বর্তমানে শুধু দুর্গাপূজা বা কালীপূজা নয় সকল পূজাই সাত্ত্বিকভাবে করা প্রয়োজন। সাত্ত্বিক পূজা এই এই শব্দদুটি প্রতিনিয়ত ব্যবহার করলেও, আমরা অনেকেই এর বৈশিষ্ট্য এবং লক্ষণ জানি না। তবে সাত্ত্বিক পূজার বৈশিষ্ট্য এবং লক্ষণ জানতে আমাদের বেশিদূর যেতে হবে না। আমরা যদি শ্রীমদ্ভগবদগীতার সপ্তদশ অধ্যায়ের দিকে দৃষ্টি দিলেই আমরা সুস্পষ্টভাবে জানতে পারি পারি যে সাত্ত্বিক যজ্ঞ বা সাত্ত্বিক পূজার বৈশিষ্ট্য এবং লক্ষণ কি কি? শ্রীমদ্ভগবদগীতার সপ্তদশ অধ্যায়ে সাত্ত্বিক, রাজসিক এবং তামসিকসহ তিনপ্রকার যজ্ঞেরই অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
অফলাকাঙ্ক্ষিভির্যজ্ঞো বিধিদিষ্টো য ইজ্যতে।
যষ্টব্যমেবেতি মনঃ সমাধায় স সাত্ত্বিকঃ ॥
অভিসন্ধায় তু ফলং দম্ভাৰ্থমপি চৈব যৎ।
ইজ্যতে ভরতশ্রেষ্ঠ তং যজ্ঞং বিদ্ধি রাজসম্ ৷৷
বিধিহীনমসৃষ্টান্নং মন্ত্রহীনমদক্ষিণম্।
শ্রদ্ধাবিরহিতং যজ্ঞং তামসং পরিচক্ষতে ॥
(শ্রীমদ্ভগবদগীতা:১৭.১১-১৩)
" ঈশ্বরের সন্তুষ্টির জন্য যজ্ঞ করাই কর্তব্য এমন মনোভাব এবং কর্তব্যবোধ নিয়ে ফলাকাঙ্ক্ষাশূন্য হয়ে সমাহিত চিত্তে শাস্ত্রবিহিত যে যজ্ঞ সম্পন্ন করা হয়, তাই সাত্ত্বিক যজ্ঞ।
হে ভরতশ্রেষ্ঠ ! বিবিধ ফল কামনা করে দম্ভ প্রকাশের জন্য যে যজ্ঞ সম্পন্ন হয়; সেই যজ্ঞকে রাজসিক যজ্ঞ বলে।
শাস্ত্রবিধিবর্জিত, অন্নদানহীন, মন্ত্রহীন, দক্ষিণাবিহীন এবং শ্রদ্ধাবিহীন যজ্ঞকে তামসিক যজ্ঞ বলে।"
দুর্গাপূজায় সাত্ত্বিক পূজা করা হয় তবে অর্থের অপচয় অনেক কমে আসে। এতে প্রচুর অর্থের সাশ্রয় হয়। সেই সাশ্রয়কৃত অর্থের অর্থের সদ্ধ্যবহার করে শিক্ষাবৃত্তি এবং অভাবগ্রস্তদের প্রতি সহায়তা অনুদান চালু করা সহ বিবিধ প্রকারের লোককল্যাণ করা যায়। সনাতন ধর্মাবলম্বী অধিকাংশ মানুষের গৃহেই বেদাদি শাস্ত্র সহজ লভ্য নয়। সেই সাশ্রয়কৃত অর্থের মাধ্যমে বেদাদি শাস্ত্রসহ সপ্তশতী গ্রন্থের (গীতা, চণ্ডী) ঘরে ঘরে প্রচার করা যায়।তামসিক পূজা কোন কল্যাণ বয়ে আনে না। তাই তামসিক পূজা নয়, একমাত্র শাস্ত্রানুমোদিত সাত্ত্বিক পূজার মাধ্যমে বিশ্বমাতার আশীর্বাদ লাভের প্রচেষ্টা সর্বদা করা উচিত। একথা স্মর্তব্য যে, দুর্গাপূজা মাতৃরূপী পরমব্রহ্মেরই উপাসনা। তাই দুর্গাপূজায় আলোচনা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পূজার মাহাত্ম্য ও স্বরূপ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে আদ্যাশক্তি মহামায়া দুর্গাতত্ত্ব সম্পর্কে সচেতন করা একান্ত আবশ্যক। দুর্গাপ্রতিমা ইচ্ছেমতো তৈরি করা উচিত নয়। শাস্ত্রে বর্ণিত ধ্যানমন্ত্রের বর্ণনানুসারে দুর্গা প্রতিমা তৈরি করা উচিত। প্রতিমা তৈরি করার সময়ে একথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, দেবী প্রতিমাতে যেন জগজ্জননী ভাবটি সন্নিবেশিত থাকে। আধুনিকতার নামে অহেতুক রুচিহীন ও দৃষ্টিকটু প্রতিমা তৈরি করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
দুর্গাপূজায় অশালীন গান ও মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণ এবং DJ ব্যবহার যথাসম্ভব পরিহার করা উচিত। এর বিপরীতে ধর্মীয় সংগীত, ঐতিহ্যবাহী ধুনুচিনৃত্য ও
ঢাকের ব্যবহারকে আরো প্রসারিত করা প্রয়োজন। নিম্ন আয়ের গরীব ঢাকিরা সারা বছর এই বাৎসরিক দুর্গোৎসবের অপেক্ষায় থাকে। সর্বজনীন পূজাতে অনেক বড় অঙ্কের বাজেট থাকে। সেই সর্বজনীন পূজাতে গরীব ঢাকিদের সাথে অহেতুক টাকা পয়সা নিয়ে দরকষাকষি করা উচিত নয়।দুর্গাপূজাসহ সকল পূজার তিথিগুলোতে মাদকদ্রব্য সেবন থেকে বিরত থেকে শুদ্ধহৃদয়ে মাতৃ আরাধনায় ব্রতী হতে হবে। প্রতিমা নিরঞ্জনের সময় সর্বপ্রকার অশ্লীলতার, উচ্ছৃঙ্খলতা পরিত্যাগ করে এক আবেগঘন সাত্ত্বিকভাব বজায় রাখতে হবে। দুর্গাপূজা সম্পর্কে মুণ্ডমালাতন্ত্রের দ্বিতীয় পটলে বলা হয়েছে:
ন হি দুর্গা সমা পূজ্যা ন হি দুৰ্গা-সমং ফলম্ ৷
নহি দুর্গা সমং জ্ঞানং ন হি দুর্গা সমং তপঃ ॥
দুর্গায়াশ্চরিতং যত্র তত্র কৈলাস-মন্দিরম্ ।
ইদং সত্যমিদং সত্যমিদং সত্যং বরাননে ৷৷
(মুণ্ডমালাতন্ত্র:২.১৮-১৯)
"দুর্গার সমান পূজ্যা নেই। দুর্গাপূজার সমান ফলও নেই। দুর্গাতত্ত্বের সমান জ্ঞান নেই। দুর্গার সমান তপস্যা, সাধনা নেই।
যে স্থানে দুর্গার চরিত বর্ণিত হয়, সে স্থানটি কৈলাস মন্দির তুল্য হয়ে উঠে । হে বরাননে! এটাই সত্য, এটাই সত্য, এটাই সত্য।"
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।