২০১৬ সালের জুলাই মাসে আমি অযোধ্যায় শ্রীরাম জন্মভূমি দর্শনে যাই।শ্রীরামজন্মভূমি অযোধ্যাতে গিয়ে এত ভাল লেগেছিল, তা ভাষায় ব্যক্ত করার মত নয়। মনে হয় জীবনে এমন আনন্দের দিন খুব কমই এসেছে। অযোধ্যার রাস্তায় হাটতে হাটতে বারবার মনে হচ্ছিল, এই সেই অযোধ্যার রাজপথ যে পথ দিয়ে রাবণকে বধ করে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র দীপাবলির দিনে বীরবেশে অযোধ্যায় প্রবেশ করেছিলেন। সারা অযোধ্যাবাসী অযোধ্যাপতির আগমনে আনন্দঘন হয়ে ছিলেন। তাঁদের চোখে ছিল আনন্দাশ্রু। মঙ্গলঘট, প্রদীপসহ বিবিধ মাঙ্গলিক দ্রব্যে সুসজ্জিত হয়ে ছিল সম্পূর্ণ অযোধ্যা নগরী। লাখো লাখো প্রদীপের আলোয় প্রজ্জ্বলিত হয়েছিল অযোধ্যা। প্রদীপের আলোর শোভায় দিন না রাত্রি ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। অযোধ্যা স্বয়ং শ্রীহরির নগরী।স্কন্দ পুরাণের বিষ্ণুখণ্ডে বর্ণিত হয়েছে, অযোধ্যা নগরীতে স্বয়ং শ্রীহরি মূর্তিমান হয়ে বিরাজমান হয়ে আছেন।
অযোধ্যা সা পরা মেধ্যা পুরী পুরী দুষ্কৃতিদুর্লভা।
কস্য সেব্যা চ নাযোধ্যা যস্যাং সাক্ষাদ্ধরিঃ স্বয়ম্।।
সরযূতীরমাসাদ্য দিব্যা পরমশোভনা।
অমরাবতীনিভা প্রায়ঃ শ্রিতা বহুতপোধনৈঃ।।
(স্কন্দ পুরাণ: বিষ্ণুখণ্ড,অযোধ্যা,১.৩০-৩১)
"যে স্থান অত্যন্ত পবিত্র, যে স্থানে দুষ্কৃতকারীরা বসবাস করতে পারে না; যেখানে স্বয়ং শ্রীহরি মূর্তিমান হয়ে বিরাজ করেন, এমন পবিত্র অযোধ্যা পুরীর কে না সেবা করতে চায়? স্বর্গের নগরী অমরাবতীর মত পরম শোভাশালিনী দিব্যপুরী অযোধ্যা সরযূনদীর তীরে অবস্থিত।এ পুরীর সর্বত্রই তপধনগণ সুখে বসবাস করেন।"
অযোধ্যায় গিয়ে প্রথমেই সরযূ নদীর জলে স্নান করি। প্রচণ্ড স্রোতস্বিনী নদী। স্নান করতে করতে আমি যেন ত্রেতাযুগে ফিরে গেলাম। মনে হল এই সেই নদী, যে নদীর জলে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র স্নান করেছেন। এমনকি তাঁর অবতার লীলাও সমাপন করেছেন। সরযূর নদী ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের স্পর্শ অনুভব করতে গেল। হৃদয়টা শান্ত হয়ে গেল। বারবার মনে হতে লাগত রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে বর্ণিত ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের অবতার লীলা সমাপনের বিবরণটি। এই সরযূ নদীতেই ভ্রাতাদের সঙ্গে সশরীরে অবতার লীলা সমাপন করেছিলেন ভগবান শ্রীরামচন্দ্র।
অধ্যর্ধযোজনং গত্বা নদীং পশ্চান্মুখাশ্রিতাম্।
সরযূং পুণ্যসলিলাং দদর্শ রঘুনন্দনঃ।।
তাং নদীমাকুলাবর্তাং সর্বত্রানুসরন্ নৃপঃ।
আগতঃ সপ্রজো রামস্তং দেশং রঘুনন্দনঃ ॥
(রামায়ণ: উত্তরকাণ্ড, ১১০.১-২)
"অযোধ্যা থেকে দেড় যোজন দূরে গিয়ে রঘুকুলনন্দন ভগবান শ্রীরাম পশ্চিমাভিমুখ হয়ে নিকটস্থ পুণ্যসলিলা সরযূ নদী দর্শন করেন।
সরযূনদীর চারদিকে ভ্রমর উঠছিল। সেখানে সবদিকে ঘুরে ফিরে রঘুনন্দন রাজা শ্রীরাম প্রজাগণের সঙ্গে এক উত্তম স্থানে এলেন।"
স্নান সমাপন করে প্রথমেই গেলাম হনুমান গঢ়ি মন্দিরে। প্রথা অনুসারে হনুমান গঢ়ি মন্দিরে পূজা দিয়ে হনুমানজীর আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে হয়। হনুমানজীর আশীর্বাদ নিয়েই পরবর্তীতে শ্রীরাম জন্মভূমি মন্দিরের দিকে অগ্রসর হতে হয়। মন্দিরটি অসংখ্য মন্দিরের মাঝখানে কিছুটা উচ্চতায় অবস্থিত। ৭৬টি ধাপ অতিক্রম করে তবেই হনুমানজীর মন্দিরে প্রবেশ করতে হয়। হনুমান গঢ়ি মন্দিরে পূজা দিয়ে এরপরে ধীরেধীরে আমি এবং আমার সাথে আরও দুইজন মিলে জন্মভূমি মন্দিরের অভিমুখে অগ্রসর হলাম।জন্মভূমি মন্দিরে যেতে পথটি চারফিট প্রশস্ত দেড়-দুই কিলোমিটারের একটা খাচায় মোড়ানো কারাগার, যা কিছুক্ষণ পরেপরেই তল্লাশি চেক হতে হতে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তার চাদরে মোড়ানো। শ্রীরামজন্মভূমিতে ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের প্রতিমা একটা অস্থায়ী তাবুতে রাখা। চারিদিকে প্রচুর হনুমানসহ বানরসেনা। আমাকে অন্যান্য তীর্থযাত্রীরা বললো, বানর থেকে সাবধানে থাকতে। আমিও অন্যদের সাবধান করলাম, এরমধ্যেই দেখি আমার হাতের প্রসাদ উধাও। ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম এক বানর প্রসাদের পাত্রটি নিয়ে গাছের ডালে বসে আনন্দে খাচ্ছে। প্রথমে একটু খারাপ লেগেছিল, পরক্ষণেই আমার মনে হল পূজাটা স্বার্থক হয়েছে; যাঁর কাছে এসেছি তিনিই তাঁর প্রিয় বানরসেনার মাধ্যমে প্রসাদটি গ্রহণ করলেন।অযোধ্যা নাম স্মরণেও মহাপুণ্য হয়।অযোধ্যা শব্দের মাহাত্ম্য প্রসঙ্গে অগস্ত্য ঋষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেবকে বলেছেন:
অকারো ব্রহ্ম চ প্রোক্তং যকারো বিষ্ণুরুচ্যতে।
ধকারো রুদ্ররূপশ্চ অযোধ্যানাম রাজতে।।
(স্কন্দ পুরাণ: বিষ্ণুখণ্ড, অযোধ্যা,১.৬০)
"শাস্ত্র বলে, 'অ'-কার ব্রহ্ম, 'য'-কার বিষ্ণু এবং 'ধ'-কার রুদ্রের রূপ; অযোধ্যা এ বর্ণত্রয়ে ব্রহ্মা বিষ্ণু রুদ্র সতত বাস করে।"
চারিদিকে হাজার হাজার মন্দির।শ্রীজন্মভূমিতে অস্থায়ী মন্দিরের কিছু দূরেই থরে থরে সাজানো আছে প্রস্তাবিত শ্রীরামজন্মভূমি মন্দিরের জন্যে রাজস্থান থেকে আনা অপূর্ব কারুকাজ খচিত পাথর এবং সারা পৃথিবী থেকে শ্রীরাম ভক্তদের আনা জয় শ্রীরাম লেখা ইট। অল্পকিছু আত্মঘাতী হিন্দুদের বাদ দিয়ে শ্রীরামজন্মভূমিতে একটি ভব্য মন্দির শতকোটি হিন্দুর প্রাণের দাবি। ভারতের কিছু বামপন্থী মিডিয়া হাউজের নিউজ দেখে কখনই বোঝা যাবে না, এ মন্দিরকে ঘিরে মানুষের আবেগের কথা। এক মাঝবয়সী মহিলাকে দেখলাম তিনি প্রস্তাবিত মন্দিরের জন্যে আনা পাথরগুলোর উপরে বারবার হাত বুলাচ্ছেন এবং জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছেন।একদিন কারুকার্য খচিত এ পাথরগুলো দিয়েই মন্দির হবে, এ স্বপ্ন তার চোখেমুখে। পাথরগুলোর প্রতি তার মাতৃত্বের বাৎসল্য প্রেম দেখে আমারও চোখের জল চলে আসলো। মনে একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগলো, পৃথিবীর অন্য কোন জাতি কি আছে যারা সাম্রাজ্যবাদী অসভ্য বর্বরদের হাতে পৈশাচিকভাবে নির্যাতিত হয়েও পরাধীনতার ক্ষতচিহ্ন সাজিয়েগুছিয়ে রেখেছে?এটা সম্ভবত পৃথিবীর কোথাও নেই। পৃথিবীর সকল জাতিই তাদের পরাধীনকালীন সময়ে বিদেশীদের সকল চিহ্ন মুছে দিয়েছে।শুধু ব্যতিক্রম ভারতবর্ষ। স্কন্দ পুরাণে বলা হয়েছে, অযোধ্যা স্মরণে শত কল্পান্তেও পুনর্জন্ম হয় না।
যত্র কুত্র স্থিতো যস্তু হ্যযোধ্যাং মনসা স্মরেৎ।
ন তস্য পুনরাবৃত্তিঃ কল্পান্তরশতৈরপি।।
(স্কন্দ পুরাণ: বিষ্ণুখণ্ড, অযোধ্যা, ১০.৩৪)
" মানব যেখানেই থাকুক না কেন, মনে মনে অযোধ্যাকে স্মরণ করলেও, তার শত কল্পান্তেও পুনর্জন্ম হয় না।"
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।