মানব, মহামানব, ঋষি, মুনি দেবতা—সকলের মনীষায় ভ্রম, প্রমাদ, করণাপাটব ও বিপ্রলিপ্সা এই চার প্রকার দোষ বা ত্রুটি বর্তমান। শুধু কম আর বেশি। তাই জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে তাদের সিদ্ধান্তে ভুলভ্রান্তির সম্ভাবনা থাকে। শুধু ভুল নেই, পরমেশ্বরের বাণীতে। এ প্রসঙ্গে শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ বলেছেন:
"প্রভু কহে, বেদান্তসূত্র—ঈশ্বর-বচন।
ব্যাসরূপে কৈল তাহা শ্রীনারায়ণ৷৷
ভ্রম, প্রমাদ, বিপ্রলিপ্সা, করণাপাটব।
ঈশ্বরের বাক্যে নাহি দোষ এই সব।।”
(শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত: আদি, ৭.১০৬-১০৭)
জগতে সবাই ভুল করে। বেদ-বেদান্তে বলা হয়েছে মনুষ্য চার প্রকার ত্রুটি দ্বারা আচ্ছন্ন। চার প্রকার ত্রুটি হল: ভ্রম, প্রমাদ, করণাপাটব এবং বিপ্রলিপ্সা।
ভ্রম: ভুল করার প্রবণতা। মানুষ চায় বা না চায় জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে সে ভুল করবেই। বাংলা ভাষায় লিখতে গেলে 'র' লিখতে গিয়ে ডট না দিয়ে, ভুলবশত নিজের অজান্তেই 'ব' লিখে ফেলে। পরীক্ষার খাতায় ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এ ভুলটি বেশি দেখা যায় । যাদের ভুলের শতাংশ অনেক কম, তারাই ঋষি মুনি ইত্যাদি।সবার ভুল হবে, মানুষ মাত্রই ভুল হবে, এক শতাংশ বা তারও অনেক কম হলেও ভুল হবে। ভুল নেই শুধু ঈশ্বরের বাক্যে। তবে এই ভুলকে চাইলেই দরজা বন্ধ করে রোখা যায় না। ভুলের ভয়ে জ্ঞানের দরজা রুদ্ধ করে রাখলে ভুলের সাথে সাথে সত্যের আলোও হৃদয়গুহায় প্রবেশ করতে পারে না। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'কণিকা' কাব্যগ্রন্থের 'একই পথ' কবিতায় বলেছেন:
"দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি।
সত্য বলে, আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি?"
প্রমাদ: মনুষ্যের ইন্দ্রিয় সামান্যতেই মোহগ্রস্ত হয়ে যায়। তাই সে সর্বদা যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। মিষ্টি খাওয়ার পরে চা খেতে গেলে চায়ের মিষ্টত্ব অনুভব হয় না। অথচ চায়ের মধ্যে প্রচুর মিষ্টি রয়েছে, এরপরেও জিহ্বায় প্রমাদযুক্ত হওয়ায় মিষ্টি অনুভব হয় না। প্রমাদগ্রস্থের পাল্লায় পড়ে মনুষ্যের চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, ত্বক ও জিহ্বা এ পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং বাক, পাণি, পাদ, পায়ু ও উপস্হ এ পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় মোহগ্রস্ত হয়ে যায়। যেমন আকাশে মেঘ সাময়িক সময়ের জন্য সূর্যকে ঢেকে ফেলে, তখন সকল কিছুই অন্ধকার দেখা যায়। পুনরায় মেঘ সরে গেলে আকাশ আবার পূর্বের মত জ্বলজ্বল করে ওঠে। তেমনি বয়ঃসন্ধিকালে অনেক ছাত্রছাত্রীরাই মোহগ্রস্ত হয়ে যায়। তখন যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। আবেগের বশে তখন অনেক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেয়ে ফেলে। এই সিদ্ধান্তের ফলে জীবনে অনেক ভয়ংকর দুর্ঘটনা ঘটে।
করণাপাটব: ইন্দ্রিয়ের সীমাবদ্ধতা। ইদানীং অনেককে বলতে শোনা যায়, ঈশ্বর আছে এ আমি বিশ্বাস করি না। ঈশ্বরকে কে কবে দেখেছে ইত্যাদি অজ্ঞানতাপ্রসূত নাস্তিকতামূলক বাক্য অনেকেই বলে। কিন্তু তাদের এই সামান্য জ্ঞানটুকু নেই যে, জগতে সকল কিছুই ইন্দ্রিয়ের সামনে দৃশ্যমান নয়। পার্শ্ববর্তী একটি দেয়ালের ওপাশে কি আছে আমি হয়ত জানি না। তাই বলে কি দেয়ালের ওপাশে কিছুই নেই? আছে, অবশ্যই আছে; শুধু আমি ইন্দ্রিয়ের সীমাবদ্ধতার কারণে দেখতে পারছি না। দেয়ালের ওপাশে আমি দেখতে পারছি না, কারণ আমার চোখ বা দর্শন ইন্দ্রিয় সীমাবদ্ধ। হয়ত এ নিয়ে মনুষ্য দুঃখ করতে পারে যে, সৃষ্টিকর্তা কেন তাদের দর্শন ইন্দ্রিয়সহ সকল ইন্দ্রিয়কে সীমাবদ্ধ করে পাঠালেন। আবার অনেকের আকাঙ্ক্ষা, সৃষ্টিকর্তা আমাদের দর্শন ইন্দ্রিয়কে কেন একটি অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মত করে পাঠালেন না। যাতে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয় দর্শন করা যায়। কিন্তু আমরা যদি একটু ভেবে দেখি তবে বুঝতে পারব যে, আমাদের ইন্দ্রিয় সীমাবদ্ধ বলেই আমরা এত সুন্দরভাবে স্বাচ্ছন্দ্যে বেঁচে আছি। আজকে যদি আমার চোখ অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হত, তবে আমি হয়ত একগ্লাস জলও খেতে পারতাম না। জলের অসংখ্য জীবন্ত কিলবিল করা জীবকে যখন দেখতে পতাম, তখন হয়ত একগ্লাস জলও ঠিকমত খেতে পারত না। মনুষ্য প্রত্যেকদিন প্রতিগ্লাস জলে লক্ষ লক্ষ জীবকে নির্দ্বিধায় খেয়ে চলছে। এ নিয়ে তার চিন্তা নেই। কারণ সে সাধারণ চোখদিয়ে জীবগুলোকে দেখতে পারছে না। তাই চোখের সীমাবদ্ধতা তাকে নিশ্চিন্ত করেছে এবং নিরুদ্বেগ করেছে।
বিপ্রলিপ্সা: জগতে বিভিন্ন উৎস থেকে যে তথ্য সংগ্রহ করা হয়, সেই সকল তথ্যের উৎসেই কিছুটা স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ত্রুটি রয়ে যায়। এ কারণে জ্ঞানের উৎস এবং জ্ঞানদাতা সর্বদা নির্ভুল হয় না।
এই চারপ্রকার ত্রুটির কারণে আমরা যা কিছুই করি বা যা কিছুই বলি ; তা সকলের মধ্যেই কিছু না কিছু ভুল রয়ে যায়। শুধু ঋষি, মুনি দেবতাদের ভুল হয় না। বা কদাচিৎ কারো হলেও সেই ভুলের শতাংশ অত্যন্ত নগন্য।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।