ভারত, নেপাল যেখানে হিন্দু সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ, সে সকল দেশের বাস্তবতা এবং বাংলাদেশের বাস্তবতা এক নয়। বাংলাদেশে রাষ্ট্রের বিশেষ সংরক্ষণ সুবিধা না থাকায়, হিন্দু সম্প্রদায়ের সংখ্যা দিনেদিনে অবনতি হচ্ছে। তাই বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ তাদের পুরাণত শাস্ত্রীয় আইনকে পরিবর্তন করতে আপাতত রাজি নয়। তবে বিভিন্ন অরাজনৈতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বা এনজিওর সাথে যুক্ত নেতৃবৃন্দ ব্যতিক্রম। তারা হিন্দু শাস্ত্রীয় আইনে ছুরি চালিয়ে কাটাছেঁড়া করে তাদের আকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন করে নিতে চায়। বিষয়টি নিয়ে সনাতনপন্থী এবং সংস্কারপন্থী এ দুইপক্ষই যুদ্ধংদেহী ভাবাপন্ন। এ প্রসঙ্গে দুইপক্ষের কোন পক্ষের অন্তর্ভুক্ত হয়েও নিরপেক্ষভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, কালের পরবর্তনে বিধিব্যবস্থাকেও পরিবর্তিত করে যুগোপযোগী করে নেয়ার বিধান বেদাদি শাস্ত্রেই উল্লেখ রয়েছে। সনাতন ধর্ম সর্বদা সর্বকালের আধুনিক একটি ধর্ম। শুধু ধর্ম নয়, সম্পূর্ণ জীবনব্যবস্থা। তাই সনাতন ধর্মের বিধিবিধানের সকল বিধানই অচলায়তনের জগদ্বল পাথর কখনো শাস্ত্রের নামে শস্ত্র হয়ে মনুষ্যের বুকে চেপে থাকে না। প্রয়োজনে এ পাথরকে ঘষামাজা যেমনি করা যায়, তেমনি সরিয়েও ফেলা যায়। তাই সনাতন সমাজ সর্বদা সংস্কৃত হয়ে চির তরুণ এবং চির আধুনিক।
প্রয়োজনে সনাতন বিধিব্যবস্থা বা আইনকে পরিবর্তন করা যায়। এর জন্যে প্রয়োজনের স্থান, কাল পাত্রকে বিবেচনায় নেয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। ধর্মের গতি গভীর এবং নিগূঢ়তম। প্রয়োজনে ধর্মে গতিপ্রকৃতি পরিবর্তিত হয়। সেই আপদধর্মের বাস্তবতার কারণে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ে অধিকাংশ মানুষই বর্তমানে হিন্দু আইনের সংস্কারকে সুদৃষ্টিতে দেখেন না। তারা বিষয়টিকে অপ্রয়োজনীয় এবং মিছরির ছুরির মত সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখেন। সেই বাস্তবতায় আপাতত হিন্দু বিশেষ আইনে পরিবর্তন না করে, বিদ্যমান আইনের মধ্যেও বহু বিষয়ের অত্যন্ত যৌক্তিক সমাধান করা যায়। এক্ষেত্রে একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে বিষয়টি বোঝানো সম্ভব। বাংলাদেশের হিন্দু পিতামাতার যদি কোন পুত্র সন্তান না থাকে। এবং শুধুই এক বা একাধিক কন্যা সন্তান থাকে তারা তাদের সম্পত্তির উত্তরসূরী নিয়ে চিন্তিত স্বভাবতই ব্যাপক চিন্তিত হয়ে পড়েন। কিন্তু তারা মাত্র ১০০ টাকা সরকারি রেজিস্ট্রেশন ফি দিয়ে নিজের স্ত্রী, কন্যা বা সন্তানসন্ততিদের নামে দানপত্র করে দিতে পারেন। এই আইনটি ব্যবহারের মাধ্যমে উত্তরাধিকার আইনের অনেক সমস্যার খুব সহজেই সহজতর সমাধান সম্ভব।'দানপত্র' বা 'হেবা' আইনটি দেশে মুসলিম সম্প্রদায়ের মাঝে অনেক আগে থেকেই বিদ্যমান রয়েছে। তাদের কাছে এ আইনটি হেবা আইন নামে পরিচিত। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে ২০০৯ সালে জন্মাষ্টমীর অনুষ্ঠানে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ এই আইনটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে বাস্তবায়নের অনুরোধ করেন। প্রধানমন্ত্রী আইনটি বাস্তবায়নের কথা দিয়ে বলেন, হেবা আইনের সাথে যেহেতু ইসলামের ধর্মীয় বিধান জড়িত আছে; ঠিক সেভাবেই দানপত্রের কোন বৈদিক বা বেদানুগত বিধান প্রদান করতে। তবেই আইনটি সংসদে পাশ করে দেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসারে তৎকালীন আইনমন্ত্রীর প্রচেষ্টায় আইনটি ড্রাফট করা শুরু হয়। পরবর্তীতে আইনটি পাশ হয়।আইনটি শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে সংখ্যালঘু বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের জন্য প্রযোজ্য হয়। এ আইনের মাধ্যমে একজন অবিভাবক নির্ঝঞ্ঝাটভাবে দানপত্রের মাধ্যমে তাদের সন্তানসন্ততিদের মাঝে সম্পত্তি দান করতে পারেন। এ দানপত্রে সরকারি রেজিস্ট্রেশন খরচ মাত্র ১০০ টাকা। আইনটি আজ ২০২১ খ্রিস্টাব্দে এসেও হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে অত্যন্ত অপরিচিত। এমনকি অনেক আইনজীবীরাও দেখেছি এ আইনের বিষয়টি জানেন না। তাই আমি সরকারি গেজেট থেকে সম্পূর্ণ আইনটি তুলে দিচ্ছি:
Published in Bangladesh Gazette Extra-ordinary Dated 24th September, 2012
Act No. 41 of 2012
Registration Act, 1908 এর অধিকতর সংশোধকল্পে প্রণীত আইন
যেহেতু নিম্নবর্ণিত উদ্দেশ্যসমূহ পূরণকল্পে Registration Act, 1908 Act No. XVI of 1908) এর অধিকতর সংশোধন করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়; সেহেতু এতদ্দ্বারা নিম্নরূপ আইন করা হইল :
১। সংক্ষিপ্ত শিরোনাম ও প্রবর্তন।–(১) এই আইন Registration (Amendment) Act, 2012 নামে অভিহিত হইবে ।
(২) সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, যে তারিখ নির্ধারণ করিবে সেই তারিখে এই আইন কার্যকর হইবে।
21 Act No. XVI of 1908 এর section 17 এর sub-section (1) এ নূতন clause (aaa) এর সন্নিবেশ।
Registration Act, 1908 (Act No. XVI of 1908), অতঃপর উক্ত Act বলিয়া উল্লিখিত, এর section 17 এর sub section (1) এর clause (ca) এর পর নিম্নরূপ নূতন clause (aaa) সন্নিবেশিত হইবে, যথাঃ—
"(aaa) declaration of gift under the Hindu, Christian and Buddhist Personal Law,"
31 Act No. XVI of 1908 এর section 78A এ নূতন clause (bb) এর সন্নিবেশ।– উক্ত Act এর section 78A এর clause (b) এর পর নিম্নরূণ clause (bb) সন্নিবেশিত হইবে,
"(bb) registration fee payable for registration of a declaration of gift of any immovable property made under the Hindu, Christian and Buddhist Personal Law, if such gift is permitted by their Personal Law, shall be one hundred taka irrespective of the value of the property, provided such gift is made between spouses, parents and children, grand parents and grand children, full brothers, full sisters and, full brothers and full sisters;"
আমি আইনের ছাত্র নই। এরপরও আইনটি পড়ে আমি যতটুকু আমি বুঝতে পেরেছি, তা হল: দেশের
হিন্দু, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বিশেষ আইন অনুসারে যে কোনও স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি মাত্র একশত টাকা রেজিস্ট্রেশন ফি দিয়ে দান করতে পারবে। স্বামী-স্ত্রী, পিতামাতা এবং সন্তানের মধ্যে; দাদু, পিতামাতা এবং সন্তানদের মধ্যে; সকল ভাইদের মধ্যে, সকল বোনেদের মধ্যে সম্পত্তির মূল্য নির্বিশেষে একশত টাকা রেজিস্ট্রেশন ফি দিয়ে এ দানপত্র করতে পারবে। তবে এ দানপত্র আইনটি তৈরির সাথে আমার একটি সুখকর স্মৃতি করেছে। সে স্মৃতিটি হল- যখন দানপত্রের কোন বৈদিক বা বেদানুগত পূর্ববর্তী বিধান প্রদান করতে বলেন। তখন সচিবালয়ে এই আইনটি ড্রাফট করা ব্যক্তিগণ, এই আইনের কোন বৈদিক বা শাস্ত্রীয় রেফারেন্স খোঁজা শুরু করেন। সে ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের ঢাকেশ্বরী কেন্দ্রিক হিন্দু নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ করেন। তবে কেউ মৃত্যুর পূর্বে পিতার সন্তানকে প্রদানের রেফারেন্স খুঁজে দিতে পারে না। অথবা এটাও হতে পারে সেই নেতৃবৃন্দের দেয়া রেফারেন্স সেই দায়িত্বপ্রাপ্ত আমলাদের পছন্দ হয়নি। বিষয়টি বিভিন্ন ব্যক্তি হয়ে আমার কাছে আছে। এ প্রসঙ্গে দুজন কর্মকর্তা আমার সাথে যোগাযোগ করে। তখন আমি ঋগ্বেদ থেকে এমনি একটি পিতার দানপত্রের শাস্ত্রীয় রেফারেন্স খুঁজে দেই। এবং সাথে মন্ত্রটি অনুবাদ করে সেই দায়িত্বপ্রাপ্ত আমলাদের প্রদান করি। পরবর্তীতে আইনটি পাশ হয়। তারা আমাকে না জানালেও, আমি দানপত্র আইনটি সংসদে পাশ হওয়ার বিষয়টি জানতে পারি। আমার আনন্দ হয় এ বিষয়টি ভেবে যে, সম্প্রদায়ের কল্যাণে পাশ হওয়া একটি আইনের পেছনে, আমার বিন্দু পরিমাণ ভূমিকা রয়েছে। ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুন, চট্টগ্রামের জেএম সেন হলে একটি ধর্মীয় সংগঠনের অনুষ্ঠানে আমাকে নিমন্ত্রিত করে। আমার পূর্ববর্তী বক্তা, ছিলেন চট্টগ্রামের একজন পরম শ্রদ্ধেয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। সেই অনুষ্ঠানে তিনি তার বক্তৃতায় বলেন যে, হিন্দুদের হেবা বা দানপত্র আইনটি অতিদ্রুতই পাশ হবে। তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাকে আস্বস্ত করেছেন যে আইনটি অতিশীঘ্রই সংসদে পাশ হবে। চট্টগ্রামের সেই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বক্তব্যের ঠিক পরেই, আমার বক্তব্যের সুযোগ আসলো। আমি তখন আমার বক্তব্যে বললাম- দাদা! আমার খুব দুঃখ লাগলো, এ কথাটি শুনে যে আপনার কথামত আইনটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পাশ করে দিবেন। হিন্দু দানপত্র আইনটা অলরেডি কয়েকবছর আগে ২০১২ সালেই পাশ হয়ে গেছে। সেটা তিনি জানেন না। অথচ তিনি ২০১৮ সালে এসে প্রকাশ্য সবায় বললেন যে, তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বলে আইনটি শীঘ্রই পাশ করিয়ে দিতে সাহায্য করবেন। আমি সেই দাদার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে, পুনরায় বললাম, দাদা! এতবছর আগে পাশ হয়ে যাওয়া আইনটির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে অন্ততপক্ষে আপনার জানা উচিত ছিল। দাদার দুর্ভাগ্য ছিল যে, যে ব্যক্তি আইনটি পাশের ব্যাকগ্রাউন্ডে তথ্যসংগ্রহে বিন্দু পরিমাণ ভূমিকা ছিল; এমনি একজন সেই সভাতেই উপস্থিত। সেখানেই বিপত্তি বা গোল বেঁধেছে। হয়ত এ বক্তব্য দাদা আরও শতশত সভায় দিয়েছেন। সকলেই শ্রোতা হয়ে তার কথা শুধুই শুনে গিয়েছে।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
ফেসবুক পোস্ট লিঙ্ক : হিন্দু দানপত্র আইন।
ফেসবুক পেজ লিঙ্ক : Shri Kushal Baran Chakraborty | Facebook