নিজস্ব সংস্কৃতি এবং ভাষা যত বেশি চর্চা এবং পরচর্যায় উপরেই স্থায়িত্ব পায়। যে সংস্কৃতি যত বেশি দৃশ্যমান তাকে বিজাতীয় সংস্কৃতি দ্রুতই গ্রাস করে গলাধঃকরণ করে নেয়। কিন্তু সংস্কৃতির উপাদানটি যদি প্রতিদিনের চর্চায় থাকে, তবে কখনই বৈদেশিক সংস্কৃতি গ্রাস করতে পারে না। বৈদেশিক সংস্কৃতির মধ্যে কিছু সংস্কৃতি আগ্রাসী তাদের দুটি পদ্ধতি প্রয়োজন। হয় সেই সকল আগ্রাসী বৈদেশিক সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন করতে হবে। অথবা নিজস্ব শক্তিশালী সংস্কৃতির প্রভায় বৈদিক সংস্কৃতিতে ম্লান করে ঢেকে দিতে হবে। ভাষার কাজ প্রবাহমানতা। প্রতিদিনই ভাষায় নিত্যনতুন শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে। যে কোন ভাষাই যেকোন ভাষা থেকে শব্দ গ্রহণ করতে পারে। এতে খুব একটা বেশি ক্ষতি নেই। কিন্তু সমস্যা হয় তখন, যখন কোন ভাষা অপ্রয়োজনীয়ভাবেই অন্য ভাষা থেকে শব্দ গ্রহণ করে। অর্থাৎ বলতে গেলে সচেতনভাবে করে। এই গ্রহণে যতটা না প্রয়োজন, এর থেকে ঢেরবেশি রাজনৈতিক কারণ।
সকালের প্রথম আহার অর্থে বাংলা ভাষায় একটি শব্দ প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবহৃত, সেই পুংলিঙ্গবাচক শব্দটি হল 'প্রাতরাশ'। শব্দটি সংস্কৃত 'প্রাতঃ', অর্থাৎ সকালবেলা এবং ভোজনার্থক 'আশ' (√অশ্+অ) এ শব্দদুটির পরস্পর সন্ধিতে নিষ্পন্ন। এ প্রাতরাশ শব্দটি রামায়ণেও ব্যবহৃত হয়েছে। শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণে ব্যবহৃত হয়েছে। এবং বিভিন্ন মনুসংহিতা, বিষ্ণুসংহিতা সহ বিবিধ স্মৃতিশাস্ত্রেও ব্যবহৃত হয়েছে। আমাদের পরম্পরার সাথে শব্দটি থাকার পরেও আমরা বর্তমানে সকালে খাওয়া অর্থে 'নাশতা' শব্দটি ব্যবহার করছি। এর মূল শব্দ ফারসি 'নাশ্ তা' শব্দটি। যার বাংলা অর্থ প্রাতরাশ বা সকালের খাবার। শব্দটি বাংলায় আমরা এতটা ব্যবহার করছি যে, ফারসি 'নাশ্ তা' থেকে শব্দটি 'নাশতা' হয়ে বর্তমানে আমাদের কাছে শব্দটি 'নাস্তা' শব্দে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। এই 'নাস্তা' শব্দটিও তার শুধু সকালে খাওয়া অর্থকে সম্প্রসারিত করে বিকালবেলার খাওয়া সহ বিভিন্ন সময়ের খাওয়া অর্থেই বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে তো গৃহে অতিথি আসলেই নাস্তার জন্যে ব্যতিব্যস্ত হয়ে যায়। অথচ নাস্তা অর্থে শুধুই সকালের খাবার। সকল সময়েই অতিথিকে আপ্যায়নেই নাস্তা শব্দটি ব্যবহৃত হয়।
অশোকবনে বন্দী সীতাকে প্রলুব্ধ করার জন্যে অনেক প্রচেষ্টা করে রাবন। রাবনের নোংরা প্রস্তাবে ক্ষুদ্ধ হয়ে সীতা বলেন, পদ্মাবনে পদ্মফুলে রাজহংসের সঙ্গে সর্বদা ক্রীড়ারতা হংসী তৃণের মধ্যে অবস্থিত জলকাকের (পানকৌড়িকে) দিকে কখনো ফিরেও তাকায় না। দেবী সীতা নিশাচর রাবনকে উদ্দেশ্য করে আরও বলেন, তাঁকে শারীরিকভাবে বেঁধে রাখতে বা হত্যা করতে উদ্যত হলেও, সে এমন কোন কর্ম করবে না যাতে জগতে তাঁর নিন্দা হয়। সীতার এমন রোমহর্ষক নির্ভীক কঠোর বাক্য নিশাচর রাবন সীতাকে ভয় দেখিয়ে প্রত্যুত্তরে বলল:
শৃণু মৈথিলি মদ্বাক্যং মাসান্ দ্বাদশ ভামিনি৷।
কালেনানেন নাভ্যেষি যদি মাং চারুহাসিনি।
ততত্ত্বাং প্রাতরাশার্থং সূদাশ্ছেৎস্যন্তি লেশশঃ ৷৷
(রামায়ণ: অরণ্যকাণ্ড, ৫৬.২৪-২৫)
‘হে সুহাসিনি মিথিলা রাজনন্দিনি ! আমার শেষ কথা শোনো। বারো মাস সময় দিলাম, এই সময়ের মধ্যে যদি তুমি আমার কাছে না আসো, তাহলে হে কোপনশিলে ! আমার প্রাতঃরাশের জন্য পাচকেরা তোমার দেহকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলবে।'
সীতার মনের মতো মধ্যে ভীতির সঞ্চার করার জন্যেই ক্রুদ্ধ রাবণ সীতার প্রতি এইরকম কর্কশ কথা বলে, তারপর রক্ষীদের এই কথা বলে। অর্থাৎ তোমাকে তোমাকে একবছর সময় দিলাম যদি এর মধ্যে আমার কথা শুনে আমার কাছে না আসো তবে আমি রান্না করে তোমাকে খেয়ে ফেলবো -এ ছিলো রাবনের কামার্ত অসহায় মনের কথা। অরণ্যকাণ্ডের পরে সুন্দরকাণ্ডে গিয়ে রাবনের সীতাকে কেটে খেয়ে ফেলার হুমকি আরও একবার পাওয়া যায়। পূর্বে সে সীতাকে সময় দিয়েছিলো বারো মাসের, কিন্তু এবার সে সীতাকে সময় দেয় মাত্র দুইমাসের। এই দুইমাসের মধ্যেই বিয়ে করতে হবে বলে সীতাকে সময় বেঁধে দেয়। সাথে বলে দেয়, কথা না শুনলে তাঁর ঘরের সূপকার বা রাধুনিরা সীতাকে কেটে টুকরোটুকরো করে রাবনের সকালের প্রাতরাশ বানিয়ে ফেলবে।
দ্বৌ মাসৌ রক্ষিতব্যৌ মে যোঽবধিস্তে ময়া কৃতঃ।
ততঃ শয়নমারোহ মম ত্বং বরবর্ণিনি।।
দ্বাভ্যামূর্ধ্বং তু মাসাভ্যাং ভর্তারং মামনিচ্ছতীম্।
মম ত্বাং প্রাতরাশার্থে সূদাশ্ছেৎস্যন্তি খণ্ডশঃ৷৷
(রামায়ণ: সুন্দরকাণ্ড, ২২.৮-৯)
"আমি তোমার জন্য দুই মাস পর্যন্ত যে সময়-সীমা নির্দিষ্ট করেছি, সেটি আমাকে পালন করতে হবে। তারপর, তোমাকে আমার শয়ন-শয্যায় আসতেই হবে।
অতএব মনে রেখো- দুই মাস পর্যন্ত সময়ের পরে পতিরূপে আমাকে না চাইলে, সূপকারগণ আমার প্রাতঃরাশের জন্য তোমাকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলবে !"
বন্দী সীতাকে উদ্ধারে যখন শ্রীরামচন্দ্রের লঙ্কায় আসতে বিলম্ব হচ্ছে। রাবনের দেয়া বারোমাসের সময়কালও শেষ হয়ে যাচ্ছে দেখে, পরবর্তীতে সীতা শ্রীরামচন্দ্রের দর্শনে অস্থির হয়ে যায়। মাংসাশী রাক্ষসেরা ধর্ম সম্পর্কে জানে না, তাই তারা এমন অধর্মের আচরণ করছে। যদি ধর্ম সম্পকে তাদের সুস্পষ্ট ধারণা থাকত, তবে এ সকল অধর্মের কাজ তারা কখনই করতো না। শ্রীরামের বিরহে অস্থির সীতা, দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়। যদি রাক্ষসেরা প্রাতরাশের জন্যে কেটে খেয়ে ফেলার উদ্যোগ গ্রহণ করে, তবে তিনি নিজেই স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বরণ করে নিবেন।
ধ্রুবং মাং প্রাতরাশার্থং রাক্ষসঃ কল্পয়িষ্যতি।
সাহং কথং করিষ্যামি তং বিনা প্রিয়দর্শনম্৷৷
রামং রক্তান্তনয়নমপশ্যন্তী সুদুঃখিতা।
ক্ষিপ্রং বৈবস্বতং দেবং পশ্যেয়ং পতিনা বিনা।।
(রামায়ণ: সুন্দরকাণ্ড, ২৬.৩৫-৩৬)
"এই সকল রাক্ষস প্রাতঃরাশের জন্য নিঃসন্দেহে আমাকে অর্থাৎ আমার শরীরকে বিবেচনা করবে। প্রিয়দর্শন শ্রীরামচন্দ্রের বিহনে এইরূপ অসহায়া আমি কি করব ?
রক্তাক্তলোচন পতি শ্রীরামচন্দ্রের দর্শন না পেলে সাতিশয় দুঃখিতা আমি অতি শীঘ্রই যম-দেবকে দেখতে পাব অর্থাৎ মৃত্যু বরণ করব।"
বর্তমানেও আমরা দেখতে পাই, একজন অন্যজনের সাথে বড়মাপের ঝগড়া মারামারি হলে একে অন্যকে বলে থাকে, " তুই আমার সাথে বেশি বাড়াবাড়ি করবি না, বাড়াবাড়ি করলে তোকে কেটে টুকরোটুকরো করে জলে ভাসিয়ে দিবো।" আবার ঝগড়ার মাত্রাটি যদি একটু বেশি থাকে, তখন অনেকে বলে, তোকে কেটে লবন মরিচ দিয়ে রান্না করে খেয়ে ফেলবো।" এই যে কাউকে ভয় দেখাতে কেটে খেয়ে ফেলার হুমকি, এই হুমকিটি সকলেই বিশেষ করে বাঙালি মাত্রই কথা প্রসঙ্গে ব্যবহার করে । কিন্তু আদতে কেউ কাউকে কেটে খেয়েছে, তার কোন পরিসংখ্যান কারোই হয়ত নেই।ঝগড়াঝাটি এবং ভয় দেখাতে ফাঁকা বুলি হিসেবে আউড়াতে সকলে ব্যবহার করে।এর বাইরে, আর অন্য কিছুই নয়। কিন্তু এ বহুল ব্যবহৃত হুমকিটি যে রাবণ থেকেই এসেছে, তা আমরা হয়তো অধিকাংশ মানুষই জানি না। অথবা জানার প্রয়োজনও কোনদিন বোধ করিনি।শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধেও প্রাতরাশ শব্দটির দেখা পাওয়া যায় । ভগবান বলরাম এবং কৃষ্ণ সকালে উঠে প্রাতরাশের খাদ্যদ্রব্য সাথে নিয়ে গোচারণে চলে যেতেন। গো এবং তার বৎসদের সাথে নিয়ে তাঁরা এক বন থেকে অন্য বনে ঘুরে গোচারণ করে বেড়াতেন।
তৌ বৎসপালকৌ ভূত্বা সর্বলোকৈকপালকৌ।
সপ্রাতরাশৌ গোবৎসাংশ্চারয়ন্তৌ বিচেরতুঃ॥
(শ্রীমদ্ভাগবত:১০.১১.৪৫)
"মহারাজ পরীক্ষিৎ ! এ এক বিচিত্র লীলা! সর্বলোকের একমাত্র পালক অবতাররূপে জগতে দেহধারণ করে বলরাম এবং কৃষ্ণ হয়ে গোবৎসদের পালক হয়েছেন। তাঁরা সকাল-সকাল উঠে প্রাতরাশের জন্য খাদ্যদ্রব্য সাথে নিয়ে গোচারণে বেরিয়ে গোবৎসদের সাথে নিয়ে এক বন থেকে অন্য বনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।"
মনুসংহিতায় খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে নির্দেশনা প্রদান করতে গিয়ে প্রাতরাশ শব্দটির উল্লেখ করা হয়েছে।সেখানে বলা হয়েছে, যে সকল খাদ্য থেকে স্নেহপদার্থ তুলে নেওয়া হয়েছে সে সকল খাবার গ্রহণ করবে না। যে সকল খবারে অতিমাত্রায় তৃপ্তি জন্মে, সেই সকল খাবার অতিরিক্ত জিহ্বার তৃপ্তিতে উদর পরিপূর্ণ করে গ্রহণ করা অনুচিত।অতি প্রত্যূষে বা সন্ধ্যাবেলায় ভোজন করা উচিত নয়। আবার, সকালের প্রাতরাশে বেশী খাওয়া হয়ে গেলে, সেদিন সন্ধ্যাকালে ভোজন না করাই শরীরের জন্য উত্তম।
ন ভুঞ্জীতোদ্ধৃতস্নেহং নাতিসৌহিত্যমাচরেৎ।
নাতিপ্ৰগে নাতিসায়ং ন সায়ং প্রাতরাশিতঃ।।
(মনুসংহিতা:৪.৬২)
"যে দ্রব্যের থেকে স্নেহপদার্থ তুলে নেয়া হয়েছে, তা সে সকল খাদ্য ভোজন করবে না, অতি তৃপ্তিকর খাদ্য উদর পরিপূর্ণ করে ভোজন করবে না, সূর্যের উদয় ও অস্তকালে ভোজন করবে না। সকালের প্রাতরাশে অধিক ভোজন করলে, সেইদিন সন্ধ্যাবেলা আর ভোজন করবে না।"
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
ফেসবুক পোস্ট লিঙ্ক : 'প্রাতরাশ' বনাম 'নাশতা': শব্দদ্বয়ের তুলনামূলক আলোচনা ।
ফেসবুক পেজ লিঙ্ক : Shri Kushal Baran Chakraborty | Facebook