১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গরাজ লক্ষ্মণ সেনকে পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলায় বিদেশি তুর্কী সাম্রাজ্যবাদী শাসন শুরু হয়। এই বিদেশীয় আততায়ীরা এই ভূখণ্ডের উপরে তাদের করায়ত্ব বজায় রাখতে প্রথমেই এদেশীয় পবিত্র সকল বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধাস্পদ বিষয়কে আক্রমণে কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করে। এদেশীয় মানুষের যে সকল বস্তুই ছিল শ্রদ্ধার, তা সকলেই তাদের কাছে পরিহাস এবং ঘৃণার বস্তুতে পরিণত হয়। এর অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যায়।ভারতবর্ষের হিন্দু সমাজের সবচেয়ে পরম শ্রদ্ধেয় হলেন সাধু, সন্ন্যাসীবৃন্দ; এবং সাধু, সন্ন্যাসীদের চেনার চিহ্নই হলো তাদের হাতে রাখা দণ্ডকমণ্ডলু। জগতের সৃষ্টিকর্তা প্রজাপতি ব্রহ্মার হাতেও কমণ্ডলু রয়েছে।
ব্রহ্মা কমণ্ডলুধরঃ কর্তব্য স চতুর্মুখঃ।
হংসারূঢ়ঃ ক্বচিৎ কার্য্যঃ ক্বচিচ্চ কমলাসনঃ ॥
বর্ণতঃ পদ্মগর্ভাভশ্চতুৰ্ব্বাহঃ শুভেক্ষণঃ ।
কমণ্ডলুং বামকরে স্রুবং হস্তে তু দক্ষিণে ॥
বামে দণ্ডধরং তদ্বৎ স্রুবঞ্চাপি প্রদর্শয়েৎ ।
মুনিভির্দেবগন্ধর্বৈঃ স্তূয়মানং সমস্ততঃ ॥
কুর্বাণমিব লোকাংস্ত্ৰীন্ শুক্লাম্বরধরং বিভুম্ ।
মৃগচর্মধরঞ্চাপি দিব্যযজ্ঞোপবীতিনম্ ॥
আজাস্থালীং ন্যসেৎ পার্শ্বে বেদাংশ্চ চতুরঃ পুনঃ।
বামপার্শ্বেঽহ্য সাবিত্রীং দক্ষিণে চ সরস্বতীম্ ।।
(মৎসপুরাণ: ২৬০.৪০-৪৪)
" ব্রহ্মাকে কমণ্ডলুধারী, চতুর্মুখ, হংসারূঢ় অথবা কোথাও কমলাসন করে নিৰ্ম্মাণ করবে । তাঁর বর্ণ পদ্মগর্ভসম, চারবাহু এবং আকৃতি মনোরম । তাঁর বাম করে কমণ্ডলু, দক্ষিণে স্রুব, এবং অপর দুই হস্তেরও বাম, দক্ষিণ ক্রমে দণ্ড ও স্রুব প্রদান করবে। মুনি ও গন্ধর্বগণ কর্তৃক সেই শুক্লাম্বর মৃগচর্মধারী দিব্য যজ্ঞোপবীতান্বিত লোকত্রয়স্রষ্টা বিভু ব্ৰহ্মা ইতস্তত স্তুত হচ্ছেন। তাঁর পার্শ্বে চারবেদ ও আজ্যস্থালী বিন্যস্ত রয়েছে । তাঁর বামপার্শ্বে সাবিত্রী দেবী, দক্ষিণে সরস্বতী, এবং অগ্রে ঋষিগণ অবস্থিত।"
ব্রহ্মা কমণ্ডলুধরশ্চতুর্বক্ত্রশ্চতুর্ভুজঃ ।
কদাচিদ্রক্তকমলে হংসারূঢ়ঃ কদাচন ॥
বর্ণেন রক্তগৌরাঙ্গঃ প্রাংশুস্তুঙ্গাঙ্গ উন্নতঃ।
কমণ্ডলুং বামকরে স্রুচং হস্তে চ দক্ষিণে ॥
দক্ষিণাধস্তথামালাং বামাধশ্চ তথা স্রুবম্।।
আজ্যস্থালী বামপার্শ্বে দেবাঃ সর্বেঽগ্রতঃ স্থিতাঃ।
সাবিত্রী বামপার্শ্বস্থা দক্ষিণস্থা সরস্বতী ॥
(কালিকাপুরাণ: ৮০.৭৩-৭৫)
"ব্রহ্মা,—উন্নতকায়, উন্নতাঙ্গ, কমণ্ডলুধারী চতুর্ভুজ এবং চতুৰ্ম্মুখ; তিনি কখন রক্তকমলে, কখন বা হংসে আরোহণ করে থাকেন ।
তাঁর বর্ণ রক্ত-গৌর, তাঁর ঊর্দ্ধ, বাম-করে কমণ্ডলু, ঊর্দ্ধ দক্ষিণ করে স্রুক্, অধো-বাম করে স্রুব, অধোদক্ষিণ করে মালা, সাবিত্রী ও আজ্যস্থালী তাঁর বামপার্শ্বে ; সরস্বতী দক্ষিণ পার্শ্বে ।"
প্রজাপতি ব্রহ্মার পরম্পরায় বৈদিক মুনি, ঋষিদের সকলের হাতেই পবিত্র কমণ্ডলু দেখা যায়। রামায়ণেও রাবন যখন সীতাকে হরণ করতে তার সামনে পরিব্রাজক সন্ন্যাসী হিসেবে উপস্থিত হয়, তখন তার হাতে দণ্ড-কমণ্ডলু ছিল। অর্থাৎ দণ্ড কমণ্ডলু হল সন্ন্যাসীদের চিহ্ন।
শ্লক্ষ্মকাষায়সংবীতঃ বামে শিখী ছত্রী উপানহী।
বামে চাংসেঽবসজ্যাথ শুভে যষ্টিকমণ্ডলূ॥
পরিব্রাজকরূপেণ বৈদেহীমন্ববৰ্তত।
তামাসসাদাতিবলো ভ্রাতৃভ্যাং রহিতাং বনে।।
(রামায়ণ: অরণ্যকাণ্ড, ৪৬.৩-৪)
"সূক্ষ্ম ক্ষৌমবস্ত্রে আবৃত দেহ, শিখাধারী, ছত্রধারী, কাষ্ঠ পাদুকাপরিহিত এবং বামস্কন্ধে শুভ লক্ষণযুক্ত যষ্ঠি ও কমণ্ডলুধারী পরিব্রাজকরূপী অতিবলশালী রাবণ বনে উপস্থিত হয়ে রাম-লক্ষ্মণ ভ্রাতৃদ্বয় বিরহিতা বিদেহ রাজনন্দিনীর অনুসরণ করতে লাগল।"
মহাভারতের আদিপর্বে পাওয়া যায়, সমুদ্রমন্থনের কালে ভগবান ধন্বন্তরিদেব দ্বিভুজ শ্বেতকায় রূপে আবির্ভূত হন। সে সময়ে তাঁর হাতে থাকে অমৃতপূর্ণ শ্বেত কমণ্ডলু। অর্থাৎ কমণ্ডলু ভগবান ব্রহ্মাসহ নারদ, ধন্বন্তরিদেবসহ আমাদের অবতার পুরুষেরাও হাতে ধারণ করতেন।
ধন্বন্তরিস্ততো দেবো বপুষ্মানুদতিষ্ঠত।
শ্বেতং কমণ্ডলুং বিভ্ৰদমৃতং যত্র তিষ্ঠতি ॥
(মহাভারত: আদিপর্ব, ১৪.৪০)
" সমুদ্রমন্থনে ধন্বন্তরিদেব অমৃতপূর্ণ শ্বেত কমণ্ডলু হাতে ধারণ করে আবির্ভূত হলেন।"
সন্ন্যাসীদের হাতে থাকা পবিত্র কমণ্ডলুই তুর্কিরা প্রথম মলত্যাগ করে শৌচকার্যে ব্যবহার শুরু করে শুধুমাত্র এদেশীয় বিশ্বাস এবং পরম্পরাগত ভাবাবেগকে আঘাত করার জন্যে।কমণ্ডলুর উপরের ধরণী অংশটা বাদ দিলেই এটা বর্তমানে আমাদের ব্যবহৃত বদনা হয়ে যায়, যা তুর্কিদের দেখানো পথে আমি আপনি সকলেই টয়লেটে প্রতিনিয়ত নিজের অজান্তেই ব্যবহার করে চলছি!এবং সাথে সাথে ঋষিদেরও প্রতিনিয়ত অপমান করে চলছি।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।