-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

আমাদের শিশুকালে, দুর্গোৎসবের আমেজ।

আমাদের শিশুকালে, দুর্গোৎসবের আমেজ  বাঙালির কাছে শরৎকাল এবং দুর্গাপূজা অনেকটাই আজ সমার্থক শব্দ হয়ে গেছে। মেঘমুক্ত শরতের আকাশের দিকে তাকালে  অন্যরকমের একটা ঘোর চলে আসে মনে। কিছু সময়ের জন্যে মন আনমনে হয়ে যায়। শরৎ মানেই স্বচ্ছ নীল আকাশে শুভ্র মেঘের ভেলা। স্বপ্নগুলো সেই শুভ্র মেঘের ভেলার মত অসীম মহাকাশে ভেসে ভেসে অজানা গন্তব্যে যায়। ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায় শরতের আকাশ।ঋতু পরিক্রমার গ্রীষ্ম, বর্ষা ঋতুর পরেই তৃতীয় ঋতু হিসেবে আমাদের কাছে আসে শরৎকাল।বাংলা ভাদ্র মাস এবং আশ্বিন এ দুইমাসকে শরৎকাল বলে। ইংরেজি মধ্য আগস্ট থেকে মধ্য অক্টোবর মাস পর্যন্ত শরৎ ঋতুর পথচলা ছয়টি ঋতুর মধ্যে, এক স্নিগ্ধ শুভ্র মায়াবী ঋতু হল শরৎকাল। সারা মাঠ জুড়ে, নদীর পাড়ে থোকা থোকা ফুটে থাকে সাদা কাশফুল।স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না, আলোছায়ার দিনভর  খেলা- এই নিয়েই শরৎকাল। কাচের মতো স্বচ্ছ নীল আকাশে, তুলার মত ভেসে যায় শরতের সাদা মেঘমালা।আকাশের দিকে তাকালে মন উদাস হয়ে যায়। সাদা বক উড়ে যায় আকাশে।শরৎকালে মাঠে মাঠে সবুজ ধানের ওপর সোনালি আলোর ঝলমলানি স্বপ্নে আশায় বুক বাঁধে কৃষক। শরতের গোধূলিলগ্নে সোনারঙে রঙিন হয়ে উঠে, এক অন্যরকমের আচ্ছন্নতা তৈরি করে আকাশ। শরৎকালের সৌন্দর্য নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ সহ অসংখ্য কবিরা কবিতা লিখেছেন। এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'শরৎ' কবিতাটি অন্যতম।  "আজি কি তোমার মধুর মূরতি হেরিনু শারদ প্রভাতে! হে মাত বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ ঝলিছে অমল শোভাতে।  পারে না বহিতে নদী জলধার, মাঠে মাঠে ধান ধরে নাকো আর-- ডাকিছে দোয়েল গাহিছে কোয়েল তোমার কাননসভাতে! মাঝখানে তুমি দাঁড়ায়ে জননী,   শরৎকালের প্রভাতে।" সকালে গাছ থেকেই ঝরে পরে শিউলি ফুল। অত্যন্ত সুন্দর একটি ঘ্রাণ শিউলি ফুলের। হালকা শীত শীত অনুভব হয় শরতের সকালে। ফুলের সাজিতে গাছ থেকে ঝরে পরা শিউলি ফুল পূর্ণ করতাম। মনে পড়ে শিউলি ফুলের নিচের অংশে যে হলদে গেরুয়া রঙের অংশটি আছে। তা দিয়ে আমরা ছবি আঁকতাম, দেয়ালের বিভিন্ন স্থানে নাম লিখতাম। হয়ত এই প্রাকৃতিক রং দিয়েই প্রাচীন ভারতবর্ষে শিল্পীরা ছবি আঁকতেন। আমাদের উঠানের চারপাশে চারটি স্থলপদ্মের গাছ ছিল। সাদা এবং গোলাপি দুইধরণের ফুল ফুটতো গাছে। দুইতিনটি ফুলেই হাত পূর্ণ হয়ে যেত। পদ্মফুলগুলো হাতে নিলে, মায়ের স্মিত সহাস্য  মুখ মনে ভেসে উঠত। আজও প্রচণ্ড টানে আমাকে শরৎকাল।  ছোটবেলায় পূজার ঠিক মাসখানেক আগে আমাদের বাড়ির পার্শ্ববর্তী কালীবাড়িতে প্রতিমা বানাতে শিল্পীরা আসত, আমরা তখন অবাক বিস্ময়ে নিয়ে প্রতিমা বানানো দেখতাম। একটু একটু করে তৈরি হত মায়ের দেহসৌষ্ঠব। স্কুলে যাওয়ার পথে এবং স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রতিবারই দেখে যেতাম; যে কতখানি তৈরি হয়েছে দুর্গাপ্রতিমা। ভেতরে যে কতটা আবেগ এবং আনন্দ কাজ করত, তা আজ বলে বোঝাতে পারব না। সর্বদা মনে হত, কবে শেষ হবে প্রতিমাটি; কবে রং করা হবে ; কবে চোখ আঁকা হবে ইত্যাদি। খড়কুটার উপরে একটু একটু করে মাটির প্রলেপ পরে এগিয়ে চলে মায়ের প্রতিমা। আমাদের শিশুমন অবাক বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম। জানিনা আমাদের সময়ের সে আবেগ বর্তমান প্রজন্মের ছোটছোট বাচ্চাদের আছে কিনা। যদি না থাকে তবে তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমরা নগরায়ণ এবং যান্ত্রিকতাবাদের ফাঁদে পরে কিভাবে বর্তমানের শিশুদের থেকে তাদের শিশুকাল ছিনিয়ে নিচ্ছি, তা হয়ত একবারও ভেবে দেখেছি না। যে বয়সে আনন্দে তাদের শেখার সময়, তখন আমরা তাদের কাঁধে চাপিয়ে দিচ্ছি একব্যাগ বই। ব্যাগের ভারে ঘাড় সহ দেহমনও অনেক সময় নুইয়ে যায় শিশুদের। অবশ্য শিশুদের স্কুলব্যাগের যা ভার, তাতে এ ব্যাগগুলোকে ব্যাগ না বলে বস্তা বলাই ভাল। মোবাইল এবং কম্পিউটারের আসক্তি কেড়ে নিচ্ছে সেই পূর্বের শিশুতোষ সারল্য।  এখনকার ঠাকুমাও আর নাতিপুতিদের পড়ে শোনায় না, 'ঠাকুমার ঝুলি'র রাক্ষস খোক্কসের গল্প। কারণ আমরা এখন তথাকথিত আধুনিক এবং উচ্চশিক্ষিত। আমাদের অনেকের দৃষ্টিতে ঠাকুমার ঝুলি পড়বে গ্রামের অশিক্ষিত কৃষকের ছেলেমেয়ে। কিন্তু আমাদের ছেলেরা পড়বে 'হ্যারিপটার' সহ বিদেশি গল্প। আমাদের অনেকের মানসিকতা যে, স্বপ্নটাও দেখতে হবে বিদেশি। বিদেশি সাম্রাজ্যবাদীরা এ দেশ থেকে চলেও রেখে গেছে তাদের অনেক মানসিক দাসদের। বিদেশিদের অন্ধ অনুকরণ করতে গিয়ে, আজও আমরা দেখি ; আমাদের অনেক সাহেব বাবুরা চৈত্রমাসের গরমের মধ্যেও ভারি কোর্ট পরে অফিসে বসে থাকে। এটা একবারের জন্যেও উপলব্ধি করে না, যারা কোর্টটাই সারাবছর পরে থাকে তারা শীতপ্রধান অঞ্চলের মানুষ। শীতের আধিক্যের কারণে, এ পোশাকটি তাদের সারাবছরের পোশাক হতে পারে, কিন্তু ছয়টি ঋতু বৈচিত্রের দেশ বাংলায় কখনই সারাবছর পরিধান করা যায় না। অন্ততপক্ষে চৈত্র-জৈষ্ঠ্যমাসে মাসে নয়ই। কিন্তু কে বোঝাবে কাকে? কালীমন্দিরে যিনি দুর্গাপ্রতিমা বানাতেন, সেই কাকার নাম ছিল অতুল মণ্ডল। কিন্তু সবাই তাকে অতুল পাল বলেই ডাকত। একটু একটু করে তার হাতের ছোঁয়ায়  দেবী যখন ধীরেধীরে মূর্তিমতী হয়ে উঠত; তখন আমাদেরও শিশু  হৃদয়ে আনন্দ দোল খেত। একদিন মনে হল, আমিও চাইলে প্রতিমা বানাতে পারি। যেই বলা সেই কাজ। আমি খড়কুটার ব্যানা যেহেতু বাঁধতে পারি না, আমি শুধু মাটি দিয়েই বানিয়ে ফেললাম কয়েকটি প্রতিমার মুখ। সাথে বানালাম শিব এবং লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আবক্ষ মূর্তি। প্রথম বানানো হিসেবে মূর্তিগুলো ভালই ছিল বলে পরিবারের সবাই মতামত দিয়েছিল। আমার বাবা সচরাচর সব আগ্রহী হয় না; তিনি মূর্তিগুলো দেখে কিছু কৌটা রঙের ব্যবস্থা করে দিলেন। সবাই আমার তৈরিকৃত প্রতিমা দেখে, আমার নামই দিয়ে দিল অতুল পাল। শিল্পী সত্ত্বাটা শিশুকাল থেকেই ছিল, হয়ত এর যথাযথ প্রয়োগ সর্বদা করতে পারিনি। ছবি আঁকতে পারতাম, টুকটাক মূর্তি বানাতে পারতাম, রবীন্দ্রনাথের গান খুব প্রিয় ছিল। জীবনে অনেক কিছুই হতে চেয়েছিলাম, করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু জীবন জীবনের মত তার গন্তব্যে আমাকে নিয়ে এসেছে। জীবনে সবকিছু একসাথে করতে গেলে, কিছুই বোধহয়  ঠিকমত করা যায় না। বিভিন্ন প্রিয় ইচ্ছা বা শখের মধ্যে দুইএকটাকে নির্দিষ্ট করে বেঁছে নিতে হয়। তবেই ইচ্ছা গন্তব্যে অভিমুখে যায়। ফোর কি ফাইবে পড়ি তখন, ক্লাসের বইতে কবি কাজী কাদের নেওয়াজের 'শিক্ষকের মর্যাদা' কবিতায় একটি লাইন ছিল, "পুলকিত হৃদে আনত-নয়নে।" এ লাইনটিকে অবলম্বন করে দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে একটি কবিতা লিখলাম সেই ছোট্ট বয়সে। স্কুলের অনেক বন্ধু সহ অনেকেই প্রশংসা  করেছিল কবিতাটির। ছোট্ট বয়সের কবিতা, এখন কথাগুলো  মনে পড়লে নিজের অজান্তেই হাসি পায়। কবিতাটির প্রথম প্যারাটি ছিল: "দেখতে দেখতে এল যে মায়ের পূজা  আনন্দে একূল থেকে ওকূল যাই, সকালবেলা শিউলি ফুল কুড়াই ফুল কুড়িয়ে, দিব ফুল মায়ের চরণে পুলকিত হৃদে আনত-নয়নে।" ছোট্টবয়সে এরকম অনেক কবিতা লিখেছিলাম পূজাকে নিয়ে। যার অনেক কবিতাই সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে গেছে। আজ কষ্ট লাগে যখন ছোট ছোট বাচ্চাদের তাদের বইয়ের একটি কবিতা বলতে বলি। অধিকাংশই বলতে পারে না। বুঝতে পারি যে, শিক্ষা ব্যবস্থায় একটা আমূল পরিবর্তন এসেছে। এতে ছেলেমেয়েরা আগের থেকে অনেক কিছুই বেশী পড়ছে। কিন্তু সেই পঠিত বিদ্যাকে আত্মস্থ করতে পারছে না। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার সবকিছুই মিনিপ্যাকে এবং মাল্টিপল কোশ্চেন আকারে চলে এসেছে। ফলে ছাত্রছাত্রীরা কোন বিষয়ের গভীরে ডুব দিয়ে অমূল্যসম্পদ নিয়ে আসতে পারছে না। যা জানছে যা পড়ছে সকলই ভাসাভাসা। কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে বলে, কয়েকটি অপশন দিন উত্তরটি বলে দিচ্ছি।  সময়টা অনেকটাই বুঝি পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। প্রতিবেশী যে ছেলেটা আমার সাথে বসে আমার মত অবাক বিস্ময়ে মন্দিরে প্রতিমা বানানো দেখত; পূজার সন্ধ্যাকালে প্রত্যেকদিন আরতি প্রতিযোগিতা হত, সেই প্রতিযোগিতায় যে অংশগ্রহণ করত; সেই ছেলেটাই আজ যখন মূর্তিপূজা নিয়ে, হিন্দু সম্প্রদায় নিয়ে ফেসবুকে বিভিন্ন নোংরা কটূক্তি করে পোস্ট করে তখন বুঝতে পারি, সময়টা ধীরেধীরে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। সেই সুন্দর দিনগুলো হয়ত আর ফিরে আসবে না। এই যে সম্প্রদায়গত মনজগতের পরিবর্তন, এটা তীব্র হয় নব্বইদশকের শুরু থেকে।এর আগে যাপিত জীবনের আশেপাশে হিন্দু মুসলিম মেরুকরণ এতটা ছিল না। সারা বাংলার কথা বলতে না পারলেও, অন্ততপক্ষে আমাদের এলাকায় ধর্মীয় মেরুকরণ ছিল না এটা নির্দ্বিধায় বলতে পারি। জাতিধর্মনির্বিশেষে অত্যন্ত সম্প্রীতি ছিল পাড়া প্রতিবেশী সকলের মধ্যে। আমাদের বাড়ি ভর্তি ছিল নারিকেল গাছ। প্রচুর নারিকেল হত গাছগুলোতে। পূজার আগে এগুলো দিয়ে প্রচুর পরিমাণে নারিকেলের নাড়ু তৈরি করা হত। ছাতুর মোয়া, চিড়ার মোয়া,মুড়ির মোয়া, খইয়ের মোয়া সহ বিভিন্ন প্রকারের মোয়া তৈরি করা হত। ঢ্যাপের খইয়ের মোয়া তো আজ বিরল হয়ে গেছে। নারিকেল এবং ক্ষীর দিয়ে তৈরি করা হত, অপূর্ব স্বাদের টাটখিসসা নাড়ু। বিভিন্ন আকৃতির মাটির সাঁচের ছাপ দিয়ে তৈরি হত সুদৃশ্য বাহারী নাড়ু।এ খাবারের ঐতিহ্যগুলো যেভাবে হারিয়ে যাচ্ছে, আগামী প্রজন্ম হয়ত উপলব্ধিই করতে পারবে না বা জানতেই পারবে না ঐতিহ্যবাহী আমাদের এ বাঙালি খাবারগুলোর কথা। আমাদের আশেপাশে অধিকাংশ পরিবারই মুসলিম পরিবার। তাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ। তারা আসত এবং অত্যন্ত আগ্রহে একরকম কাড়াকাড়ি করে এ নাড়ু, মোয়া খেত। অনেকেই এই নাড়ু, মোয়া রাখার টিনের বড় বড় কৌটাগুলো কোথায় রাখা আছে তাও জানত।কিন্তু আজ দুঃখ লাগে যখন দেখি, গত এক দুইদশকে চারিপাশটা অনেকটাই বদলে গেছে। যারা আগে প্রচণ্ড আগ্রহ ভালবাসা নিয়ে আমাদের বাসাতে পূজায় নাড়ু, মোয়া খেতে আসতো; তাদের অনেকেই আজ দেখি হিন্দুদের বাড়িতে খায়না। হতবাক হই কয়েক দশকের মধ্যে আশেপাশের পরিচিত মানুষদের পরিবর্তনে। এখনো সম্প্রীতির সেই পুরাতন স্মৃতিগুলো চোখে ভাসে। পূজার মাসখানেক আগে থেকে শুরু করে, প্রতিদিন দিন গুনতাম পূজার আর কতদিন বাকি। আগে থেকেই পরিকল্পনা থাকত, পূজায় কোন কোন পোশাক পড়ব, কোথায় যাব ইত্যাদি। শিশুকালে পূজাতে একটা জামা একটা প্যান্টে যে মনের আনন্দ ছিল, তা আজ শতশত জামা প্যান্টও যদি একসাথে পাই, তবে সেরকম আনন্দ আর হবে না। আনন্দগুলো এভাবে নিজদের অজান্তেই হারিয়ে গেছে। একদিন টের পেলাম পুরনো সেই আনন্দগুলো আর পূর্বের মত সজীব নেই। অবশ্য  সম্পূর্ণ বিষয়টিই হয়ত মানসিক এবং সমকালীন।  দুর্গাপূজার দিন গণনা আপাতত শেষ হত মহালয়ার দিনে। মহালয়ার দিনে মনে হত, পূজা শুরু হয়ে গেছে। অবচেতন মনে ঢাকের কাঠির বোল শুনতে পেতাম। মনে হত সর্বদা কে যেন মায়ের জয়ঢাক কানের কাছে বাজাচ্ছে এবং মা স্মিতহাসিতে সন্তানের সেই বাদ্যধ্বনি শুনছেন। মহালয়ার দিনে ভোররাত্রে উঠে রেডিও ছেড়ে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে মহালয়া অনুষ্ঠানের চণ্ডীপাঠে এক স্বর্গীয় আনন্দের স্পর্শ পেতাম। মন হিল্লোলিত হত।বর্তমানে ইউটিউবে যদিও সেই মহালয়ার  'মহিষাসুরমর্দিনী' অনুষ্ঠানটি শুনি; কিন্তু সেই ছোটবেলায় ধরে রাখা স্মৃতির মত আনন্দ আর পাই না।  “আশ্বিনের শারদপ্রাতে, বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর, ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা, প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগতমাতার আগমনবার্তা। আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনি অসীম ছন্দে  বেজে উঠে রূপলোক ও রসলোকে  আনে নবভাব মাধুরীর সঞ্জীবন। তাই আনন্দিতা শ্যামলী মাতৃকার চিন্ময়ীকে মৃন্ময়ীতে আবাহন।" ১৯৩১ সালে, পরাধীন ভারতে প্রথম বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রেকে দিয়ে 'মহিষাসুরমর্দিনী' নামক প্রোগ্রামটি আয়োজিত হয় অল ইন্ডিয়া রেডিওতে। বৈচিত্র্য আনতে ১৯৭৬ সালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্থানে নায়ক  উত্তমকুমারকে দিয়ে পাঠ করানো হয়েছিল। কিন্তু শ্রোতারা তা পছন্দ করেনি। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সাথে মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানটির সাথে যুক্ত ছিল, সে সময়ের সংস্কৃতি জগতের সকল প্রখ্যাত ব্যক্তিরা। সুরকার ছিলেন প্রবাদপ্রতীম শিল্পী পঙ্কজ মল্লিক। চিত্রনাট্য লিখেছেন, সে সময়য়ের বিখ্যাত চিত্রনাট্যকার বাণী কুমার। গান করেছেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, আরতী মুখোপাধ্যায়, সুপ্রীতি ঘোষ, বিমল ভূষণ, উৎপলা সেন, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃষ্ণা দাশগুপ্ত, সুমিত্রা সেন, অসীমা ভট্টাচার্য, শিপ্রা বসু ও পঙ্কজ মল্লিক প্রমুখ। প্রথমে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে লাইভ পাঠ করা হত মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানটি। পরবর্তীকালে ১৯৬৬ সালে রেকর্ডিং করা হয়। এ রেকডিং করা অনুষ্ঠানটিই আজ আমরা শুনছি।বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র যখন চণ্ডীপাঠ করতেন, দেবী দুর্গার অসুরবধের দৃশ্য বর্ণনা করতেন, পাঠ করতে করতে দু’চোখ বেয়ে নামত দেবীর প্রতি সমর্পিত  নিবেদিত অশ্রুধারা। রেডিওর রেডিয়েশনের মধ্যেও ভেসে আসত তাঁর অস্ফুটস্বরে কান্নার ধ্বনি। আমাদের রুচিবোধ অনেক পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে, আমরা অন্যদের দৃষ্টিতে নিজদের দেখা শুরু করেছি।মূর্তিপরিকল্পনায় দেবী দুর্গার মত এত ঐশ্বর্যময়ী দেবী বোধহয় সম্পূর্ণ পৃথিবীতেই আর নেই। দেবীর যখন চোখ আঁকা হত। খুবই বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখতাম। প্রতিবছর দেখতে পেতাম না, সাধারণত প্রতিমাতে এ নিখুঁত কাজগুলো রাত্রে নিরিবিলিতে করা হত। আগের সাবেকি প্রতিমার মুখশ্রীতে যে একটা মাতৃত্বের ভাব ছিল, সে ভাবগুলো দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। বিষয়টি অত্যন্ত  দুঃখজনক। আধুনিকতার নামে, থিম প্রতিমার নামে অনেক দৃষ্টিকটু প্রতিমাও তৈরি করে ফেলছি। তবে আধুনিক নামে, থিম নামেই সব নেগেটিভ নয়; সম্পূর্ণ বিষয়টি দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রয়োগের উপরে নির্ভর করে। অবসরে পুরনো স্মৃতিতে হাতড়ে বেড়ানো মানুষের সহজাত স্বভাব। ঘরে একা যখন মানুষ  বসে থাকে, তখন কখন যেন নিজের অজান্তেই পেছনে ফেলে আসা জীবনের স্মৃতিগুলো মনের আকাশে খণ্ড খণ্ড মেঘ হয়ে ভেসে উঠে। স্মৃতিসমুদ্রতে ডুবে মানুষ অনুভব করে, আহারে যদি পূর্বের সেই সোনালী দিনগুলোতে ফিরে যেতে পারতাম! এ অনুভূতিকেই বলে 'নস্টালজিয়া।' প্রত্যেক মানুষের জীবনে নস্টালজিয়া নামক সুখকর স্মৃতিটি বারেবারে ঘুরেফিরে আসে। স্মৃতিগুলো প্রতিনিয়ত ডাকে, কেউ সে ডাক শুনতে পায়, কেউ বা পায়না। বর্নি‌ল অতীত সবসময়ই মায়াজালে জড়িয়ে রাখে। মানুষ সেই অতীতকে আজীবন রোমন্থন করে। এ অতীতের রোমন্থনের  মাঝে সুখের দুঃখের সকল স্মৃতিই থাকে। তবে মানুষ নস্টালজিক হয়ে শুধু সুখের স্মৃতিই রোমন্থন করে বা করতে চায়। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে দুঃখের স্মৃতিও মনজগতে চলে আসে। আমাদের ছোটবেলার দুর্গাপূজার স্মৃতি হল, নব্বইদশকের কিছু আমৃত্যু  আনন্দের স্মৃতি। বাস্তবে হয়ত সে আনন্দকে আর পাব কিনা জানি না, কিন্তু স্মৃতির মণিপুরে সে মণিদীপা হয়ে নিরন্তর বসতি করবে।  শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ। ফেসবুক পোস্ট লিঙ্ক :  আমাদের শিশুকালে, দুর্গোৎসবের আমেজ। ফেসবুক পেজ লিঙ্ক :  Shri Kushal Baran Chakraborty | Facebook

বাঙালির কাছে শরৎকাল এবং দুর্গাপূজা অনেকটাই আজ সমার্থক শব্দ হয়ে গেছে। মেঘমুক্ত শরতের আকাশের দিকে তাকালে অন্যরকমের একটা ঘোর চলে আসে মনে। কিছু সময়ের জন্যে মন আনমনে হয়ে যায়। শরৎ মানেই স্বচ্ছ নীল আকাশে শুভ্র মেঘের ভেলা। স্বপ্নগুলো সেই শুভ্র মেঘের ভেলার মত অসীম মহাকাশে ভেসে ভেসে অজানা গন্তব্যে যায়। ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায় শরতের আকাশ।ঋতু পরিক্রমার গ্রীষ্ম, বর্ষা ঋতুর পরেই তৃতীয় ঋতু হিসেবে আমাদের কাছে আসে শরৎকাল।বাংলা ভাদ্র মাস এবং আশ্বিন এ দুইমাসকে শরৎকাল বলে। ইংরেজি মধ্য আগস্ট থেকে মধ্য অক্টোবর মাস পর্যন্ত শরৎ ঋতুর পথচলা ছয়টি ঋতুর মধ্যে, এক স্নিগ্ধ শুভ্র মায়াবী ঋতু হল শরৎকাল। সারা মাঠ জুড়ে, নদীর পাড়ে থোকা থোকা ফুটে থাকে সাদা কাশফুল।স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না, আলোছায়ার দিনভর খেলা- এই নিয়েই শরৎকাল। কাচের মতো স্বচ্ছ নীল আকাশে, তুলার মত ভেসে যায় শরতের সাদা মেঘমালা।আকাশের দিকে তাকালে মন উদাস হয়ে যায়। সাদা বক উড়ে যায় আকাশে।শরৎকালে মাঠে মাঠে সবুজ ধানের ওপর সোনালি আলোর ঝলমলানি স্বপ্নে আশায় বুক বাঁধে কৃষক। শরতের গোধূলিলগ্নে সোনারঙে রঙিন হয়ে উঠে, এক অন্যরকমের আচ্ছন্নতা তৈরি করে আকাশ। শরৎকালের সৌন্দর্য নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ সহ অসংখ্য কবিরা কবিতা লিখেছেন। এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'শরৎ' কবিতাটি অন্যতম।
"আজি কি তোমার মধুর মূরতি
হেরিনু শারদ প্রভাতে!
হে মাত বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ
ঝলিছে অমল শোভাতে।
পারে না বহিতে নদী জলধার,
মাঠে মাঠে ধান ধরে নাকো আর--
ডাকিছে দোয়েল গাহিছে কোয়েল
তোমার কাননসভাতে!
মাঝখানে তুমি দাঁড়ায়ে জননী,
শরৎকালের প্রভাতে।"
সকালে গাছ থেকেই ঝরে পরে শিউলি ফুল। অত্যন্ত সুন্দর একটি ঘ্রাণ শিউলি ফুলের। হালকা শীত শীত অনুভব হয় শরতের সকালে। ফুলের সাজিতে গাছ থেকে ঝরে পরা শিউলি ফুল পূর্ণ করতাম। মনে পড়ে শিউলি ফুলের নিচের অংশে যে হলদে গেরুয়া রঙের অংশটি আছে। তা দিয়ে আমরা ছবি আঁকতাম, দেয়ালের বিভিন্ন স্থানে নাম লিখতাম। হয়ত এই প্রাকৃতিক রং দিয়েই প্রাচীন ভারতবর্ষে শিল্পীরা ছবি আঁকতেন। আমাদের উঠানের চারপাশে চারটি স্থলপদ্মের গাছ ছিল। সাদা এবং গোলাপি দুইধরণের ফুল ফুটতো গাছে। দুইতিনটি ফুলেই হাত পূর্ণ হয়ে যেত। পদ্মফুলগুলো হাতে নিলে, মায়ের স্মিত সহাস্য মুখ মনে ভেসে উঠত। আজও প্রচণ্ড টানে আমাকে শরৎকাল।
ছোটবেলায় পূজার ঠিক মাসখানেক আগে আমাদের বাড়ির পার্শ্ববর্তী কালীবাড়িতে প্রতিমা বানাতে শিল্পীরা আসত, আমরা তখন অবাক বিস্ময়ে নিয়ে প্রতিমা বানানো দেখতাম। একটু একটু করে তৈরি হত মায়ের দেহসৌষ্ঠব। স্কুলে যাওয়ার পথে এবং স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রতিবারই দেখে যেতাম; যে কতখানি তৈরি হয়েছে দুর্গাপ্রতিমা। ভেতরে যে কতটা আবেগ এবং আনন্দ কাজ করত, তা আজ বলে বোঝাতে পারব না। সর্বদা মনে হত, কবে শেষ হবে প্রতিমাটি; কবে রং করা হবে ; কবে চোখ আঁকা হবে ইত্যাদি। খড়কুটার উপরে একটু একটু করে মাটির প্রলেপ পরে এগিয়ে চলে মায়ের প্রতিমা। আমাদের শিশুমন অবাক বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম। জানিনা আমাদের সময়ের সে আবেগ বর্তমান প্রজন্মের ছোটছোট বাচ্চাদের আছে কিনা। যদি না থাকে তবে তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমরা নগরায়ণ এবং যান্ত্রিকতাবাদের ফাঁদে পরে কিভাবে বর্তমানের শিশুদের থেকে তাদের শিশুকাল ছিনিয়ে নিচ্ছি, তা হয়ত একবারও ভেবে দেখেছি না। যে বয়সে আনন্দে তাদের শেখার সময়, তখন আমরা তাদের কাঁধে চাপিয়ে দিচ্ছি একব্যাগ বই। ব্যাগের ভারে ঘাড় সহ দেহমনও অনেক সময় নুইয়ে যায় শিশুদের। অবশ্য শিশুদের স্কুলব্যাগের যা ভার, তাতে এ ব্যাগগুলোকে ব্যাগ না বলে বস্তা বলাই ভাল। মোবাইল এবং কম্পিউটারের আসক্তি কেড়ে নিচ্ছে সেই পূর্বের শিশুতোষ সারল্য।
এখনকার ঠাকুমাও আর নাতিপুতিদের পড়ে শোনায় না, 'ঠাকুমার ঝুলি'র রাক্ষস খোক্কসের গল্প। কারণ আমরা এখন তথাকথিত আধুনিক এবং উচ্চশিক্ষিত। আমাদের অনেকের দৃষ্টিতে ঠাকুমার ঝুলি পড়বে গ্রামের অশিক্ষিত কৃষকের ছেলেমেয়ে। কিন্তু আমাদের ছেলেরা পড়বে 'হ্যারিপটার' সহ বিদেশি গল্প। আমাদের অনেকের মানসিকতা যে, স্বপ্নটাও দেখতে হবে বিদেশি। বিদেশি সাম্রাজ্যবাদীরা এ দেশ থেকে চলেও রেখে গেছে তাদের অনেক মানসিক দাসদের। বিদেশিদের অন্ধ অনুকরণ করতে গিয়ে, আজও আমরা দেখি ; আমাদের অনেক সাহেব বাবুরা চৈত্রমাসের গরমের মধ্যেও ভারি কোর্ট পরে অফিসে বসে থাকে। এটা একবারের জন্যেও উপলব্ধি করে না, যারা কোর্টটাই সারাবছর পরে থাকে তারা শীতপ্রধান অঞ্চলের মানুষ। শীতের আধিক্যের কারণে, এ পোশাকটি তাদের সারাবছরের পোশাক হতে পারে, কিন্তু ছয়টি ঋতু বৈচিত্রের দেশ বাংলায় কখনই সারাবছর পরিধান করা যায় না। অন্ততপক্ষে চৈত্র-জৈষ্ঠ্যমাসে মাসে নয়ই। কিন্তু কে বোঝাবে কাকে?
Durga-Puja-of-our-childhood
কালীমন্দিরে যিনি দুর্গাপ্রতিমা বানাতেন, সেই কাকার নাম ছিল অতুল মণ্ডল। কিন্তু সবাই তাকে অতুল পাল বলেই ডাকত। একটু একটু করে তার হাতের ছোঁয়ায় দেবী যখন ধীরেধীরে মূর্তিমতী হয়ে উঠত; তখন আমাদেরও শিশু হৃদয়ে আনন্দ দোল খেত। একদিন মনে হল, আমিও চাইলে প্রতিমা বানাতে পারি। যেই বলা সেই কাজ। আমি খড়কুটার ব্যানা যেহেতু বাঁধতে পারি না, আমি শুধু মাটি দিয়েই বানিয়ে ফেললাম কয়েকটি প্রতিমার মুখ। সাথে বানালাম শিব এবং লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আবক্ষ মূর্তি। প্রথম বানানো হিসেবে মূর্তিগুলো ভালই ছিল বলে পরিবারের সবাই মতামত দিয়েছিল। আমার বাবা সচরাচর সব আগ্রহী হয় না; তিনি মূর্তিগুলো দেখে কিছু কৌটা রঙের ব্যবস্থা করে দিলেন। সবাই আমার তৈরিকৃত প্রতিমা দেখে, আমার নামই দিয়ে দিল অতুল পাল। শিল্পী সত্ত্বাটা শিশুকাল থেকেই ছিল, হয়ত এর যথাযথ প্রয়োগ সর্বদা করতে পারিনি। ছবি আঁকতে পারতাম, টুকটাক মূর্তি বানাতে পারতাম, রবীন্দ্রনাথের গান খুব প্রিয় ছিল। জীবনে অনেক কিছুই হতে চেয়েছিলাম, করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু জীবন জীবনের মত তার গন্তব্যে আমাকে নিয়ে এসেছে। জীবনে সবকিছু একসাথে করতে গেলে, কিছুই বোধহয় ঠিকমত করা যায় না। বিভিন্ন প্রিয় ইচ্ছা বা শখের মধ্যে দুইএকটাকে নির্দিষ্ট করে বেঁছে নিতে হয়। তবেই ইচ্ছা গন্তব্যে অভিমুখে যায়।
ফোর কি ফাইবে পড়ি তখন, ক্লাসের বইতে কবি কাজী কাদের নেওয়াজের 'শিক্ষকের মর্যাদা' কবিতায় একটি লাইন ছিল, "পুলকিত হৃদে আনত-নয়নে।" এ লাইনটিকে অবলম্বন করে দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে একটি কবিতা লিখলাম সেই ছোট্ট বয়সে। স্কুলের অনেক বন্ধু সহ অনেকেই প্রশংসা করেছিল কবিতাটির। ছোট্ট বয়সের কবিতা, এখন কথাগুলো মনে পড়লে নিজের অজান্তেই হাসি পায়। কবিতাটির প্রথম প্যারাটি ছিল:
"দেখতে দেখতে এল যে মায়ের পূজা
আনন্দে একূল থেকে ওকূল যাই,
সকালবেলা শিউলি ফুল কুড়াই
ফুল কুড়িয়ে, দিব ফুল মায়ের চরণে
পুলকিত হৃদে আনত-নয়নে।"
ছোট্টবয়সে এরকম অনেক কবিতা লিখেছিলাম পূজাকে নিয়ে। যার অনেক কবিতাই সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে গেছে। আজ কষ্ট লাগে যখন ছোট ছোট বাচ্চাদের তাদের বইয়ের একটি কবিতা বলতে বলি। অধিকাংশই বলতে পারে না। বুঝতে পারি যে, শিক্ষা ব্যবস্থায় একটা আমূল পরিবর্তন এসেছে। এতে ছেলেমেয়েরা আগের থেকে অনেক কিছুই বেশী পড়ছে। কিন্তু সেই পঠিত বিদ্যাকে আত্মস্থ করতে পারছে না। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার সবকিছুই মিনিপ্যাকে এবং মাল্টিপল কোশ্চেন আকারে চলে এসেছে। ফলে ছাত্রছাত্রীরা কোন বিষয়ের গভীরে ডুব দিয়ে অমূল্যসম্পদ নিয়ে আসতে পারছে না। যা জানছে যা পড়ছে সকলই ভাসাভাসা। কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে বলে, কয়েকটি অপশন দিন উত্তরটি বলে দিচ্ছি।
সময়টা অনেকটাই বুঝি পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। প্রতিবেশী যে ছেলেটা আমার সাথে বসে আমার মত অবাক বিস্ময়ে মন্দিরে প্রতিমা বানানো দেখত; পূজার সন্ধ্যাকালে প্রত্যেকদিন আরতি প্রতিযোগিতা হত, সেই প্রতিযোগিতায় যে অংশগ্রহণ করত; সেই ছেলেটাই আজ যখন মূর্তিপূজা নিয়ে, হিন্দু সম্প্রদায় নিয়ে ফেসবুকে বিভিন্ন নোংরা কটূক্তি করে পোস্ট করে তখন বুঝতে পারি, সময়টা ধীরেধীরে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। সেই সুন্দর দিনগুলো হয়ত আর ফিরে আসবে না। এই যে সম্প্রদায়গত মনজগতের পরিবর্তন, এটা তীব্র হয় নব্বইদশকের শুরু থেকে।এর আগে যাপিত জীবনের আশেপাশে হিন্দু মুসলিম মেরুকরণ এতটা ছিল না। সারা বাংলার কথা বলতে না পারলেও, অন্ততপক্ষে আমাদের এলাকায় ধর্মীয় মেরুকরণ ছিল না এটা নির্দ্বিধায় বলতে পারি। জাতিধর্মনির্বিশেষে অত্যন্ত সম্প্রীতি ছিল পাড়া প্রতিবেশী সকলের মধ্যে।
আমাদের বাড়ি ভর্তি ছিল নারিকেল গাছ। প্রচুর নারিকেল হত গাছগুলোতে। পূজার আগে এগুলো দিয়ে প্রচুর পরিমাণে নারিকেলের নাড়ু তৈরি করা হত। ছাতুর মোয়া, চিড়ার মোয়া,মুড়ির মোয়া, খইয়ের মোয়া সহ বিভিন্ন প্রকারের মোয়া তৈরি করা হত। ঢ্যাপের খইয়ের মোয়া তো আজ বিরল হয়ে গেছে। নারিকেল এবং ক্ষীর দিয়ে তৈরি করা হত, অপূর্ব স্বাদের টাটখিসসা নাড়ু। বিভিন্ন আকৃতির মাটির সাঁচের ছাপ দিয়ে তৈরি হত সুদৃশ্য বাহারী নাড়ু।এ খাবারের ঐতিহ্যগুলো যেভাবে হারিয়ে যাচ্ছে, আগামী প্রজন্ম হয়ত উপলব্ধিই করতে পারবে না বা জানতেই পারবে না ঐতিহ্যবাহী আমাদের এ বাঙালি খাবারগুলোর কথা। আমাদের আশেপাশে অধিকাংশ পরিবারই মুসলিম পরিবার। তাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ। তারা আসত এবং অত্যন্ত আগ্রহে একরকম কাড়াকাড়ি করে এ নাড়ু, মোয়া খেত। অনেকেই এই নাড়ু, মোয়া রাখার টিনের বড় বড় কৌটাগুলো কোথায় রাখা আছে তাও জানত।কিন্তু আজ দুঃখ লাগে যখন দেখি, গত এক দুইদশকে চারিপাশটা অনেকটাই বদলে গেছে। যারা আগে প্রচণ্ড আগ্রহ ভালবাসা নিয়ে আমাদের বাসাতে পূজায় নাড়ু, মোয়া খেতে আসতো; তাদের অনেকেই আজ দেখি হিন্দুদের বাড়িতে খায়না। হতবাক হই কয়েক দশকের মধ্যে আশেপাশের পরিচিত মানুষদের পরিবর্তনে। এখনো সম্প্রীতির সেই পুরাতন স্মৃতিগুলো চোখে ভাসে।
পূজার মাসখানেক আগে থেকে শুরু করে, প্রতিদিন দিন গুনতাম পূজার আর কতদিন বাকি। আগে থেকেই পরিকল্পনা থাকত, পূজায় কোন কোন পোশাক পড়ব, কোথায় যাব ইত্যাদি। শিশুকালে পূজাতে একটা জামা একটা প্যান্টে যে মনের আনন্দ ছিল, তা আজ শতশত জামা প্যান্টও যদি একসাথে পাই, তবে সেরকম আনন্দ আর হবে না। আনন্দগুলো এভাবে নিজদের অজান্তেই হারিয়ে গেছে। একদিন টের পেলাম পুরনো সেই আনন্দগুলো আর পূর্বের মত সজীব নেই। অবশ্য সম্পূর্ণ বিষয়টিই হয়ত মানসিক এবং সমকালীন।
দুর্গাপূজার দিন গণনা আপাতত শেষ হত মহালয়ার দিনে। মহালয়ার দিনে মনে হত, পূজা শুরু হয়ে গেছে। অবচেতন মনে ঢাকের কাঠির বোল শুনতে পেতাম। মনে হত সর্বদা কে যেন মায়ের জয়ঢাক কানের কাছে বাজাচ্ছে এবং মা স্মিতহাসিতে সন্তানের সেই বাদ্যধ্বনি শুনছেন। মহালয়ার দিনে ভোররাত্রে উঠে রেডিও ছেড়ে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে মহালয়া অনুষ্ঠানের চণ্ডীপাঠে এক স্বর্গীয় আনন্দের স্পর্শ পেতাম। মন হিল্লোলিত হত।বর্তমানে ইউটিউবে যদিও সেই মহালয়ার 'মহিষাসুরমর্দিনী' অনুষ্ঠানটি শুনি; কিন্তু সেই ছোটবেলায় ধরে রাখা স্মৃতির মত আনন্দ আর পাই না।
“আশ্বিনের শারদপ্রাতে,
বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর,
ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা,
প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত
জ্যোতির্ময়ী জগতমাতার আগমনবার্তা।
আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনি অসীম ছন্দে
বেজে উঠে রূপলোক ও রসলোকে
আনে নবভাব মাধুরীর সঞ্জীবন।
তাই আনন্দিতা শ্যামলী মাতৃকার
চিন্ময়ীকে মৃন্ময়ীতে আবাহন।"
১৯৩১ সালে, পরাধীন ভারতে প্রথম বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রেকে দিয়ে 'মহিষাসুরমর্দিনী' নামক প্রোগ্রামটি আয়োজিত হয় অল ইন্ডিয়া রেডিওতে। বৈচিত্র্য আনতে ১৯৭৬ সালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্থানে নায়ক উত্তমকুমারকে দিয়ে পাঠ করানো হয়েছিল। কিন্তু শ্রোতারা তা পছন্দ করেনি। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সাথে মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানটির সাথে যুক্ত ছিল, সে সময়ের সংস্কৃতি জগতের সকল প্রখ্যাত ব্যক্তিরা। সুরকার ছিলেন প্রবাদপ্রতীম শিল্পী পঙ্কজ মল্লিক। চিত্রনাট্য লিখেছেন, সে সময়য়ের বিখ্যাত চিত্রনাট্যকার বাণী কুমার। গান করেছেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, আরতী মুখোপাধ্যায়, সুপ্রীতি ঘোষ, বিমল ভূষণ, উৎপলা সেন, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃষ্ণা দাশগুপ্ত, সুমিত্রা সেন, অসীমা ভট্টাচার্য, শিপ্রা বসু ও পঙ্কজ মল্লিক প্রমুখ। প্রথমে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে লাইভ পাঠ করা হত মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানটি। পরবর্তীকালে ১৯৬৬ সালে রেকর্ডিং করা হয়। এ রেকডিং করা অনুষ্ঠানটিই আজ আমরা শুনছি।বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র যখন চণ্ডীপাঠ করতেন, দেবী দুর্গার অসুরবধের দৃশ্য বর্ণনা করতেন, পাঠ করতে করতে দু’চোখ বেয়ে নামত দেবীর প্রতি সমর্পিত নিবেদিত অশ্রুধারা। রেডিওর রেডিয়েশনের মধ্যেও ভেসে আসত তাঁর অস্ফুটস্বরে কান্নার ধ্বনি।
আমাদের রুচিবোধ অনেক পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে, আমরা অন্যদের দৃষ্টিতে নিজদের দেখা শুরু করেছি।মূর্তিপরিকল্পনায় দেবী দুর্গার মত এত ঐশ্বর্যময়ী দেবী বোধহয় সম্পূর্ণ পৃথিবীতেই আর নেই। দেবীর যখন চোখ আঁকা হত। খুবই বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখতাম। প্রতিবছর দেখতে পেতাম না, সাধারণত প্রতিমাতে এ নিখুঁত কাজগুলো রাত্রে নিরিবিলিতে করা হত। আগের সাবেকি প্রতিমার মুখশ্রীতে যে একটা মাতৃত্বের ভাব ছিল, সে ভাবগুলো দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। আধুনিকতার নামে, থিম প্রতিমার নামে অনেক দৃষ্টিকটু প্রতিমাও তৈরি করে ফেলছি। তবে আধুনিক নামে, থিম নামেই সব নেগেটিভ নয়; সম্পূর্ণ বিষয়টি দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রয়োগের উপরে নির্ভর করে।
অবসরে পুরনো স্মৃতিতে হাতড়ে বেড়ানো মানুষের সহজাত স্বভাব। ঘরে একা যখন মানুষ বসে থাকে, তখন কখন যেন নিজের অজান্তেই পেছনে ফেলে আসা জীবনের স্মৃতিগুলো মনের আকাশে খণ্ড খণ্ড মেঘ হয়ে ভেসে উঠে। স্মৃতিসমুদ্রতে ডুবে মানুষ অনুভব করে, আহারে যদি পূর্বের সেই সোনালী দিনগুলোতে ফিরে যেতে পারতাম! এ অনুভূতিকেই বলে 'নস্টালজিয়া।' প্রত্যেক মানুষের জীবনে নস্টালজিয়া নামক সুখকর স্মৃতিটি বারেবারে ঘুরেফিরে আসে। স্মৃতিগুলো প্রতিনিয়ত ডাকে, কেউ সে ডাক শুনতে পায়, কেউ বা পায়না। বর্নি‌ল অতীত সবসময়ই মায়াজালে জড়িয়ে রাখে। মানুষ সেই অতীতকে আজীবন রোমন্থন করে। এ অতীতের রোমন্থনের মাঝে সুখের দুঃখের সকল স্মৃতিই থাকে। তবে মানুষ নস্টালজিক হয়ে শুধু সুখের স্মৃতিই রোমন্থন করে বা করতে চায়। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে দুঃখের স্মৃতিও মনজগতে চলে আসে। আমাদের ছোটবেলার দুর্গাপূজার স্মৃতি হল, নব্বইদশকের কিছু আমৃত্যু আনন্দের স্মৃতি। বাস্তবে হয়ত সে আনন্দকে আর পাব কিনা জানি না, কিন্তু স্মৃতির মণিপুরে সে মণিদীপা হয়ে নিরন্তর বসতি করবে।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
ফেসবুক পোস্ট লিঙ্ক :  আমাদের শিশুকালে, দুর্গোৎসবের আমেজ। ফেসবুক পেজ লিঙ্ক : Shri Kushal Baran Chakraborty | Facebook
মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁