বাংলাভাষায় সংবাদপত্র,গণমাধ্যম সহ আমরা নিজেরাও অজ্ঞানতাবশত প্রতিনিয়ত একটি শব্দ আমাদের যাপিত জীবনে ব্যবহার করি, শব্দটি হলো 'হোতা'। হোতা শব্দের প্রধান অর্থ হল, আহ্বানকারী। তিনি কি আহ্বান করেন? তিনি যজ্ঞের আহ্বান করেন এবং যজ্ঞপুরুষ ভগবানকে আহ্বান করেন। আবার ঋগ্বেদের প্রথম মন্ত্রেই অগ্নিরূপ পরমেশ্বরকে হোতা বলে সম্বোধন করে তাঁর কাছে ধনরত্নের কামনা করা হয়েছে। এ অনন্ত ধনরত্ন কোন জাগতিক ধনরত্ন নয়, এ ধন হলো যোগ্য অধিকারী সাধকের মুক্তি।
অগ্নিমীলে পুরােহিতং
যজ্ঞস্য দেবমৃত্বিজম্।
হােতারং রত্নধাতমম্।।
(ঋগ্বেদ সংহিতা:১.১.১)
"আমি যজ্ঞের পুরােহিত, দেবগণের আহ্বানকারী, ঋত্বিক, প্রভূতপরিমাণ রত্নের ধারণকারী এবং দাতা দীপ্তিমান অগ্নিদেবকে স্তুতি করি।"
বৈদিক যজ্ঞে হোতার মহিমা অপরিসীম। হোতার দক্ষ নেতৃত্বেই সকল যজ্ঞ সুনিপুণভাবে সম্পন্ন করা হয়। কোন যজ্ঞ সমাধা করতে ষোলজন ঋত্বিকের প্রয়োজন। এ ঋত্বিকের মধ্যে সর্বপ্রথম এবং সর্বপ্রধান হলেন হোতা। বৈদিক এ ষোলজন ঋত্বিক চার প্রকারের বা চারটি গণের।এ চারটি গণ হলেন: হােতৃগণ, উদগাতৃগণ, অধ্বর্যুগণ ও ব্রহ্মাগণ। এর মধ্যে হোতৃগণের চারজন যজ্ঞে ঋগ্বেদীয় মন্ত্রপাঠ করেন। উদগাতৃগণের চারজন উদগাতা, যজ্ঞে বীণা ও বাদ্যযন্ত্রাদি সহযোগে সামগান করেন। অধ্বর্যুগণের অন্তর্ভুক্ত চারজন অধ্বর্যু, যজ্ঞে আহুতি দিয়ে যজ্ঞকর্ম বা পৌরহিত্য সুসম্পন্ন করেন। সর্বশেষ ব্রহ্মাগণের অন্তর্ভুক্ত চারজন ব্রহ্মা, যজ্ঞের সকল বিষয় সুনিপুণভাবে সমাধা হচ্ছে কিনা তা দর্শন করেন। এ যজ্ঞে এ ষোলজন ঋত্বিকের প্রত্যেকেরই স্বতন্ত্র ভূমিকা রয়েছে। বেদাঙ্গে এ ষোড়শ ঋত্বিকের প্রত্যেকের আলাদা আলাদাভাবে নামকরণ করা হয়েছে।
তস্যর্ত্বিজঃ।।
চত্বারস্ ত্রিপুরুষাঃ।।
তস্য তস্যোত্তরে ত্রয়ঃ।।
হােতা মৈত্রাবরুণােঽচ্ছাবাকো গ্রাবস্তুদ্ অধ্বর্যুঃ
প্রতিপ্রস্থাতা নেষ্টোন্নেতা ব্রহ্মা ব্রাহ্মণাচ্ছংস্যাগ্মীধ্রঃ
পােতােদ্ গাতা প্রস্তোতা প্রতিহর্তা সুব্রহ্মণ্য ইতি ।।
(আলায়ন-শ্রৌতসূত্র: ৪.১.৪-৭)
চারজন ঋত্বিকের প্রত্যেকেই তিনজন করে সহকারী থাকতেন এবং প্রত্যেক চারজনে এক একটি গণ রচনা করতেন। যেমন:হােতৃগণ, উদগাতৃগণ, অধ্বর্যুগণ ও ব্রহ্মাগণ।
হােতৃগণ : হােতা, মৈত্রাবরুণ, অচ্ছাবাক এবং গ্রাবস্তুৎ।
উদগাতৃগণ : উদগাতা, প্রস্তোতা, প্রতিহর্তা এবং সুব্রহ্মণ্য।
অর্ধ্বর্যুগণ : অধ্বর্যু, প্রতিপ্রস্থাতা, নেষ্টা এবং উন্নেতা।
ব্রহ্মাগণ : ব্রহ্মা, ব্রাহ্মাণাচ্ছংসী, পােতা এবং আগ্নীধ্র।
হােতা, পোতা, নেষ্টা, অগ্নীধ্র, প্রশাস্তৃ, অধ্বর্যু এবং ব্রহ্মা -এ ঋত্বিকদের নাম ঋগ্বেদ সংহিতার দ্বিতীয় মণ্ডলে পাওয়া যায়।
তবাগ্নে হােত্রং তব পােত্রমৃত্বিয়ং
তব নেষ্ট্রং ত্বমগ্নিদৃতায়তঃ।
তব প্রশাস্ত্রং ত্বমধ্বরীয়সি
ব্রহ্মা চাসি গৃহপতিশ্চ নাে দমে।।
(ঋগ্বেদ সংহিতা:২.১.২)
যজ্ঞানুষ্ঠানে প্রধান ঋত্বিক হােতাই একাধারে দেবতাদের আহ্বান করতেন এবং দেবতাদের উদ্দেশ্যে আহুতি নিজে প্রদান করতেন বা অর্ধ্বযুকে আহুতি প্রদানে নির্দেশনা দিতেন। হােতৃশব্দের 'হ্বে'-ধাতুর দুটি অর্থের ব্যুৎপত্তি পাওয়া যায়। প্রথমত আহ্বান করা এবং দ্বিতীয়ত আহুতিপ্রদান করা। তবে আহ্বানার্থক অর্থেই শব্দটি বেশী প্রয়োগ করা হয়। যাঙ্কের নিরুক্ত গ্রন্থে ঋগ্বেদের একটি মন্ত্রের (১.১৬৪.১) ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে:
"হােতুঃ হ্বাতব্যস্য"(৪.২৬.২)। অর্থাৎ আহ্বানার্থক 'হ্বে' ধাতু থেকেই হােতৃ শব্দটি নিষ্পন্ন।
ষোলজন ঋত্বিকের প্রধানকে বলা হয় হোতা। তাই হোতা অত্যন্ত পবিত্র এবং সম্মানিত একটি শব্দ। কিন্তু আমরা বর্তমানে নিজেদের অজ্ঞাতসারে হোতা শব্দটিকে ব্যবহারিক জীবনে নেতিবাচক অর্থে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যবহার করছি। কেউ চুরি, ডাকাতি বা ছিনতাই করে ধরা পরলে, আমরা অবলীলায় সেই চোর,ডাকাত এবং ছিনতাইকারীর নেতাকে হোতা বলে সম্বোধন করে ফেলি। আমরা বলি, "চোরের হোতা, ডাকাতের হোতা বা ছিনতাইকারীচক্রের হোতা পুলিশের হাটে আটক হয়েছে, দেশের প্রশাসনের কাছে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই"। কোন দেশদ্রোহী রাজাকার প্রসঙ্গে আমরা বলি যে, "রাজাকারের হোতা অমুখ ব্যক্তিকে ১৯৭১ সালের গণহত্যার কারণে দেশের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনাল যুদ্ধাপরাধীদের হোতা হিসেবে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে"। কোন শিশু একটু দুষ্ট হলে, আমরা বলি, "এই ছেলেটাই হলো দুষ্টের হোতা, সে অন্যদের দুষ্টামি করতে প্ররোচিত করছে"।বাংলা ভাষায় কেউ কোন কিছুর নেতৃত্বস্থানীয় বা প্রধান হলেই, তাকে হোতা সম্মোধন করা করা হয়। বৈদিক যজ্ঞের ষোলজন ঋত্বিকের প্রধান এবং সর্বোচ্চ সম্মানিত হোতা শব্দটি কখনই নেতিবাচক শব্দ হিসেবে প্রয়োগ করা উচিতনয়। কিন্তু আমরা নেতিবাচক অর্থে নেতিবাচক শব্দের সাথে যুক্ত করে প্রতিনিয়ত ব্যবহার করে চলছি।বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক, পরিতাপের এবং নিন্দনীয়।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।