-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

সংখ্যালঘুর দুঃখ-যাতনা, সকলে উপলব্ধি করতে পারে না।

সামান্য একটা চায়ের দোকানে গিয়ে, চা বিস্কুট খাওয়ার পরে দোকানদারের কাছে যদি বলা হয়, ভাই একগ্লাস জল দিন তো। তবে "এক গ্লাস জল"-এ বাক্যটি শুনে দোকানদার যে দৃষ্টিতে তাকায়, এই দৃষ্টির ভাষা যিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ তিনি কোনদিনও বুঝতে পারবেন কিনা আমি ঠিক জানি না। হয়ত কালেভদ্রে  কেউ কেউ পারবেন, এর বিপরীতে অধিকাংশই বুঝতে পারেন না।বছরে একদিন দুইদিন ধর্মনিরপেক্ষ বা বাঙালিত্ব নিয়ে হয়ত রাস্তায় বা জনসভায় বক্তব্য দেয়া যায়। কিন্তু একজন সংখ্যালঘুর মনবেদনা এবং তাদের রূঢ় বাস্তবতা সম্যক উপলব্ধি করা সত্যিই যেন ধীরেধীরে অত্যন্ত দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একটি ঘটনা মনে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী একটি খাবারের হোটেলে রাতে মাঝেমধ্যে খেতে যেতাম। হোটেলের একটি ছোটছেলে নিয়মিত খাবার পরিবেশন করতো। একদিন আমি যখন ওকে খাবার খেতে খেতে একগ্লাস জল নিয়ে আসতে বললাম। ছোট্ট ছেলেটি সরল মনে বল্লো, "ও মামা আপনি হিন্দু? তবে আপনাকে দেখতে হিন্দুর মত মনে হয় না, আপনি না অনেক ভাল"। আমি ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম, হিন্দুরা যে খারাপ এটা তোমাকে কে শিখিয়েছে? ছেলেটি মাথা নিচু করে একটু মুচকি হাসি দিয়ে দূরে চলে গেল। মনে হল, সে বিষয়টি বুঝতে পেরে কিছুটা লজ্জিত।তবে ছেলেটি হয়ত কোন নেতিবাচক মনোভাব থেকে কথাগুলো বলেনি। তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাপেক্ষে সরল মনেই কথাগুলো বলেছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থার সেই ছোট্ট ঘটনাটি এখনো আমার মনে দাগ কেটে যায়।প্রসঙ্গক্রমে মাঝেমধ্যে মনে পড়ে। কারণ এ ছোট্ট ঘটনাটির মধ্যে এক নির্মম সামাজিক বাস্তবতা নিহিত রয়েছে। যা একজন সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্যক্তি সচরাচর অনুভব করতে পারবে না। যদি সেই ব্যক্তি অত্যন্ত মানবিক বোধসম্পন্ন না হয়। সংখ্যালঘুদের বেদনা উপলব্ধি করতে হলে, নিজেকে একজন সংখ্যালঘুর ভাবনা এবং মানসিকতা নিয়ে অনুভব করতে হবে। তা না হলে সে, লোকদেখানো সম্প্রীতির তত্ত্বকথা শুধুই তোতাপাখির মত মুখস্থ আউড়ে যাবে। এই তত্ত্ব তার ব্যক্তিজীবন এবং পরিবার জীবনে প্রতিফলিত হবে না। বাস্তবতা সর্বদা অধরাই থেকে যাবে। এ বিষয়টি কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার অত্যন্ত সুন্দর করে বর্ণনা করেছেন তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতায়। "চিরসুখীজন ভ্রমে কি কখন ব্যথিতবেদন বুঝিতে পারে। কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে কভূ আশীবিষে দংশেনি যারে। যতদিন ভবে, না হবে না হবে, তোমার অবস্থা আমার সম। ঈষৎ হাসিবে, শুনে না শুনিবে বুঝে না বুঝিবে, যাতনা মম।" বগুড়া শহরের নবাববাড়ি সড়কে আধুনিক বিপণিবিতান রানার প্লাজা। সেই বিপণিবিতানে  'সম্পাস ডাইন' নামে একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্ট রয়েছে।২০২১ সালের ১৯ মে বৃহস্পতিবার বিকেলে বগুড়ার দুপচাঁচিয়ার সনাতন ধর্মাবলম্বী এক তরুণী বন্ধুদের সাথে সেই রেস্টুরেন্টে খেতে আসে। তিনি ওয়েটার আনন্দীকে ফ্রাইড রাইস ও চিংড়ি কারির অর্ডার করেন। কিন্তু খাওয়ার সময় সেই ভুক্তভোগী হিন্দু তরুণী লক্ষ্য করেন চিংড়ির সঙ্গে গোমাংস মেশানো হয়েছে। সাথে সাথে তরুণীটি তীব্র প্রতিবাদ করেন। এবং ঘৃণায় তিনি বমি করে ফেলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় তরণীটি কান্নায় ভেঙে পড়ে। স্মর্তব্য যে, ধর্মান্তরিত করার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে কিছু বিকৃত মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের লক্ষ্য থাকে, ছলে বা কৌশলে হিন্দু তরুণ-তরুণীদের অমেধ্য গোমাংস খাওয়ানো। গোমাংস পরিবেশন নিয়ে রেস্টুরেন্টটির কর্তৃপক্ষের সাথে তরুণীটি একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেই ভিডিওতে তরুণীটি কাঁদতে কাঁদতে বলেন,"আমরা কি গায়ে গায়ে ট্যাগ লাগিয়ে ঘুরবো যে, আমরা হিন্দু কি মুসলিম?"  রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তরুণীটি এই নোংরামির যথাযথ উত্তর কামনা করেন। সে আরও বলে, রেস্টুরেন্টের যদি শুধুই মুসলিমদের জন্য দেয়া হত, তবে কখনই এই রেস্টুরেন্টে আসতো না। সে অর্ডার করে চিংড়ি অথচ চিংড়ির সাথে বিনামূল্যে পরিবেশন করা হয় অমেধ্য গোমাংস। তার সাথে কাজটি অত্যন্ত খারাপ হয়েছে জানিয়ে সে বলে, "আমার আসলে রুচি হচ্ছে না, আমার ভিতরটা ফেটে যাচ্ছে ভাইয়া ।বসবো না ভাই, আমি কখনোই বসবো না। আমি মাত্র বমি করে আসলাম ভাইয়া তারপর আমার মনে হচ্ছে যে...। বগুড়ার এই তরুণীটির মত এমন অনাকাঙ্ক্ষিত অভিজ্ঞতা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের সকলের জীবনেই কমবেশি আছে। প্রতিনিয়ত সমাজে ঘটা এ সকল ঘটনার অভিঘাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় দিনেদিনে হীনমন্য হয়ে যাচ্ছে।  দেশের সংখ্যালঘুদের সার্বিক অবস্থা এবং নির্যাতন প্রসঙ্গে বাংলাদেশের একটি প্রথম শ্রেণীর জাতীয় দৈনিক 'প্রথম আলো' পত্রিকার "সংখ্যালঘু নির্যাতনের পর প্রশাসন নীরব"(২৮.১২.২০১৭) -এ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এতে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, হত্যা ও নির্যাতনে বিবিধ তথ্য এবং পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়। সেখানে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালনের অভিযোগ করা হয়: "রাজনৈতিক ক্ষমতাসীন ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নিজ স্বার্থের জন্য সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, হত্যা ও নির্যাতন করছে। কিন্তু প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করেছে।সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনার বিচার না হওয়ায় এই সম্প্রদায়ের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে ও ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। এএলআরডি থেকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও উচ্ছেদের একটি সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হয়। ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ১১টি ঘটনার বিশ্লেষণ করে বলা হয়, রাজনৈতিক ক্ষমতাসীন ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নিজ স্বার্থের জন্য হামলা, হত্যা ও নির্যাতন করেছেন। প্রশাসন প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই নীরব ভূমিকা পালন করে। এসব ঘটনার বিচার না হওয়ার কারণে নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে ও ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। বেসরকারি সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) এক গোলটেবিলে ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ১১টি ঘটনার বিশ্লেষণ করে এ কথা বলা হয়। আজ বৃহস্পতিবার সকাল রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘বিশ্ব মানবাধিকার বনাম বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং আদিবাসীদের ভূমি অধিকার ও নিরাপত্তা’ শীর্ষক এই গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশ গুপ্ত। প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন, গত পাঁচ দশকে আনুমানিক ১ কোটি ১৩ লাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বী দেশান্তরিত হয়েছেন। সে হিসেবে গড়ে বছরে দেশ ছেড়েছেন ২ লাখ ৩০ হাজার ৬১২ জন। এ ছাড়া বলেন, দেশে ৫০টিরও বেশি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ‘আদিবাসী’ পরিচয়ে সাংবিধানিক স্বীকৃতি মেলেনি। জনসংখ্যা ব্যুরোর হিসেব তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশে ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমছে। সত্তরের দশকে এ দেশে ২০ দশমিক ১ শতাংশ ছিল সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। ২০১১ সালে সে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭ শতাংশে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। তিনি বলেন, ‘পার্বত্য চুক্তির অনেকগুলোর অগ্রগতি হলেও চুক্তির মূল বিষয় ভূমি অধিকারের অগ্রগতি নেই।’ বিচারহীনতার কথা উল্লেখ করে বলেন, শাস্তি যদি দৃশ্যমান না হয়, এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বিশ্বে আমরা প্রশংসিত হচ্ছি। কিন্তু সংখ্যালঘুদের বিতাড়নের চেষ্টা করে সেই দোষে দোষী হচ্ছি কি না।’ তিনি প্রশ্ন রাখেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের সময়ে এ ধরনের ঘটনা কেন ঘটবে।"  সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল অন্যদেশের  রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বিশ্বে প্রশংসিত হওয়ার সাথে সাথে নিজদেশের সংখ্যালঘুদের বিতাড়নের যে অভিযোগ করেছেন -একথাটি নির্মম সত্য। আজ সময় এসেছে সামাজিক, রাজনৈতিকসহ সকল ক্ষেত্রের মানুষদের যথাসাধ্য  সংখ্যালঘুদের বেদনা উপলব্ধি করার। তা না হলে এ দেশ জাতি কখনই এগিয়ে যেতে পারবে না। কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী  সহকারী অধ্যাপক  সংস্কৃত বিভাগ,  চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সামান্য একটা চায়ের দোকানে গিয়ে, চা বিস্কুট খাওয়ার পরে দোকানদারের কাছে যদি বলা হয়, ভাই একগ্লাস জল দিন তো। তবে "এক গ্লাস জল"-এ বাক্যটি শুনে দোকানদার যে দৃষ্টিতে তাকায়, এই দৃষ্টির ভাষা যিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ তিনি কোনদিনও বুঝতে পারবেন কিনা আমি ঠিক জানি না। হয়ত কালেভদ্রে কেউ কেউ পারবেন, এর বিপরীতে অধিকাংশই বুঝতে পারেন না।বছরে একদিন দুইদিন ধর্মনিরপেক্ষ বা বাঙালিত্ব নিয়ে হয়ত রাস্তায় বা জনসভায় বক্তব্য দেয়া যায়। কিন্তু একজন সংখ্যালঘুর মনবেদনা এবং তাদের রূঢ় বাস্তবতা সম্যক উপলব্ধি করা সত্যিই যেন ধীরেধীরে অত্যন্ত দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একটি ঘটনা মনে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী একটি খাবারের হোটেলে রাতে মাঝেমধ্যে খেতে যেতাম। হোটেলের একটি ছোটছেলে নিয়মিত খাবার পরিবেশন করতো। একদিন আমি যখন ওকে খাবার খেতে খেতে একগ্লাস জল নিয়ে আসতে বললাম। ছোট্ট ছেলেটি সরল মনে বল্লো, "ও মামা আপনি হিন্দু? তবে আপনাকে দেখতে হিন্দুর মত মনে হয় না, আপনি না অনেক ভাল"। আমি ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম, হিন্দুরা যে খারাপ এটা তোমাকে কে শিখিয়েছে? ছেলেটি মাথা নিচু করে একটু মুচকি হাসি দিয়ে দূরে চলে গেল। মনে হল, সে বিষয়টি বুঝতে পেরে কিছুটা লজ্জিত।তবে ছেলেটি হয়ত কোন নেতিবাচক মনোভাব থেকে কথাগুলো বলেনি। তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাপেক্ষে সরল মনেই কথাগুলো বলেছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থার সেই ছোট্ট ঘটনাটি এখনো আমার মনে দাগ কেটে যায়।প্রসঙ্গক্রমে মাঝেমধ্যে মনে পড়ে। কারণ এ ছোট্ট ঘটনাটির মধ্যে এক নির্মম সামাজিক বাস্তবতা নিহিত রয়েছে। যা একজন সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্যক্তি সচরাচর অনুভব করতে পারবে না। যদি সেই ব্যক্তি অত্যন্ত মানবিক বোধসম্পন্ন না হয়। সংখ্যালঘুদের বেদনা উপলব্ধি করতে হলে, নিজেকে একজন সংখ্যালঘুর ভাবনা এবং মানসিকতা নিয়ে অনুভব করতে হবে। তা না হলে সে, লোকদেখানো সম্প্রীতির তত্ত্বকথা শুধুই তোতাপাখির মত মুখস্থ আউড়ে যাবে। এই তত্ত্ব তার ব্যক্তিজীবন এবং পরিবার জীবনে প্রতিফলিত হবে না। বাস্তবতা সর্বদা অধরাই থেকে যাবে। এ বিষয়টি কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার অত্যন্ত সুন্দর করে বর্ণনা করেছেন তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতায়।
"চিরসুখীজন ভ্রমে কি কখন
ব্যথিতবেদন বুঝিতে পারে।
কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে
কভূ আশীবিষে দংশেনি যারে।
যতদিন ভবে, না হবে না হবে,
তোমার অবস্থা আমার সম।
ঈষৎ হাসিবে, শুনে না শুনিবে
বুঝে না বুঝিবে, যাতনা মম।"
বগুড়া শহরের নবাববাড়ি সড়কে আধুনিক বিপণিবিতান রানার প্লাজা। সেই বিপণিবিতানে 'সম্পাস ডাইন' নামে একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্ট রয়েছে।২০২১ সালের ১৯ মে বৃহস্পতিবার বিকেলে বগুড়ার দুপচাঁচিয়ার সনাতন ধর্মাবলম্বী এক তরুণী বন্ধুদের সাথে সেই রেস্টুরেন্টে খেতে আসে। তিনি ওয়েটার আনন্দীকে ফ্রাইড রাইস ও চিংড়ি কারির অর্ডার করেন। কিন্তু খাওয়ার সময় সেই ভুক্তভোগী হিন্দু তরুণী লক্ষ্য করেন চিংড়ির সঙ্গে গোমাংস মেশানো হয়েছে। সাথে সাথে তরুণীটি তীব্র প্রতিবাদ করেন। এবং ঘৃণায় তিনি বমি করে ফেলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় তরণীটি কান্নায় ভেঙে পড়ে। স্মর্তব্য যে, ধর্মান্তরিত করার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে কিছু বিকৃত মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের লক্ষ্য থাকে, ছলে বা কৌশলে হিন্দু তরুণ-তরুণীদের অমেধ্য গোমাংস খাওয়ানো। গোমাংস পরিবেশন নিয়ে রেস্টুরেন্টটির কর্তৃপক্ষের সাথে তরুণীটি একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেই ভিডিওতে তরুণীটি কাঁদতে কাঁদতে বলেন,"আমরা কি গায়ে গায়ে ট্যাগ লাগিয়ে ঘুরবো যে, আমরা হিন্দু কি মুসলিম?" রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তরুণীটি এই নোংরামির যথাযথ উত্তর কামনা করেন। সে আরও বলে, রেস্টুরেন্টের যদি শুধুই মুসলিমদের জন্য দেয়া হত, তবে কখনই এই রেস্টুরেন্টে আসতো না। সে অর্ডার করে চিংড়ি অথচ চিংড়ির সাথে বিনামূল্যে পরিবেশন করা হয় অমেধ্য গোমাংস। তার সাথে কাজটি অত্যন্ত খারাপ হয়েছে জানিয়ে সে বলে, "আমার আসলে রুচি হচ্ছে না, আমার ভিতরটা ফেটে যাচ্ছে ভাইয়া ।বসবো না ভাই, আমি কখনোই বসবো না। আমি মাত্র বমি করে আসলাম ভাইয়া তারপর আমার মনে হচ্ছে যে...। বগুড়ার এই তরুণীটির মত এমন অনাকাঙ্ক্ষিত অভিজ্ঞতা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের সকলের জীবনেই কমবেশি আছে। প্রতিনিয়ত সমাজে ঘটা এ সকল ঘটনার অভিঘাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় দিনেদিনে হীনমন্য হয়ে যাচ্ছে।
দেশের সংখ্যালঘুদের সার্বিক অবস্থা এবং নির্যাতন প্রসঙ্গে বাংলাদেশের একটি প্রথম শ্রেণীর জাতীয় দৈনিক 'প্রথম আলো' পত্রিকার "সংখ্যালঘু নির্যাতনের পর প্রশাসন নীরব"(২৮.১২.২০১৭) -এ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এতে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, হত্যা ও নির্যাতনে বিবিধ তথ্য এবং পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়। সেখানে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালনের অভিযোগ করা হয়:
"রাজনৈতিক ক্ষমতাসীন ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নিজ স্বার্থের জন্য সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, হত্যা ও নির্যাতন করছে। কিন্তু প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করেছে।সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনার বিচার না হওয়ায় এই সম্প্রদায়ের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে ও ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
এএলআরডি থেকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও উচ্ছেদের একটি সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হয়। ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ১১টি ঘটনার বিশ্লেষণ করে বলা হয়, রাজনৈতিক ক্ষমতাসীন ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নিজ স্বার্থের জন্য হামলা, হত্যা ও নির্যাতন করেছেন। প্রশাসন প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই নীরব ভূমিকা পালন করে। এসব ঘটনার বিচার না হওয়ার কারণে নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে ও ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
বেসরকারি সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) এক গোলটেবিলে ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ১১টি ঘটনার বিশ্লেষণ করে এ কথা বলা হয়। আজ বৃহস্পতিবার সকাল রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘বিশ্ব মানবাধিকার বনাম বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং আদিবাসীদের ভূমি অধিকার ও নিরাপত্তা’ শীর্ষক এই গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশ গুপ্ত। প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন, গত পাঁচ দশকে আনুমানিক ১ কোটি ১৩ লাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বী দেশান্তরিত হয়েছেন। সে হিসেবে গড়ে বছরে দেশ ছেড়েছেন ২ লাখ ৩০ হাজার ৬১২ জন। এ ছাড়া বলেন, দেশে ৫০টিরও বেশি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ‘আদিবাসী’ পরিচয়ে সাংবিধানিক স্বীকৃতি মেলেনি। জনসংখ্যা ব্যুরোর হিসেব তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশে ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমছে। সত্তরের দশকে এ দেশে ২০ দশমিক ১ শতাংশ ছিল সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। ২০১১ সালে সে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭ শতাংশে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। তিনি বলেন, ‘পার্বত্য চুক্তির অনেকগুলোর অগ্রগতি হলেও চুক্তির মূল বিষয় ভূমি অধিকারের অগ্রগতি নেই।’ বিচারহীনতার কথা উল্লেখ করে বলেন, শাস্তি যদি দৃশ্যমান না হয়, এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বিশ্বে আমরা প্রশংসিত হচ্ছি। কিন্তু সংখ্যালঘুদের বিতাড়নের চেষ্টা করে সেই দোষে দোষী হচ্ছি কি না।’ তিনি প্রশ্ন রাখেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের সময়ে এ ধরনের ঘটনা কেন ঘটবে।"
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল অন্যদেশের রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বিশ্বে প্রশংসিত হওয়ার সাথে সাথে নিজদেশের সংখ্যালঘুদের বিতাড়নের যে অভিযোগ করেছেন -একথাটি নির্মম সত্য। আজ সময় এসেছে সামাজিক, রাজনৈতিকসহ সকল ক্ষেত্রের মানুষদের যথাসাধ্য সংখ্যালঘুদের বেদনা উপলব্ধি করার। তা না হলে এ দেশ জাতি কখনই এগিয়ে যেতে পারবে না।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁