জগত একটি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। এ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা প্রতিনিয়ত বিদ্যার্থী। মানুষ জন্ম থেকে আমৃত্যু বিদ্যার্থী ; একদিনের শিশু থেকে শতবছরের বৃদ্ধ প্রত্যেকেই একজন বিদ্যার্থী। তাই যতদিন দেহের প্রাণবায়ু স্পন্দিত হবে ততদিনই জ্ঞান আহরণ করতে হবে। এ জ্ঞান আহরণে কোন ধনী-দরিদ্র, ব্রাহ্মণ-শূদ্রে ভেদাভেদ নেই। জগতে জাতিধর্মনির্বিশেষে সকলের থেকেই শিক্ষা লাভ করা যায়। এ প্রসঙ্গে গরুড়পুরাণে অসাধারণ দুটি পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে একটি বালকের থেকে শিক্ষা লাভ করতে। বিষ থেকেও অমৃত গ্রহণ করতে। সামাজিকভাবে যতই মর্যাদাহীন ব্যক্তি হোন না কেন, তার থেকেও জ্ঞান লাভ করতে। অর্থাৎ জগতের সর্বপ্রকার মানুষ থেকে উত্তম বিদ্যা গ্রহণ করা উচিত। রসিকমোহন চট্টোপাধ্যায় অনূদিত 'অষ্টাদশপুরাণম্' অন্তর্ভুক্ত গরুড়পুরাণের পূর্বখণ্ডের ১১০ অধ্যায়ের ৭ ও ৮ নং দুটি শ্লোক হিসেবে পাওয়া যায়। কিন্তু গরুড়পুরাণের পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত সংস্করণে দুটি শ্লোকের স্থানে মাত্র একটি শ্লোক (৭) পাওয়া যায়। সংকলিত, সম্পাদিত শ্লোকের মধ্যে সামান্য পাঠান্তর রয়েছে।"বিষাদপ্যমৃতং গ্রাহং" -এ শ্লোকটি চাণক্য শ্লোক সংগ্রহেও (চাণক্য শ্লোক:৬৭) রয়েছে।
হবির্দেবকুলাদগ্রাহং বালাদপি সুভাষিতং।
অমেধ্যাৎ কাঞ্চনং গ্রাহৎ স্ত্রীরত্নং দুষ্কুলাদপি ॥
বিষাদপ্যমৃতং গ্রাহং অমেধ্যাদপি কাঞ্চনং ।
নীচাদপ্যুত্তমাং বিদ্যাং স্ত্রীরত্নং দুষ্কুলাদপি॥
(গরুড়পুরাণ: পূর্বখণ্ড,১১০.৭-৮)
"দেবকুল হতেও হবি গ্ৰহণ করতে পারে, বালকের থেকেও সুভাষিত বাক্য শ্রবণ করবে। অপবিত্রস্থান থেকেও কাঞ্চন গ্রহণ করবে এবং দুষ্কুল হতেও উত্তমা স্ত্রীগ্রহণ করবে।
বিষ হতে অমৃত গ্রহণ করবে, অপবিত্রস্থান হতে কাঞ্চন গ্রহণ করবে, নীচ হতেও উত্তম বিদ্যা গ্রহণ করবে এবং দুষ্কুল হতেও স্ত্রীরত্ন গ্রহণ করবে।"
কেউ যদি তথাকথিত শিক্ষিত না, অথবা কায়িকশ্রমেরর মাধ্যমে সামান্য জীবিকা নির্বাহ করে ; তার থেকেও যদি কিছু শিক্ষণীয় থাকে তবে তা শেখা উচিত। এবং বিদ্যা লাভ করে তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। বিদ্যা শিক্ষার ক্ষেত্রে কে শিক্ষা দিচ্ছেন, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়; তিনি কি শিক্ষা দিচ্ছে সেটিই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে কয়েকবছর আগের আমার একটি ঘটনা মনে পড়ে। আমি সেলুনে দাড়ি কাটাচ্ছিলাম। যে ছেলেটা দাড়ি কেঁটে দিচ্ছিলো, সেই ছেলেটা গল্প করতে খুব পছন্দ করে। আমার দাড়ি কাটতে কাটতে সে বলে, আচ্ছা স্যার আপনি কি নতুন লাল রঙের গামছা কিনেছেন তাই না? আমি হঠাৎ একটু অবাক হলাম। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমি যে নতুন লাল রঙের গামছা ইদানীং ব্যবহার করছি তুমি তা কি করে জানলে? সে তখন বলে, এটা তো খুবই সহজ স্যার; এটা আবার না জানার কি আছে? আমি আরেকটু বিস্মিত হয়ে বললাম, সম্পূর্ণ খুলে বলত বিষয়টি। তখন সেই ছেলেটি তার হাতের ক্ষুরের অগ্রভাগ আমাকে দেখায়। আমি প্রথম দৃষ্টিতে বুঝতে পারি না যে, সে আমাকে কি দেখাতে চাচ্ছে। পরে ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম যে, আমার দাড়ি কাটার পরবর্তীতে ক্ষুরের অগ্রভাগে লাল রঙের একটি হালকা আবরণ জন্মেচ্ছে। তা দেখেই ছেলেটি বুঝতে পেরেছে যে আমি একটি নতুন লাল রঙের গামছা ব্যবহার করছি। আমি মনে মনে ভাবলাম, পর্যবেক্ষণ এবং অভিজ্ঞতা সঞ্চিত জ্ঞানের মূল্য। এমন জ্ঞান আমাদের আশেপাশে বহু ছড়িয়ে রয়েছে, যা অনেক তথাকথিত শিক্ষিত মানুষেরাও জানে না। আমি ক্ষৌরকর্ম করা যে ছেলেটির কথা বললাম, সেই ছেলেটি ভালো করে বাংলা অক্ষরও চেনে না। অথচ সে তার দৈনন্দিন কাজের পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তথ্যটি লাভ করেছে; সেই বিষয়টি আমরা কখনো লক্ষ্যই করিনি।
একজন তথাকথিত অশিক্ষিত কৃষকের মাটি, জল, আকাশ এবং বাতাসের প্রতি অভিজ্ঞতা সঞ্চিত জ্ঞান; সেই জ্ঞান হয়ত কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া কৃষি বিজ্ঞানীরও নেই। কারণ বিষয়টি একজনের রয়েছে পড়াশোনা এবং পেশায়; পক্ষান্তরে অন্যজনের সম্পূর্ণ জীবন জুড়ে। ভূমিতে কৃষিকার্য করে স্বয়ং শষ্য উৎপাদন এবং নিজে কৃষিকার্য না করে বইয়ের পাতার পড়া কিছুটা পার্থক্য রয়েছে বৈকি। তবে এটাও সত্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বর্তমানে শিক্ষিত কৃষিবিজ্ঞানীরা উচ্চফলনশীল ধান, গম ইত্যাদি আবিষ্কার করছে। এর বিপরীতে একজন কৃষক হয়ত, কেন হচ্ছে বা কিভাবে হচ্ছে তা বৈজ্ঞানিকভাবে বলতে পারবে না। কিন্তু সে ফলাফলটা বলতে পারবে। সে আকাশ দেখে বলতে পারবে বৃষ্টি হবে কিনা। সে মাটির দিকে তাকিয়ে বলতে পারবে যে, মাটির উর্বরতা অথবা মাটিতে সারের প্রয়োজন রয়েছে কিনা।এ জাতীয় বহু বছরের অভিজ্ঞতা সঞ্চিত ব্যবহারিক জ্ঞানপ্রবাহ থেকে হরিপদ কাপালি আবিষ্কার করেন উচ্চ ফলনশীল হরি ধানের। অথচ হরিপদ কাপালি কোন প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত শিক্ষিত ছিলেন না। তাই চারিপাশে ছড়ানো প্রকৃতি ও পরিবেশ থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চিত জ্ঞান লাভ করতে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে হয় না বা ডিগ্রীধারী শিক্ষিতও হতে হয় না। এক্ষেত্রে শুধুই নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং জীবনবোধের প্রয়োজন।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।