবী অন্নপূর্ণা কুলবধূ রূপ ধারণ করে আছেন। তাই তিনি তাঁর আত্মপরিচয় দিতে দ্ব্যর্থবোধক শব্দের আশ্রয় নিয়ে ঈশ্বরী পাটনিকে নিজের পরিচয় প্রদান করলেন। স্বামীর নাম যেহেতু স্ত্রীরা উচ্চারণ করে না, তাই তিনি বিশেষণে সবিশেষ আত্মপরিচয় দিলেন। ঈশ্বরীরে পরিচয় কহেন ঈশ্বরী। বুঝহ ঈশ্বরী আমি পরিচয় করি।।  বিশেষণে সবিশেষ কহিবারে পারি। জানহ স্বামীর নাম নাহি ধরে নারী।।  দেবী অন্নপূর্ণা দুঃখিত বদনে আত্মপরিচয় দিতে শুরু করলেন। সেখানে তিনি যা বললেন এর আভিধানিক অর্থ মাঝি গ্রহণ করলো। মাঝির উপলব্ধিতে সেই কথাগুলোর অর্থ হলো: এই একাকী অসহায় নারীর পিতা 'মুখবংশজাত', অর্থাৎ মুখোপাধ্যায় বংশের। তাঁর স্বামী অত্যন্ত কুলিন বংশীয় 'বন্দ্যবংশখ্যাত'; অর্থাৎ স্বামী কুলীন বংশীয় বন্দ্যোপাধ্যায় বংশের। তাঁর অন্নপূর্ণা নাম দিয়েছে তার পিতার পিতা পিতামহ। তাঁর স্বামীর একাধিক স্ত্রী রয়েছে। তাই তাঁর প্রতি সর্বদাই বিরূপভাব প্রকাশ করে, তাঁকে আদর করে না। তাঁর স্বামী বয়সেও বৃদ্ধ। সারাদিন বিভিন্ন সিদ্ধি ভাং খেয়ে মাতলামি করে বেড়ায়। স্বামীর কোন গুণ তো নেই, বরং কপালে আগুন থাকায় সারাদিন সকলের সাথে দুর্ব্যবহার করে। কুকথা এবং অশ্লীল কথা ছাড়া সে কথাই বলতে পারে না। সারাক্ষণ তাঁর মুখে কুকথাই শোভা পায়। স্ত্রীর সাথে তাঁর চলে দিনরাত্রি দ্বন্দ্ব। তাঁর স্বামী অনেক স্ত্রীর মধ্যে গঙ্গা নামের স্ত্রীকে বেশি ভালোবাসে। সেই গঙ্গাকে পারলে সবকিছুই দিয়ে দেয়। অতিরিক্ত প্রশ্রয় এবং ভালোবাসায় গঙ্গাও কম যায় না; সে স্বামীর শিরোমণি হয়ে সর্বদা স্বামীর মাথায় বসে থাকে। স্বামী তাঁর পেশায় তান্ত্রিক, ভুতপ্রেত ঘরে ঘরে সারাক্ষণ নাচিয়ে বেড়ানোই তাঁর কাজ। তাঁর পিতার হৃদয়টি পাথরের মত কঠিন, তাই সে জেনে-বুঝে মেয়েকে এমন স্বামীর কাছে বিয়ে দিয়েছে।অভিমান সমুদ্রে ঝাপ দিয়ে, তাঁর হৃদয় আজ দুঃখ বেদনায় ভারাক্রান্ত। তাই যে তাঁকে আপন মনে করে ভালোবাসে সে শুধু তার কাছেই যায়। গোত্রের প্রধান পিতা মুখবংশজাত।  পরমকুলীন স্বামী বন্দ্যবংশখ্যাত।। পিতামহ দিলা মোরে অন্নপূর্ণা নাম। অনেকের পতি তেঁই পতি মোর বাম।।  অতি বড় বৃদ্ধ পতি সিদ্ধিতে নিপুণ। কোন গুণ নাহি তাঁর কপালে আগুন।।  কুকথায় পঞ্চমুখ কন্ঠভরা বিষ। কেবল আমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ।।  গঙ্গা নামে সতা তার তরঙ্গ এমনি।  জীবনস্বরূপা সে স্বামীর শিরোমণি।। ভূত নাচাইয়া পতি ফেরে ঘরে ঘরে। না মরে পাষাণ বাপ দিলা হেন বরে।।  অভিমানে সমুদ্রেতে ঝাঁপ দিলা ভাই।  যে মোরে আপনা ভাবে তারি ঘরে যাই।।  একাকী কুলবধূরূপ দুঃখের  কথা শুনে ঈশ্বরী পাটুনীর মন ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। তখন পাটুনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি পঙক্তি বলে। যে পঙক্তিটিও আজ বাংলা ভাষায় প্রবাদবাক্যের মতই ব্যবহৃত হয়। তিনি নদী পাড় হতে আসা একাকী নারীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন- যেখানেই কুলীন জাতি, সেখানেই কোন্দল। আমরাও দেখি ঝগড়াবিবাদ সমাজের উচ্চ শ্রেণীর শহুরে নাগরিক জীবনে অভ্যস্তদের মধ্যেই বেশি। গ্রাম এলাকায় দেখা যায়,  পাড়াপ্রতিবেশি নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি করবে, মারামারি করবে, চুলাচুলি করবে ; আবার পরক্ষণেই একে অন্যের বিপদে ঝাপিয়ে পড়বে। সকল পরিচয় পেয়ে আস্বস্ত হয়ে পড়ে ঈশ্বর পাটুনী দেবীকে নদী পারি দিতে নৌকা ছেড়ে দেয়। সহজ, সরল মাঝি জানে না আজ তাঁর কতভাগ্য। পাটুনী বলিছে আমি বুঝিনু সকল।  যেখানে কুলীন জাতি সেখানে কন্দল।। শীঘ্র আসি নায়ে চড় দিবা কিবা বল। দেবী কন দিব আগে পারে লয়ে চল।।  জন্মজন্মান্তরে সুকৃতির ফলে এমন সৌভাগ্য আসে মানুষের জীবনে। যার শুধু নামেই এ ভবসিন্ধু পাড়ি দেয়া যায়, তিনিই কিনা এসেছে নদী পারি দিতে। ঈশ্বরী পাটুনির আজ কত সৌভাগ্য। ভবসিন্ধু পাড়ি দিয়ে সকল জীবের  যিনি একমাত্র লক্ষ্য, সেই তিনিই লীলার বশে আজ সামান্য নদী পাড়ি দিতে এসেছেন ঈশ্বরীর নৌকায়। বিষয়টি উপলব্ধি করে ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর বলেন: যার নামে পার করে ভবপারাবার । ভাল ভাগ্য পাটুনী তাহারে করে পার।।  নৌকায় উঠে দেবী অন্নপূর্ণা নৌকার বাড়ানো অংশে নদীর উপরে পা ঝুলিয়ে বসলেন। তৎক্ষণাৎ সেই পায়ের নিচে নদীর জল থেকে একটি লাল পদ্মফুল ফুটে উঠলো। ঈশ্বরী খেলাল কিরলো না বিষয়টি। সে তখন নৌকায় পা তুলে দেবীকে বসতে বলে। গঙ্গায় প্রচুর কুমিরের উৎপাদ। তাই তুলে না বসলে কুমির যে কোন সময়ে পা টান দিয়ে নদীতে নিয়ে যেতে পারে।   বসিলা নায়ের বাড়ে নামাইয়া পদ। কিবা শোভা নদীতে ফুটিল কোকনদ।।  পাটুনী বলিছে মা গো বৈস ভাল হয়ে।  পায়ে ধরি কি জানি কুমীরে যাবে লয়ে।। পাটুনীর কথা শুনে দেবী বলেন, তোর সারা নৌকা ভর্তি জল। সেই জলে আমার পা রাখার সামান্য স্থানও নেই। এই জলে যদি আমি পা রাখি, তবে আমার পায়ের আলতা ধুয়ে যাবে। দেবীর কথা শুনে ঈশ্বরী পাটুনী তখন দেবীর রাঙা পা জল সেঁচার কাঠের সেঁউতীর উপরে রাখতে বলেন। ভবানী কহেন তোর নায়ে ভরা জল।  আলতা ধুইবে পদ কোথা থুব বল।।  পাটুনী বলিছে মাগো শুন নিবেদন।  সেঁউতী উপরে রাখ ও রাঙ্গা চরণ।।  পাটুনীর কথায় দেবী মৃদু হেসে কাঠের সেঁউতী উপরে  পা রাখলেন। ভারতচন্দ্র রায় বর্ণনা করছেন, আহা ঈশ্বরী পাটনী এবং তাঁর নৌকার কত ভাগ্য! ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ইন্দ্র, চন্দ্র যে চরণের সর্বদা ধ্যান করে; যে চরণ হৃদয়ে ধারণ করে ভুতনাথ শিব মাটিতে লুটিয়ে পরে; সেই অচিন্ত্য চরণকমলদ্বয়  রাখলেন দেবী নৌকার সেঁউতী উপরে। দেবীর ইচ্ছাতেই সকল কর্ম সাধিত হয়, তাই তাঁর নাম ইচ্ছাময়ী তাঁরা। অনন্ত জপ, তপেও জীব মুক্ত হয় না ; যদি দেবীর ইচ্ছা না হয়। কাঠের সেঁউতী উপরে দেবী তাঁর চরণদ্বর রাখার সাথে সাথেই, তা সোনার  কাঠের থেকে সোনার সেঁউতী হয়ে গেলো। চোখের সামনে এভাবে কাঠের সেঁউতীকে সোনার হতে দেখে মাঝি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলো। সে বুঝতে পারলো, এ কোন সাধারণ নারী নয়; নিশ্চয়ই কোন দেবী। পাটুনীর বাক্যে মাতা হাসিয়া অন্তরে।  রাখিলা দুখানি পদ সেঁউতী উপরে।।  বিধি বিষ্ণু ইন্দ্র চন্দ্র যে পদ ধেয়ায়।  হৃদে ধরি ভূতনাথ ভূতলে লুটায়।।  সে পদ রাখিলা দেবী সেঁউতী উপরে। তাঁর ইচ্ছা বিনা ইথে কি তপ সঞ্চরে।।  সেঁউতীতে পদ দেবী রাখিতে রাখিতে।  সেঁউতী হইল সোনা দেখিতে দেখিতে।। সোনার সেঁউতী দেখি পাটুনীর ভয়।  এ ত মেয়ে মেয়ে নয় দেবতা নিশ্চয়।। ভয়ে ভয়ে নদী পাড়ি দিয়ে ঈশ্বরী পাটুনী  নৌকা তীরে উত্তরিলো। হাসিমুখে নৌকা থেকে নেমে দেবী মুখে কিছু না বলেই কোন দিকে না তাকিয়ে পূর্বদিকে হাতির মত গজগামিনী ভঙ্গিতে এগিয়ে যেতে থাকলো। ভয়ে ভয়ে পাটুনী সোনার সেঁউতীটিকে বুকের সাথে জড়িয়ে দেবীর পিছে পিছে এগিয়ে যেতে থাকে।দেবী তখন পেছনে ফিরিয়া তাকান। ঈশ্বরী পাটনী আনন্দে, বিস্ময়ে এবং ভয়ে কাঁদতে থাকেন। তাঁর দুচোখ থেকে অশ্রু বইতে থাকে। ভয়ে ভয়ে পাটুনী বলে, আমি জানি তুমি ছল করে তোমার পরিচয় দিয়েছ। তা না হলে আমার কাঠের সেঁউতী কি করে তোমার চরণ রাখার সাথে সাথেই সোনার হয়ে গেলো? আমি জানি তুমি নিশ্চই কোন দেবী। হে দেবী, যখন দেখাই  দিয়েছ তখন দয়া করে তোমার পরিচয়টুকু দাও। তপ, জপ ধ্যান, জ্ঞান কিছুই আমার নেই; এরপরেও তুমি আমাকে দেখা দিয়েছ। এ তোমার অহৈতুকী দয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। যে দয়া করে তুমি আমায় দর্শন দিলে, সেই দয়া করেই তুমি আমায় তোমার পরিচয় দাও। তীরে উত্তরিল তরি তারা উত্তরিলা।  পূর্বমুখে সুখে গজগমনে চলিলা।। সেঁউতী লইয়া বক্ষে চলিলা পাটুনী। পিছে দেখি তারে দেবী ফিরিয়া আপনি।। সভয়ে পাটুনী কহে চক্ষে বহে জল।  দিয়াছ যে পরিচয় সে বুঝিনু ছল।।  হের দেখ সেঁউতীতে থুয়েছিলা পদ।  কাঠের সেউতী মোর হৈলা অষ্টাপদ।।  ইহাতে বুঝিনু তুমি দেবতা নিশ্চয়।  দয়ায় দিয়াছ দেখা দেহ পরিচয়।।  তপ জপ জানি নাহি ধ্যান জ্ঞান আর। তবে যে দিয়াছ দেখা দয়া সে তোমার।।  যে দয়া করিল মোর এ ভাগ্য উদয়।  সেই দয়া হৈতে মোরে দেহ পরিচয়।।  ঈশ্বরী পাটনীকে তখন বাধ্য হয়েই দেবী অন্নপূর্ণা তাঁর আত্মপরিচয় প্রদান করেন। আমি দেবী অন্নপূর্ণা, আমার প্রকাশ কাশীতে। চৈত্র মাসের শুক্ল অষ্টমী তিথিতে আমার পূজা অনুষ্ঠিত হয়।তিনি বলেন পূর্ববর্তী আত্মপরিচয়ের যত কথা বলেছি, তা সকলই সত্য। তুমি ভেবে দেখ, তবেই বুঝতে পারবে। দেবী তাঁর আত্মপরিচয়কালে নিজে যে সচেতনভাবে দ্ব্যর্থবোধক শব্দের ব্যবহার করেছেন স্বীকার করে নিলেন। দেবী বলেছেন, তাঁর  পিতা 'মুখবংশজাত', পাটনী মনে করেছে সে মুখোপাধ্যায় বংশের। কিন্তু দেবী 'মুখবংশজাত' বলতে বুঝিয়েছেন যে  প্রজাপতি ব্রহ্মার পুত্র দক্ষের বংশজাত তিনি। যা সৃষ্টির প্রধানতম বংশ।  একইভাবে  তাঁর স্বামী অত্যন্ত কুলিন বংশীয় 'বন্দ্যবংশখ্যাত' বা বন্দ্যোপাধ্যায় বংশের মনে করেছে ঈশ্বরী পাটনী। কিন্তু দেবী 'বন্দ্যবংশখ্যাত' বলতে শিবকে জীবের সদা বন্দনীয় বলে পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর থেকে শ্রেষ্ঠ আর কেউ নেই। সকল জীবের আদিপিতা তিনি, তাই তিনি পরম শ্রেষ্ঠ। পাটনী মনে করেছে, অন্নপূর্ণা নামটি  তাঁর পিতার পিতা পিতামহ দিয়েছে। কিন্তু এখানে পিতামহ বলতে দেবী পিতামহ প্রজাপতি ব্রহ্মার কথা বলেছে।  প্রজাপতি ব্রহ্মাই জগতে অন্নের অধিষ্ঠাত্রী হিসেবে দেবীর নাম অন্নপূর্ণা রাখেন। পাটনী ভেবেছে তাঁর স্বামীর একাধিক স্ত্রী রয়েছে।কিন্তু দেবী সকলের পতি বলতে,  শিব যে জগতের পতি এই বিষয়টিই বুঝিয়েছেন। "পতি মোর বাম"  বলতে পাটুনী ভেবেছে  তাঁর স্বামী সর্বদাই বিরূপভাব প্রকাশ করে, তাঁকে আদর করে না। কিন্তু দেবী বুঝিয়েছেন, তিনি শিবের প্রকৃতি রূপা বাম অংশ।এই পুরুষ এবং প্রকৃতির মিলনেই জগতের উৎপত্তি।   "অতি বড় বৃদ্ধ পতি"  দেবীর মুখে এই বাক্য শুনে ঈশ্বরী পাটনী ভেবেছে তাঁর স্বামী বুঝি বয়সে অনেক  বৃদ্ধ। কিন্তু দেবী বলেছেন, শিব যেহেতু আদিনাথ এবং আদিযোগী। সৃষ্টির পূর্ব থেকেই তিনি বর্তমান। তাই জগতে শিবের থেকে বৃদ্ধ আর কে বা থাকবে? ঈশ্বরী পাটনী "সিদ্ধিতে নিপুণ" শুনে ভেবেছে, সারাদিন বিভিন্ন সিদ্ধি ভাং খেয়ে তাঁর স্বামী মাতলামি করে বেড়ায়। কিন্তু শিব জীবের সকল অভীষ্ট সিদ্ধি প্রদান করে, তাই তিনি  সিদ্ধিদানে নিপুণ। শিব সাত্ত্বিক, রাজসিক এবং তামসিক এ ত্রিগুণের অতীত। তিনি সাধারণ মনুষ্যের মত  ত্রিগুণ দ্বারা আছন্ন নন। তাই বলা হয়েছে,  তাঁর কোন গুণ তো নেই।  কপালে আগুন কথাটি শুনে পাটুনী ভেবেছে তাঁর স্বামী বুঝি সর্বদা সকলের সাথে দুর্ব্যবহার করে। কিন্তু দেবী অন্নপূর্ণা কপালে আগুন বলতে শিবের ললাটনেত্রকে  বুঝিয়েছেন। "কুকথায় পঞ্চমুখ" এই কথা শুনে পাটুনী ভেবেছে তাঁর স্বামী সর্বদা কুকথা এবং অশ্লীল কথা বলে বেড়ায়। কিন্তু 'কু' শব্দের অর্থ পৃথিবী, অর্থাৎ পৃথিবী যাঁর কথায় পঞ্চমুখ।  কুকথা শব্দটির আরেকটি অর্থ হয় যে,  আগম- নিগম প্রতিপাদ্য বিদ্যা। অর্থাৎ বেদ-বেদাঙ্গ শাস্ত্র যাঁর কথায় পঞ্চমুখ। "আমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ" বলতে সৃষ্টি প্রক্রিয়ার দ্বন্দ্ব এবং মিলনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পাটুনী ভেবেছে,  দিনরাত্রি বুঝি স্বামী স্ত্রীর দ্বন্দ্ব হয়। পাটুনী ভেবেছে, তাঁর স্বামী অনেক স্ত্রীর মধ্যে গঙ্গা নামের স্ত্রীকে বেশি ভালোবাসে। কিন্তু দেবী এখানে বুঝিয়েছেন, গঙ্গা পতিতপাবনী তাঁরই আরেকটি রূপ। তাই শিবের প্রিয় কাশীক্ষেত্রও গঙ্গা তীরে অবস্থিত।  হিমালয়কে শিবের জটার সাথে তুলনা করা হয়। আর এই হিমালয়ের গোমুখ উৎসমুখ থেকেই নেমে আসছে পতিতপাবনী গঙ্গা। মনে হয় যেন শিবের জটা থেকেই কুলকুল ধ্বনিতে সমতল ভূমিতে নেমে আসছে। যেহেতু গঙ্গা শিবের জটার আকৃতির হিমালয় পর্বত থেকে নেমে আসছে,  তাই গঙ্গাকে  স্বামীর শিরোমণি বলে অবিহিত করা হয়েছে। ভুত শব্দের অর্থ জীব। সকল জীবের অধীশ্বর শিবকে তাই ভূতনাথ বলা হয়। ভুত নাচানোর কথা শুনে ঈশ্বরী পাটনী ভেবেছে,  তাঁর স্বামীর পেশা তান্ত্রিকতা করা। যিনি ভুতপ্রেত ঘরে ঘরে সারাক্ষণ নাচিয়ে বেড়ায়।  কিন্তু ভুত নাচানোর কথা বলতে দেবী বুঝিয়েছেন যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল জীবের স্পন্দন তিনি। তাঁর স্পন্দনেই সকল জীব সচল থাকে।  তাঁর পিতার হৃদয়টি পাথরের মত কঠিন বলতে দেবী বুঝিয়েছেন, যে তিনি দক্ষরাজ হিমালয়ের কন্যা।এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করে সেই সৃষ্টির প্রত্যেকটি অণু পরমাণুতেই আদ্যাশক্তির শক্তি বিরাজত। "সমুদ্রেতে ঝাঁপ দিলা" বলতে দেবী বুঝিয়েছেন, তিনি এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করে তিনি নিজেই সেই সৃষ্টির সমুদ্রে ঝাপ দিয়েছেন। জগতের মাতা জগন্মাতা তিনি, তাই জগতের কোন জীবের কাছেই শুধু ভক্তি ছাড়া তিনি কিছুই প্রত্যাশা করেন না। তাই আপন মনে করে যে দেবীকে একাগ্রচিত্তে স্মরণ করে এবং  ভালোবাসে অচিন্ত্য দেবী তাঁর কাছেই প্রকাশিত হন। দেবী শুধুই ভক্তি ভালোবাসাতেই বদ্ধ হন। ছাড়াইতে নারি দেবী কহিলা হাসিয়া।  কহিয়াছি সত্য কথা বুঝহ ভাবিয়া।।  আমি দেবী অন্নপূর্ণা প্রকাশ কাশীতে।  চৈত্র মাসে মোর পূজা শুরু অষ্টমীতে।।  দেবী অন্নপূর্ণা বললেন তিনি কোন্দল পছন্দ করেন না। এই কোন্দলের কারণে তিনি হরিহোড়ের নিবাস পরিত্যাগ করে ভবানন্দের নিবাসে যাচ্ছেন। বিদায় বেলায় দেবী ঈশ্বরী পাটনীর উপরে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে যেকোন বর প্রার্থনা করতে বললেন।  কত দিন ছিনু হরিহোড়ের নিবাসে। ছাড়িলাম তার বাড়ী কন্দলের ত্রাসে।।  ভবানন্দ মজুন্দার নিবাসে রহিব।  বর মাগ মনোনীত যাহা চাহ দিব।।  দেবীর স্বেচ্ছায় বরদানের বাক্যে পাটুনী অনেক কিছুই চাইতে পারতেন দেবীর কাছে। তিনি জগতের সকল ধনসম্পত্তি চাইতে পারতেন অথবা তিনি রাজা হওয়ার বরদান চাইতে পারতেন। কিন্তু তিনি চাইলেন তাঁর সন্তানেরা যেন সামান্য দুধভাত খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে। ঈশ্বরী পাটুনী জোড়হাতে দেবীকে প্রণাম করে, তাঁর সন্তানেরা যেন দুধভাত বেঁচে থাকতে পারে এই বরদান চাইতেই দেবী 'তথাস্তু' বলে তাতে সম্মতি দিলেন। দেবীর বর আনন্দিত মনে নৌকা ঘাটের দিকে ফিরে যেতে থাকে। হঠাৎ করে পিছনে ফিরে দেখে কেউ নেই। দেবী অদৃশ্য হয়ে গেছে। পাটুনী বুঝতে পারে দেবীর নৌকায় পাড়ি দেয়া তাঁকে কৃপা করার জন্যেই। এই ভেবে পাটুনীর চোখ দিয়ে দরদর করে আনন্দাশ্রু বয়ে যেতে থাকে। প্রণমিয়া পাটুনী কহিছে যোড় হাতে।  আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।। তথাস্তু বলিয়া দেবী দিলা বরদান। দুধে ভাতে থাকিবেক তোমার সন্তান।।  বর পেয়ে পাটুনী ফিরিয়া ঘাটে যায়।  পুনর্বার ফিরি চাহে দেখিতে না পায়।।  সাত পাঁচ মনে করি প্রেমেতে পুরিল।  মাঝি এসে সকল ঘটনা ভবানন্দ মজুমদারকে বলে। তাঁকেও যে দেবী অন্নপূর্ণা কৃপা করতে নদী পাড়ি দিয়েছেন, একথা সবিস্তারে বললেন। কিন্তু ঈশ্বরী পাটনীর কথায় ভবানন্দ মজুমদার প্রথমে বিশ্বাস করতে পারলেন না। তিনি ঘটনাটি অবিশ্বাস্য মনে করলেন। কিন্তু পরক্ষণেই যখন সোনার সেঁউতীটি দেখলেন, তখন তিনি বুঝতে পারলেন দিন আনে দিন খায় দরিদ্র সামান্য মাঝির কাছে সোনার সেঁউতী কখনই থাকার কথা না। তিনি তখন তাঁর ভুল বুঝতে পেরে এবং দেবীর মহিমা উপলব্ধি করে ভাবে বিহ্বলিত হয়ে পড়েন।  ভবানন্দ মজুন্দারে আসিয়া কহিল।।  তার বাক্যে মজুন্দারে প্রত্যয় না হয়।  সোনার সেঁউতী দেখি করিলা প্রত্যয়।। সংস্কৃত সাহিত্য সহ ভারতবর্ষীয় অধিকাংশ সাহিত্যই এমনি দ্ব্যর্থবোধক শব্দে লেখা। যেন যোগ্য অধিকারী বিহীন কেউ বুঝতে না পারে। কারণ অধিকারী বিহীন বিদ্যা কখনও ফলবতী হয় না।  শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ। ফেসবুক পোস্ট লিঙ্ক :  অন্নপূর্ণার ভবানন্দ ভবনে যাত্রা (আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে)। ফেসবুক পেজ লিঙ্ক :  Shri Kushal Baran Chakraborty | Facebook

"আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে"

"আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে" -এ সুবিখ্যাত পঙক্তিটির শোননি এমন বাঙালি হয়ত পাওয়া দুষ্কর। মোটামুটি শিক্ষিত অধিকাংশ বাঙালিই এই পঙক্তিটির সাথে পরিচিত। কিন্তু আমরা অধিকাংশ মানুষই জানি না এই পঙক্তিটি কার লেখা? এটি মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য ধারার খ্যাতিমান কবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের লেখা 'অন্নদামঙ্গল' কাব্যের একটি পঙক্তি। পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার পেঁড়ো গ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর সময়কাল ১৭১২-১৭৬০ খ্রিস্টাব্দ। তিনি ছিলেন নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সভাকবি।অন্নদামঙ্গল কাব্যটি রচনার জন্যে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় ভারতচন্দ্র রায়কে অত্যন্ত খুশি হয়ে মূলাজোড় গ্রাম ইজারা দেন। অন্নদামঙ্গল কাব্যে হিমালয় নন্দিনী উমা ভিক্ষুক রূপী শিবকে অন্ন দান করেন। জগতের পিতা মহেশ্বরকে অন্ন প্রদান করাতেই তিনি অন্নপূর্ণা রূপে পূজিতা। বেদে বলা আছে, অন্নই ব্রহ্ম। অন্নকে ত্যাগ করে কিছুই হয় না। এই অন্নব্রহ্মরূপেরই অধিশ্বরী হলেন দেবী অন্নপূর্ণা। ‘জীব স্বরূপতঃ শিব’- তাই জীবকে অন্ন প্রদান করাই হল শিবকে অন্নদানের সমতুল্য। অন্নহীনকে অন্নদানই অন্নপূর্ণার প্রকৃত পূজা।
কবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর তাঁর অন্নদামঙ্গল কাব্যে নাটকীয় ভঙ্গিতে অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী হিসেবে দেবী অন্নপূর্ণার মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন। এই বর্ণনা রীতিতে ভাষায় অসাধারণ প্রয়োগ করেছেন কবি। তিনি এই কাব্যে দেবীর আত্মপরিচিতি অংশে অত্যন্ত সফলতার সাথে দ্ব্যর্থবোধক শব্দের ব্যবহার করেছেন। সেখানে প্রত্যেকটি শব্দই দু'টি বা এর অধিক অর্থ প্রকাশ করে। শব্দশক্তি সাধারণত তিন প্রকার। যথা: অভিধা, ব্যঞ্জনা এবং লক্ষণা। অভিধা হলো কোন শব্দের আভিধানিক অর্থ। ব্যঞ্জনা হলো কাব্যে কোন বিশেষ আলঙ্কারিক প্রয়োগের মাধ্যমে যে শব্দের প্রয়োগ করা হয় তা। সর্বশেষ হলো লক্ষণা অলঙ্কার। অর্থাৎ বলা হয়েছে একটি বিষয়ে, কিন্তু সেই বলা বিষয়ের ঝোঁক অন্যদিকে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি সহজ হবে। কোন ঘোড়ার দৌড়ে বিভিন্ন রঙের অনেক ঘোড়া দৌড়াচ্ছে। এরমধ্যে সবচে এগিয়ে লাল রঙের ঘোড়াটি। তখন কেউ যদি বলে, "লালটির সাথে কেউ দৌড়ে পারবে না; লালটা নিশ্চিত দৌড়ে প্রথম হবে"। এখানে ব্যক্তিটি লাল বলতে শুধু লাল রঙকে বোঝায়নি। সে লাল বলতে, লাল ঘোড়াকে বুঝিয়েছে। কোন সাহিত্যকে সেই সাহিত্যের একটি নিজস্বতার আলোকেই দেখতে হবে। তবেই সেই সাহিত্য ফলপ্রসূ হবে। আমরা অধিকাংশই এদেশীয় সাহিত্য, সংস্কৃতিকে বিদেশীয় দৃষ্টিতে দেখি। তাই এদেশীয় সাহিত্যের অন্তর্নিহিত স্বভাবটি ধরতে পারি না। শুধুই মোটাদাগে বৃথাই আমরা প্রয়াস করি।
দেবী অন্নপূর্ণা অচিন্ত্য আদ্যাশক্তি মহামায়া। তাঁর কোন সুনির্দিষ্ট মূর্তি নেই। এর পরেও সাধকের কল্যাণের জন্যে তিনি বিবিধ মূর্তিতে প্রকাশিত হয়ে রূপধারিণী হয়ে দৃশ্যমান হন। যোগ্য সাধক এবং যোগ্য অধিকারীকে কখনো কখনো মূর্তিমান হয়ে দর্শনই দেন। এ সকলই তাঁর লীলা। তিনিই মহামায়া হয়ে জীবকে মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ করেন, আবার তিনিই জীবকে মুক্ত করেন। তিনিই জীবকে অন্নপূর্ণা হয়ে অন্নদান করেন, এতে জীব বেঁচে থাকে। আবার তিনিই প্রলয়কালে কালীরূপে জীবকে গ্রাস করেন। সেই আদ্যাশক্তি মহামায়া ঈশ্বরী পাটনী এবং ভবানন্দ মজুমদারকে কৃপা করতে একজন নারীর রূপ ধারণ করে গঙ্গার তীরে উপস্থিত হন। তিনি গঙ্গার তীরে এসে উচ্চস্বরে আমাকে পার কর বলে চিৎকার করতে থাকেন। স্ত্রীকণ্ঠ শুনে খেয়াপাড়ের মাঝি ঈশ্বরী পাটনি এগিয়ে আসেন। তিনি দেখলেন একজন অসহায় নারী পাড় হতে, নদীতীরে উপস্থিত। তিনি সেই একাকী নারীকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনার বেশভূষা দেখে মনে হচ্ছে আপনি কোন সম্ভ্রান্ত কুলের বধূ। আপনি কে? যদি আপনি আপনার পরিচয় না দেন, তবে আপনাকে আমি নদী পাড় করতে পারবো না। ভয় হয় যে, উপকার করতে গিয়ে, পরবর্তীতে বিপদে পড়ে যেতে পারি।
অন্নপূর্ণা উত্তরিলা গাঙ্গিনীর তীরে।
পার কর বলিয়া ডাকিলা পাটুনীরে।।
সেই ঘাটে খেয়া দেয় ঈশ্বরী পাটুনী।
ত্বরায় আনিল নৌকা বামাস্বর শুনি।।
ঈশ্বরীরে জিজ্ঞাসিল ঈশ্বরী পটলী।
একা দেখি কুলবধূ কে বট আপনি।।
পরিচয় না দিলে করিতে নারি পার।
ভয় করি কি জানি কে দিবে ফেরফার।।
ঈশ্বরী দ্বিধাগ্রস্ত হলেন। দেবীতো সদা সত্যে প্রতিষ্ঠিত। তিনি তো কখনো মিথ্যার আশ্রয় নিতে পারবেন না। পক্ষান্তরে আবার তিনি মিথ্যা কথাও বলতে পারবেন না। দেবী অন্নপূর্ণা কুলবধূ রূপ ধারণ করে আছেন। তাই তিনি তাঁর আত্মপরিচয় দিতে দ্ব্যর্থবোধক শব্দের আশ্রয় নিয়ে ঈশ্বরী পাটনিকে নিজের পরিচয় প্রদান করলেন। স্বামীর নাম যেহেতু স্ত্রীরা উচ্চারণ করে না, তাই তিনি বিশেষণে সবিশেষ আত্মপরিচয় দিলেন।
ঈশ্বরীরে পরিচয় কহেন ঈশ্বরী।
বুঝহ ঈশ্বরী আমি পরিচয় করি।।
বিশেষণে সবিশেষ কহিবারে পারি।
জানহ স্বামীর নাম নাহি ধরে নারী।।
দেবী অন্নপূর্ণা দুঃখিত বদনে আত্মপরিচয় দিতে শুরু করলেন। সেখানে তিনি যা বললেন এর আভিধানিক অর্থ মাঝি গ্রহণ করলো। মাঝির উপলব্ধিতে সেই কথাগুলোর অর্থ হলো:
এই একাকী অসহায় নারীর পিতা 'মুখবংশজাত', অর্থাৎ মুখোপাধ্যায় বংশের। তাঁর স্বামী অত্যন্ত কুলিন বংশীয় 'বন্দ্যবংশখ্যাত'; অর্থাৎ স্বামী কুলীন বংশীয় বন্দ্যোপাধ্যায় বংশের। তাঁর অন্নপূর্ণা নাম দিয়েছে তার পিতার পিতা পিতামহ। তাঁর স্বামীর একাধিক স্ত্রী রয়েছে। তাই তাঁর প্রতি সর্বদাই বিরূপভাব প্রকাশ করে, তাঁকে আদর করে না। তাঁর স্বামী বয়সেও বৃদ্ধ। সারাদিন বিভিন্ন সিদ্ধি ভাং খেয়ে মাতলামি করে বেড়ায়। স্বামীর কোন গুণ তো নেই, বরং কপালে আগুন থাকায় সারাদিন সকলের সাথে দুর্ব্যবহার করে। কুকথা এবং অশ্লীল কথা ছাড়া সে কথাই বলতে পারে না। সারাক্ষণ তাঁর মুখে কুকথাই শোভা পায়। স্ত্রীর সাথে তাঁর চলে দিনরাত্রি দ্বন্দ্ব। তাঁর স্বামী অনেক স্ত্রীর মধ্যে গঙ্গা নামের স্ত্রীকে বেশি ভালোবাসে। সেই গঙ্গাকে পারলে সবকিছুই দিয়ে দেয়। অতিরিক্ত প্রশ্রয় এবং ভালোবাসায় গঙ্গাও কম যায় না; সে স্বামীর শিরোমণি হয়ে সর্বদা স্বামীর মাথায় বসে থাকে। স্বামী তাঁর পেশায় তান্ত্রিক, ভুতপ্রেত ঘরে ঘরে সারাক্ষণ নাচিয়ে বেড়ানোই তাঁর কাজ। তাঁর পিতার হৃদয়টি পাথরের মত কঠিন, তাই সে জেনে-বুঝে মেয়েকে এমন স্বামীর কাছে বিয়ে দিয়েছে।অভিমান সমুদ্রে ঝাপ দিয়ে, তাঁর হৃদয় আজ দুঃখ বেদনায় ভারাক্রান্ত। তাই যে তাঁকে আপন মনে করে ভালোবাসে সে শুধু তার কাছেই যায়।
গোত্রের প্রধান পিতা মুখবংশজাত।
পরমকুলীন স্বামী বন্দ্যবংশখ্যাত।।
পিতামহ দিলা মোরে অন্নপূর্ণা নাম।
অনেকের পতি তেঁই পতি মোর বাম।।
অতি বড় বৃদ্ধ পতি সিদ্ধিতে নিপুণ।
কোন গুণ নাহি তাঁর কপালে আগুন।।
কুকথায় পঞ্চমুখ কন্ঠভরা বিষ।
কেবল আমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ।।
গঙ্গা নামে সতা তার তরঙ্গ এমনি।
জীবনস্বরূপা সে স্বামীর শিরোমণি।।
ভূত নাচাইয়া পতি ফেরে ঘরে ঘরে।
না মরে পাষাণ বাপ দিলা হেন বরে।।
অভিমানে সমুদ্রেতে ঝাঁপ দিলা ভাই।
যে মোরে আপনা ভাবে তারি ঘরে যাই।।
একাকী কুলবধূরূপ দুঃখের কথা শুনে ঈশ্বরী পাটুনীর মন ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। তখন পাটুনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি পঙক্তি বলে। যে পঙক্তিটিও আজ বাংলা ভাষায় প্রবাদবাক্যের মতই ব্যবহৃত হয়। তিনি নদী পাড় হতে আসা একাকী নারীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন- যেখানেই কুলীন জাতি, সেখানেই কোন্দল। আমরাও দেখি ঝগড়াবিবাদ সমাজের উচ্চ শ্রেণীর শহুরে নাগরিক জীবনে অভ্যস্তদের মধ্যেই বেশি। গ্রাম এলাকায় দেখা যায়, পাড়াপ্রতিবেশি নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি করবে, মারামারি করবে, চুলাচুলি করবে ; আবার পরক্ষণেই একে অন্যের বিপদে ঝাপিয়ে পড়বে। সকল পরিচয় পেয়ে আস্বস্ত হয়ে পড়ে ঈশ্বর পাটুনী দেবীকে নদী পারি দিতে নৌকা ছেড়ে দেয়। সহজ, সরল মাঝি জানে না আজ তাঁর কতভাগ্য।
পাটুনী বলিছে আমি বুঝিনু সকল।
যেখানে কুলীন জাতি সেখানে কন্দল।।
শীঘ্র আসি নায়ে চড় দিবা কিবা বল।
দেবী কন দিব আগে পারে লয়ে চল।।
জন্মজন্মান্তরে সুকৃতির ফলে এমন সৌভাগ্য আসে মানুষের জীবনে। যার শুধু নামেই এ ভবসিন্ধু পাড়ি দেয়া যায়, তিনিই কিনা এসেছে নদী পারি দিতে। ঈশ্বরী পাটুনির আজ কত সৌভাগ্য। ভবসিন্ধু পাড়ি দিয়ে সকল জীবের যিনি একমাত্র লক্ষ্য, সেই তিনিই লীলার বশে আজ সামান্য নদী পাড়ি দিতে এসেছেন ঈশ্বরীর নৌকায়। বিষয়টি উপলব্ধি করে ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর বলেন:
যার নামে পার করে ভবপারাবার ।
ভাল ভাগ্য পাটুনী তাহারে করে পার।।
নৌকায় উঠে দেবী অন্নপূর্ণা নৌকার বাড়ানো অংশে নদীর উপরে পা ঝুলিয়ে বসলেন। তৎক্ষণাৎ সেই পায়ের নিচে নদীর জল থেকে একটি লাল পদ্মফুল ফুটে উঠলো। ঈশ্বরী খেলাল কিরলো না বিষয়টি। সে তখন নৌকায় পা তুলে দেবীকে বসতে বলে। গঙ্গায় প্রচুর কুমিরের উৎপাদ। তাই তুলে না বসলে কুমির যে কোন সময়ে পা টান দিয়ে নদীতে নিয়ে যেতে পারে।
বসিলা নায়ের বাড়ে নামাইয়া পদ।
কিবা শোভা নদীতে ফুটিল কোকনদ।।
পাটুনী বলিছে মা গো বৈস ভাল হয়ে।
পায়ে ধরি কি জানি কুমীরে যাবে লয়ে।।
পাটুনীর কথা শুনে দেবী বলেন, তোর সারা নৌকা ভর্তি জল। সেই জলে আমার পা রাখার সামান্য স্থানও নেই। এই জলে যদি আমি পা রাখি, তবে আমার পায়ের আলতা ধুয়ে যাবে। দেবীর কথা শুনে ঈশ্বরী পাটুনী তখন দেবীর রাঙা পা জল সেঁচার কাঠের সেঁউতীর উপরে রাখতে বলেন।
ভবানী কহেন তোর নায়ে ভরা জল।
আলতা ধুইবে পদ কোথা থুব বল।।
পাটুনী বলিছে মাগো শুন নিবেদন।
সেঁউতী উপরে রাখ ও রাঙ্গা চরণ।।
পাটুনীর কথায় দেবী মৃদু হেসে কাঠের সেঁউতী উপরে পা রাখলেন। ভারতচন্দ্র রায় বর্ণনা করছেন, আহা ঈশ্বরী পাটনী এবং তাঁর নৌকার কত ভাগ্য! ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ইন্দ্র, চন্দ্র যে চরণের সর্বদা ধ্যান করে; যে চরণ হৃদয়ে ধারণ করে ভুতনাথ শিব মাটিতে লুটিয়ে পরে; সেই অচিন্ত্য চরণকমলদ্বয় রাখলেন দেবী নৌকার সেঁউতী উপরে। দেবীর ইচ্ছাতেই সকল কর্ম সাধিত হয়, তাই তাঁর নাম ইচ্ছাময়ী তাঁরা। অনন্ত জপ, তপেও জীব মুক্ত হয় না ; যদি দেবীর ইচ্ছা না হয়। কাঠের সেঁউতী উপরে দেবী তাঁর চরণদ্বর রাখার সাথে সাথেই, তা সোনার কাঠের থেকে সোনার সেঁউতী হয়ে গেলো। চোখের সামনে এভাবে কাঠের সেঁউতীকে সোনার হতে দেখে মাঝি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলো। সে বুঝতে পারলো, এ কোন সাধারণ নারী নয়; নিশ্চয়ই কোন দেবী।
পাটুনীর বাক্যে মাতা হাসিয়া অন্তরে।
রাখিলা দুখানি পদ সেঁউতী উপরে।।
বিধি বিষ্ণু ইন্দ্র চন্দ্র যে পদ ধেয়ায়।
হৃদে ধরি ভূতনাথ ভূতলে লুটায়।।
সে পদ রাখিলা দেবী সেঁউতী উপরে।
তাঁর ইচ্ছা বিনা ইথে কি তপ সঞ্চরে।।
সেঁউতীতে পদ দেবী রাখিতে রাখিতে।
সেঁউতী হইল সোনা দেখিতে দেখিতে।।
সোনার সেঁউতী দেখি পাটুনীর ভয়।
এ ত মেয়ে মেয়ে নয় দেবতা নিশ্চয়।।
ভয়ে ভয়ে নদী পাড়ি দিয়ে ঈশ্বরী পাটুনী নৌকা তীরে উত্তরিলো। হাসিমুখে নৌকা থেকে নেমে দেবী মুখে কিছু না বলেই কোন দিকে না তাকিয়ে পূর্বদিকে হাতির মত গজগামিনী ভঙ্গিতে এগিয়ে যেতে থাকলো। ভয়ে ভয়ে পাটুনী সোনার সেঁউতীটিকে বুকের সাথে জড়িয়ে দেবীর পিছে পিছে এগিয়ে যেতে থাকে।দেবী তখন পেছনে ফিরিয়া তাকান। ঈশ্বরী পাটনী আনন্দে, বিস্ময়ে এবং ভয়ে কাঁদতে থাকেন। তাঁর দুচোখ থেকে অশ্রু বইতে থাকে। ভয়ে ভয়ে পাটুনী বলে, আমি জানি তুমি ছল করে তোমার পরিচয় দিয়েছ। তা না হলে আমার কাঠের সেঁউতী কি করে তোমার চরণ রাখার সাথে সাথেই সোনার হয়ে গেলো? আমি জানি তুমি নিশ্চই কোন দেবী। হে দেবী, যখন দেখাই দিয়েছ তখন দয়া করে তোমার পরিচয়টুকু দাও। তপ, জপ ধ্যান, জ্ঞান কিছুই আমার নেই; এরপরেও তুমি আমাকে দেখা দিয়েছ। এ তোমার অহৈতুকী দয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। যে দয়া করে তুমি আমায় দর্শন দিলে, সেই দয়া করেই তুমি আমায় তোমার পরিচয় দাও।
তীরে উত্তরিল তরি তারা উত্তরিলা।
পূর্বমুখে সুখে গজগমনে চলিলা।।
সেঁউতী লইয়া বক্ষে চলিলা পাটুনী।
পিছে দেখি তারে দেবী ফিরিয়া আপনি।।
সভয়ে পাটুনী কহে চক্ষে বহে জল।
দিয়াছ যে পরিচয় সে বুঝিনু ছল।।
হের দেখ সেঁউতীতে থুয়েছিলা পদ।
কাঠের সেউতী মোর হৈলা অষ্টাপদ।।
ইহাতে বুঝিনু তুমি দেবতা নিশ্চয়।
দয়ায় দিয়াছ দেখা দেহ পরিচয়।।
তপ জপ জানি নাহি ধ্যান জ্ঞান আর।
তবে যে দিয়াছ দেখা দয়া সে তোমার।।
যে দয়া করিল মোর এ ভাগ্য উদয়।
সেই দয়া হৈতে মোরে দেহ পরিচয়।।
ঈশ্বরী পাটনীকে তখন বাধ্য হয়েই দেবী অন্নপূর্ণা তাঁর আত্মপরিচয় প্রদান করেন। আমি দেবী অন্নপূর্ণা, আমার প্রকাশ কাশীতে। চৈত্র মাসের শুক্ল অষ্টমী তিথিতে আমার পূজা অনুষ্ঠিত হয়।তিনি বলেন পূর্ববর্তী আত্মপরিচয়ের যত কথা বলেছি, তা সকলই সত্য। তুমি ভেবে দেখ, তবেই বুঝতে পারবে। দেবী তাঁর আত্মপরিচয়কালে নিজে যে সচেতনভাবে দ্ব্যর্থবোধক শব্দের ব্যবহার করেছেন স্বীকার করে নিলেন। দেবী বলেছেন, তাঁর পিতা 'মুখবংশজাত', পাটনী মনে করেছে সে মুখোপাধ্যায় বংশের। কিন্তু দেবী 'মুখবংশজাত' বলতে বুঝিয়েছেন যে প্রজাপতি ব্রহ্মার পুত্র দক্ষের বংশজাত তিনি। যা সৃষ্টির প্রধানতম বংশ।
একইভাবে তাঁর স্বামী অত্যন্ত কুলিন বংশীয় 'বন্দ্যবংশখ্যাত' বা বন্দ্যোপাধ্যায় বংশের মনে করেছে ঈশ্বরী পাটনী। কিন্তু দেবী 'বন্দ্যবংশখ্যাত' বলতে শিবকে জীবের সদা বন্দনীয় বলে পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর থেকে শ্রেষ্ঠ আর কেউ নেই। সকল জীবের আদিপিতা তিনি, তাই তিনি পরম শ্রেষ্ঠ। পাটনী মনে করেছে, অন্নপূর্ণা নামটি তাঁর পিতার পিতা পিতামহ দিয়েছে। কিন্তু এখানে পিতামহ বলতে দেবী পিতামহ প্রজাপতি ব্রহ্মার কথা বলেছে। প্রজাপতি ব্রহ্মাই জগতে অন্নের অধিষ্ঠাত্রী হিসেবে দেবীর নাম অন্নপূর্ণা রাখেন। পাটনী ভেবেছে তাঁর স্বামীর একাধিক স্ত্রী রয়েছে।কিন্তু দেবী সকলের পতি বলতে, শিব যে জগতের পতি এই বিষয়টিই বুঝিয়েছেন। "পতি মোর বাম" বলতে পাটুনী ভেবেছে তাঁর স্বামী সর্বদাই বিরূপভাব প্রকাশ করে, তাঁকে আদর করে না। কিন্তু দেবী বুঝিয়েছেন, তিনি শিবের প্রকৃতি রূপা বাম অংশ।এই পুরুষ এবং প্রকৃতির মিলনেই জগতের উৎপত্তি। "অতি বড় বৃদ্ধ পতি" দেবীর মুখে এই বাক্য শুনে ঈশ্বরী পাটনী ভেবেছে তাঁর স্বামী বুঝি বয়সে অনেক বৃদ্ধ। কিন্তু দেবী বলেছেন, শিব যেহেতু আদিনাথ এবং আদিযোগী। সৃষ্টির পূর্ব থেকেই তিনি বর্তমান। তাই জগতে শিবের থেকে বৃদ্ধ আর কে বা থাকবে? ঈশ্বরী পাটনী "সিদ্ধিতে নিপুণ" শুনে ভেবেছে, সারাদিন বিভিন্ন সিদ্ধি ভাং খেয়ে তাঁর স্বামী মাতলামি করে বেড়ায়। কিন্তু শিব জীবের সকল অভীষ্ট সিদ্ধি প্রদান করে, তাই তিনি সিদ্ধিদানে নিপুণ। শিব সাত্ত্বিক, রাজসিক এবং তামসিক এ ত্রিগুণের অতীত। তিনি সাধারণ মনুষ্যের মত ত্রিগুণ দ্বারা আছন্ন নন। তাই বলা হয়েছে, তাঁর কোন গুণ তো নেই। কপালে আগুন কথাটি শুনে পাটুনী ভেবেছে তাঁর স্বামী বুঝি সর্বদা সকলের সাথে দুর্ব্যবহার করে। কিন্তু দেবী অন্নপূর্ণা কপালে আগুন বলতে শিবের ললাটনেত্রকে বুঝিয়েছেন। "কুকথায় পঞ্চমুখ" এই কথা শুনে পাটুনী ভেবেছে তাঁর স্বামী সর্বদা কুকথা এবং অশ্লীল কথা বলে বেড়ায়। কিন্তু 'কু' শব্দের অর্থ পৃথিবী, অর্থাৎ পৃথিবী যাঁর কথায় পঞ্চমুখ। কুকথা শব্দটির আরেকটি অর্থ হয় যে, আগম- নিগম প্রতিপাদ্য বিদ্যা। অর্থাৎ বেদ-বেদাঙ্গ শাস্ত্র যাঁর কথায় পঞ্চমুখ। "আমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ" বলতে সৃষ্টি প্রক্রিয়ার দ্বন্দ্ব এবং মিলনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পাটুনী ভেবেছে, দিনরাত্রি বুঝি স্বামী স্ত্রীর দ্বন্দ্ব হয়। পাটুনী ভেবেছে, তাঁর স্বামী অনেক স্ত্রীর মধ্যে গঙ্গা নামের স্ত্রীকে বেশি ভালোবাসে। কিন্তু দেবী এখানে বুঝিয়েছেন, গঙ্গা পতিতপাবনী তাঁরই আরেকটি রূপ। তাই শিবের প্রিয় কাশীক্ষেত্রও গঙ্গা তীরে অবস্থিত। হিমালয়কে শিবের জটার সাথে তুলনা করা হয়। আর এই হিমালয়ের গোমুখ উৎসমুখ থেকেই নেমে আসছে পতিতপাবনী গঙ্গা। মনে হয় যেন শিবের জটা থেকেই কুলকুল ধ্বনিতে সমতল ভূমিতে নেমে আসছে। যেহেতু গঙ্গা শিবের জটার আকৃতির হিমালয় পর্বত থেকে নেমে আসছে, তাই গঙ্গাকে স্বামীর শিরোমণি বলে অবিহিত করা হয়েছে। ভুত শব্দের অর্থ জীব। সকল জীবের অধীশ্বর শিবকে তাই ভূতনাথ বলা হয়। ভুত নাচানোর কথা শুনে ঈশ্বরী পাটনী ভেবেছে, তাঁর স্বামীর পেশা তান্ত্রিকতা করা। যিনি ভুতপ্রেত ঘরে ঘরে সারাক্ষণ নাচিয়ে বেড়ায়। কিন্তু ভুত নাচানোর কথা বলতে দেবী বুঝিয়েছেন যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল জীবের স্পন্দন তিনি। তাঁর স্পন্দনেই সকল জীব সচল থাকে। তাঁর পিতার হৃদয়টি পাথরের মত কঠিন বলতে দেবী বুঝিয়েছেন, যে তিনি দক্ষরাজ হিমালয়ের কন্যা।এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করে সেই সৃষ্টির প্রত্যেকটি অণু পরমাণুতেই আদ্যাশক্তির শক্তি বিরাজত। "সমুদ্রেতে ঝাঁপ দিলা" বলতে দেবী বুঝিয়েছেন, তিনি এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করে তিনি নিজেই সেই সৃষ্টির সমুদ্রে ঝাপ দিয়েছেন। জগতের মাতা জগন্মাতা তিনি, তাই জগতের কোন জীবের কাছেই শুধু ভক্তি ছাড়া তিনি কিছুই প্রত্যাশা করেন না। তাই আপন মনে করে যে দেবীকে একাগ্রচিত্তে স্মরণ করে এবং ভালোবাসে অচিন্ত্য দেবী তাঁর কাছেই প্রকাশিত হন। দেবী শুধুই ভক্তি ভালোবাসাতেই বদ্ধ হন।
ছাড়াইতে নারি দেবী কহিলা হাসিয়া।
কহিয়াছি সত্য কথা বুঝহ ভাবিয়া।।
আমি দেবী অন্নপূর্ণা প্রকাশ কাশীতে।
চৈত্র মাসে মোর পূজা শুরু অষ্টমীতে।।
দেবী অন্নপূর্ণা বললেন তিনি কোন্দল পছন্দ করেন না। এই কোন্দলের কারণে তিনি হরিহোড়ের নিবাস পরিত্যাগ করে ভবানন্দের নিবাসে যাচ্ছেন। বিদায় বেলায় দেবী ঈশ্বরী পাটনীর উপরে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে যেকোন বর প্রার্থনা করতে বললেন।
কত দিন ছিনু হরিহোড়ের নিবাসে।
ছাড়িলাম তার বাড়ী কন্দলের ত্রাসে।।
ভবানন্দ মজুন্দার নিবাসে রহিব।
বর মাগ মনোনীত যাহা চাহ দিব।।
দেবীর স্বেচ্ছায় বরদানের বাক্যে পাটুনী অনেক কিছুই চাইতে পারতেন দেবীর কাছে। তিনি জগতের সকল ধনসম্পত্তি চাইতে পারতেন অথবা তিনি রাজা হওয়ার বরদান চাইতে পারতেন। কিন্তু তিনি চাইলেন তাঁর সন্তানেরা যেন সামান্য দুধভাত খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে। ঈশ্বরী পাটুনী জোড়হাতে দেবীকে প্রণাম করে, তাঁর সন্তানেরা যেন দুধভাত বেঁচে থাকতে পারে এই বরদান চাইতেই দেবী 'তথাস্তু' বলে তাতে সম্মতি দিলেন। দেবীর বর আনন্দিত মনে নৌকা ঘাটের দিকে ফিরে যেতে থাকে। হঠাৎ করে পিছনে ফিরে দেখে কেউ নেই। দেবী অদৃশ্য হয়ে গেছে। পাটুনী বুঝতে পারে দেবীর নৌকায় পাড়ি দেয়া তাঁকে কৃপা করার জন্যেই। এই ভেবে পাটুনীর চোখ দিয়ে দরদর করে আনন্দাশ্রু বয়ে যেতে থাকে।
প্রণমিয়া পাটুনী কহিছে যোড় হাতে।
আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।।
তথাস্তু বলিয়া দেবী দিলা বরদান।
দুধে ভাতে থাকিবেক তোমার সন্তান।।
বর পেয়ে পাটুনী ফিরিয়া ঘাটে যায়।
পুনর্বার ফিরি চাহে দেখিতে না পায়।।
সাত পাঁচ মনে করি প্রেমেতে পুরিল।
মাঝি এসে সকল ঘটনা ভবানন্দ মজুমদারকে বলে। তাঁকেও যে দেবী অন্নপূর্ণা কৃপা করতে নদী পাড়ি দিয়েছেন, একথা সবিস্তারে বললেন। কিন্তু ঈশ্বরী পাটনীর কথায় ভবানন্দ মজুমদার প্রথমে বিশ্বাস করতে পারলেন না। তিনি ঘটনাটি অবিশ্বাস্য মনে করলেন। কিন্তু পরক্ষণেই যখন সোনার সেঁউতীটি দেখলেন, তখন তিনি বুঝতে পারলেন দিন আনে দিন খায় দরিদ্র সামান্য মাঝির কাছে সোনার সেঁউতী কখনই থাকার কথা না। তিনি তখন তাঁর ভুল বুঝতে পেরে এবং দেবীর মহিমা উপলব্ধি করে ভাবে বিহ্বলিত হয়ে পড়েন।
ভবানন্দ মজুন্দারে আসিয়া কহিল।।
তার বাক্যে মজুন্দারে প্রত্যয় না হয়।
সোনার সেঁউতী দেখি করিলা প্রত্যয়।।
সংস্কৃত সাহিত্য সহ ভারতবর্ষীয় অধিকাংশ সাহিত্যই এমনি দ্ব্যর্থবোধক শব্দে লেখা। যেন যোগ্য অধিকারী বিহীন কেউ বুঝতে না পারে। কারণ অধিকারী বিহীন বিদ্যা কখনও ফলবতী হয় না।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁