গুরু নিয়ে কোথাও কোন ধর্মসভা বা আলোচনা শুরু হলে, প্রথমেই একটি গুরুস্তোত্র অধিকাংশ গুরুভক্ত মানুষ ব্যবহার করেন। শ্লোকটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। জগতের অজ্ঞানরূপ অন্ধকারে মোহাচ্ছন্ন অন্ধ ব্যক্তির চোখকে জ্ঞানরূপ অঞ্জনশলাকা দ্বারা উন্মীলিত করে তোলেন গুরু ; স্তোত্রটিতে সেই বিষয়টি বর্ণনা করে সদগুরুকে প্রণাম জানানো হয়েছে।
অজ্ঞানতিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জন শলাকয়া।
চক্ষুরুন্মীলিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ॥
(গুরুগীতা:২৭)
"অজ্ঞানরূপ অন্ধকারে আচ্ছন্ন অন্ধ ব্যক্তির চোখকে যিনি জ্ঞানরূপ অঞ্জনশলাকা দ্বারা উন্মীলিত করে, যিনি জ্ঞানপ্রদান করেছেন; সেই শ্রীগুরুদেবকে প্রণাম করি।"
এই স্তোত্রটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হলেও, অধিকাংশ বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বী জানে না এ স্তোত্রটি কোথা থেকে নেয়া হয়েছে। এ স্তোত্রটি গুরুগীতার অন্তর্ভুক্ত এবং গুরুগীতা 'বিশ্বসারতন্ত্র' নামক তন্ত্র গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। এ শ্লোকগুলা যেহেতু শিবের মুখে পার্বতীকে বলা হয়েছে; তাই এ শ্লোকের গুরু বলতে সাধারণ মনুষ্য গুরুরূপ পরমেশ্বরকেই বোঝানো হয়েছে। শাস্ত্রের বিভিন্ন স্থানে পরমেশ্বরকেই গুরু নামে অভিহিত করা হয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাঁর 'কথামৃত' গ্রন্থে (১৮৮২, ১৪ই ডিসেম্বর) বলেছেন, সচ্চিদানন্দই গুরু এবং তিনিই জীবকে মুক্তি প্রদান করেন।
"মানুষের কি সাধ্য অপরকে সংসারবন্ধন থেকে মুক্ত করে। যাঁর এই ভুবনমোহিনী মায়া, তিনিই সেই মায়া থেকে মুক্ত করতে পারেন। সচ্চিদানন্দগুরু বই আর গতি নাই। যারা ঈশ্বরলাভ করে নাই, তাঁর আদেশ পায় নাই, যারা ঈশ্বরের শক্তিতে শক্তিমান হয় নাই, তাদের কি সাধ্য জীবের ভববন্ধন মোচন করে।"
এ অত্যন্ত জনপ্রিয় গুরুরূপ পরমেশ্বরের তন্ত্রোক্ত স্তোত্রটি বেদাঙ্গগ্রন্থে সামান্য পরিবর্তিত আকারে পাওয়া যায়। পিঙ্গলাচার্য সংকলিত 'পাণিনীয়শিক্ষা' বৈদিক ধ্বনিতত্ত্বের গ্রন্থে অনুরূপ শ্লোকটি পাওয়া যায়।
যেনাক্ষরসমান্নায়মধিগম্য মহেশ্বরাৎ।
কৃৎস্নং ব্যাকরণং প্রোক্তং তস্মৈ পাণিনয়ে নমঃ।।
যেন ধৌতা গিরঃ পুংসাং বিমলৈঃ শব্দবারিভিঃ।
তমশ্চাজ্ঞানজং ভিন্নং তস্মৈ পাণিনয়ে নমঃ।।
অজ্ঞানান্ধস্য লোকস্য জ্ঞানাঞ্জনশলাকয়া।
চক্ষুরুন্মীলিতং যেন তস্মৈ পাণিনয়ে নমঃ।।
(পাণিনীয় শিক্ষা:৫৭-৫৯)
"যিনি মহেশ্বরের কাছ থেকে বর্ণোচ্চারণ বিদ্যা আয়ত্ত করে সমগ্র ব্যাকরণ শাস্ত্র ব্যক্ত করেছেন, সেই পাণিনিকে প্রণাম ।
যিনি বিশুদ্ধ নির্মল শব্দশাস্ত্র ব্যাকরণরূপ জলের দ্বারা মানুষের বচনকে ধৌত করে অজ্ঞানতাজনিত অন্ধকার দূর করেছেন, সেই পাণিনিকে প্রণাম।
যে ব্যক্তি, জ্ঞানরূপ কাজলের শলাকা দিয়ে অজ্ঞানতারূপ দৃষ্টিহীন মানুষের চোখ খুলে দিয়েছেন, সেই পাণিনিকে প্রণাম।"
বৈদিক পাণিনীয়শিক্ষায় উক্ত শোকটির প্রথমপাদে রয়েছে "অজ্ঞানান্ধস্য লোকস্য"; কিন্তু তন্ত্রোক্ত গুরুগীতায় উক্ত শ্লোকটিতে বলা হয়েছে, "অজ্ঞানতিমিরান্ধস্য"। দুটি শ্লোকের প্রথম পাদের অর্থ প্রায় একই প্রকারের। দুটিতেই অজ্ঞানরূপ অন্ধকারে আচ্ছন্ন জগতের কথা বলা হয়েছে। প্রার্থনা করা হয়েছে, সেই অন্ধকার জগত থেকে জ্ঞান প্রদান করে আলোর পথে নিয়ে যেতে। অর্থাৎ শ্লোকের শব্দে পার্থক্য হলেও, তাদের অন্তর্নিহিত অর্থে পার্থক্য নেই। আরেকটি পার্থক্য রয়েছে শ্লোকটির শেষপাদে। বৈদিক বেদাঙ্গের পাণিনীয়শিক্ষা গ্রন্থে, "তস্মৈ পাণিনয়ে নমঃ" বলে মহর্ষি পাণিনিকে প্রণাম জানানো হয়েছে।পক্ষান্তরে তন্ত্রোক্ত শ্লোকটিতে "তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ" বলে শ্রীগুরুকে প্রণাম জানানো হয়েছে। যদিও এখানে গুরু বলতে গুরুরূপ পরমেশ্বরকেই বোঝানো হয়েছে। তন্ত্রোক্ত শ্লোকটি যে পরবর্তীকালের, এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বৈদিক মন্ত্রের সাদৃশ্যে পরবর্তীকালে পুরাণ, তন্ত্র এবং স্মৃতিতে অনেক শ্লোক রচিত হয়েছে। সে সকল শ্লোকের সকলই গ্রহণীয় নয়, আবার সকলই বর্জনীয় নয়। বেদ পরবর্তীকালের পৌরাণিক বা তান্ত্রিক যে কোন তত্ত্বকে গ্রহণ বর্জনের মাধ্যমে গ্রহণ করতে হবে। যদি বেদের সাথে কোন সাংঘর্ষিক বিষয় থাকে তবে নির্দয়ভাবে বর্জন করতে হবে।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।