ভারতের জৈন সম্প্রদায়ের মধ্যে এখনো একটি প্রথা চালু আছে; সেই প্রথার নাম 'সান্তারা'। আপাতদৃষ্টিতে প্রথাটি অমানবিক হলেও ভারতে জৈন সম্প্রদায়ের অনুসারিদের মধ্যে প্রথাটি প্রচলিত এবং অত্যন্ত জনপ্রিয়। যদি কোন সাধুসন্ত মনে করে, তার জগতকে যা দেয়ায় তা দেয়া হয়ে গেছে, তাঁর আর বেঁচে থাকার প্রয়োজন নেই; তবে তিনি সান্তারা নামক অনশন ব্রতের মাধ্যমে স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করতে পারবেন। 'সান্তারা' জৈন সম্প্রদায়ের মানুষের একটি পবিত্র ধর্মীয় রীতি। রীতিটি অমানবিক বলে আইনে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু দিগম্বর এবং শ্বেতাম্বর উভয় জৈন সম্প্রদায়ের তীব্র বিরোধিতার ফলে, গত ২০১৫ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এ আইনটির উপরের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়।
জৈন সাধুরা যেখানে না খেয়ে কৃচ্ছ্র সাধন করে মৃত্যুর অধিকার চাচ্ছেন, শ্রীমদ্ভাগবতের পরিক্ষিত মহারাজের মত। সেখানে আমাদের সাধুসন্ন্যাসীদের অনেকেই ধর্ম পালন এবং প্রচার বাদ দিয়ে আত্মপ্রচার এবং ব্যক্তিগত ভোগসর্বস্ব হয়ে যাচ্ছে দিনেদিনে।হয়ত কলিযুগের ধর্মটাই এমন। যেখানে তিনভাগ পাপ এবং একভাগ পুণ্য। সাধু-সন্ন্যাসীরা যেহেতু আমাদের সমাজেরই অংশ। তাই তারাও তিনভাগ পাপের প্রভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। শ্রীমদ্ভাগবতে 'কলিযুগধর্ম' অধ্যায়ে কলিযুগের সাধুসন্ন্যাসীদের সম্পর্কে পূর্বেই ভবিষ্যৎবাণী করা হয়েছে। কলিযুগে সন্ন্যাসীদের অবস্থা এবং পরিণতি সম্পর্কে শুকদেব গোস্বামী মহারাজ পরীক্ষিৎকে বলেছেন, সাধুসন্ন্যাসীদের শুধু তাদের বাহ্যিক বস্ত্র, দণ্ড এবং কমণ্ডলু দেখেই চেনা যাবে। অর্থাৎ অন্তঃস্থিত সাধুত্ব সকল সাধুতে থাকবে না। সাধুদের ঘরগুলো হবে গৃহীদের মত। একজন গৃহীর সকল বিলাসবহুলতা সাধুদের আশ্রমে থাকবে। সম্পূর্ণ বিষয়টি লোকদেখানো পর্যায়ে যাবে।
লিঙ্গমেবাশ্রমখ্যাতাবন্যোন্যাপত্তিকারণম্ ।
অবৃত্ত্যা ন্যায়দৌর্বল্যং পাণ্ডিত্যে চাপলং বচঃ।।
(শ্রীমদ্ভাগবত :১২.২.৪)
"ব্রহ্মচারী, সন্ন্যাসী আদির পরিচিতি বস্ত্র, দণ্ড- কমণ্ডলুতেই সীমিত হয়ে যাবে। অপরের বাহ্য প্রতীক গ্রহণই আশ্রমে প্রবেশের স্বীকৃতি পাবে। উৎকোচ, অথবা ধনসম্পদ দিতে অপারগ ব্যক্তি ন্যায়ালয়ে যথার্থ বিচার পাবে না। বাকচাতুর্য পাণ্ডিত্যের মাপকাঠি হয়ে দাঁড়াবে।"
পদ্মপুরাণের উত্তরখণ্ডে বলা হয়েছে, সন্ন্যাসীর পোশাক, জটা এবং দণ্ড চিহ্নই মুখ্য নয়; মুখ্য তার ভেতরের সাধুত্ব।
চীরবাসা জটী বিপ্র দণ্ডী মুণ্ডিত এব বা।
বিভূষিতো বা বিপ্ৰেন্দ্ৰ ন লিঙ্গং ধর্মকারণম্।।
(পদ্মপুরাণ,উত্তরখণ্ড, ৮০.১০৪)
"হে বিপ্রেন্দ্র! সাধক চীর পরিধায়ী, জটাধারী, দণ্ডী, মুণ্ডিত বা বিভূষিত হলেও, এতে বিশেষ কিছুই হয় না; কেননা চিহ্নই ধর্মের কারণ নয়।"
আমাদের গুটিকয়েক সাধুসন্ন্যাসী ছাড়া অধিকাংশই দেহের কৃচ্ছ্র সাধন করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে খুব একটা ধর্মপ্রচারে পাওয়া যায় না। অবশ্য ব্যতিক্রম দুই-একজন যারা দেহের কৃচ্ছ্র সাধন করে ধর্মপ্রচার করেছেন, তাঁরা ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছেন। যাদের কাজ ধর্ম প্রচার করা, তারা কেন তাদের সেই পবিত্র দায়িত্বটি পালন করছে না ; বিষয়টি দুঃখজনক। অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেন, ভগবানকে আমৃত্যু স্মরণ করতে এবং তাঁর বাণী প্রচার করতে যারা গৃহ সহ পরিবার পরিজন ত্যাগ করেছেন ; সেই সর্বস্বত্যাগী সাধুরা অধিকাংশ নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। কেন তাদের মধ্যে এমন সর্বনাশা আত্মকেন্দ্রিকতা? এর যথাযথ উত্তর অধিকাংশের জানা থাকলেও অজানা। শ্রীমদ্ভাগবতের তৃতীয় স্কন্ধে ভগবান কপিল তাঁর জন্মদাত্রী জননী দেবাহূতিকে সাধুর প্রসঙ্গে বলেন:
তিতিক্ষবঃ কারুণিকাঃ সুহৃদঃ সর্বদেহিনাম্।
অজাতশত্রবঃ শান্তাঃ সাধবঃ সাধুভূষণাঃ।।
(শ্রীমদ্ভাগবত:৩.২৫.২১)
" যিনি সহিষ্ণু, করুণায় যার হৃদয় পরিপূর্ণ এবং যিনি সকলের সুহৃদ। যিনি কাউকে শত্রুতার দৃষ্টিতে দেখেন না, সর্বদাই যিনি শান্ত স্বভাবের, যিনি সকল প্রকারের সদগুণের দ্বারা বিভূষিত হয়ে শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে অাচরণ করেন -এ সকল লক্ষণ যাঁর মাঝে অবস্থিত তিনিই সাধু নামে অভিহিত। "
সকল প্রকার খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়ে স্বেচ্ছায় ধীরে ধীরে মৃত্যুর পথ বেছে নেওয়া জৈন সম্প্রদায়ের সান্তারা ব্রত অনুসরণ করে জৈন সম্প্রদায়ের অনেক সন্ন্যাসীরাই দেহত্যাগ করে। সেখানে আমাদের সন্ন্যাসীদের ভোগের অন্ত নেই। আমি বলছি না যে, তারা সান্তারার মত এমন স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করুক; কিন্তু তারা ধর্মপ্রচারে তো সক্রিয় হতে পারে। অধিকাংশ সাধুসন্ন্যাসীই যার যার আশ্রমের শহর অঞ্চলে, বিভাগীয় অঞ্চলে এবং রাজধানী শহরে থাকতে চায়। প্রত্যন্তপ্রদেশে বসবাস করে প্রচার করার জন্যে সাধু পেতে তুলনামূলক কষ্ট হয়।
আত্মহত্যা যেহেতু আইনত নিষিদ্ধ, তাই সান্তারাকে আত্মহত্যা গণ্য করে এটি নিষিদ্ধ হয়ে যায়। পরে রাজস্থান হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সারা ভারতের জৈন সম্প্রদায় বিক্ষোভ শুরু করে। এর পটভূমিতে সান্তারা আবার ২০১৫ সালে হাইকোর্ট এর পক্ষে রায় দেয়। বিবিসি ("জৈনদের না খেয়ে মৃত্যুবরণ বৈধ: ভারতের সুপ্রিমকোর্ট", বিবিসি বাংলা, ৩১ অগাস্ট ২০১৫)সহ ভারতের বিভিন্ন সংবাদপত্রে এ নিয়ে বিস্তারিত সংবাদ পরিবেশিত হয়। বিষয়টি নিয়ে একটি সাক্ষাৎকারে সারা ভারত দিগম্বর জৈন মহাসভার প্রেসিডেন্ট নির্মল কুমার শেঠি সুপ্রিম কোর্টকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন এই রায় শুধু জৈন সমাজের নয় – ভারতীয় সংস্কৃতিরই জয়। তার ভাষায়, "জৈন সমাজের সবগুলো শাখা সান্তারার অধিকার চেয়ে শীর্ষ আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিল – আর এটা জৈনদের সব মুনি-ঋষি, আচার্যদের তপস্যারই ফল!" রাজস্থান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কুসুম জৈন সান্তারা এবং আত্মহত্যার পার্থক্য সম্পর্কে বলেন, "সান্তারা আর আত্মহত্যা এক নয় কারণ দুটোর প্রস্তুতি বা প্রক্রিয়ার মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। সান্তারা একটা ধর্মীয় সাধনার অংশ, কিন্তু আত্মহত্যা অনেক সময়ই মানসিক অস্থিরতার পরিণাম। ফলে দুটো একেবারেই এক জিনিস নয়।" রাজস্থান হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি পি সি জৈনও সান্তারাকে সমর্থন করে বলেন, "আত্মহত্যা একটা অপরাধ, ভারতে এই ভাবনাটাই এসেছে পশ্চিমী ধ্যানধারণা–বিশেষ করে ইংল্যান্ড থেকে। তার যুক্তি, পাদ্রীদের ওপর প্রবল বিশ্বাস থেকেই তারা ভাবতেন ঈশ্বরের দেওয়া শরীর নষ্ট করাটা অন্যায় – তাই আত্মহত্যা মহাপাপ। আত্মহত্যা করলে তার পরিবারের সম্পত্তি জব্দ করে নেওয়া হত, কবরস্থানেও জায়গা মিলত না।কিন্তু প্রাচীন ভারতে এই ভাবনা কখনওই ছিল না, পরে তো পশ্চিমে ফ্রান্স-আমেরিকা-রাশিয়াও নিজের জীবন কেড়ে নেওয়ার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে।"ভারতে আত্মহত্যা যেহেতু এখনও বেআইনি, তাই শুধু ধর্মীয় পরম্পরার দোহাই দিয়ে সান্তারার বৈধতা সর্বদাই প্রশ্নবিদ্ধ থাকবে।
শুধু যদি আমরা বৃহত্তর চট্টগ্রামের কথাই বলি, এই চট্টগ্রামে তো কম সাধুসন্ন্যাসী ছিল না। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে চট্টগ্রামে সাধুসন্ন্যাসীর সংখ্যা বেশী। এত সাধুসন্ন্যাসী থাকা সত্ত্বেও অসংখ্য গরীব নিম্নবিত্তের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ ধর্মান্তরিত হয়েছে কয়েক দশকে। বান্দরবানের ত্রিপুরা হিন্দু সম্প্রদায়ের অধিকাংশই মিশনারীদের দ্বারা ধর্মান্তরিত হয়ে গেছে। চোখের সামনে মাত্র কয়েক দশকে এ ঘটনাটি ঘটেছে। তবে বান্দরবানের ত্রিপুরা সম্প্রদায়কে ধর্মান্তরিত করলেও, খাগড়াছড়ির ত্রিপুরা সম্প্রদায়কে করতে পারেনি। সেখানে বান্দরবানের মত অধিকাংশ ধর্মান্তরিত করতে না পারার কারণ হল, সীতাকুণ্ড শঙ্কর মঠ সহ কয়েকটি হিন্দু সম্প্রদায়ের সাধুসন্ন্যাসী সক্রিয় ছিল। সাধুসন্ন্যাসী যে চাইলেই রক্ষা করতে পারে, এর বড় উদাহরণ এটি।
মুরং সম্প্রদায়ের অধিকাংশই আজ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী হয়ে গেছে। তাদের অনেকের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, বহু ইয়োরোপীয় ধর্ম প্রচারকেরা আধুনিক ভোগ বিলাস ত্যাগ করে প্রত্যন্ত গ্রামে তাদের সাথে বাস করে তাদের মন জয় করেছে। দুঃখ হয়, ইউরোপীয় ধর্ম প্রচারকেরা যদি হাজার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ধর্মের জন্যে প্রত্যন্তঅঞ্চলে দিনের পরে দিন বসবাস করতে পারে ; তবে আমাদের সাধুসন্ন্যাসী কেন পারবে না? আমাদের সাধুরা তাদের ঘরের কাছে এই অসহায় মানুষগুলোর কাছে ভালবাসার দাবি নিয়ে যায়নি বলেই ; বাইরের মানুষ এবং তাদের ধর্মীয় চিন্তা তাদের মাঝে ঢুকতে পেরেছে।তবে ইদানীংকালে কিছু সংগঠন তাদের মাঝে যাচ্ছে, প্রচার করছে ; বিষয়টি আশার। কিন্তু এর অগ্রগতি অনেকটা মন্থর।
এ ধর্মান্তর সমস্যা সমাধানে সর্বাগ্রে ভূমিকা নেয়া প্রয়োজন হিন্দু সাধু-সসন্ন্যাসীদের। কারণ তারা সকল ত্যাগের মাধ্যমেই ঈশ্বরের এবং ঈশ্বরের প্রবর্তিত ধর্মের শরণ নিয়েছেন, আত্মমুক্তি এবং সর্বজীবের কল্যাণের আকাঙ্ক্ষায়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তাঁরা তাদের উদ্দেশ্যে অর্পিত পবিত্র দায়িত্বটি যথাযথভাবে পালন করছেন না। শুধু মুখে মুখেই তাদের কামিনী, কাঞ্চন ত্যাগের বক্তব্য। যার বাস্তবিক প্রয়োগ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের জীবনে ছিটেফোঁটা পাওয়া যায় না ।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।