মানুষের দেহের ভূগোল এবং মনের ভূগোলের মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সামঞ্জস্যতা থাকে না। দেহ এক কথা বলে, মন অন্য কথা বলে। কত যে পুরুষের দেহের মধ্যে নারীসত্ত্বা লুকিয়ে আছে, সমাজ কয়জনে এর খবর রাখে। তেমনিভাবে বহু নারীর মাঝেই পুরুষ সত্ত্বা প্রচ্ছন্ন বা অপ্রচ্ছন্নভাবে লুকিয়ে থাকে। সমাজ যতই বন্ধনে বাঁধতে চায়, মনের বাঁধন ততই ছিড়ে যায়। সমাজ সংসার কাউকে উপকার করতে পারুক আর নাই পারুক উপদেশের অন্ত নেই। এ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একজন পুরুষ যেহেতু পরিবারকে পরিচালনা করে। তাই ছেলেদের জীবনটা সমাজ সংসারের প্রয়োজনীয় অথবা অপ্রয়োজনীয় উপদেশে উপদেশেই কেটে যায়। সমাজ সংসার আজও শেখায়, পুরুষ মানেই রুক্ষতা, পুরুষ মানেই দৃঢ়তা, পুরুষ মানেই বীরত্ব, পুরুষ মানেই আবেগহীনতা। পুরুষদের কাজ গাধার মত নিঃশব্দে সংসারের ভার শুধু বহন করে যাওয়া। পুরুষ জীবনের অতিদুঃখেও মন খুলে কাঁদতে পারবে না।
বাঙালি এমন পুরুষ বোধহয় কমই আছে, যাকে এই কথাগুলো শুনতে হয়নি, "ছেলে হয়ে চোখে জল? ছিঃ লজ্জা করে না কান্নাকাটি করতে? ওটা মেয়েদের মানায়। তুই না ছেলে! ছেলে হয়ে কি করে এমনভাবে কাঁদছিস? মনে রাখবি ছেলেরা কখনো কাঁদে না"।পরিবার সমাজের ভাবটা এমন যে, ছেলেদের চোখে জল আসতে নেই। শত দুঃখ বেদনায় তাদের কাঁদতে নেই। সমাজ এভাবে আমাদের আবেগ অনুভূতি পর্যন্ত নির্দিষ্ট করে দিতে চায়। কিন্তু কি যাকে এই কথাগুলো বলছে অন্তর্জগতে কি একটু উঁকি দিয়ে দেখেছে? কত ব্যাথার পাহাড় জমা রয়েছে সেই বুকে।
কোন পুরুষ একটু ফর্সা হলে তাকে শুনতে হয়, "দেখ, ছেলেটা কেমন কিটকিটে মেয়েদের মত ফর্সা। ছেলেদের একটু কালো বা শ্যামলা চেহারার হলেই ভালো লাগে"।আবার ছেলেটা যদি কালো হয়ে সুন্দরী মেয়েকে পছন্দ করে। তবে সমাজের ভাষ্য, " ভাতের পাতিলের মত কুচকুচে কালা হয়ে পরীর মত সুন্দরী মেয়েটার পিছনে ঘুরছে"। সমাজ তার সুযোগ সুবিধা অনুসারে সকল প্রকারের কথাই বলে যায়। সমাজের উপদেশ দানের পিছনে, শুভাকাঙ্ক্ষীর ছদ্মবেশ থাকে।তবে সমাজ সংসার যতই ছদ্মবেশ ধারণ করুক না কেন, ঈর্ষার দুর্গন্ধকে ঢাকতে পারে না।
পড়াশোনা করা অবস্থায় ছেলেদের জন্য একটি আতঙ্কের কথা হলো, " ভালো করে পড়াশোনা কর, যাতে দ্রুতই একটি চাকরি যোগার করতে পারিস।তোর বাবা চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার আর বেশিদিন নেই। এরমধ্যেই কিছু একটা করতে হবে"। পড়াশোনা করা বেকার ছেলের কাছে পরিবারের এ কথাগুলো পাহাড়ের মত ভারি বোধ হয়। বাবার চাকরি শেষ হওয়ার অনেক আগে থেকেই শুনতে হয় কিছু একটা করার। আর বাবার চাকরি শেষ হওয়ার পরে তো আর রক্ষা নাই।
বাসে ট্রেনে যাওয়ার সময়ে কখনো ভুলক্রমে যদি মেয়েদের সিটে কোন ছেলে বসে যায়, তখন সাথে সাথেই যাত্রীদের মধ্যে থেকে বহু নারী কল্যাণ সঙ্ঘের সদস্য আবির্ভূত হয়ে যায়। শুরু হয়ে যায় জ্ঞানদান- "ও দাদা, ছেলে হয়ে মেয়েদের সিটে বসে আছেন। দেখছেন না এখানে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে, পরিবার থেকে কোন ভদ্রতাও শিখে আসেন নি"? অথচ কথাগুলো ছেলেটিকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলা যেত।
পুরুষের জীবনব্যাপী শুধু দায়িত্ব কর্তব্য। এই দায়িত্বের মধ্যে বড় দায়িত্ব হলো, সঙ্গীর সারাজীবনের দায়িত্ব নেয়া। যা প্রায় সকল পুরুষকেই কখনো হাসিমুখে কখনো শঙ্কিত হৃদয়ে নিতে হয়।"আমি তোমার আজীবন ভাত কাপড়ের দায়িত্ব নিলাম "।
সমাজ সংসার স্বাস্থ্যবিধি কত বিধি শেখায়। আবার এই সমাজই পুরুষের পুরুষত্বে ঘা দিয়ে শেখায় -" আরে ধুর ছেলেদের আবার লজ্জিত হওয়ার কি আছে, হিসু করতে আবার অতদূরে বাথরুমে যাওয়ার কি প্রয়োজন। এখানে রাস্তার পাশেই নির্দ্বিধায় করতে পারিস"। ভাবটা এমন নারীদের জন্য বাথরুম এবং পুরুষেরা সারা পৃথিবীব্যাপী প্রস্রাব করতে পারে। অর্থাৎ যত্রতত্র প্রস্রাব করতে সমাজ শিখিয়ে দিচ্ছে।
সমাজের পরিভাষায় কোন অসুন্দর ছেলে যদি কোন সুন্দরী মেয়ের সাথে প্রেম করে, তবেই শুরু হয়ে যায় সমাজের কিছু মানুষের গা জ্বালা। " আহারে অত সুন্দরী মেয়েটা কালো বান্দরের মত ছেলেটার প্রেমে পড়লো"। কোন বেটে ছেলের প্রেমিকা লম্বা হয়, তবে -" আহারে, সুন্দরী লম্বা মেয়েটি বেটেটার পাল্লায় পড়লো। দেখে একটা কার্টুনের মত মনে হচ্ছে"। আবার কোন মাথায় চুলবিহীন টাকওয়ালা অসুন্দর ছেলে যদি অত্যন্ত সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করে তবে সমাজ হিতৈষী বাঙালির একটি কমন উক্তি এবং আচরণ রয়েছে। প্রথমেই ছেলেটির পেশা নিশ্চিত হবে। যদি দেখে যে, তথাকথিত ভালো পেশায় রয়েছে। তবে তারা বলবে-"ভালো চাকুরির যাদুকাঠিতে এই টাকলুটা সুন্দরী মেয়েটিকে পটিয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন, বান্দরের গলায় মুক্তর মালা ঝুলছে"। সমাজের কমন এই উক্তিটির মধ্যে রয়েছে ঈর্ষা ও পরশ্রীকাতরতার প্রকাশ। "আঙুল ফল টক" জাতীয় মানসিকতা।
অনেক ছেলেদেরই দাড়ি-গোঁফ একটু দেড়ি করে উঠে। আবার অনেকের সেরকম উঠে না। কোন ছেলের যদি দাড়ি-গোঁফ উঠতে একটু দেড়ি হয়, তবে সমাজের অহেতুক চিন্তার অন্ত থাকে না। সমাজের এ কল্যাণ চিন্তায় যতটা চিন্তা ; এর শতগুণ হলো মানসিক অত্যাচার। "ও দিদি! তোমার ছেলের দাড়ি-গোঁফ উঠেনি, ও কি আবার মাকুন্দ হবে নাকি"? আবার অনেকে আরও একধাপ এগিয়ে বলে, "মুখে দাড়ি-গোঁফ উঠেনি, ও কি ছেলে নাকি মেয়ে দেখেতো বোঝা যাচ্ছে না"। কথাগুলো যার উদ্দেশ্যে বলে, সে বোঝে এর যাতনা। আবার কেউ দাড়ি গোঁফ হঠাৎ করে রাখা শুরু করে, তবেও সমাজের সমস্য। এ দাড়ি-গোঁফ নিয়ে প্রায় কথাই শুনতে হয়- "কিরে স্যাকা ট্যাকা খেয়েছিস নাকি? মুখে খোচাখোচা দাড়ি নিয়ে তুই কি দেবদাস হয়ে যাবি"? অর্থাৎ মুখে দাড়ি-গোঁফ থাকলেও সমস্যা, না থাকলেও সমস্যা। সমাজের এই সমস্যার তালিকাটি দীর্ঘ।
সামর্থ্য আছে কি না আছে সমাজ সংসার প্রত্যেকটি পুরুষকে প্রতিযোগিতার সমুদ্রে ফেলে দেয়। কখনো সে প্রতিযোগিতা অসম, অসম্ভব প্রতিযোগিতাতেও রূপান্তরিত হয়ে যায়। পরিবার পরিজনদের বলতে শোনা যায়-"তোর বন্ধু সরকারি ভালো চাকুরি পেলে তুই কেন পাবি না? তুই কি ওর থেকে কোন অংশে কম? শহরের ছেলে হয়ে তুই যদি না পারিস, তবে গ্রামের ছেলে হয়ে তোর বন্ধু কি করে এত ভালো কিছু করছে"?
আমাদের সমাজের এখনো ভাবটা এমন 'Arts' বা কলাবিভাগ নারীদের জন্য। কোন তথাকথিত ভালো ছাত্র যদি কলাবিভাগ নিয়ে পড়াশোনা শুরু করে তবেই শুরু হয়ে হয়ে যায় সমাজের চিন্তা। "ছেলে আর্টস নিয়ে পড়াশোনা করে ভালো চাকুরি কি করে পাবে? কি করে আয় রোজগার করে পরিবারকে খাওয়াবে"?
প্রাচীনকালে নারী পুরুষ উভয়েরই মাথায় বড় চুল থাকতো। কিন্তু বর্তমানে কোন ছেলে যদি মাথায় বড় চুল রাখে তবে শুরু হয়ে যায় সমাজের জ্ঞানদান।"ভদ্র বাড়ির ছেলেদের যাত্রাপালার নায়কদের মত এত বড় বড় চুল হয় না! চুলের কারণে তোকে তো বোঝাই যাচ্ছে না তুই ছেলে না মেয়ে"? আবার চুলের সাথে যদি কানে দুল থাকে। তবে তো কথাই নেই, একেবারে পোয়াবারো।"তোর কি লজ্জা করে না যে মেয়েদের মত কানে দুল পড়ে আছিস"? কে কি ধারণ করবে সেটা তার রুচিবোধের বিষয়। অথচ প্রাচীনকালে ভারতবর্ষে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই কানে দুল ধারণ করতো। প্রাচীন যত পুরুষের পুরাতাত্ত্বিক মূর্তি পাওয়া গেছে, সে সকল মূর্তিরই প্রায় কানে রয়েছে।
বাঙালি সমাজে কোন ছেলে যদি ভালো রান্নাবান্না করতে পারে। এতে তা গুণ থেকে সমাজের হাসির খোরাকি হয়।"ছেলে হয়ে রাধুনিগিরি, রান্না-বান্না মেয়েদের কাজ। তাদেরই এতে মানায়, ছেলেদের জন্য নয়"। অথচ বড় বড় হোটেলসহ, পৃথিবীর সেরা রাধুনিগণই পুরুষ। অথচ বাঙালি সমাজ রান্না-বান্না শুধুই নারীদের জন্য বরাদ্দ।
মেয়েরাই শুধু রূপচর্চা করবে, এমন ধারণা সমাজের প্রতিটি স্তরে আজও প্রচলিত।মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে ছেলেদের রূপচর্চা দূরে থাক, সামান্যতম ত্বকের যত্ন নিতে দেখলেও সমাজের চোখ সজাগ হয়ে যায়। ত্বকের লাবণ্য বৃদ্ধির জন্যে কোন ছেলে যদি ফেইসওয়াশ বা ক্রিম ব্যবহার করে, তবে তাকে সমাজের বহু কথা শোনার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফেইসওয়াশ বা ক্রিম ব্যবহার করলেও লুকিয়ে লুকিয়ে ব্যবহার করতে হয়। ত্বকের যত্ন প্রসঙ্গে সমাজের জনপ্রিয় ভাষণ হলো-"ছেলে মানুষ সোনার আংটির মত; এর কোন ক্ষয় নেই। তাই মুখে এত ক্রীম, ফেইসওয়াশ ব্যবহার করার কি প্রয়োজন?শুধু সাবানই যথেষ্ট"। কদাচিত মেয়েদের বাদ দিলে মেয়েরা অধিকাংশই দিনে অসংখ্যবার আয়না দেখে। তাদের ব্যাগেও সর্বদা আয়না থাকে। কোন ছেলে যদি বারবার আয়না দেখে, তবে আর রক্ষা নেই। সমাজ বলবে-"তুই কি মেয়ে হয়ে গিয়েছিসে যে, মেয়েদের মত ঘনঘন আয়না দেখছিস"? ভাবটা এমন বারবার আয়না দেখা মেয়েদের জন্যই শুধু বরাদ্দ করা। ত্বকের যত্ন নিতে কোন ছেলে ফেসিয়াল করতে জেন্টস পার্লারে গেলে আজও বহু কথা শুনতে হয়। অথচ মেয়েদের জন্যে বিষয়টি স্বাভাবিক। এ সমস্যাগুলো অবশ্য বাঙালি উচ্চবিত্তদের মধ্যে দেখা যায় না। সমস্যাটা প্রকট বৃত্তেবদ্ধ মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে। মেয়ারা পার্লারে রূপচর্চা করতে যায় গর্বের সাথে, পক্ষান্তরে ছেলেরা যায় অনেকটাই লুকিয়ে লুকিয়ে। সমাজের ভাব এমন যে, ছেলেদের রুপচর্চা করাটা অন্যায়। রূপচর্চা শুধুই নারীদের বিষয়।
"তোর এত লজ্জা কেন রে ? সারাদিন গায়ে জামা পড়ে থাকিস? ছেলে মানুষ হয়ে এত লজ্জা কিসের"? ভাবটা এমন, ছেলে মানুষদের কোন লজ্জা থাকতে নেই। লজ্জা শুধুই নারীদের একান্ত সম্পত্তি। তাই ছেলেদের শরীরের উপরের অঙ্গে পোশাক না পড়লেও চলে। এভাবে সমাজ নারী পুরুষের লৈঙ্গিক বিভাজন করে উস্কে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। যার ভুক্তভোগী দিনশেষে সকলেই।
কোন ছেলে যদি কোন মানুষের কল্যাণকামী সামাজিক সংগঠন করে, তবে তো পরিবার পরিজনসহ সমাজের চিন্তার অন্ত নেই। শুরু হয়ে যায় তাদের চিরপরিচিত ভাষণ- " তোমার কি কোন কাম কাজ নেই, যে অন্যের জন্যে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছ? এখনো যদি নিজের ভালো-মন্দ বুঝতে না পারো তবে আবার কিছুই করার নেই। কি দরকার শুধুশুধু ফাও অহেতুক দরবারে"। অথচ বিপদে পড়লে এই আত্মকেন্দ্রিক হতে বলা সেই ব্যক্তিরাই মানুষের কল্যাণকামী সামাজিক সংগঠন করা ব্যক্তিটির কাছে এসে সাহায্য সহযোগিতা চায়। অন্যের নিন্দা সমালোচনায় কান না দিয়ে সকল পুরুষকেই উচিত নিজের মত করে নিজের পথে চলা। চোখবুঁজে নিজের মনকে প্রশ্ন করা, মন কি চায়। সেই প্রশ্নের উত্তরে মন যা বলে, সেই অনুসারে কাজ করা। আশেপাশের লোক উপকার করতে না পারুক, পিছে পিছে কথা বলে যাবেই। তাই তাদের নিয়ে না ভেবে বিবেককে জাগ্রত রেখে নিজের আত্মবিশ্বাসকে সুদৃঢ় করে নির্ভীকচিত্তে এগিয়ে যেতে হবে। তবেই গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন:
"তুমি যাহা চিন্তা করিবে, তাহাই হইয়া যাইবে। যদি তুমি নিজেকে দুর্বল ভাব, তবে দুর্বল হইবে। তেজস্বী ভাবিলে তেজস্বী হইবে।"
(স্বামী বিবেকানন্দ বাণী ও রচনা :৫,২৭)
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।