ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্র, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নিশীথ প্রামাণিক। গত ০৭.০৭.২০২১ সন্ধ্যায় নয়াদিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে নতুন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের সাথে শপথ গ্রহণ করেন নিশীথ প্রামাণিক। তিনি নরেন্দ্র মোদির মন্ত্রীসভার সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রী। তাদের পারিবারিক তথ্যসূত্র অনুসারে নিশীথ প্রামাণিকের পিতা বিধুভূষণ প্রামাণিক ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ভারতে চলে যান। তার মায়ের নাম ছন্দা প্রামাণিক। ৩৫ বছর বয়সের নিশীথ প্রামাণিকের জন্ম ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জানুয়ারী, পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার দিনহাটায়। সুদর্শন এ মন্ত্রী, মাত্র ৩৫ বছর বয়সের মধ্যেই যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন, তা বিরলতম। তার এই রাজনৈতিক উত্থানের ধারাবাহিকতা যদি বজায় থাকে, তবে আগামীতে সে আরও বড় দায়িত্বে, আরও বড় পর্যায়ে অধিষ্ঠিত হবে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন রাজনীতির জন্যে তিনি সর্বক্ষেত্রে প্রশংসিত। সম্মানিত নিশীথ প্রামাণিকের প্রতিমন্ত্রী হওয়ার খবরে আনন্দের বন্যা বইছে তার পৈতৃক বাড়ি গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ী উপজেলার ভেলাকোপা গ্রামের বাড়িতে। বাংলাদেশের মিডিয়াতে নিশীথ প্রামাণিককে নিয়ে বেশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে। তার এমন অর্জনে তার কাকা-জ্যাঠাসহ পরিবারের সবার মুখেই বইছে আনন্দের ঝিলিক।আনন্দে তারা মিষ্টি বিতরণ করছে। তাকে প্রতিমন্ত্রী করার ঘোষণা গণমাধ্যমে প্রচার পাওয়ার পর থেকেই বিষয়টি আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে সমগ্র এলাকা জুড়ে। পরিবার ছাড়াও আনন্দিত তার সম্প্রদায়ের মানুষসহ এলাকাবাসী।
বাংলাদেশের বংশোদ্ভূত একজন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী হয়েছেন। বিষয়টি সত্যি অত্যন্ত আনন্দের। তাকে আমরা
অভিনন্দন
জানাই। কিন্তু একথাও সত্য, বিষয়টি আমাদের জন্য অনেকটা লজ্জার। এ ঘটনাটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে হিন্দু সম্প্রদায়ে প্রতিনিয়ত দেশত্যাগের বিষয়টি। দেশের অধিকাংশ হিন্দু পরিবার থেকে প্রত্যেক প্রজন্ম থেকেই কেউ না কেউ ভারতে চলে যাচ্ছে - এ বিষয়টির নিশীথ প্রামাণিক একটি প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত। তিনি গাইবান্ধায় থাকলে মন্ত্রী, এমপি, পৌরসভা বা উপজেলা চেয়ারম্যান দূরে থাক ; সামান্য ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হতে পারতেন কিনা আমার ঠিক জানা নেই।নিশীথ প্রামাণিকের জন্ম হয়ত বাংলাদেশে হয়নি, কিন্তু তার পূর্বপুরুষের জন্ম এ মাটিতে। পার্শ্ববর্তী ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী তিনিও বাংলাদেশের চাঁদপুরের মানুষ। তার বাড়ি চাঁদপুরের কচুয়াউপজেলার মেঘদাইর গ্রামে। তার পিতার নাম হিরুধন দেব ও মায়ের নাম মিনা রানী দেব। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তার পিতামাতা ত্রিপুরা চলে যান। পরবর্তীতে সেখানেই স্থায়ী বাসিন্দা হন। বিপ্লব দেবের পরিবারের অধিকাংশ সদস্য এখনো কচুয়ায় বসবাস করছে। এখানে লক্ষ্যনীয় যে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেবের পিতা হিরুধন দেব এবং নরেন্দ্র মোদির মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্র, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিকের পিতা বিধুভূষণ প্রামাণিক উভয়ই মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারতে চলে যান। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এমন অগণিত হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে আর তারা ফিরেই আসেনি। এদের পরিসংখ্যান হয়ত কেউ বলতে পারবে না। কারণ এ তথ্য-উপাত্তের পরিসংখ্যান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ অথবা রাষ্ট্র এ দুয়ের কোন পক্ষ থেকেই সংরক্ষণ করা হয়নি বলা চলে।ত্রিপুরার গত বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে একজন নামকরা সংস্কৃতি অনুরাগী মন্ত্রী অনীল সরকার। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পরম বন্ধু ছিলেন। বছর দশেক আগে আমার যতদূর মনে পড়ে, জাতীয় দৈনিকে একটি সংবাদ দেখেছিলাম। তিনি তার মায়ের মৃত্যুতে অন্যান্য ভাইয়ের সাথে শ্রাদ্ধ করতে বাংলাদেশ এসেছিলেন। অর্থাৎ ছেলে ভারতের মন্ত্রী, আর তার ভাইসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্য বাংলাদেশে। এরকম অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যায়। কিভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ দেশত্যাগ করছে। এরজন্যে যে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিশেষ দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন, সে বিষয়ে কি সুদৃষ্টি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ পাচ্ছে?
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের সাথে বঞ্চনা এবং তাদের দেশত্যাগ ইত্যাদি প্রসঙ্গে ব্যাপক গবেষণা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত স্যার। তার একটি গবেষণাগ্রন্থ রয়েছে, ‘পলিটিক্যাল ইকোনমি অফ রিফরমিং এগ্রিকালচার- ল্যান্ড-ওয়াটার বডিস ইন বাংলাদেশ’। গ্রন্থটির বাংলা নাম ‘বাংলাদেশে কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি’। ২০১৪ সালে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটিতে তিনি বলেন, ১৯৬৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এই ৫ দশকে মোট ১ কোটি ১৩ লাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে ২ লাখ ৩০ হাজার ৬১২ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ নিরুদ্দিষ্ট বা দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। প্রতিদিন গড়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ৬৩২ জন মানুষ দেশ ত্যাগ করছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে আর তিনদশক পরে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অস্তিত্বই থাকবে না। দেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ১৫ টি জেলা থেকে হিন্দুদের সংখ্যা হু হু করে কমে যাচ্ছে।আপনি কি জানেন সেই ১৫ টি জেলা কোন কোন জেলা?যে জেলাগুলোকে আওয়ামীলীগের ঘাটি বলা হয় সেই গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর সেরকম প্রত্যেকটা জেলা থেকে হিন্দুদের সংখ্যা হুহু করে কমে যাচ্ছে।আপনি যদি দেখেন,আজকে বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ কেন হিন্দুদের সংখ্যা কমে যাওয়ার প্রথম তালিকায় থাকবে? তবে কি প্রদীপের নিচেই অন্ধকার?
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।