-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

পুরাণ গ্রহণ এবং, বর্জনের মাধ্যমে গ্রহণীয় ।

পুরাণ গ্রহণ এবং,   বর্জনের মাধ্যমে গ্রহণীয়  বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গানের বই, পাঁচালী, কথোপকথনের বই এবং চিঠিপত্রাদি সংকলনগ্রন্থকে যারযার ব্যক্তিগত বা সম্প্রদায়ের গুরুবাদী বিশ্বাস থেকে প্রধান ধর্মীয়গ্রন্থ মনে করেন। তারা নিজেরাও জানেন না যে, এ কাজের মাধ্যমে ধীরেধীরে তারা অজ্ঞাতসারে অজ্ঞানতার অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন । বেদবিদ্যা সম্পর্কে ধারণা না থাকায় তাদের জ্ঞানের দরজা তালাবন্ধ জড়তাগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে।বেদের পরে রামায়ণ, মহাভারত এবং অষ্টাদশ পুরাণ এবং অষ্টাদশ উপপুরাণ আমাদের ধর্মগ্রন্থ। কিন্তু এ গ্রন্থগুলির একটিও প্রধান ধর্মগ্রন্থ নয়। বেদই আমাদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ। পুরাণ শুধু বৈদিক জ্ঞানের সহায়ক মাত্র।মহাভারতে বলা হয়েছে,  ইতিহাস ও পুরাণ দ্বারা বেদকে বর্দ্ধিত করতে হবে। ইতিহাস পুরাণসহ বৈদিক জ্ঞানকে যারা গ্রহণ করে না ; বেদমাতা সেই সকল অজ্ঞানীদের থেকে দূরে থাকেন। ইতিহাসপুরাণাভ্যাং বেদং সমুপবৃংহয়েৎ। বিভেত্যল্পশ্রুতাদ্বেদো মাময়ং প্রহরিষ্যতি ॥ (মহাভারত:আদিপর্ব, ১.২২৯) "ইতিহাস ও পুরাণ দ্বারা বেদকে বর্দ্ধিত করবে। না হলে এ আমাকে প্রহার করবে এ ভেবে বেদ অল্পজ্ঞ লোক হতে ভয় পেয়ে থাকেন।" পুরাণশাস্ত্রকে অনেকে লৌকিক বাণী বলে অবিহিত করে শাস্ত্রীয় স্বীকৃতি দিতে অনিচ্ছুক। কিন্তু বিষয়টি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। বৈদিক ও বেদানুগত লৈকিক উভয় বাণীই  ইন্দ্রিয়াতীত শ্রীভগবানকে প্রকাশিত করছে। যথা হিরন্যং বহুধা সমীয়তে নৃভিঃ ক্রিয়াভির্ব্যবহারবর্ত্মসু। এবং বচোর্ভিভগবানধোক্ষজো ব্যাখ্যায়তে লৌকিকবৈদিকৈর্জনৈঃ।। (শ্রীমদ্ভাগবত:১২.৪.৩১) "মানুষ একই স্বর্ণকে অগ্নির সাহায্যে কঙ্কণ, কুণ্ডল, বলয় আদিরূপ প্রদান করে থাকে, তদনুরূপ নিপুণ বিদ্বান লৌকিক ও বৈদিক বাণীর সাহায্যে একই ইন্দ্রিয়াতীত আত্মস্বরূপ শ্রীভগবানকে ভিন্ন ভিন্ন রূপে উপস্থাপিত করেন।'' পুরাণগুলিকে যথাসম্ভব গ্রহণ বর্জনের মাধ্যমেই গ্রহণ করা উচিত। পুরাণসমূহে যেমন অনেক অসাধারণ তাৎপর্যমণ্ডিত শিক্ষা রয়েছে; তেমনি কিছু কিছু স্থানে বালখিল্য কথাও আছে। পুরাণের সামান্য দুইএকটা বালখিল্য অসার উদাহরণ দেখিয়ে কিছুকিছু তার্কিক বিশেষ করে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর অনুগামীরা সকল পুরাণকেই বাদ দেয়ার ধৃষ্টতা করেন। কিন্তু শাস্ত্রে বেদ এবং বেদের সহায়ক হিসেবে পুরাণকে গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। পক্ষান্তরে কেউ যদি সামান্যতম বেদজ্ঞান লাভ করে, সেই গর্বে অহংকারী হয়ে অন্যান্য বেদানুগত শাস্ত্রবাক্যকে অগ্রাহ্য করে তবে সে জন্মজন্মান্তরের আবর্তে আবর্তিত হয়ে পশুজন্ম লাভ করে। এর ফলশ্রুতিতে সে মুক্তি থেকে বহুদূরে অন্ধকার লোকে প্রবেশ করে। এ প্রসঙ্গে অত্রিসংহিতায় বলা হয়েছে: বেদং গৃহীত্বা যঃ কশ্চিচ্ছাস্ত্রঞ্চৈবাবস্যতে ।  স সদ্যঃ পশুতাং যাতি সম্ভবানেকবিংশতিম্ ॥ (অত্রিসংহিতা:১১) "যে ব্যক্তি বেদ অধ্যয়ন করে,  সেই গর্বে অন্যান্য শাস্ত্রের উপদেশ অগ্রাহ্য করে, সে একবিংশতিবার পশু জন্ম প্রাপ্ত হয়।" পুরাণের জগতে ভাগবত, মার্কণ্ডেয়, ব্রহ্ম, বিষ্ণু, অগ্নি, শিব, স্কন্ধ এই অসাধারণ পুরাণগুলি যেমন আছে, তেমনি ব্রহ্মবৈবর্ত, পদ্ম, ভবিষ্য এই পুরাণগুলিও আছে। ব্রহ্মবৈবর্ত, পদ্ম, ভবিষ্য সহ এমন আরো কিছু পুরাণ আছে, যেগুলি পড়লে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় এই পুরাণগুলিতে বিভিন্ন সময়ে কিছু সাম্প্রদায়িক স্বার্থান্বেষী এবং তুর্কিশাসকদের সময়ে হাতের কাটাছেড়া হয়েছে। কাটাছেড়া হওয়ার পরেও, এ পুরাণগুলি সম্পূর্ণ বাদ না দিয়ে রাজহংস যেমন দুধেজলে মিশানো থাকলে শুধুমাত্র জলের অংশকে পরিত্যাগ করে দুধটুকুই গ্রহণ করে; রাজহংসের মতো আমাদেরও পুরাণগুলি থেকে প্রয়োজনীয় সকল সারবস্তুগুলি নিয়ে অসার বস্তুগুলি পরিত্যাগ করতে হবে। একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না, ভারতবর্ষীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি পূর্ণতা পেয়েছে পুরাণগ্রন্থে।বৈদিক জ্ঞানই সাধারণের উপযোগী করে গল্পের ছলে পৌরাণিক কথাকাহিনীতে বোঝানো হয়েছে। তাই পুরাণ বর্ণাঢ্য হিন্দু সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সামবেদীয় ছান্দোগ্য উপনিষদে নারদ সনৎকুমার সংবাদে ইতিহাস-পুরাণকে পঞ্চম বেদ বলা হয়েছে। সেখানে ইতিহাস-পুরাণের সাথে পঞ্চমবেদ এই অভিধাটি বারংবার উক্ত হয়েছে: ওঁ৷ অধীহি ভগব ইতি হোপসসাদ সনৎকুমারং নারদস্তং হোবাচ যদ্বেখ তেন মোপসীদ ততস্ত উর্ধ্বং বক্ষ্যামীতি স হোবাচ ॥ ঋগ্বেদং ভগবোঽধ্যেমি যজুর্বেদং সামবেদমাথবণং চতুর্থমিতিহাসপুরাণং পঞ্চমং বেদানাং বেদং পিত্রং রাশিং দৈবং নিধিং বাকোবাক্যমেকায়নং দেববিদ্যাং ব্রহ্মবিদ্যাং ভূতবিদ্যাং ক্ষত্রবিদ্যাং নক্ষত্রবিদ্যাং সর্পদেবজনবিদ্যামেতদ্ ভগবোঽধ্যেমি॥ (ছান্দোগ্য উপনিষদ: ৭.১.১-২) "হে ভগবন্ জ্ঞাপন করুণ, এই মন্ত্র উচ্চারণ করে নারদ সনৎকুমারের নিকটে উপস্থিত হলেন। সনৎকুমার তাঁকে বললেন, তুমি যা জান তা নিয়েই আমার শিষ্যত্ব গ্রহণ কর, আমি তোমায় তারপর যা আছে তা বলবো। নারদ বলতে লাগলেন হে ভগবন্, আমি ঋগ্বেদ জানি। হে ভগবন্, আমি যজুর্বেদ, সামবেদ, চতুর্থস্থানীয় অথর্ববেদ, পঞ্চমস্থানীয় ইতিহাস-পুরাণ, ব্যাকরণ, শ্রাদ্ধতত্ব, গণিত, দৈব উৎপাতবিষয়কবিদ্যা, মহাকালাদিনিধিশাস্ত্র, তর্কশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র, শিক্ষাকল্পাদি বেদাঙ্গ, ভূতবিদ্যা, ধনুর্বেদ, জ্যোতিষ, সর্পবিদ্যা, ও গন্ধর্বশাস্ত্র - এই সমস্তই জানি৷"  মহাভারতকে ইতিহাস গ্রন্থ বলা হয়, তাই মহাভারতে মহাভারত নিজেকে পঞ্চমবেদ বলে পরিচয় দিয়েছে। শুধু মহাভারত এবং পুরাণই নয়, ভরতের নাট্যশাস্ত্রকেও পঞ্চম বেদ বলা হয়। বেদের বাইরে কাহিনী সর্বস্ব এ পঞ্চমবেদের দাবিদার অনেক গ্রন্থই। তবে আর্য সমাজের দয়ানন্দ সরস্বতীসহ অনেকেই পুরাণ বলতে বেদের ব্রাহ্মণ অংশকেই চিহ্নিত করেছেন। কারণ সেখানে মনুমৎস্য কথা সহ অসংখ্য শিক্ষামূলক গল্প আছে। তবে দয়ানন্দ সরস্বতীর মতবাদ বাদ দিলে, অধিকাংশ পণ্ডিতই পুরাণ বলতে ব্যাসদেব রচিত অষ্টাদশ পুরাণকেই বোঝে। বিষ্ণু পুরাণের তৃতীয়াংশে অষ্টাদশ পুরাণের সম্পূর্ণ তালিকা দেয়া রয়েছে।  আদ্যং সর্বপুরাণানাং পুরাণং ব্রাহ্মমুচ্যতে ।  অষ্টাদশ পুরাণানি পুরাণজ্ঞাঃ প্ৰচক্ষতে ॥ ব্রাহ্মং পাদ্মং বৈষ্ণবঞ্চ শৈবং ভাগবতং তথা ।   অথান্যন্নারদীয়ঞ্চ মার্কণ্ডেয়ঞ্চ সপ্তমম্।   আগ্নেয়মষ্টমঞ্চৈব ভবিষ্যং নবমং তথা ॥ দশমং ব্রহ্মবৈবর্ত্তং লৈঙ্গমেকাদশং স্মৃতম্ ।  বারাহং দ্বাদশঞ্চৈব স্কান্দঞ্চাত্র ত্ৰয়োদশম্ ॥  চতুৰ্দ্দশং বামনঞ্চ কৌৰ্মং পঞ্চদশং স্মৃতম্ ।  মাৎস্যঞ্চ গারুড়ঞ্চৈব ব্রহ্মাণ্ডঞ্চ ততঃ পরম্ ॥ সর্গশ্চ প্রতিসর্গশ্চ বংশো মন্বন্তরাণি চ । সর্বেষ্বেতেষু কথ্যন্তে বংশানুচরিতঞ্চ যৎ ॥ (বিষ্ণুপুরাণ:৩.৬.২১-২৫) " ব্রাহ্মপুরাণ সমুদয় পুরাণের আদি বলে কীর্ত্তিত৷ পুরাণবিৎ ব্যক্তিরা বলেন,— পুরাণসকল অষ্টাদশ সংখ্যায় বিভক্ত। তন্মধ্যে প্রথম ব্রাহ্মপুরাণ, দ্বিতীয় পদ্মপুরাণ, তৃতীয় বিষ্ণুপুরাণ, চতুর্থ শিবপুরাণ, পঞ্চম ভাগবতপুরাণ, ষষ্ঠ নারদীয়পুরাণ, সপ্তম মার্কণ্ডেয় পুরাণ, অষ্টম অগ্নিপুরাণ, নবম ভবিষ্যপুরাণ, দশম ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণ, একাদশ লিঙ্গপুরাণ, দ্বাদশ বরাহপুরাণ, ত্রয়োদশ স্কন্দপুরাণ, চতুর্দশ বামনপুরাণ, পঞ্চদশ কূর্মপূরাণ, ষোড়শ মৎস্যপুরাণ, সপ্তদশ গরুড়পুরাণ এবং অষ্টাদশ ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ। এই সকল পুরাণেই সর্গ, প্রতিসর্গ, বংশ, মন্বন্তর ও বংশানুচরিত (এক এক বংশজাত রাজগণের চরিত্র) এই পঞ্চ বিষয় সুবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে ।'' অতিরিক্ত বায়ুপুরাণসহ অষ্টাদশ পুরাণের এই তালিকাটিই কূর্মপুরাণে পাওয়া যায়। একটি বিষয় লক্ষ্যনীয় যে, একটি পুরাণের মধ্যে নিজের নামসহ অন্যান্য সপ্তদশ পুরাণের তালিকা দেয়া রয়েছে। যেন পুরাণ নামে নব্য জাল গ্রন্থ প্রবেশ করতে না পারে। শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণসহ কয়েকটি পুরাণে অষ্টদশ  পুরাণের শ্লোক সংখ্যা পর্যন্ত গুণে গুণে দেয়া হয়েছে। যেন পুরাণের মধ্যে অতিরিক্ত শ্লোক কেউ প্রক্ষিপ্ত করে দিতে না পারে। পুরাণসংখ্যাসম্ভূতিমস্য বাচ্যপ্রয়োজনে। দানং দানস্য মাহাত্ম্যং পাঠাদেশ্চ নিবোধত ॥  ব্রাহ্মং দশসহস্রাণি পাদ্মং পঞ্চোনষষ্টি চ।  শ্রীবৈষ্ণবং ত্রয়োবিংশচ্চতুর্বিংশতি শৈবকম্ ॥  দশাষ্টৌ শ্রীভাগবতং নারদং পঞ্চবিংশতিঃ।  মার্কণ্ডং নব বাহ্নং চ দশপঞ্চ চতুঃশতম্ ॥  চতুর্দশ ভবিষ্যং স্যাত্তথা পঞ্চশতানি চ।  দশাষ্টৌ ব্রহ্মবৈবর্তং লিঙ্গমেকাদশৈব তু॥  চতুর্বিংশতি বারাহমেকাশীতিসহস্ৰকম্। স্কান্দং শতং তথা চৈকং বামনং দশ কীৰ্তিতম্৷৷  কৌর্মং সপ্তদশাখ্যাতং মাৎস্যং তত্ত্ব চতুর্দশ।  একোনবিংশৎ সৌপর্ণং ব্ৰহ্মাণ্ডং দ্বাদশৈব তু॥  এবং পুরাণসন্দোহশ্চতুর্লক্ষ উদাহৃতঃ। তত্রাষ্টাদশসাহস্ৰং শ্রীভাগবতমিষ্যতে। ইদং ভগবতা পূর্বং ব্রহ্মণে নাভিপঙ্কজে। স্থিতায় ভবভীতায় কারুণ্যাৎ সম্প্রকাশিতম্॥  (শ্রীমদ্ভাগবত:১২.১৩.৩-১০) "শ্রীশৌনক ! বিভিন্ন পুরাণের আলাদাভাবে শ্লোক সংখ্যা, তার সমষ্টি, শ্রীমদ্ভাগবতের প্রতিপাদ্য বিষয় ও তার প্রয়োজনীয়তার কথা শুনুন। সাথে দান ও দান পদ্ধতি এবং পাঠের মহিমার কথাও আপনারা শ্রবণ করুন। ব্রহ্মপুরাণে দশ সহস্র, পদ্ম পুরাণে পঞ্চ পঞ্চাশৎ শ্রীবিষ্ণুপুরাণে ত্রয়োবিংশতি সহস্র এবং শিবপুরাণে চতুর্বিংশতি সহস্ৰ শ্লোক রয়েছে। শ্রীমদ্ভাগবতে অষ্টাদশ সহস্র, নারদপুরাণে পঞ্চবিংশতি সহস্র, মার্কণ্ডেয় পুরাণে নয় সহস্র এবং অগ্নি পুরাণে পঞ্চদশ সহস্র চার শত শ্লোক রয়েছে।  ভবিষ্যপুরাণে শ্লোক সংখ্যা চতুর্দশ সহস্র পাঁচ শত এবং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে অষ্টাদশ সহস্র ও লিঙ্গপুরাণে একাদশ সহস্ৰ৷ বরাহপুরাণে চতুর্বিংশতি সহস্র শ্লোক,স্কন্ধপুরাণে একাশীতি সহস্র এক শত এবং বামনপুরাণে দশ সহস্ৰ। কর্মপুরাণে সপ্তদশ সহস্র এবং মৎস্যপুরাণে চতুর্দশ সহস্র শ্লোক আছে। গরুড়পুরাণের শ্লোক সংখ্যা ঊনবিংশতি সহস্র ও ব্রহ্মাণ্ডপুরাণে দ্বাদশ সহস্ৰ। এইভাবে সমস্ত পুরাণের শ্লোক সংখ্যার যোগফল হল চার লক্ষ। তাতে শ্রীমদ্ভাগবতে, যেমন পূর্বেই বলা হয়েছে শ্লোক সংখ্যা অষ্টাদশ সহস্ৰ৷  শ্রীশৌনক সর্ব প্রথম ভগবান বিষ্ণু নিজ নাভি কমলের উপর স্থিত ও সংসারের ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত ব্রহ্মাকে পরম করুণা করে এই পুরাণ প্রকাশিত করেছিলেন৷" এ অষ্টাদশ পুরাণের সাথে আছে আরো অষ্টাদশ উপপুরাণ।কূর্মপুরাণে পুরাণের তালিকার পরবর্তীতে উপপুরাণের আরেকটি তালিকা দেয়া রয়েছে: অন্যান্যুপপুরাণানি মুনিভিঃ কথিতানি তু। অষ্টাদশ পুরাণানি শ্রুত্বা সংক্ষেপতো দ্বিজাঃ।। আদ্যং সনৎকুমারোক্তং নারসিংহমতঃ পরম্। তৃতীয়ং স্কান্দর্মুদ্দিষ্টং কুমারেণ তু ভাষিতম্ ॥ চতুর্থং শিবধর্মাখ্যাং সাক্ষান্নন্দীশ-ভাষিতম্। দুর্বাসসোত্তমাশ্চর্যং নারদীয়মতঃপরম্৷৷ কাপিলং বামনঞ্চৈব তথৈবোশনসেরিতম্।  ব্রহ্মাণ্ডং বারুণঞ্চৈব কালিকাখ্যমেব চ।  মাহেশ্বরং তথা সাম্বং সৌরং সর্বার্থসঞ্চয়ম্।   পরাশারোক্তং মারীচং তথৈব ভার্গবাহ্বয়ম্ ৷৷ (কূর্মপুরাণ: পূর্বভাগ, ১.১৬-২০) "মুনিরা এই অষ্টাদশপুরাণ শ্রবণ করে সংক্ষেপে অন্যান্য উপপুরাণ লিখেছেন। সনৎকুমারোক্ত আদিপুরাণ, এরপর নরসিংহপুরাণ, তৃতীয় স্কন্দপুরাণ, চতুর্থ শিবধর্মপুরাণ সাক্ষাৎ নন্দীশ্বর কর্তৃক উক্ত হয়েছে। অতঃপর দুর্বাসা মুনি প্রোক্ত আশ্চর্য পুরাণ পঞ্চম। নারদীয় পুরাণ ষষ্ঠ। পরে কপিল এবং বামনপুরাণ; উশনাকর্তৃক নবম পুরাণ উক্ত হয়েছে; এরপর ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ, বরুণপুরাণ, কালিকাপুরাণ, মহেশ্বর পুরাণ, শাম্বপুরাণ, সর্বার্থপ্রকাশক সৌরপুরাণ, পরাশরপুরাণ, মারীচপুরাণ এবং ভার্গব পুরাণ ; উপপুরাণ এই অষ্টাদশসংখ্যক।" আপাতদৃষ্টিতে পুরাণের সংখ্যা (১৮+১৮) = ৩৬ টি হলেও, বর্তমানে পুরাণ নামে গ্রন্থ পাওয়া যায় ৩৬ সংখ্যাটির দ্বিগুণেরও বেশী। এ পুরাণের অনেকগুলোই পরস্পর বিরোধী ভাব দ্বারা পূর্ণ। তাই লেখাগুলি একজনের লেখা কিনা, এটা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে বিস্তর মতভেদ। বিষ্ণুপুরাণে এবং দেবী ভাগবতে বিভিন্নকালে ২৮ জন ব্যাসের কথা আছে। এ পুরাণগুলির মধ্যে পদ্মপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ সহ কয়েকটির বঙ্গ সংস্করণের সাথে দক্ষিণ ভারত, উত্তর ভারতের সংস্করণ মেলে না। শ্লোক পর্যন্ত মেলে না। পঞ্চদশ ষোড়শ শতাব্দীর বিখ্যাত স্মৃতিশাস্ত্রকাররা তাদের স্মৃতির বচনে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ থেকে যে সকল শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন এর অধিকাংশই বর্তমান গ্রন্থে নেই। উদাহরণ হিসেবে স্মৃতিচন্দ্রিকা গ্রন্থের কথা বলা যায়। এ গ্রন্থটি সহ তৎকালীন স্মৃতি নিবন্ধকারগণ তাদের গ্রন্থে প্রায় ১৫০০ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন। কিন্তু নিবন্ধকারদের সে ১৫০০ শ্লোক থেকে বর্তমানে প্রাপ্ত ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে মাত্র ৩০ টি শ্লোক পাওয়া যায়। এতেই সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় গ্রন্থটির প্রাচীনরূপ এবং বর্তমান রূপের বিস্তর পার্থক্য। দক্ষিণভারতে গ্রন্থটির নাম পর্যন্ত আলাদা,সেখানে নাম ব্রহ্মকৈবর্তপুরাণ। (লেখাটি অসমাপ্ত। তাই কপি করবেন না। শেয়ার দিতে পারেন) শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ। ফেসবুক পোস্ট লিঙ্ক : Facebook ফেসবুক পেজ লিঙ্ক :  Shri Kushal Baran Chakraborty | Facebook


বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গানের বই, পাঁচালী, কথোপকথনের বই এবং চিঠিপত্রাদি সংকলনগ্রন্থকে যারযার ব্যক্তিগত বা সম্প্রদায়ের গুরুবাদী বিশ্বাস থেকে প্রধান ধর্মীয়গ্রন্থ মনে করেন। তারা নিজেরাও জানেন না যে, এ কাজের মাধ্যমে ধীরেধীরে তারা অজ্ঞাতসারে অজ্ঞানতার অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন । বেদবিদ্যা সম্পর্কে ধারণা না থাকায় তাদের জ্ঞানের দরজা তালাবন্ধ জড়তাগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে।বেদের পরে রামায়ণ, মহাভারত এবং অষ্টাদশ পুরাণ এবং অষ্টাদশ উপপুরাণ আমাদের ধর্মগ্রন্থ। কিন্তু এ গ্রন্থগুলির একটিও প্রধান ধর্মগ্রন্থ নয়। বেদই আমাদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ। পুরাণ শুধু বৈদিক জ্ঞানের সহায়ক মাত্র।মহাভারতে বলা হয়েছে, ইতিহাস ও পুরাণ দ্বারা বেদকে বর্দ্ধিত করতে হবে। ইতিহাস পুরাণসহ বৈদিক জ্ঞানকে যারা গ্রহণ করে না ; বেদমাতা সেই সকল অজ্ঞানীদের থেকে দূরে থাকেন।
ইতিহাসপুরাণাভ্যাং বেদং সমুপবৃংহয়েৎ।
বিভেত্যল্পশ্রুতাদ্বেদো মাময়ং প্রহরিষ্যতি ॥
(মহাভারত:আদিপর্ব, ১.২২৯)
"ইতিহাস ও পুরাণ দ্বারা বেদকে বর্দ্ধিত করবে। না হলে এ আমাকে প্রহার করবে এ ভেবে বেদ অল্পজ্ঞ লোক হতে ভয় পেয়ে থাকেন।"
পুরাণশাস্ত্রকে অনেকে লৌকিক বাণী বলে অবিহিত করে শাস্ত্রীয় স্বীকৃতি দিতে অনিচ্ছুক। কিন্তু বিষয়টি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। বৈদিক ও বেদানুগত লৈকিক উভয় বাণীই ইন্দ্রিয়াতীত শ্রীভগবানকে প্রকাশিত করছে।
যথা হিরন্যং বহুধা সমীয়তে
নৃভিঃ ক্রিয়াভির্ব্যবহারবর্ত্মসু।
এবং বচোর্ভিভগবানধোক্ষজো
ব্যাখ্যায়তে লৌকিকবৈদিকৈর্জনৈঃ।।
(শ্রীমদ্ভাগবত:১২.৪.৩১)
"মানুষ একই স্বর্ণকে অগ্নির সাহায্যে কঙ্কণ, কুণ্ডল, বলয় আদিরূপ প্রদান করে থাকে, তদনুরূপ নিপুণ বিদ্বান লৌকিক ও বৈদিক বাণীর সাহায্যে একই ইন্দ্রিয়াতীত আত্মস্বরূপ শ্রীভগবানকে ভিন্ন ভিন্ন রূপে উপস্থাপিত করেন।''
পুরাণগুলিকে যথাসম্ভব গ্রহণ বর্জনের মাধ্যমেই গ্রহণ করা উচিত। পুরাণসমূহে যেমন অনেক অসাধারণ তাৎপর্যমণ্ডিত শিক্ষা রয়েছে; তেমনি কিছু কিছু স্থানে বালখিল্য কথাও আছে। পুরাণের সামান্য দুইএকটা বালখিল্য অসার উদাহরণ দেখিয়ে কিছুকিছু তার্কিক বিশেষ করে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর অনুগামীরা সকল পুরাণকেই বাদ দেয়ার ধৃষ্টতা করেন। কিন্তু শাস্ত্রে বেদ এবং বেদের সহায়ক হিসেবে পুরাণকে গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। পক্ষান্তরে কেউ যদি সামান্যতম বেদজ্ঞান লাভ করে, সেই গর্বে অহংকারী হয়ে অন্যান্য বেদানুগত শাস্ত্রবাক্যকে অগ্রাহ্য করে তবে সে জন্মজন্মান্তরের আবর্তে আবর্তিত হয়ে পশুজন্ম লাভ করে। এর ফলশ্রুতিতে সে মুক্তি থেকে বহুদূরে অন্ধকার লোকে প্রবেশ করে। এ প্রসঙ্গে অত্রিসংহিতায় বলা হয়েছে:
বেদং গৃহীত্বা যঃ কশ্চিচ্ছাস্ত্রঞ্চৈবাবস্যতে ।
স সদ্যঃ পশুতাং যাতি সম্ভবানেকবিংশতিম্ ॥
(অত্রিসংহিতা:১১)
"যে ব্যক্তি বেদ অধ্যয়ন করে, সেই গর্বে অন্যান্য শাস্ত্রের উপদেশ অগ্রাহ্য করে, সে একবিংশতিবার পশু জন্ম প্রাপ্ত হয়।"
পুরাণের জগতে ভাগবত, মার্কণ্ডেয়, ব্রহ্ম, বিষ্ণু, অগ্নি, শিব, স্কন্ধ এই অসাধারণ পুরাণগুলি যেমন আছে, তেমনি ব্রহ্মবৈবর্ত, পদ্ম, ভবিষ্য এই পুরাণগুলিও আছে। ব্রহ্মবৈবর্ত, পদ্ম, ভবিষ্য সহ এমন আরো কিছু পুরাণ আছে, যেগুলি পড়লে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় এই পুরাণগুলিতে বিভিন্ন সময়ে কিছু সাম্প্রদায়িক স্বার্থান্বেষী এবং তুর্কিশাসকদের সময়ে হাতের কাটাছেড়া হয়েছে। কাটাছেড়া হওয়ার পরেও, এ পুরাণগুলি সম্পূর্ণ বাদ না দিয়ে রাজহংস যেমন দুধেজলে মিশানো থাকলে শুধুমাত্র জলের অংশকে পরিত্যাগ করে দুধটুকুই গ্রহণ করে; রাজহংসের মতো আমাদেরও পুরাণগুলি থেকে প্রয়োজনীয় সকল সারবস্তুগুলি নিয়ে অসার বস্তুগুলি পরিত্যাগ করতে হবে। একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না, ভারতবর্ষীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি পূর্ণতা পেয়েছে পুরাণগ্রন্থে।বৈদিক জ্ঞানই সাধারণের উপযোগী করে গল্পের ছলে পৌরাণিক কথাকাহিনীতে বোঝানো হয়েছে। তাই পুরাণ বর্ণাঢ্য হিন্দু সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সামবেদীয় ছান্দোগ্য উপনিষদে নারদ সনৎকুমার সংবাদে ইতিহাস-পুরাণকে পঞ্চম বেদ বলা হয়েছে। সেখানে ইতিহাস-পুরাণের সাথে পঞ্চমবেদ এই অভিধাটি বারংবার উক্ত হয়েছে:
ওঁ৷ অধীহি ভগব ইতি হোপসসাদ সনৎকুমারং নারদস্তং হোবাচ যদ্বেখ তেন মোপসীদ ততস্ত উর্ধ্বং বক্ষ্যামীতি স হোবাচ ॥
ঋগ্বেদং ভগবোঽধ্যেমি যজুর্বেদং সামবেদমাথবণং চতুর্থমিতিহাসপুরাণং পঞ্চমং বেদানাং বেদং পিত্রং রাশিং দৈবং নিধিং বাকোবাক্যমেকায়নং দেববিদ্যাং ব্রহ্মবিদ্যাং ভূতবিদ্যাং ক্ষত্রবিদ্যাং নক্ষত্রবিদ্যাং সর্পদেবজনবিদ্যামেতদ্ ভগবোঽধ্যেমি॥
(ছান্দোগ্য উপনিষদ: ৭.১.১-২)
"হে ভগবন্ জ্ঞাপন করুণ, এই মন্ত্র উচ্চারণ করে নারদ সনৎকুমারের নিকটে উপস্থিত হলেন। সনৎকুমার তাঁকে বললেন, তুমি যা জান তা নিয়েই আমার শিষ্যত্ব গ্রহণ কর, আমি তোমায় তারপর যা আছে তা বলবো। নারদ বলতে লাগলেন
হে ভগবন্, আমি ঋগ্বেদ জানি। হে ভগবন্, আমি যজুর্বেদ, সামবেদ, চতুর্থস্থানীয় অথর্ববেদ, পঞ্চমস্থানীয় ইতিহাস-পুরাণ, ব্যাকরণ, শ্রাদ্ধতত্ব, গণিত, দৈব উৎপাতবিষয়কবিদ্যা, মহাকালাদিনিধিশাস্ত্র, তর্কশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র, শিক্ষাকল্পাদি বেদাঙ্গ, ভূতবিদ্যা, ধনুর্বেদ, জ্যোতিষ, সর্পবিদ্যা, ও গন্ধর্বশাস্ত্র - এই সমস্তই জানি৷"
মহাভারতকে ইতিহাস গ্রন্থ বলা হয়, তাই মহাভারতে মহাভারত নিজেকে পঞ্চমবেদ বলে পরিচয় দিয়েছে। শুধু মহাভারত এবং পুরাণই নয়, ভরতের নাট্যশাস্ত্রকেও পঞ্চম বেদ বলা হয়। বেদের বাইরে কাহিনী সর্বস্ব এ পঞ্চমবেদের দাবিদার অনেক গ্রন্থই। তবে আর্য সমাজের দয়ানন্দ সরস্বতীসহ অনেকেই পুরাণ বলতে বেদের ব্রাহ্মণ অংশকেই চিহ্নিত করেছেন। কারণ সেখানে মনুমৎস্য কথা সহ অসংখ্য শিক্ষামূলক গল্প আছে। তবে দয়ানন্দ সরস্বতীর মতবাদ বাদ দিলে, অধিকাংশ পণ্ডিতই পুরাণ বলতে ব্যাসদেব রচিত অষ্টাদশ পুরাণকেই বোঝে। বিষ্ণু পুরাণের তৃতীয়াংশে অষ্টাদশ পুরাণের সম্পূর্ণ তালিকা দেয়া রয়েছে।
আদ্যং সর্বপুরাণানাং পুরাণং ব্রাহ্মমুচ্যতে ।
অষ্টাদশ পুরাণানি পুরাণজ্ঞাঃ প্ৰচক্ষতে ॥
ব্রাহ্মং পাদ্মং বৈষ্ণবঞ্চ শৈবং ভাগবতং তথা ।
অথান্যন্নারদীয়ঞ্চ মার্কণ্ডেয়ঞ্চ সপ্তমম্।
আগ্নেয়মষ্টমঞ্চৈব ভবিষ্যং নবমং তথা ॥
দশমং ব্রহ্মবৈবর্ত্তং লৈঙ্গমেকাদশং স্মৃতম্ ।
বারাহং দ্বাদশঞ্চৈব স্কান্দঞ্চাত্র ত্ৰয়োদশম্ ॥
চতুৰ্দ্দশং বামনঞ্চ কৌৰ্মং পঞ্চদশং স্মৃতম্ ।
মাৎস্যঞ্চ গারুড়ঞ্চৈব ব্রহ্মাণ্ডঞ্চ ততঃ পরম্ ॥
সর্গশ্চ প্রতিসর্গশ্চ বংশো মন্বন্তরাণি চ ।
সর্বেষ্বেতেষু কথ্যন্তে বংশানুচরিতঞ্চ যৎ ॥
(বিষ্ণুপুরাণ:৩.৬.২১-২৫)
" ব্রাহ্মপুরাণ সমুদয় পুরাণের আদি বলে কীর্ত্তিত৷ পুরাণবিৎ ব্যক্তিরা বলেন,— পুরাণসকল অষ্টাদশ সংখ্যায় বিভক্ত। তন্মধ্যে প্রথম ব্রাহ্মপুরাণ, দ্বিতীয় পদ্মপুরাণ, তৃতীয় বিষ্ণুপুরাণ, চতুর্থ শিবপুরাণ, পঞ্চম ভাগবতপুরাণ, ষষ্ঠ নারদীয়পুরাণ, সপ্তম মার্কণ্ডেয় পুরাণ, অষ্টম অগ্নিপুরাণ, নবম ভবিষ্যপুরাণ, দশম ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণ, একাদশ লিঙ্গপুরাণ, দ্বাদশ বরাহপুরাণ, ত্রয়োদশ স্কন্দপুরাণ, চতুর্দশ বামনপুরাণ, পঞ্চদশ কূর্মপূরাণ, ষোড়শ মৎস্যপুরাণ, সপ্তদশ গরুড়পুরাণ এবং অষ্টাদশ ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ। এই সকল পুরাণেই সর্গ, প্রতিসর্গ, বংশ, মন্বন্তর ও বংশানুচরিত (এক এক বংশজাত রাজগণের চরিত্র) এই পঞ্চ বিষয় সুবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে ।''
অতিরিক্ত বায়ুপুরাণসহ অষ্টাদশ পুরাণের এই তালিকাটিই কূর্মপুরাণে পাওয়া যায়। একটি বিষয় লক্ষ্যনীয় যে, একটি পুরাণের মধ্যে নিজের নামসহ অন্যান্য সপ্তদশ পুরাণের তালিকা দেয়া রয়েছে। যেন পুরাণ নামে নব্য জাল গ্রন্থ প্রবেশ করতে না পারে। শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণসহ কয়েকটি পুরাণে অষ্টদশ পুরাণের শ্লোক সংখ্যা পর্যন্ত গুণে গুণে দেয়া হয়েছে। যেন পুরাণের মধ্যে অতিরিক্ত শ্লোক কেউ প্রক্ষিপ্ত করে দিতে না পারে।
পুরাণসংখ্যাসম্ভূতিমস্য বাচ্যপ্রয়োজনে।
দানং দানস্য মাহাত্ম্যং পাঠাদেশ্চ নিবোধত ॥
ব্রাহ্মং দশসহস্রাণি পাদ্মং পঞ্চোনষষ্টি চ।
শ্রীবৈষ্ণবং ত্রয়োবিংশচ্চতুর্বিংশতি শৈবকম্ ॥
দশাষ্টৌ শ্রীভাগবতং নারদং পঞ্চবিংশতিঃ।
মার্কণ্ডং নব বাহ্নং চ দশপঞ্চ চতুঃশতম্ ॥
চতুর্দশ ভবিষ্যং স্যাত্তথা পঞ্চশতানি চ।
দশাষ্টৌ ব্রহ্মবৈবর্তং লিঙ্গমেকাদশৈব তু॥
চতুর্বিংশতি বারাহমেকাশীতিসহস্ৰকম্।
স্কান্দং শতং তথা চৈকং বামনং দশ কীৰ্তিতম্৷৷
কৌর্মং সপ্তদশাখ্যাতং মাৎস্যং তত্ত্ব চতুর্দশ।
একোনবিংশৎ সৌপর্ণং ব্ৰহ্মাণ্ডং দ্বাদশৈব তু॥
এবং পুরাণসন্দোহশ্চতুর্লক্ষ উদাহৃতঃ।
তত্রাষ্টাদশসাহস্ৰং শ্রীভাগবতমিষ্যতে।
ইদং ভগবতা পূর্বং ব্রহ্মণে নাভিপঙ্কজে।
স্থিতায় ভবভীতায় কারুণ্যাৎ সম্প্রকাশিতম্॥
(শ্রীমদ্ভাগবত:১২.১৩.৩-১০)
"শ্রীশৌনক ! বিভিন্ন পুরাণের আলাদাভাবে শ্লোক সংখ্যা, তার সমষ্টি, শ্রীমদ্ভাগবতের প্রতিপাদ্য বিষয় ও তার প্রয়োজনীয়তার কথা শুনুন। সাথে দান ও দান পদ্ধতি এবং পাঠের মহিমার কথাও আপনারা শ্রবণ করুন।
ব্রহ্মপুরাণে দশ সহস্র, পদ্ম পুরাণে পঞ্চ পঞ্চাশৎ শ্রীবিষ্ণুপুরাণে ত্রয়োবিংশতি সহস্র এবং শিবপুরাণে চতুর্বিংশতি সহস্ৰ শ্লোক রয়েছে।
শ্রীমদ্ভাগবতে অষ্টাদশ সহস্র, নারদপুরাণে পঞ্চবিংশতি সহস্র, মার্কণ্ডেয় পুরাণে নয় সহস্র এবং অগ্নি পুরাণে পঞ্চদশ সহস্র চার শত শ্লোক রয়েছে।
ভবিষ্যপুরাণে শ্লোক সংখ্যা চতুর্দশ সহস্র পাঁচ
শত এবং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে অষ্টাদশ সহস্র ও লিঙ্গপুরাণে একাদশ সহস্ৰ৷
বরাহপুরাণে চতুর্বিংশতি সহস্র শ্লোক,স্কন্ধপুরাণে একাশীতি সহস্র এক শত এবং বামনপুরাণে দশ সহস্ৰ।
কর্মপুরাণে সপ্তদশ সহস্র এবং মৎস্যপুরাণে চতুর্দশ সহস্র শ্লোক আছে। গরুড়পুরাণের শ্লোক সংখ্যা ঊনবিংশতি সহস্র ও ব্রহ্মাণ্ডপুরাণে দ্বাদশ সহস্ৰ।
এইভাবে সমস্ত পুরাণের শ্লোক সংখ্যার যোগফল হল চার লক্ষ। তাতে শ্রীমদ্ভাগবতে, যেমন পূর্বেই বলা হয়েছে শ্লোক সংখ্যা অষ্টাদশ সহস্ৰ৷
শ্রীশৌনক সর্ব প্রথম ভগবান বিষ্ণু নিজ নাভি কমলের উপর স্থিত ও সংসারের ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত ব্রহ্মাকে পরম করুণা করে এই পুরাণ প্রকাশিত করেছিলেন৷"
এ অষ্টাদশ পুরাণের সাথে আছে আরো অষ্টাদশ উপপুরাণ।কূর্মপুরাণে পুরাণের তালিকার পরবর্তীতে উপপুরাণের আরেকটি তালিকা দেয়া রয়েছে:
অন্যান্যুপপুরাণানি মুনিভিঃ কথিতানি তু।
অষ্টাদশ পুরাণানি শ্রুত্বা সংক্ষেপতো দ্বিজাঃ।।
আদ্যং সনৎকুমারোক্তং নারসিংহমতঃ পরম্।
তৃতীয়ং স্কান্দর্মুদ্দিষ্টং কুমারেণ তু ভাষিতম্ ॥
চতুর্থং শিবধর্মাখ্যাং সাক্ষান্নন্দীশ-ভাষিতম্।
দুর্বাসসোত্তমাশ্চর্যং নারদীয়মতঃপরম্৷৷
কাপিলং বামনঞ্চৈব তথৈবোশনসেরিতম্।
ব্রহ্মাণ্ডং বারুণঞ্চৈব কালিকাখ্যমেব চ।
মাহেশ্বরং তথা সাম্বং সৌরং সর্বার্থসঞ্চয়ম্।
পরাশারোক্তং মারীচং তথৈব ভার্গবাহ্বয়ম্ ৷৷
(কূর্মপুরাণ: পূর্বভাগ, ১.১৬-২০)
"মুনিরা এই অষ্টাদশপুরাণ শ্রবণ করে সংক্ষেপে অন্যান্য উপপুরাণ লিখেছেন। সনৎকুমারোক্ত আদিপুরাণ, এরপর নরসিংহপুরাণ, তৃতীয় স্কন্দপুরাণ, চতুর্থ শিবধর্মপুরাণ সাক্ষাৎ নন্দীশ্বর কর্তৃক উক্ত হয়েছে। অতঃপর দুর্বাসা মুনি প্রোক্ত আশ্চর্য পুরাণ পঞ্চম। নারদীয় পুরাণ ষষ্ঠ। পরে কপিল এবং বামনপুরাণ; উশনাকর্তৃক নবম পুরাণ উক্ত হয়েছে; এরপর ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ, বরুণপুরাণ, কালিকাপুরাণ, মহেশ্বর পুরাণ, শাম্বপুরাণ, সর্বার্থপ্রকাশক সৌরপুরাণ, পরাশরপুরাণ, মারীচপুরাণ এবং ভার্গব পুরাণ ; উপপুরাণ এই অষ্টাদশসংখ্যক।"
আপাতদৃষ্টিতে পুরাণের সংখ্যা (১৮+১৮) = ৩৬ টি হলেও, বর্তমানে পুরাণ নামে গ্রন্থ পাওয়া যায় ৩৬ সংখ্যাটির দ্বিগুণেরও বেশী। এ পুরাণের অনেকগুলোই পরস্পর বিরোধী ভাব দ্বারা পূর্ণ। তাই লেখাগুলি একজনের লেখা কিনা, এটা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে বিস্তর মতভেদ। বিষ্ণুপুরাণে এবং দেবী ভাগবতে বিভিন্নকালে ২৮ জন ব্যাসের কথা আছে। এ পুরাণগুলির মধ্যে পদ্মপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ সহ কয়েকটির বঙ্গ সংস্করণের সাথে দক্ষিণ ভারত, উত্তর ভারতের সংস্করণ মেলে না। শ্লোক পর্যন্ত মেলে না। পঞ্চদশ ষোড়শ শতাব্দীর বিখ্যাত স্মৃতিশাস্ত্রকাররা তাদের স্মৃতির বচনে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ থেকে যে সকল শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন এর অধিকাংশই বর্তমান গ্রন্থে নেই। উদাহরণ হিসেবে স্মৃতিচন্দ্রিকা গ্রন্থের কথা বলা যায়। এ গ্রন্থটি সহ তৎকালীন স্মৃতি নিবন্ধকারগণ তাদের গ্রন্থে প্রায় ১৫০০ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন। কিন্তু নিবন্ধকারদের সে ১৫০০ শ্লোক থেকে বর্তমানে প্রাপ্ত ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে মাত্র ৩০ টি শ্লোক পাওয়া যায়। এতেই সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় গ্রন্থটির প্রাচীনরূপ এবং বর্তমান রূপের বিস্তর পার্থক্য। দক্ষিণভারতে গ্রন্থটির নাম পর্যন্ত আলাদা,সেখানে নাম ব্রহ্মকৈবর্তপুরাণ।
(লেখাটি অসমাপ্ত। তাই কপি করবেন না। শেয়ার দিতে পারেন)
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
ফেসবুক পোস্ট লিঙ্ক : Facebook ফেসবুক পেজ লিঙ্ক : Shri Kushal Baran Chakraborty | Facebook
মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁