'নমস্কার' প্রসঙ্গে আজ আমার একটি ব্যক্তিগত স্মৃতি মনে পড়ছে। কয়েকবছর পূর্বে, সালটি ২০১৪ হবে। আমাদের চট্টগ্রামের এক অত্যন্ত সুপরিচিত দাদার সাথে আন্দরকিল্লা মোড়ে কথা বলছিলাম। তিনি চট্টগ্রামের বিভিন্ন ধর্মসভায় বক্তব্য প্রদান করেন। আমি সেই দাদার সাথে প্রায় ঘন্টাখানেক ছিলাম। সেই দাদাটি একজন ব্যস্ত মানুষ। কিছুক্ষণ পরপরেই তার মোবাইলে কল আসছিল। তিনি মোবাইলে কথা বলছিলেন। বুঝতে পারলাম যে, অধিকাংশ কলই বিভিন্ন ধর্মসভায় অংশগ্রহণের জন্য অনুরোধ। তবে মোবাইলে তার কথা বলার সময়ে একটি বিষয় লক্ষ্য করলাম যে, তিনি কারো সাথে কথা বলার সময় 'হরেকৃষ্ণ' বলে শুরু করছিলেন, অথবা মোবাইলের অপরপক্ষ থেকে হরেকৃষ্ণের উত্তরে তিনিও হরেকৃষ্ণ বলছিলেন। বুঝতে পারলাম যে মোবাইলের অপরপ্রান্তের ব্যক্তি গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের। তেমনিভাবে কারো সাথে 'জয় রাম' বলে সম্বোধন করছিলেন। সেই ব্যক্তিরা হয়ত চট্টগ্রাম কৈবল্যধাম আশ্রমের রাম ঠাকুরের শিষ্য হবে। জয় রাম বলতে তারা ভগবান শ্রীরামচন্দ্রকে নয়, তারা রাম ঠাকুরকে বোঝায়। আবার কারো সাথে 'জয় গুরু' বলে সম্বোধন করছিলেন। তারা অনুকূল ঠাকুরের সৎসঙ্গ বা গুরুবাদী কোন প্রতিষ্ঠান হবে হয়ত। কারো সাথে কথা বলার সময়ে 'জয় মা' বলে প্রতুত্তর করছিলেন। জয় মা সম্বোধন করা ব্যক্তিরা হয়ত চট্টগ্রামের কোন কালীমন্দির কমিটির নেতৃত্বস্থানীয়। তার সাথে আমার সম্প্রদায়ের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছিল। কথার ফাঁকে ফাঁকে তার এই মোবাইলে বিভিন্ন প্রকারের সম্ভাষণ দেখে, আমার একটু কৌতুহল হয়।তাই কৌতুহলের আতিশয্যে পরিশেষে আমি দাদাকে একটি ছোট্ট প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে বসলাম। দাদা, কারা এত আপনাকে বারবার কল করছে? দাদা অত্যন্ত সরল এবং ভালো মানুষ। তিনি বললেন, বিভিন্ন ধর্মসভার আয়োজকদের পক্ষ থেকে কল করছে। তিনি বুঝতে পারলেন যে, আমি তার এই বিভিন্নজনকে বিভিন্ন প্রকারের সম্ভাষণ বিষয়টি লক্ষ্য করেছি। তিনি বিষয়টি উপলব্ধি করে, একটু মৃদু হাসি দিয়ে বললেন- বুঝেনই তো যারা যাতে খুশি হয় সেটাই বলি।ঐ যে কথায় বলে না যে, দেবতা যে ফুলে সন্তুষ্ট, এই আর কি! দাদার কথা শুনে আমি বললাম, দাদা এরকম একেক জনের কাছে একেক রকম ভাবে এভাবে "ঝোলের লাউ অম্বলের কদু" হয়ে আমাদের কি লাভ? এত বিবিধ প্রকারের সম্ভাষণ না করে, আমরা তো সবাইকে আমার পূর্ব থেকে চলে আসা 'নমস্কার' বলে সম্ভাষণ করতে পারি। এবং সর্বক্ষেত্রে সবার মাঝে নমস্কারের প্রচারও করতে পারি। এই নমস্কার সম্ভাষণটি বৈদিককাল থেকে আজ পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রচলিত হয়ে আসছে। বেদের মধ্যে ঈশ্বরের কাছে অসংখ্য মন্ত্রে নমস্কার জানানো হয়েছে। ঋগ্বেদ সংহিতার প্রথম অগ্নিসূক্তের মধ্যেই অগ্নিরূপ পরমেশ্বরের কাছে প্রতিদিন অহোরাত্র শুভ বুদ্ধিযুক্ত হয়ে নমস্কার জানানোর কথা বলা হয়েছে।
উপ ত্বাগ্নে দিবে দিবে
দোষাবস্তর্ধিয়া বয়ম্।
নমো ভরন্ত এমসি।।
(ঋগ্বেদ সংহিতা:১.১.৭)
"হে অগ্নিরূপ পরমেশ্বর, আমরা প্রতিদিন অহোরাত্র শুভ বুদ্ধিযুক্ত হয়ে নমস্কার জানাতে জানাতে তোমার নিকটে আগমন করি।"
নমঃ শম্ভবায় চ ময়োভবায় চ।
নমঃ শঙ্করায় চ ময়স্করায় চ।
নমঃ শিবায় চ শিবতরায় চ।।
(শুক্লযজুর্বেদ সংহিতা : ১৬.৪১)
"মুক্তি এবং সংসারসুখদাতা ভগবান শিবকে নমস্কার, লৌকিক ও মোক্ষসুখের কারক শিবকে নমস্কার ; যিনি কল্যাণরূপ হয়ে ভক্তজনের কল্যাণ-বিধান করেন সেই ভগবান রুদ্রকে নমস্কার। "
বেদের তৈত্তিরীয় আরণ্যকে একা শুধু ভগবান শিব নয়; অম্বিকাপতি, উমাপতিকে নমস্কার করা হয়েছে। অর্থ্যাৎ ভগবান শিবের সাথে সাথে জগন্মাতা অম্বিকাকেও নমস্কার করা হয়েছে।
নমো হিরণ্যবাহবে হিরণ্যবর্ণায় হিরণ্যরূপায়
হিরণ্যপতয়ে অম্বিকাপতয় উমাপতয়ে
পশুপতয়ে নমো নমঃ।।
(তৈত্তিরীয় আরণ্যক:১০.২২)
"অম্বিকাপতি,উমাপতি, পশুপতি, হিরণ্যাদি সর্বনিধির পালক,তেজোময়, হিরণ্যবাহু, হিরণ্যবর্ণ, হিরণ্যরূপ পরমেশ্বর শিবের উদ্দেশে নমস্কার। "
নমস্কার শুধু একটি শব্দ নয়, এ নমস্কারকে শাস্ত্রে পবিত্র যজ্ঞ বলে অভিহিত করা হয়েছে। ঋকবেদের আশ্বলায়ন গৃহসূত্রে নমস্কারকে শুধু যজ্ঞই বলা হয়নি, সাথে এটাও বলা হয়েছে এই নমস্কাররূপ পবিত্র যজ্ঞকে দেবতারাও অতিক্রম করেন না। অর্থাৎ, কাউকে নমস্কার সম্ভাষণ করলে, দেবতারাও অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন।
যো নমসা স্বধ্বর ইতি নমস্কারেণ বৈ
খল্বপি ন বৈ দেবা নমস্কারম্ অতি;
যজ্ঞো বৈ নম ইতি হি ব্রাহ্মণং ভবতি।।
(আশ্বলায়ন গৃহসূত্র:১.১.৫)
"নমঃ অর্থাৎ নমস্কার দ্বারাও দেবতার উৎকৃষ্ট পূজারী হওয়া যায়। নমস্কারকে দেবতারা অতিক্রম করেন না। তাই ব্রাহ্মণগ্রন্থের মধ্যে নমস্কারকে যজ্ঞ বলা হয়েছে।"
আশ্বলায়ন গৃহসূত্রে স্পষ্ট করে বলা আছে যে, আমার এই শব্দটি অর্থ যারা বেদ পাঠ করছেন। নমঃ অর্থাৎ নমস্কার দ্বারা দেবোতারাও উৎকৃষ্ট পূজারী হওয়া যায়। নমস্কার কে দেবোতারাও অতিক্রম করেন না।বৈদিক এ বিষয়টি নৃসিংহপুরাণের সিদ্ধান্ত হিসেবে গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের প্রধান স্মৃতিগ্রন্থ 'শ্রীহরিভক্তিবিলাস' গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে।
নারসিংহে-
নমস্কারঃ স্মৃতো যজ্ঞঃ সৰ্বযজ্ঞেযু চোত্তমঃ।
নমস্কারেণ চৈকেন নরঃ পূতো হরিং ব্রজেৎ।।
(শ্রীহরিভক্তিবিলাস: পূর্বার্দ্ধ,৮.৩৬৫)
"শ্রীনৃসিংহপুরাণে—নমস্কার যজ্ঞস্বরূপ এবং সকল যজ্ঞের শিরোমণি। মনুষ্য একমাত্র নমস্কার দ্বারাই পবিত্র হয়ে শ্রীভগবানকে লাভ করার যোগ্য হয় ৷"
বর্তমানে আমরা কি করেছি? আমরা একজনের সাথে দেখা হলে প্রত্যেকেই যে যার মত আচরণ করছি। যেমন খুশি তেমন সম্ভাষণবাক্য বলছি। কেউ 'হরে কৃষ্ণ' বলছি, কেউ 'জয় রাম', কেউ 'জয় মা'। এতে আর কিছুই হোক বা না হোক অন্ততপক্ষে একতা নষ্ট হচ্ছে, এটা সুনিশ্চিতভাবে বলা যায়। কিন্তু পক্ষান্তরে আমরা বৈদিক যুগ থেকেই চলে আসা নমস্কার সম্ভাষণ সকলেই ব্যবহার করতাম, তবে মধ্যে ঐক্যবদ্ধতা বাড়ত। একটা গৃহ কিভাবে সুন্দর করে চলবে, এই পারিবারিক বিধানগুলো যেখানে আছে, সেই গৃহসূত্রে নমস্কার দেয়ার কথা বলা হয়েছে। মহাভারতের মধ্যেও অসংখ্য স্থানে ঋষি-মুনিরা নমস্কার, নম এবং বিবিধ প্রকারের প্রণামের ব্যবহার করেছেন। শ্রীমদ্ভাগবতে মধ্যে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে পূজিত ও সৎকৃত হতে দেখে যজ্ঞসভায় উপস্থিত ব্যক্তিগণ হাত জোড় করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে নমস্কার করে তাঁর নামে জয়ধ্বনি দিয়েছিলেন।
ইত্থং সভাজিতং বীক্ষ্য সর্বে প্রাঞ্জলয়ো জনাঃ।
নমো জয়েতি নেমুস্তং নিপেতুঃ পুষ্পবৃষ্টয়ঃ৷৷
(শ্রীমদ্ভাগবত:১০.৭৪.২৯)
"ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে এইভাবে পূজিত ও সৎকৃত হতে দেখে যজ্ঞসভায় উপস্থিত ব্যক্তিগণ বদ্ধাঞ্জলি হয়ে জয়ধ্বনি দিতে লাগলেন ও নমস্কার জ্ঞাপন করতে লাগলেন। তখন আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি হতে লাগল৷"
রামায়ণ, মহাভারত, শ্রীমদ্ভাগবতপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণসহ বিবিধ পুরাণে নমস্কারের কথা রয়েছে। এমনকি সংস্কৃত সাহিত্যে বিভিন্ন স্থানে ঋষি-মুনিদের নমস্কার বলে সম্ভাষণ করা হয়েছে।
মঙ্গল্যং মঙ্গলং বিষ্ণুং বরেণ্যমনঘং শুচিম্ ।
নমস্কৃত্য হৃষীকেশং চরাচরগুরুং হরিম্ ॥
(মহাভারত: আদিপর্ব, ১.২৪)
"যিনি মঙ্গলজনক ও মঙ্গলময় বিষ্ণু, ভোগ ও মুক্তিপ্রার্থীদের আদরণীয়, নিষ্পাপ, পবিত্র, মায়ার নিয়ন্তা ও জগতের গুরু; সেই নারায়ণকে নমস্কার।
নমস্তে পুণ্ডরীকাক্ষ নমস্তে পুরুষোত্তম।
নমস্তে সর্ব্বলোকাত্মন্ নমস্তে তিগ্মচক্রিণে।।
নমো ব্রহ্মণ্যদেবায় গোব্রাহ্মণহিতায় চ।
জগদ্ধিতায় কৃষ্ণায় গোবিন্দায় নমো নমঃ।
ব্রহ্মতে সৃজতে বিশ্বং স্থিতৌ পালয়তে পুনঃ।
রুদ্ররূপায় কল্পান্তে নমস্তুভ্যং ত্রিমূর্তয়ে।।
(বিষ্ণুপুরাণ:১.১৯.৬৪-৬৫)
"হে পুণ্ডরীকাক্ষ! তোমাকে নমস্কার। হে পুরুষোত্তম! তোমাকে নমস্কার। হে সর্ব্বলোকাত্মন্! তোমাকে নমস্কার। হে তীক্ষ্ণচক্রিণ! তোমাকে নমস্কার।
গো-ব্রাহ্মণের হিতকারী ব্রহ্মণ্যদেবকে নমস্কার; জগতের হিতস্বরূপ কৃষ্ণকে নমস্কার। গোবিন্দকে নমস্কার। ব্রহ্মারূপে তুমি সৃষ্টি কর, বিষ্ণুরূপে পালন কর এবং কল্পান্তে রুদ্ররূপে জগতের লয় কর; এ ত্রিমূর্তিধারী হে পরমেশ্বর তোমাকে নমস্কার।"
দেবদেবীদের প্রায় সকল স্তোত্রেই নমস্কার সম্ভাষণ পাওয়া যায়। এর সংখ্যা এত বেশি যে যার উদাহরণ দিয়ে সমাপ্তিসূচক দাড়ি চিহ্ন দেয়া সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পুরাণের দৃষ্টান্ত দেয়া যায়।ব্রহ্মাণ্ড পুরাণে প্রজাপতি ব্রহ্মাকৃত শিবস্তোত্রে নমস্কার :
জটিনে দণ্ডিনে তুভ্যং ব্যালযজ্ঞোপবীতিনে ।
নমোঽস্তু নৃত্যশীলায় বাদ্যনৃত্যপ্রিয়ায় চ ।।
মন্যবে শীতশীলায় সুগীতিগায়তে নমঃ ।
কটকরায় ভীমায় চোগ্ররূপধরায় চ ।।
বিভীষোণায় ভীমায় ভগপ্রমথনায় চ ।
সিদ্ধসঙ্ঘাতগীতায় মহাভাগায় বৈ নমঃ।।
নমো মুক্তাট্টহাসায় ক্ষোভিতস্ফোটিকায় চ ।
নদতে কুর্দ্দতে চৈব নমঃ প্রমাদিতায় চ ।।
( ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ:২৬. ৫১-৫৪)
"জটাজুটধারী, দণ্ডী , সর্প উপবীত ধারী, নৃত্যশীল ও নৃত্যপ্রিয় মহাদেবকে আমি প্রণাম করি। মন্যু, শীতশীল, সুগীতিগায়ক, ভীম, উগ্ররূপকে আমি প্রণাম করি। অট্টহাসরত, , ক্ষোভিত , স্ফোটিত , সিদ্ধগণের দ্বারা বন্দিত মহাভাগ শিবের চরণে নমস্কার করি।"
লিঙ্গপুরাণের পূর্বভাবে শিবস্তোত্রে নমস্কার
একাক্ষরায় রুদ্রায় ওঙ্কারাতাত্মরূপিণে ।
ওকারায়াদিদেবায় বিশ্বদেবায় বৈ নমঃ ।।
তৃতীয়ায় মকারায় শিবায় পরমাত্মনে ।
সূর্য্যাগ্নিসোমবর্নায় যজমানায় বৈ নমঃ ।।
অগ্নৈয় রুদ্ররুপায় রুদ্রাণা পতয়ে নমঃ ।
( লিঙ্গ পুরাণ:পূর্বভাগ,১৮.১-৩ )
"বিষ্ণু বললেন হে রুদ্র ! একাক্ষররূপী তোমাকে নমস্কার ; হে আত্মরূপিন্ ! অকাররূপী তোমাকে নমস্কার । হে আদিদেব , বিশ্বদেব উকাররূপী তোমাকে নমস্কার । হে শিব! তুমি পরমাত্মা ও মকার ; তুমি সূর্য তুমি সোমবর্ণ ; তুমি যজমান । হে রুদ্র ! তুমি অগ্নি ও রুদ্রাধিপতি তোমাকে নমস্কার।"
শ্রীচণ্ডীর উত্তর চরিত্রের পঞ্চম অধ্যায়ে 'দেবীদূতসংবাদ' নামক অধ্যায়ে ৯-৮২ মন্ত্রে 'নমঃ' শব্দটি অসংখ্যবার অনুপ্রাস অলংকার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
অতিসৌম্যাতিরৌদ্রায়ৈ নতাস্তস্যৈ নমো নমঃ ।
নমো জগৎপ্রতিষ্ঠায়ৈ দেব্যৈ কৃত্যৈ নমো নমঃ ॥
যা দেবী সর্বভূতেষু বিষ্ণুমায়েতি শব্দিতা ।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।।
(শ্রীচণ্ডী:৫.১৩-১৬)
"বিদ্যারূপে অতিসৌম্যা এবং অবিদ্যারূপে অতি রৌদ্রা বা অতি ভীষণাকে প্রণাম করি। তাঁকে পুনঃপুন প্রণাম। জগতের আশ্রয়রূপিণীকে প্রণাম। ক্রিয়ারূপা দেবীকে পুনঃপুন প্রণাম।
যে দেবী সকল প্রাণীতে 'বিষ্ণুমায়া' নামে অভিহিতা তাঁকে নমস্কার। তাঁকে নমস্কার। তাঁকে বারংবার নমস্কার।"
এই নমস্কারের ঐতিহ্য ভারতবর্ষ ছাপিয়ে পার্শ্ববর্তী মায়ানমার, থাইল্যান্ড, এমন কি ইন্দোনেশিয়া মালয়েশিয়া ইত্যাদি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশেও রয়েছে। তারা মুখে হয়ত বলে, "সালামত পাগে" কিন্তু সাথে নমস্কার সম্ভাষণের ভঙ্গিতে হাত জোড় করে।নমস্কার সম্ভাষণ দেয়ার সময়ে হাত জোড় করে বুকের সাথে সামান্য স্পর্শ করা হয় কেন, তা হয়ত আমরা অনেকেই জানি না। বা হয়ত কখনো ভেবেও দেখি না। আমাদের দেহের মধ্যে ছয়টি চক্র আছে। তাকে ষটচক্র বলে। এ ষটচক্রের মধ্যে সবচেয়ে বড় রক্তিম চক্রটি হল অনাহত চক্র। চক্র দেহের অন্তঃস্থিত সূক্ষ্মদেহের মধ্যে অবস্থিত। এ অনাহত স্থানটিকে হৃদয় বলা হয় হৃদয়মণ্ডলও বলে। স্বয়ং জীবাত্মা সেখানে বিরাজ করেন। মানবদেহে নাভিদেশে মণিপুর চক্রের অবস্থান। এ চক্রে অসীম শক্তিশালী তেজ অবস্থান করে, তাই এতে অগ্নিতত্ত্বের প্রাধাণ্য। এর ঠিক উপরে এবং মেরুদণ্ড সংলগ্ন কণ্ঠমূল বরাবর আকাশতত্ত্বের প্রাধান্য যুক্ত বিশুদ্ধচক্রের নিচে রয়েছে অনাহত চক্র। অর্থাৎ মণিপুর এবং বিশুদ্ধচক্রের মধ্যবর্তী চতুর্থ চক্র হল অনাহত চক্র। হৃদপিণ্ড বুকে এই চক্রটি অবস্থিত। এতে বায়ুতত্ত্বের প্রাধান্য। এ চক্রের উত্তরণে সাধকরা অনাহত নাদ শুনতে পায়। রক্তিম বর্ণের বৃহৎ অনাহত চক্রের স্পর্শে ভালবাসার বৃদ্ধি ঘটে।সেই অনাহত চক্রে স্পর্শ করে নমস্কার সম্ভাষণ করতে হয়। এ নমস্কার সম্ভাষণে ছোট বড় কোন বিষয় নেই। সকলেই সকলকে নমস্কার দিতে পারে। নমস্কার কোন ব্যক্তিকে দেয়া হয় না। নমস্কার সেই ব্যক্তির অন্তঃস্থিত পরমাত্মারূপ পরমেশ্বরকেই দেয়া হয়। এ কারণে একজন শিশু থেকে শুরু করে অতিবৃদ্ধ সবাইকে নমস্কার দেওয়া যায়। শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতায় বলা হয়েছে, জগতের বড়-ছোট সকল জীবের মধ্যেই রুদ্ররূপ পরমেশ্বর বিরাজমান।সেই সর্বরূপ পরমেশ্বর রুদ্রকে বারংবার নমস্কার করা হয়েছে।তাঁর কাছে কোন বয়সের ভেদ নেই, কোন ধনী এবং ধনহীনের ভেদাভেদ নেই, কোন জ্ঞানী বা অজ্ঞানীর ভেদ নেই। তিনিই বামন, আবার তিনিই দীর্ঘদেহি; তিনিই শিশুকিশোর, আবার তিনিই প্রৌঢ়-বর্ষীয়ান। তিনি জ্যেষ্ঠের মধ্যে যেমন আছেন, তেমনি কনিষ্ঠের মধ্যেও আছেন
নমো হ্রস্বায় চ বামনায় চ।
নমো বৃহতে চ বর্ষীয়সে চ।
নমো বৃদ্ধায় চ সবৃধে চ।
নমোঽগ্নায় চ প্রথমায় চ৷৷
নম আশবে চাজিরায় চ নমঃ শীঘ্রায় চ শীভ্যায় চ।
নম ঊর্ম্যায় চা-বম্বন্যায় চ নমো নাদেয়ায় চ দ্বীপ্যায় চ৷৷
নমো জ্যেষ্ঠায় চ কনিষ্ঠায় চ নমঃ পূর্বজায় চাপরজায় চ।
নমো মধ্যমায় চাপগল্ভায় চ নমো জঘন্যায় চ বুধ্যায় চ৷৷
(শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতা: ১৬.৩০-৩২)
"ক্ষুদ্র ও বামনরূপী রুদ্রকে নমস্কার, প্রৌঢ় ও বর্ষীয়ান- রূপী রুদ্রকে নমস্কার, বয়োবৃদ্ধ ও জ্ঞানবৃদ্ধরূপী রুদ্রকে নমস্কার, জগতের আদি ও মুখ্য রুদ্রকে নমস্কার।
সর্বব্যাপক ও গতিশীল রূপী রুদ্রকে নমস্কার, শীঘ্র জাত ও ক্ষিপ্র জাতরূপী রুদ্রকে নমস্কার, তরঙ্গ ও স্থিরজলে জাতরূপী রুদ্রকে নমস্কার, নদী ও দ্বীপে জাতরূপী রুদ্রকে নমস্কার।
জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠরূপী রুদ্রকে নমস্কার, পূর্বে ও পশ্চাৎ জাত-রূপী রুদ্রকে নমস্কার, তির্যক আদি রূপে ও অব্যুৎপন্ন ইন্দ্রিয়ে জাত রূপী রুদ্রকে নমস্কার, গাভী প্রভৃতির পশ্চাদ্ভাগে ও বৃক্ষাদিমূলে জাতরূপী রুদ্রকে নমস্কার।"
নমস্কার মানে পবিত্র যজ্ঞকর্ম। যজ্ঞ মানে আগুন জ্বালিয়ে শুধুই আগুনে আহুতি দেয়া নয়। ভগবানের সন্তুষ্টির জন্য যে কর্ম তাকেই যজ্ঞ বলে। একটি শিশুকেও নমস্কার দেয়া যায়। কিন্তু আমাদের ঐতিহ্য যে, ছোটরা পূর্বে বড়দের নমস্কার সম্ভাষণ করবে। এরপরে বড়রা ছোটদের নমস্কার বলে প্রতুত্তর প্রদান করবে। প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যে সেই অনন্ত পরমেশ্বরকে স্মরণ করে তাকে যখন নমস্কার দেয়া হচ্ছে। নমস্কার কোন মনুষ্য বা মনুষ্যদেহকে দেয়া হচ্ছে না। এজন্যই এ নমস্কার সম্ভাষণ অনাহত চক্রের স্থানের সাথে স্পর্শ করে দেয়া হয়। আজকে আমাদের যেমন খুশি তেমন সাজ পরিত্যাগ করে বৈদিক পরম্পরার সাথে যুক্ত হওয়া অত্যন্ত আবশ্যক। বৈদিককাল থেকে যে ঐতিহ্য চলে আসছে, সেই শাশ্বত ঐতিহ্যকে বহমান রাখা অত্যন্ত আবশ্যক। যখনই বৈদিক প্রধান সম্ভাষণ নমস্কারের বাইরে গিয়ে কেউ নতুন কোন সম্ভাষণ আমদানি করবে ; তখন শতভাগ মানুষ কিন্তু সেই নব্য সম্ভাষণটি গ্রহণ করবে না। এর মধ্যে কেউ হয়ত চিন্তা করবে, ওমুক ব্যক্তি নতুন একটি সম্ভাষণ বাক্য প্রচার করছে ; তবে আরেক জন চিন্তা করবে তাহলে আমিই বা কম কি? আমিও নতুন একটি সম্ভাষণ বাক্য প্রচার করব। আমি হরেকৃষ্ণ শুরু করলাম; আমার দেখাদেখি আরেকজন, জয়রাম, জয় মা, বলা শুরু করবে।এতে সম্পূর্ণভাবে জাতিগতভাবে একতা বিনষ্ট হবে।তাই সবাই সবাইকে দেখলে শাশ্বত বৈদিক সম্ভাষণ নমস্কার প্রদান যথাসম্ভব করবেন। শিশুদের ছোটকাল থেকেই নমস্কার ঐতিহ্যের সাথে যুক্ত করে বড় করতে হবে। বড়দের নমস্কার দেওয়া এবং গুরুবর্গীয়ান যারা আছেন পিতা-মাতা, শিক্ষক তাদের পায়ে হাত দিয়ে নমস্কার করা উচিত। এটাই এই ভারতবর্ষের সংস্কৃতি। কাউকে নমস্কার প্রদান করতে কখনই লজ্জিত হওয়া অনুচিত। কিন্তু লজ্জাজনক হলেও সত্য, অনেকের ক্ষেত্রেই বিষয়টি দেখা যায়। অফিস, লোকসমাগম বা বাসসহ যানবাহনে যদি মোবাইলে কারো কল আসে। তবে সেই কলের ওপাশ থেকে যদি নমস্কার সম্ভাষণ করা হয়, তবে সেই সম্ভাষণের প্রতুত্তরে অনেকে নমস্কার বলতে কুণ্ঠিত হন। অর্থাৎ সকলের সম্মুখে নমস্কার দিলে তার হিন্দু পরিচয় প্রকাশিত হয়ে যাবে, এই মানসিক হীনমন্যতা থেকে অনেকে সকলের সম্মুখে নমস্কার সম্ভাষণ উচ্চারণ করতে দ্বিধা বোধ করেন। তখন হু, হ্যাঁ, ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে কোনমতে কাটিয়ে যাই।তারা নিজেরা তো অন্যদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে নমস্কার সম্ভাষণ দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেনা, আবার অন্য কেউ দিলেও উত্তরেও নমস্কার বলবে না।আবার সামনাসামনি নমস্কার দিলে অনেক সময়ে ইশারায় কোনমতে কাটিয়ে যায়। এই লজ্জা হীনমন্যতা কাটিয়ে উঠতে না পারলে, জাতিগতভাবে আমাদের সেই স্বাভিমান কখনই তৈরী হবে না। অথচ পক্ষান্তরে আমরা অন্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে দেখি, টেলিফোনের অপরপাড়ে কে আছে, সেই ব্যক্তির ধর্মীয় বিশ্বাস কি কিছুই চিন্তা না করে তারা তাদের ধর্মীয় সম্ভাষণ করে বাক্যালাপ শুরু করেন।বিষয়টির জন্য তাদের ধন্যবাদ দেয়া উচিত। ঠিক একইভাবে আমাদেরও সবাইকে নমস্কার দিয়ে বাক্যালাপ শুরু করা উচিত। ফোনের অপরপাশে কে আছে -এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তা না করে সকলকেই নমস্কার দেয়া উচিত। নমস্কার সম্ভাষণকে যেহেতু পবিত্র যজ্ঞ বলা হয়েছে। তাই কাউ নমস্কার সম্ভাষণ করলে যজ্ঞের পুণ্যলাভ হয়ে পাপের খণ্ডন হয়। গাছের কোঠরে বাস করা পেঁচা যেমন সূর্যের আলোর দিকে তাকাতে পারে না, তেমনি সর্বদা নমস্কার সম্ভাষণকারী ব্যক্তির প্রতিও যতদূতের দৃষ্টি পড়ে না। বিষয়টি শ্রীহরিভক্তিবিলাস গ্রন্থে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে:
অপি পাপং দুরাচারং নরং তৎ প্রণতং হরে।
নেক্ষন্তে কিঙ্করা যাম্যা উলূকাস্তপনং যথা ৷৷
(শ্রীহরিভক্তিবিলাস: পূর্বার্দ্ধ,৮.৩৮০)
"সূর্য্যের দিকে দৃষ্টিসঞ্চালনে অক্ষম পেঁচার মত, শ্রীহরিপ্রণামকারী দুরাচারী ও পাপীদের প্রতিও যমদূতেরা দৃষ্টি সঞ্চালনে সক্ষম হয় না।"
নমস্কার শিশু-বৃদ্ধ এবং জাতিধর্মনির্বিশেষে সকলেই সকলকেই দেয়া যায়। কারণ তত্ত্বগতভাবে নমস্কারের সাথে কোন বয়সের সম্পর্ক নেই, জাতিধর্মের সম্পর্ক নেই। আছে শুধুই স্রষ্টা এবং সৃষ্টির সম্পর্ক। একথা স্মর্তব্য যে, নমস্কার কোন আমদানি করা বহিরাগত শব্দ নয়। নমস্কার এই ভূখণ্ডের মাটি, পরিবেশ, ধর্ম, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যসহ সকল বিষয়ের সাথেই সম্পৃক্ত। একে-অন্যকে দেখলে সৌজন্যস্বরূপ নমস্কার জানানো যেহেতু পবিত্র যজ্ঞতুল্য মহাপুণ্যদায়ক। তাই অর্জুনের মত সম্মুখে, পশ্চাতেসহ দশদিকেই পরমেশ্বরকে উপলব্ধি করে তাঁর উদ্দেশ্যে সর্বদা নমস্কার সম্ভাষণের চর্চা করা উচিত।
নমঃ পুরস্তাদথ পৃষ্ঠতস্তে নমোঽস্তু তে সর্বত এব সর্ব।
অনন্তবীর্যামিতবিক্রমস্ত্বং সর্বং সমাপ্নোষি ততোঽসি সৰ্বঃ।।
(শ্রীমদ্ভগবদগীতা:১১.৪০)
"হে অনন্ত সামর্থ্যসম্পন্ন ঈশ্বর! তোমাকে সম্মুখে নমস্কার, পশ্চাতে নমস্কার, তোমাকে সর্বদিক হতে নমস্কার জানাই। হে সর্বস্বরূপ অসীম পরাক্রমশালী একমাত্র তুমিই সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে আছ এবং তুমিই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের দৃশ্য-অদৃশ্য সকল কিছু।"
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
ফেসবুক পোস্ট লিঙ্ক : 'নমস্কার' একটি, বৈদিক সম্ভাষণ ।
ফেসবুক পেজ লিঙ্ক : Shri Kushal Baran Chakraborty | Facebook