-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

শাশ্বত বেদে দ্বাপরযুগে অবতীর্ণ, শ্রীকৃষ্ণের নাম কি করে আসলো ?

শাশ্বত বেদে দ্বাপরযুগে অবতীর্ণ,   শ্রীকৃষ্ণের নাম কি করে আসলো ?  ভগবান শ্রীবিষ্ণুর বিভিন্ন নামের মধ্যে 'বাসুদেব' নামটি সুস্পষ্টভাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে নির্দেশ করে। যদু বংশীয় বসুদেব পুত্র শ্রীকৃষ্ণকেই বাসুদেব বলা হয়। অর্থাৎ বসুদেবের যিনি পুত্র, তিনিই বাসুদেব। সেই বাসুদেব নামটি বেদের মধ্যেও পাওয়া যায়। নারায়ণায় বিদ্মহে বাসুদেবায় ধীমহি। তন্নো বিষ্ণুঃ প্রচোদয়াৎ।। (তৈত্তিরীয় আরণ্যক, ১০.১;  মহানারায়ণ উপনিষদ: ১০.১.২৯) "আমরা নারায়ণকে জানব। তাই বাসুদেবের ধ্যান করি। সেই ধ্যানে তিনি আমাদের প্রেরণ করুন।" সামবেদীয় ছান্দোগ্য উপনিষদে দেবকীপুত্র কৃষ্ণের কথা বলা হয়েছে। সেই সপ্তদশ খণ্ডে আত্মতত্ত্ব সংক্রান্ত  দার্শনিক তত্ত্ব আলোচিত হয়েছে। শ্রীমদ্ভগবদগীতার দার্শনিক তত্ত্বের সাথে সেই ছান্দোগ্য উপনিষদের দার্শনিক তত্ত্ব অত্যন্ত সাদৃশ্যপূর্ণ। তাই বিভিন্ন দিক বিবেচনায় ছান্দোগ্য উপনিষদে বর্ণিত দেবকীপুত্র কৃষ্ণ এবং দ্বাপরযুগের অবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যে একই ব্যক্তি, একথা অনেকটা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তদ্ধৈতদ্ ঘোর আঙ্গিরসঃ কৃষ্ণায় দেবকীপুত্ৰায়োক্ত্বোবাচাপিপাস এব  স বভূব সোঽস্তবেলায়ামেতত্রয়ং প্রতিপদ্যেতাক্ষিতমস্যচ্যুতমসি  প্রাণসংশিতমসীতি তত্রৈতে দ্বে ঋচৌ ভবতঃ॥ আদিৎ প্রত্নস্য রেতসঃ। উদ্বয়ং তমসম্পরি জ্যোতিঃ পশ্যন্ত উত্তরং স্বঃ পশ্যন্ত উত্তরং দেবং দেবত্রা সূর্যমগন্ম জ্যোতিরুত্তমমিতি জ্যোতিরুত্তমমিতি ॥ (ছান্দোগ্য উপনিষদ: ৩.১৭.৬-৭) "আঙ্গিরস ঘোর পূর্বোক্ত এই যজ্ঞবিজ্ঞান দেবকীপুত্র কৃষ্ণকে উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন, “যথোক্ত যজ্ঞবিদ্ মৃত্যুকালে এই মন্ত্রত্রয় জপ করবে-তুমি অক্ষত, তুমি অচ্যুত, তুমি সূক্ষ্মপ্রাণস্বরূপ৷” এই বিজ্ঞান শ্রবণ করে কৃদেবকীপুত্র কৃষ্ণ নিঃস্পৃহ হয়েছিলেন৷ এ বিষয়ে দুটি ঋক রয়েছে।  যে জ্যোতি পরব্রহ্মে প্রকাশিত, দিবালোকের ন্যায় সর্বব্যাপী, পুরাতন, ও জগৎকারণ, সেই পরমজ্যোতিকে ব্রহ্মবিদগণ সর্বত্র দর্শন করেন৷ আমাদের স্বহৃদয়স্থ জ্যোতির সঙ্গে যা অভিন্ন সেই আদিত্যস্থ অজ্ঞানবিনাশক জ্যোতিকে দর্শন করে,-সকল জ্যোতি অপেক্ষা যে জ্যোতি উৎকৃষ্টতর, তাঁকে দর্শন করে- আমরা দেবগণের মধ্যে দ্যুতিমান্ পরমেশ্বরস্বরূপ সর্বোত্তম জ্যোতিকেই প্রাপ্ত হয়েছি৷"  বেদের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে ভগবানের মৎস্য, বরাহ, বামন, নৃসিংহাদি অবতারের কথা যেমন রয়েছে। তেমনি বেদের একাধিক স্থানে রয়েছে লীলা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা। এ প্রসঙ্গে একটি অত্যন্ত যৌক্তিক প্রশ্ন হতে পারে যে, বেদ তো শাশ্বত স্বয়ং পরমেশ্বরের নিঃশ্বাস স্বরূপ। বিষয়টি বেদের মধ্যেই বলা হয়েছে: অস্য মহতো ভূতস্য নিঃশ্বসিতং যদেতদৃগ্বেদো   যজুর্বেদঃ সামবেদঃ অর্থবাঙ্গিরসঃ।  (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ০২.০৪.১০) "সেই পরমেশ্বর থেকেই ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ এবং অথর্ব বেদের উৎপত্তি। স্বয়ংপ্রকাশ এই চতুর্বেদই পরমেশ্বরের নিঃশ্বাসস্বরূপ। " ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তো ৫২০০ বছর আগে দ্বাপরযুগের শেষে অবতাররূপে এসেছেন। তবে শাশ্বত বেদে দ্বাপরযুগে অবতীর্ণ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নাম কি করে আসলো ? সরল ভাবে চিন্তা করলে সুপ্রাচীন শাশ্বত বেদের অভ্যন্তরে  দ্বাপরযুগে অবতীর্ণ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রসঙ্গ থাকার কথা নয়।এ প্রশ্নের উত্তর মহাভারতের দ্রোণপর্বে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেই দিয়েছেন। ভগবান বলেছেন, তিনি নিজেই একই সময়ে একই সাথে তাঁর বিবিধ মূর্তিতে বিরাজমান। তিনি বিবিধ অচিন্ত্যমূর্তিতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে বিরাজমান। এ বিষয়টি মহাভারতসহ একাধিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে। একা মূর্তিস্তপশ্চর্যাং কুরুতে মে ভুবি স্থিতা। অপরা পশ্যতি জগৎ কুর্বাণং সাধ্বসাধুনী।। অপরা কুরুতে কর্ম মানুষং লােকমাশ্রিতা। শেতে চতুর্থী ত্বপরা নিদ্রাং বর্ষসহস্রিকাম্।। (মহাভারত:দ্রোণ পর্ব,২৭.২৫-২৬) "একটি মূর্তিতে আমি নারায়ণরূপে ভুবনে তপস্যা করি, পরব্রহ্মরূপ দ্বিতীয় মূর্তি জগতের ভাল-মন্দ কার্য দর্শন করি। মৎস্য-কূর্মাদি অবতাররূপ তৃতীয় মূর্তিতে মনুষ্যলােকে থেকে মানুষের মত কার্য করে ধর্মসংস্থাপন করি এবং চতুর্থী মূর্তিতে অনন্তকালব্যাপী কালনিদ্রায় কারণসমুদ্রে শায়িত থাকি।" যেমন ব্রহ্মরূপে তিনি আছেন, তেমনি তিনি আবার মানুষের কল্যাণের জন্য অবতার রূপেও আসেন। তিনিই ব্রহ্মা হয়ে সৃষ্টি করেন, বিষ্ণু হয়ে পালন করেন আবার তিনিই মহেশ্বর শিবরূপে বিনাশ করেন। পরমেশ্বরের অনন্তরূপী এ বিষয়টি আমরা না বুঝে অহেতুক ভুল বিভ্রান্ত হয়ে যাই।শাশ্বত বেদের অভ্যন্তরে ৫২০০ বছর আগে দ্বাপরযুগের শেষে আবির্ভূত ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নাম প্রসঙ্গে আরেকটি অত্যন্ত যৌক্তিক উত্তর হল। প্রতি কল্পে ভগবান বেদের জ্ঞান ঋষিদের প্রদান করেন। প্রতি কল্পেই এক একজন ব্যাসদেব এসে এই বেদকে সম্পাদিত করেন। বর্তমান কল্পে বেদকে যিনি সম্পাদনা করেছেন, তাঁর নাম শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস। তিনি ভগবানের চব্বিশ অবতারের অন্যতম। তাঁর প্রকৃত নাম শ্রীকৃষ্ণ। তিনি যমুনা নদীর কূলে এক দ্বীপে জন্মেছেন, তাই তাঁর নামের সাথে এসে যুক্ত হয় দ্বৈপায়ন এবং তিনি বেদকে সম্পাদনা করেছেন তাই তাঁর নামের সাথে একটি উপাধি যুক্ত হয় ‘বেদব্যাস’। শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাসের পিতার নাম ঋষি পরাশর এবং মাতার নাম সত্যবতীর।শ্রীমদ্ভাগবতে তাঁর সম্পর্কে বলা আছে: ততঃ সপ্তদশো জাতঃ সত্যবত্যাং পরাশরাৎ। চক্রে বেদতরোঃ শাখা দৃষ্ট্বা পুংসঃ অল্পমেধসঃ।। (শ্রীমদ্ভাগবত: ০১.০৩.২১) "এরপর তিনি সপ্তদশ অবতারে সত্যবতীর গর্ভে এবং পরাশর মুনির ঔরসে বেদব্যাসরূপে অবতীর্ণ হন। পৃথিবীর মানুষের মেধাশক্তি দিনদিন ক্ষীণ হয়ে আসছে দেখে অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন মানবের প্রতি কৃপাপূর্ণ হয়ে তিনি বেদরূপ বৃক্ষের শাখা বিভাজন করেন (তাই তাঁর নামের সাথে অনন্তকালের জন্যে একটি উপাধি যুক্ত হয় বেদব্যাস)।" মহাভারতের শান্তিপর্বে বলা হয়েছে, কল্পে কল্পে বা মন্বন্তরে ভগবান ঋষিদের মাধ্যমে মানবজাতিকে বেদ জ্ঞান দান করেন। ঋষয়ো মন্ত্রদ্রষ্টারো ন তু বেদস্য কর্তারঃ। ন কশ্চিদদ্বেদ কর্ত্তা চ বেদস্মর্তা চতুর্ভুজঃ।। যুগান্তে অন্তর্হিতান্ বেদান্ সেতিহাসান্ মহর্ষয়ঃ।  লেভিরে তপসা পূর্বমনুজ্ঞাতা স্বয়ম্ভূবা। (মহাভারত: শান্তিপর্ব, ২১০.১৯) "একমাত্র ভগবান ছাড়া কেউই বেদের স্রষ্টা নয়। বেদদ্রষ্টা ঋষিগণ মন্ত্রদ্রষ্টা মাত্র, বেদের রচনাকারী নন। যুগান্তে প্রলয়কালে ইতিহাস সহ বেদ অপ্রকাশিত হয়ে থাকে। কিন্তু সৃষ্টির শুরুতে মহর্ষিরা তপস্যার মাধ্যমে স্বয়ম্ভূ পরমেশ্বর থেকে এ জ্ঞানপ্রবাহ পুনরায় লাভ করেন।" বিষ্ণুপুরাণে বলা হয়েছে, ভগবান বিষ্ণুই বেদব্যাসরূপে যুগে যুগে জগতে এসে বেদ বিভাগ করেন। বিষ্ণুপুরাণে পূর্ববর্তী অষ্টাবিংশতি বেদব্যাসের নামের সাথে সাথে ভবিষ্যৎ ব্যাসদেব অশ্বত্থামার নামও বর্ণিত হয়েছে। তিনি ভাবি মন্বন্তরে এসে বেদকে বিভাগসহ সম্পাদনা করবেন। জ্ঞাতমেতন্ময়া ত্বত্তো যথাপূৰ্বমিদং জগৎ। বিষ্ণুর্বিষ্ণৌ বিষ্ণুতশ্চ ন পরং বিদ্যতে ততঃ ॥  এতত্তু শ্রোতুমিচ্ছামি ব্যস্তা বেদা মহাত্মনা ।  বেদব্যাসস্য রূপেণ যথা তেন যুগে যুগে ॥ (বিষ্ণুপুরাণ:৩.৩.১-২) "এই জগৎ বিষ্ণুস্বরূপ ; বিষ্ণুতেই ইহা অবস্থিতি করিতেছে এবং সেই বিষ্ণু ব্যতিরিক্ত আর কোন পদার্থই নাই ; এইবিষয় পূর্বে আপনার নিকট জ্ঞাত হইয়াছি। মহাত্মা বিষ্ণু বেদব্যাসরূপে যুগে যুগে যে প্রকারে বেদ বিভাগ করিয়াছেন, এক্ষণে তাহা শ্রবণ করিতে ইচ্ছা করি।" এই ব্যাসরূপী বিষ্ণুর অবতারগণ যেহেতু জগতের কল্যাণের জন্য প্রতি মন্বন্তরের দ্বাপরযুগে আবির্ভূত হন। এই মন্বন্তরের বেদ সম্পাদক শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দুজনেই ভগবান শ্রীবিষ্ণুর অবতার তো ছিলেন বটে ; সাথে তারা সমসাময়িক ছিলেন। দুজনেই যেহেতু একই সময়ের ছিলেন তাই, ৫২০০ বছর পূর্বে আবির্ভূত হলেও ; এই কল্পের বা এই মন্বন্তরের বেদের অভ্যন্তরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নাম রয়েছে। দ্বাপরে দ্বাপরে বিষ্ণুর্ব্যাসরূপী মহামুনে ৷  বেদমেকং স বহুধা কুরুতে জগতো হিতঃ।। (বিষ্ণুপুরাণ:৩.৩.৫) "হে মহামুনে! ব্যাসরূপী বিষ্ণু, প্রতি দ্বাপরযুগেই জগতের মঙ্গলের জন্য এক বেদ বহুভাগে বিভক্ত করে সম্পাদিত করেন।" মনুর সংখ্যা চৌদ্দ, যথা—স্বায়ম্ভুব (ব্রহ্মার মানস পুত্র), স্বারোচিষ (স্বায়ম্ভবপুত্র প্রিয়ব্রতের পুত্র), ঔত্তম (প্রিয়ব্রতপুত্র উত্তমের পুত্র), তামস (প্রিয়ব্রতের পুত্র), রৈবত (প্রিয়ব্রতের পুত্র), চাক্ষুষ (অন্ধরাজের পুত্র), বৈবস্বত, সাবর্ণি, দক্ষসাবর্ণি, ব্রহ্মসাবর্ণি, ধর্মসাবর্ণি, রুদ্রসাবর্ণি, দেবসাবর্ণি (রোচ্য) এবং ইন্দ্রসাবর্ণি (ভৌত্য)। এক এক মনুর অধিকৃত কালের নাম মন্বন্তর। এক মন্বন্তর কিঞ্চিদধিক ৭১ দিব্য যুগ। ব্রহ্মার এক একটি দিন ও রাত্রিকে এক একটি কল্প বলে। দিনরূপ কল্পে সৃষ্টি ও রাত্রিরূপ কল্পে প্রলয় হয়। প্রত্যেক সৃষ্টিকল্পে ১৪টি মন্বন্তর হয় অর্থাৎ ১৪ জন মনু যথাক্রমে জগতের অধীশ্বর হন। অধুনা বৈবস্বত মনুর শাসন বা অধিকার চলছে। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি—এই চারি যুগে এক দৈব যুগ হয়। এইরূপ এক সহস্র দৈব যুগই এক সৃষ্টিকল্পের পরিমাণকাল। পরমেশ্বর ভগবানের এ বিবিধ অবতাররূপ ধারণের কারণ সম্পর্কে শ্রীমদ্ভাগবতের ষষ্ঠস্কন্ধে দক্ষ প্রজাপতি অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বলেছেন। তিনি ইন্দ্রিয়াতীত ভগবানকে 'হংসগুহ্য' নামক একটি স্তোত্রে বিষয়টি বলেন। সম্পূর্ণ জগৎ ভগবানেরই সৃষ্টি। আবার তিনিই উপাদান কারণ হয়ে তাঁর সৃষ্টির মধ্যেই অবস্থিত হয়ে আছেন। সৃষ্টির নিমিত্ত কারণ সহ সকল বিধিই তিনি। কার্য ও কারণের ভেদ যখন ছিল না তখনও ঈশ্বরই স্বয়ংসিদ্ধ স্বরূপে স্থিত ছিল। ঈশ্বর জীব-জগতের ভেদ ও স্বগতভেদ থেকে সর্বদাই মুক্ত এক ও অদ্বিতীয় স্বয়ং ব্রহ্ম। তিনিই মায়া, অবিদ্যা প্রভৃতি শক্তিসমূহ। বাদিপ্রতিবাদিগণের মধ্যে কখনাে বিবাদ কখনাে সংবাদ (ঐকমত্য)-এর বিষয় হয় এবং সেই সকল বাদী- প্রতিবাদীগণের অন্তঃকরণে পুনঃপুন মােহ উৎপাদন করে। তিনি অনন্ত, অপ্রাকৃত নিত্যগুণযুক্ত এবং নিজেও অনন্ত। সাকার মূর্তিতে উপাসকদের মতে তিনি হস্ত-পদাদিযুক্ত সাকার বিগ্রহ এবং তিনিই আবার হস্তপদবিহীন নিরাকার অচিন্ত্য। সাধনজগতে এমন বহুপ্রকার বিরুদ্ধমতাবলম্বী দেখা গেলেও সকলশাস্ত্রের লক্ষ্য একই। সেই লক্ষ্যের লক্ষ্যবস্তুতে তাদের কোন বিরােধ নেই। কারণ সকল শাস্ত্রের প্রতিপাদ্য বিষয়ই একই ; তা হল একমেবাদ্বিতীয়ম্ ভগবান।তিনি সকল বিধি নিষেধ এবং আধারের অতীত। তিনি সাকার এবং নিরাকার দুই অবিরুদ্ধসম্মতরূপেই চিন্তার অতীত পরব্রহ্ম। ভগবানের কোন প্রাকৃত নামও নেই, প্রাকৃত রূপও নেই ; তবুও যে ব্যক্তি তাঁকে ভজনা করে, তাদের প্রতি কৃপা করে তিনি মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামনাদি অবতার সহ নানারূপ ধারণ করে বিবিধ লীলা সম্পাদন করেন।বায়ু যেমন গন্ধের আশ্রয় নিয়ে সুগন্ধি বলে প্রতীত হলেও বাস্তবিকপক্ষে বায়ু নিজে সুগন্ধি নয়। এইভাবে সকলের সাধনার ধারানুসারে বাসনা পূরণকারী প্রভু বিভিন্নরূপে প্রকাশিত হয়ে ভক্তকে রক্ষা করলেও সেই রূপগুলো সাময়িক ক্ষণিকের।  যস্মিন্ যতাে যেন চ যস্য যস্মৈ  যদ্ যাে যথা কুরুতে কার্যতে চ। পরাবরেষাং পরমং প্রাক্ প্রসিদ্ধং তদ্ ব্ৰহ্ম তদ্ধেতুরনন্যদেকম্।।  যচ্ছক্তয়াে বদতাং বাদিনাং বৈ বিবাদসংবাদভুবাে ভবন্তি। কুর্বন্তি চৈষাং মুহুরাত্মমােহং তস্মৈ নমােঽনন্তগুণায় ভূম্নে৷৷  অস্তীতি নাস্তীতি চ বস্তুনিষ্ঠয়াে- রেকস্থয়াের্ভিন্নবিরুদ্ধর্ময়ােঃ। অবেক্ষিতং কিঞ্চন যােগসাংখ্যয়ােঃ সমং পরং হ্যানুকূলং বৃহত্তৎ৷। যােহনুগ্রহার্থং ভজতাং পাদমূল- মনামরূপাে ভগবাননন্তঃ।  নামানি রূপাণি চ জন্মকর্মভি- র্ভেজে স মহ্যং পরমঃ প্রসাদতু৷৷ যঃ প্রাকৃতৈর্জ্ঞানপথৈর্জনানাং যথাশয়ং দেহগতাে বিভাতি। যথানিলঃ পার্থিবমাশ্রিতো গুণং স ঈশ্বরাে মে কুরুতান্মনােরথম্৷ (শ্রীমদ্ভাগবত:০৬.০৪.৩০-৩৪) "হে ভগবান! এই সম্পূর্ণ জগৎ আপনার মধ্যেই অবস্থিত; আপনার থেকেই এর উৎপত্তি এবং অপর কারাের সাহায্য ছাড়া আপনিই এর নির্মাণ করেছেন। এ জগৎ আপনারই আর আপনারই জন্য। আপনিই জগতরূপে সৃষ্ট হচ্ছেন এবং সৃষ্টিকর্তাও আপনিই। এই সৃষ্ট হওয়া এবং সৃষ্টিকার্যের বিধিও আপনিই। আপনিই সকলকে দিয়ে কাজ করাবার প্রভু। কার্য ও কারণের ভেদ যখন ছিল না তখনও আপনি স্বয়ংসিদ্ধ স্বরূপে স্থিত ছিলেন। এজন্য সকল কিছুর কারণও আপনিই। প্রকৃত সত্য এই যে আপনি জীব জগতের ভেদ ও স্বগতভেদ থেকে সর্বদাই মুক্ত এক ও অদ্বিতীয়। আপনি স্বয়ং ব্রহ্ম, আপনি আমার প্রতি প্রসন্ন হােন। হে প্রভু! আপনারই মায়া, অবিদ্যা প্রভৃতি শক্তিসমূহ বাদিপ্রতিবাদিগণের মধ্যে কখনাে বিবাদ কখনাে সংবাদ (ঐকমত্য)-এর বিষয় হয় এবং সেই সকল বাদী- প্রতিবাদীগণের অন্তঃকরণে পুনঃপুন মােহ উৎপাদন করে। আপনি অনন্ত, অপ্রাকৃত নিত্যগুণযুক্ত এবং নিজেও অনন্ত। আমি আপনাকে প্রণাম করি।  হে ভগবান ! উপাসকদের মতে আপনি হস্ত-পদাদিযুক্ত সাকার বিগ্রহ আর সাংখ্যশাস্ত্র মতে হস্তপদবিহীন নিরাকার। এইরকম বিভিন্ন প্রকার বিরুদ্ধমতাবলম্বী হলেও ওই উভয়শাস্ত্রের লক্ষ্য একই, তাদের লক্ষ্যবস্তুতে বিরােধ নেই। কারণ দুটির প্রতিপাদ্য বিষয় একই পরমবস্তু ভগবান। আধার ছাড়া হাত পা থাকা সম্ভব নয় আর বিধি নিষেধেরও একটা সীমা আছে। আপনি সেই আধার এবং নিষেধের অতীত। তাই আপনি সাকার-নিরাকার দুইয়েরই অবিরুদ্ধসম্মত সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রতিপাদ্য পরব্রহ্ম। হে প্রভু ! আপনি অনন্ত। আপনার কোনাে প্রাকৃত নামও নেই, প্রাকৃত রূপও নেই ; তবুও যে ব্যক্তি আপনার চরণকমল ভজনা করে, তাদের প্রতি কৃপা করার জন্য আপনি নানারূপ ধারণ করে বিবিধ লীলা সম্পাদন করেন এবং সেই সেই রূপ এবং লীলানুরূপ নাম গ্রহণ করে থাকেন। হে পরমাত্মন ! আপনি আমাকে কৃপা করুন।  মানুষের উপাসনা প্রায়শই সাধারণ স্তরের হয়ে থাকে। তাই আপনি তাদের সকলের হৃদয়ে থেকে তাদের ধ্যান অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন দেবতার রূপে প্রতীত হয়ে থাকেন বায়ু যেমন গন্ধের আশ্রয় নিয়ে সুগন্ধি বলে প্রতীত হয় ; কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে বায়ু তাে আর নিজে সুগন্ধি নয়। এইভাবে সকলের সাধনার ধারানুসারে বাসনা পূরণকারী প্রভু আমার অভিলাষ পূর্ণ করুন৷" শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ। ফেসবুক পোস্ট লিঙ্ক :  শাশ্বত বেদে দ্বাপরযুগে অবতীর্ণ, শ্রীকৃষ্ণের নাম কি করে আসলো ?   ফেসবুক পেজ লিঙ্ক :  Shri Kushal Baran Chakraborty | Facebook
ভগবান শ্রীবিষ্ণুর বিভিন্ন নামের মধ্যে 'বাসুদেব' নামটি সুস্পষ্টভাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে নির্দেশ করে। যদু বংশীয় বসুদেব পুত্র শ্রীকৃষ্ণকেই বাসুদেব বলা হয়। অর্থাৎ বসুদেবের যিনি পুত্র, তিনিই বাসুদেব। সেই বাসুদেব নামটি বেদের মধ্যেও পাওয়া যায়।
নারায়ণায় বিদ্মহে বাসুদেবায় ধীমহি।
তন্নো বিষ্ণুঃ প্রচোদয়াৎ।।
(তৈত্তিরীয় আরণ্যক, ১০.১;
মহানারায়ণ উপনিষদ: ১০.১.২৯)
"আমরা নারায়ণকে জানব। তাই বাসুদেবের ধ্যান করি। সেই ধ্যানে তিনি আমাদের প্রেরণ করুন।"
সামবেদীয় ছান্দোগ্য উপনিষদে দেবকীপুত্র কৃষ্ণের কথা বলা হয়েছে। সেই সপ্তদশ খণ্ডে আত্মতত্ত্ব সংক্রান্ত দার্শনিক তত্ত্ব আলোচিত হয়েছে। শ্রীমদ্ভগবদগীতার দার্শনিক তত্ত্বের সাথে সেই ছান্দোগ্য উপনিষদের দার্শনিক তত্ত্ব অত্যন্ত সাদৃশ্যপূর্ণ। তাই বিভিন্ন দিক বিবেচনায় ছান্দোগ্য উপনিষদে বর্ণিত দেবকীপুত্র কৃষ্ণ এবং দ্বাপরযুগের অবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যে একই ব্যক্তি, একথা অনেকটা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
তদ্ধৈতদ্ ঘোর আঙ্গিরসঃ কৃষ্ণায় দেবকীপুত্ৰায়োক্ত্বোবাচাপিপাস এব
স বভূব সোঽস্তবেলায়ামেতত্রয়ং প্রতিপদ্যেতাক্ষিতমস্যচ্যুতমসি
প্রাণসংশিতমসীতি তত্রৈতে দ্বে ঋচৌ ভবতঃ॥
আদিৎ প্রত্নস্য রেতসঃ।
উদ্বয়ং তমসম্পরি জ্যোতিঃ পশ্যন্ত উত্তরং
স্বঃ পশ্যন্ত উত্তরং
দেবং দেবত্রা সূর্যমগন্ম জ্যোতিরুত্তমমিতি জ্যোতিরুত্তমমিতি ॥
(ছান্দোগ্য উপনিষদ: ৩.১৭.৬-৭)
"আঙ্গিরস ঘোর পূর্বোক্ত এই যজ্ঞবিজ্ঞান দেবকীপুত্র কৃষ্ণকে উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন, “যথোক্ত যজ্ঞবিদ্ মৃত্যুকালে এই মন্ত্রত্রয় জপ করবে-তুমি অক্ষত, তুমি অচ্যুত, তুমি সূক্ষ্মপ্রাণস্বরূপ৷” এই বিজ্ঞান শ্রবণ করে কৃদেবকীপুত্র কৃষ্ণ নিঃস্পৃহ হয়েছিলেন৷ এ বিষয়ে দুটি ঋক রয়েছে।
যে জ্যোতি পরব্রহ্মে প্রকাশিত, দিবালোকের ন্যায় সর্বব্যাপী, পুরাতন, ও জগৎকারণ, সেই পরমজ্যোতিকে ব্রহ্মবিদগণ সর্বত্র দর্শন করেন৷ আমাদের স্বহৃদয়স্থ জ্যোতির সঙ্গে যা অভিন্ন সেই
আদিত্যস্থ অজ্ঞানবিনাশক জ্যোতিকে দর্শন করে,-সকল জ্যোতি অপেক্ষা যে জ্যোতি উৎকৃষ্টতর, তাঁকে দর্শন করে- আমরা দেবগণের মধ্যে দ্যুতিমান্ পরমেশ্বরস্বরূপ সর্বোত্তম জ্যোতিকেই প্রাপ্ত হয়েছি৷"
বেদের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে ভগবানের মৎস্য, বরাহ, বামন, নৃসিংহাদি অবতারের কথা যেমন রয়েছে। তেমনি বেদের একাধিক স্থানে রয়েছে লীলা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা। এ প্রসঙ্গে একটি অত্যন্ত যৌক্তিক প্রশ্ন হতে পারে যে, বেদ তো শাশ্বত স্বয়ং পরমেশ্বরের নিঃশ্বাস স্বরূপ। বিষয়টি বেদের মধ্যেই বলা হয়েছে:
অস্য মহতো ভূতস্য নিঃশ্বসিতং যদেতদৃগ্বেদো
যজুর্বেদঃ সামবেদঃ অর্থবাঙ্গিরসঃ।
(বৃহদারণ্যক উপনিষদ ০২.০৪.১০)
"সেই পরমেশ্বর থেকেই ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ এবং অথর্ব বেদের উৎপত্তি। স্বয়ংপ্রকাশ এই চতুর্বেদই পরমেশ্বরের নিঃশ্বাসস্বরূপ। "
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তো ৫২০০ বছর আগে দ্বাপরযুগের শেষে অবতাররূপে এসেছেন। তবে শাশ্বত বেদে দ্বাপরযুগে অবতীর্ণ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নাম কি করে আসলো ? সরল ভাবে চিন্তা করলে সুপ্রাচীন শাশ্বত বেদের অভ্যন্তরে দ্বাপরযুগে অবতীর্ণ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রসঙ্গ থাকার কথা নয়।এ প্রশ্নের উত্তর মহাভারতের দ্রোণপর্বে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেই দিয়েছেন। ভগবান বলেছেন, তিনি নিজেই একই সময়ে একই সাথে তাঁর বিবিধ মূর্তিতে বিরাজমান। তিনি বিবিধ অচিন্ত্যমূর্তিতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে বিরাজমান। এ বিষয়টি মহাভারতসহ একাধিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে।
একা মূর্তিস্তপশ্চর্যাং কুরুতে মে ভুবি স্থিতা।
অপরা পশ্যতি জগৎ কুর্বাণং সাধ্বসাধুনী।।
অপরা কুরুতে কর্ম মানুষং লােকমাশ্রিতা।
শেতে চতুর্থী ত্বপরা নিদ্রাং বর্ষসহস্রিকাম্।।
(মহাভারত:দ্রোণ পর্ব,২৭.২৫-২৬)
"একটি মূর্তিতে আমি নারায়ণরূপে ভুবনে তপস্যা করি, পরব্রহ্মরূপ দ্বিতীয় মূর্তি জগতের ভাল-মন্দ কার্য দর্শন করি।
মৎস্য-কূর্মাদি অবতাররূপ তৃতীয় মূর্তিতে মনুষ্যলােকে থেকে মানুষের মত কার্য করে ধর্মসংস্থাপন করি এবং চতুর্থী মূর্তিতে অনন্তকালব্যাপী কালনিদ্রায় কারণসমুদ্রে শায়িত থাকি।"
যেমন ব্রহ্মরূপে তিনি আছেন, তেমনি তিনি আবার মানুষের কল্যাণের জন্য অবতার রূপেও আসেন। তিনিই ব্রহ্মা হয়ে সৃষ্টি করেন, বিষ্ণু হয়ে পালন করেন আবার তিনিই মহেশ্বর শিবরূপে বিনাশ করেন। পরমেশ্বরের অনন্তরূপী এ বিষয়টি আমরা না বুঝে অহেতুক ভুল বিভ্রান্ত হয়ে যাই।শাশ্বত বেদের অভ্যন্তরে ৫২০০ বছর আগে দ্বাপরযুগের শেষে আবির্ভূত ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নাম প্রসঙ্গে আরেকটি অত্যন্ত যৌক্তিক উত্তর হল। প্রতি কল্পে ভগবান বেদের জ্ঞান ঋষিদের প্রদান করেন। প্রতি কল্পেই এক একজন ব্যাসদেব এসে এই বেদকে সম্পাদিত করেন। বর্তমান কল্পে বেদকে যিনি সম্পাদনা করেছেন, তাঁর নাম শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস। তিনি ভগবানের চব্বিশ অবতারের অন্যতম। তাঁর প্রকৃত নাম শ্রীকৃষ্ণ। তিনি যমুনা নদীর কূলে এক দ্বীপে জন্মেছেন, তাই তাঁর নামের সাথে এসে যুক্ত হয় দ্বৈপায়ন এবং তিনি বেদকে সম্পাদনা করেছেন তাই তাঁর নামের সাথে একটি উপাধি যুক্ত হয় ‘বেদব্যাস’। শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাসের পিতার নাম ঋষি পরাশর এবং মাতার নাম সত্যবতীর।শ্রীমদ্ভাগবতে তাঁর সম্পর্কে বলা আছে:
ততঃ সপ্তদশো জাতঃ সত্যবত্যাং পরাশরাৎ।
চক্রে বেদতরোঃ শাখা দৃষ্ট্বা পুংসঃ অল্পমেধসঃ।।
(শ্রীমদ্ভাগবত: ০১.০৩.২১)
"এরপর তিনি সপ্তদশ অবতারে সত্যবতীর গর্ভে এবং পরাশর মুনির ঔরসে বেদব্যাসরূপে অবতীর্ণ হন। পৃথিবীর মানুষের মেধাশক্তি দিনদিন ক্ষীণ হয়ে আসছে দেখে অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন মানবের প্রতি কৃপাপূর্ণ হয়ে তিনি বেদরূপ বৃক্ষের শাখা বিভাজন করেন (তাই তাঁর নামের সাথে অনন্তকালের জন্যে একটি উপাধি যুক্ত হয় বেদব্যাস)।"
মহাভারতের শান্তিপর্বে বলা হয়েছে, কল্পে কল্পে বা মন্বন্তরে ভগবান ঋষিদের মাধ্যমে মানবজাতিকে বেদ জ্ঞান দান করেন।
ঋষয়ো মন্ত্রদ্রষ্টারো ন তু বেদস্য কর্তারঃ।
ন কশ্চিদদ্বেদ কর্ত্তা চ বেদস্মর্তা চতুর্ভুজঃ।।
যুগান্তে অন্তর্হিতান্ বেদান্ সেতিহাসান্ মহর্ষয়ঃ।
লেভিরে তপসা পূর্বমনুজ্ঞাতা স্বয়ম্ভূবা।
(মহাভারত: শান্তিপর্ব, ২১০.১৯)
"একমাত্র ভগবান ছাড়া কেউই বেদের স্রষ্টা নয়। বেদদ্রষ্টা ঋষিগণ মন্ত্রদ্রষ্টা মাত্র, বেদের রচনাকারী নন। যুগান্তে প্রলয়কালে ইতিহাস সহ বেদ অপ্রকাশিত হয়ে থাকে। কিন্তু সৃষ্টির শুরুতে মহর্ষিরা তপস্যার মাধ্যমে স্বয়ম্ভূ পরমেশ্বর থেকে এ জ্ঞানপ্রবাহ পুনরায় লাভ করেন।"
বিষ্ণুপুরাণে বলা হয়েছে, ভগবান বিষ্ণুই বেদব্যাসরূপে যুগে যুগে জগতে এসে বেদ বিভাগ করেন। বিষ্ণুপুরাণে পূর্ববর্তী অষ্টাবিংশতি বেদব্যাসের নামের সাথে সাথে ভবিষ্যৎ ব্যাসদেব অশ্বত্থামার নামও বর্ণিত হয়েছে। তিনি ভাবি মন্বন্তরে এসে বেদকে বিভাগসহ সম্পাদনা করবেন।
জ্ঞাতমেতন্ময়া ত্বত্তো যথাপূৰ্বমিদং জগৎ।
বিষ্ণুর্বিষ্ণৌ বিষ্ণুতশ্চ ন পরং বিদ্যতে ততঃ ॥
এতত্তু শ্রোতুমিচ্ছামি ব্যস্তা বেদা মহাত্মনা ।
বেদব্যাসস্য রূপেণ যথা তেন যুগে যুগে ॥
(বিষ্ণুপুরাণ:৩.৩.১-২)
"এই জগৎ বিষ্ণুস্বরূপ ; বিষ্ণুতেই ইহা অবস্থিতি করিতেছে এবং সেই বিষ্ণু ব্যতিরিক্ত আর কোন পদার্থই নাই ; এইবিষয় পূর্বে আপনার নিকট জ্ঞাত হইয়াছি। মহাত্মা বিষ্ণু বেদব্যাসরূপে যুগে যুগে যে প্রকারে বেদ বিভাগ করিয়াছেন, এক্ষণে তাহা শ্রবণ করিতে ইচ্ছা করি।"
এই ব্যাসরূপী বিষ্ণুর অবতারগণ যেহেতু জগতের কল্যাণের জন্য প্রতি মন্বন্তরের দ্বাপরযুগে আবির্ভূত হন। এই মন্বন্তরের বেদ সম্পাদক শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দুজনেই ভগবান শ্রীবিষ্ণুর অবতার তো ছিলেন বটে ; সাথে তারা সমসাময়িক ছিলেন। দুজনেই যেহেতু একই সময়ের ছিলেন তাই, ৫২০০ বছর পূর্বে আবির্ভূত হলেও ; এই কল্পের বা এই মন্বন্তরের বেদের অভ্যন্তরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নাম রয়েছে।
দ্বাপরে দ্বাপরে বিষ্ণুর্ব্যাসরূপী মহামুনে ৷
বেদমেকং স বহুধা কুরুতে জগতো হিতঃ।।
(বিষ্ণুপুরাণ:৩.৩.৫)
"হে মহামুনে! ব্যাসরূপী বিষ্ণু, প্রতি দ্বাপরযুগেই জগতের মঙ্গলের জন্য এক বেদ বহুভাগে বিভক্ত করে সম্পাদিত করেন।"
মনুর সংখ্যা চৌদ্দ, যথা—স্বায়ম্ভুব (ব্রহ্মার মানস পুত্র), স্বারোচিষ (স্বায়ম্ভবপুত্র প্রিয়ব্রতের পুত্র), ঔত্তম (প্রিয়ব্রতপুত্র উত্তমের পুত্র), তামস (প্রিয়ব্রতের পুত্র), রৈবত (প্রিয়ব্রতের পুত্র), চাক্ষুষ (অন্ধরাজের পুত্র), বৈবস্বত, সাবর্ণি, দক্ষসাবর্ণি, ব্রহ্মসাবর্ণি, ধর্মসাবর্ণি, রুদ্রসাবর্ণি, দেবসাবর্ণি (রোচ্য) এবং ইন্দ্রসাবর্ণি (ভৌত্য)। এক এক মনুর অধিকৃত কালের নাম মন্বন্তর। এক মন্বন্তর কিঞ্চিদধিক ৭১ দিব্য যুগ। ব্রহ্মার এক একটি দিন ও রাত্রিকে এক একটি কল্প বলে। দিনরূপ কল্পে সৃষ্টি ও রাত্রিরূপ কল্পে প্রলয় হয়। প্রত্যেক সৃষ্টিকল্পে ১৪টি মন্বন্তর হয় অর্থাৎ ১৪ জন মনু যথাক্রমে জগতের অধীশ্বর হন। অধুনা বৈবস্বত মনুর শাসন বা অধিকার চলছে। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি—এই চারি যুগে এক দৈব যুগ হয়। এইরূপ এক সহস্র দৈব যুগই এক সৃষ্টিকল্পের পরিমাণকাল।
পরমেশ্বর ভগবানের এ বিবিধ অবতাররূপ ধারণের কারণ সম্পর্কে শ্রীমদ্ভাগবতের ষষ্ঠস্কন্ধে দক্ষ প্রজাপতি অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বলেছেন। তিনি ইন্দ্রিয়াতীত ভগবানকে 'হংসগুহ্য' নামক একটি স্তোত্রে বিষয়টি বলেন। সম্পূর্ণ জগৎ ভগবানেরই সৃষ্টি। আবার তিনিই উপাদান কারণ হয়ে তাঁর সৃষ্টির মধ্যেই অবস্থিত হয়ে আছেন। সৃষ্টির নিমিত্ত কারণ সহ সকল বিধিই তিনি। কার্য ও কারণের ভেদ যখন ছিল না তখনও ঈশ্বরই স্বয়ংসিদ্ধ স্বরূপে স্থিত ছিল। ঈশ্বর জীব-জগতের ভেদ ও স্বগতভেদ থেকে সর্বদাই মুক্ত এক ও অদ্বিতীয় স্বয়ং ব্রহ্ম। তিনিই মায়া, অবিদ্যা প্রভৃতি শক্তিসমূহ। বাদিপ্রতিবাদিগণের মধ্যে কখনাে বিবাদ কখনাে সংবাদ (ঐকমত্য)-এর বিষয় হয় এবং সেই সকল বাদী- প্রতিবাদীগণের অন্তঃকরণে পুনঃপুন মােহ উৎপাদন করে। তিনি অনন্ত, অপ্রাকৃত নিত্যগুণযুক্ত এবং নিজেও অনন্ত। সাকার মূর্তিতে উপাসকদের মতে তিনি হস্ত-পদাদিযুক্ত সাকার বিগ্রহ এবং তিনিই আবার হস্তপদবিহীন নিরাকার অচিন্ত্য। সাধনজগতে এমন বহুপ্রকার বিরুদ্ধমতাবলম্বী দেখা গেলেও সকলশাস্ত্রের লক্ষ্য একই। সেই লক্ষ্যের লক্ষ্যবস্তুতে তাদের কোন বিরােধ নেই। কারণ সকল শাস্ত্রের প্রতিপাদ্য বিষয়ই একই ; তা হল একমেবাদ্বিতীয়ম্ ভগবান।তিনি সকল বিধি নিষেধ এবং আধারের অতীত। তিনি সাকার এবং নিরাকার দুই অবিরুদ্ধসম্মতরূপেই চিন্তার অতীত পরব্রহ্ম। ভগবানের কোন প্রাকৃত নামও নেই, প্রাকৃত রূপও নেই ; তবুও যে ব্যক্তি তাঁকে ভজনা করে, তাদের প্রতি কৃপা করে তিনি মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামনাদি অবতার সহ নানারূপ ধারণ করে বিবিধ লীলা সম্পাদন করেন।বায়ু যেমন গন্ধের আশ্রয় নিয়ে সুগন্ধি বলে প্রতীত হলেও বাস্তবিকপক্ষে বায়ু নিজে সুগন্ধি নয়। এইভাবে সকলের সাধনার ধারানুসারে বাসনা পূরণকারী প্রভু বিভিন্নরূপে প্রকাশিত হয়ে ভক্তকে রক্ষা করলেও সেই রূপগুলো সাময়িক ক্ষণিকের।
যস্মিন্ যতাে যেন চ যস্য যস্মৈ
যদ্ যাে যথা কুরুতে কার্যতে চ।
পরাবরেষাং পরমং প্রাক্ প্রসিদ্ধং
তদ্ ব্ৰহ্ম তদ্ধেতুরনন্যদেকম্।।
যচ্ছক্তয়াে বদতাং বাদিনাং বৈ
বিবাদসংবাদভুবাে ভবন্তি।
কুর্বন্তি চৈষাং মুহুরাত্মমােহং
তস্মৈ নমােঽনন্তগুণায় ভূম্নে৷৷
অস্তীতি নাস্তীতি চ বস্তুনিষ্ঠয়াে-
রেকস্থয়াের্ভিন্নবিরুদ্ধর্ময়ােঃ।
অবেক্ষিতং কিঞ্চন যােগসাংখ্যয়ােঃ
সমং পরং হ্যানুকূলং বৃহত্তৎ৷।
যােহনুগ্রহার্থং ভজতাং পাদমূল-
মনামরূপাে ভগবাননন্তঃ।
নামানি রূপাণি চ জন্মকর্মভি-
র্ভেজে স মহ্যং পরমঃ প্রসাদতু৷৷
যঃ প্রাকৃতৈর্জ্ঞানপথৈর্জনানাং
যথাশয়ং দেহগতাে বিভাতি।
যথানিলঃ পার্থিবমাশ্রিতো গুণং
স ঈশ্বরাে মে কুরুতান্মনােরথম্৷
(শ্রীমদ্ভাগবত:০৬.০৪.৩০-৩৪)
"হে ভগবান! এই সম্পূর্ণ জগৎ আপনার মধ্যেই অবস্থিত; আপনার থেকেই এর উৎপত্তি এবং অপর কারাের সাহায্য ছাড়া আপনিই এর নির্মাণ করেছেন। এ জগৎ আপনারই আর আপনারই জন্য। আপনিই জগতরূপে সৃষ্ট হচ্ছেন এবং সৃষ্টিকর্তাও আপনিই। এই সৃষ্ট হওয়া এবং সৃষ্টিকার্যের বিধিও আপনিই। আপনিই সকলকে দিয়ে কাজ করাবার প্রভু। কার্য ও কারণের ভেদ যখন ছিল না তখনও আপনি স্বয়ংসিদ্ধ স্বরূপে স্থিত ছিলেন। এজন্য সকল কিছুর কারণও আপনিই। প্রকৃত সত্য এই যে আপনি জীব জগতের ভেদ ও স্বগতভেদ থেকে সর্বদাই মুক্ত এক ও অদ্বিতীয়। আপনি স্বয়ং ব্রহ্ম, আপনি আমার প্রতি প্রসন্ন হােন।
হে প্রভু! আপনারই মায়া, অবিদ্যা প্রভৃতি শক্তিসমূহ বাদিপ্রতিবাদিগণের মধ্যে কখনাে বিবাদ কখনাে সংবাদ (ঐকমত্য)-এর বিষয় হয় এবং সেই সকল বাদী- প্রতিবাদীগণের অন্তঃকরণে পুনঃপুন মােহ উৎপাদন করে। আপনি অনন্ত, অপ্রাকৃত নিত্যগুণযুক্ত এবং নিজেও অনন্ত। আমি আপনাকে প্রণাম করি।
হে ভগবান ! উপাসকদের মতে আপনি হস্ত-পদাদিযুক্ত সাকার বিগ্রহ আর সাংখ্যশাস্ত্র মতে হস্তপদবিহীন নিরাকার। এইরকম বিভিন্ন প্রকার বিরুদ্ধমতাবলম্বী হলেও ওই উভয়শাস্ত্রের লক্ষ্য একই, তাদের লক্ষ্যবস্তুতে বিরােধ নেই। কারণ দুটির প্রতিপাদ্য বিষয় একই পরমবস্তু ভগবান। আধার ছাড়া হাত পা থাকা সম্ভব নয় আর বিধি নিষেধেরও একটা সীমা আছে। আপনি সেই আধার এবং নিষেধের অতীত। তাই আপনি সাকার-নিরাকার দুইয়েরই অবিরুদ্ধসম্মত সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রতিপাদ্য পরব্রহ্ম।
হে প্রভু ! আপনি অনন্ত। আপনার কোনাে প্রাকৃত নামও নেই, প্রাকৃত রূপও নেই ; তবুও যে ব্যক্তি আপনার চরণকমল ভজনা করে, তাদের প্রতি কৃপা করার জন্য আপনি নানারূপ ধারণ করে বিবিধ লীলা সম্পাদন করেন এবং সেই সেই রূপ এবং লীলানুরূপ নাম গ্রহণ করে থাকেন। হে পরমাত্মন ! আপনি আমাকে কৃপা করুন।
মানুষের উপাসনা প্রায়শই সাধারণ স্তরের হয়ে থাকে। তাই আপনি তাদের সকলের হৃদয়ে থেকে তাদের ধ্যান অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন দেবতার রূপে প্রতীত হয়ে থাকেন বায়ু যেমন গন্ধের আশ্রয় নিয়ে সুগন্ধি বলে প্রতীত হয় ; কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে বায়ু তাে আর নিজে সুগন্ধি নয়। এইভাবে সকলের সাধনার ধারানুসারে বাসনা পূরণকারী প্রভু আমার অভিলাষ পূর্ণ করুন৷"
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁