সঙ্কল্পবিকল্পাত্মক মনের মত ভবঘুরে আর নেই। এ মনকে তাই যথাসাধ্য নিয়ন্ত্রিত করে রাখতে হয়। সে মেঘের মত গন্তব্যহীন হয়ে দিগ্দিগন্তের পানে ছুটে চলে যায়। তাকে ধরে রাখা যায় না। হংসবলাকার মত দুটিপাখা মেলে উড়ে যায় শুধুই উড়ে যায়। চঞ্চল মন নিজেও জানে না, তার গন্তব্যের শেষ কোথায়।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়:
"মন মোর মেঘের সঙ্গী,
উড়ে চলে দিগ্দিগন্তের পানে
নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণবর্ষণসঙ্গীতে
রিমিঝিম রিমিঝিম রিমিঝিম॥
মন মোর হংসবলাকার পাখায় যায় উড়ে
ক্বচিৎ ক্বচিৎ চকিত তড়িত-আলোকে।"
শুদ্ধ বুদ্ধিই মনকে পথ দেখায়। যতক্ষণ শুদ্ধবুদ্ধির উদয় না হয়, মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে চলতেই থাকে। কোথায় চলছে, কোথায় গন্তব্য সে জানে না ; এরপরেও চলতে থাকে। আগুনে ঘি দিলে যেমন আগুন দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে, তেমনি মন সহ ইন্দ্রিয়কে যদি আমরা নিয়ন্ত্রিত করে বশে আনতে না পারি; তবে দোদুল্যমান মন আমাদের নিয়ন্ত্রণ করবে। এর পরিনাম নিশ্চিত দুর্ঘটনা। এ প্রসঙ্গে ঋগ্বেদ সংহিতায় বলা হয়েছে:
তব শরীরং পতয়িষ্ণুর্বন্তব চিত্তং বাত ইব ধ্রজীমান্।
তব শৃঙ্গাণি বিষ্টিতা পুরুত্রারন্যেষু জর্ভুরাণা চরন্তি॥
(ঋগ্বেদ সংহিতা:১.১৬৩.১১)
" হে আত্মন্! তোমার শরীর পতনশীল, তোমার চিত্ত বায়ুর ন্যায় বেগবান, তোমার ইন্দ্রিয়রূপী পুষ্টশৃঙ্গ বিষয় বাসনারূপী অরণ্যে নিরন্তর বিচরণ করে।"
চঞ্চল এ মনের কথা শুধু বেদ নয়, অধিকাংশ শাস্ত্রেই বর্ণিত হয়েছে। শ্রীমদ্ভগবদগীতাতেও চঞ্চল মনের কথা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। চঞ্চল মনকে বশে রাখা বায়ুকে নিরুদ্ধ করার মতই অত্যন্ত দুষ্কর।
চঞ্চল হি মনঃ কৃষ্ণ প্রমাথি বলবৎ দৃঢম্।
তস্যাহং নিগ্রহং মন্যে বায়োরিব সুদুষ্করম্।।
(শ্রীমদ্ভগবদগীতা:৬.৩৪)
"হে কৃষ্ণ, মন অত্যন্ত চঞ্চল, ইন্দ্রিয়াদির বিক্ষোভকারী, দৃঢ় ও শক্তিশালী। তাই তাকে বশে রাখা, বায়ুকে নিরুদ্ধ করার মত দুষ্কর বলে মনে করি।"
রহস্যময় মনকে ঠিক করতেই লালন সাঁই, মনকে মুগুর পিটা করে ঠিক করতে চেয়েছেন। গরুছাগল জমির আল ডিঙিয়ে অন্যের জমির শস্য খেতে না পারে; এ জন্যে আমরা এদের ভাল করে বেঁধে রাখি।এমনকি মুখেও একটি ঠুশি পরিয়ে দেই, যাতে সে আর কিছুই খেতে না পারে। এরপরেও যে গরুর আল ডিঙিয়ে খাওয়ার স্বভাব তাকে শতচেষ্টাতেও নিয়ন্ত্রিত করা যায় না। আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো আমাদের শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ সহ বিভিন্ন বিষয়ে অভিহিত করে।কিন্তু এ যদি আমরা এদের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার করি, তবে তারাই আমাদের ক্ষতির কারণ হয়,ধ্বংসের কারণ হয়।
"মন সহজে কি সই হবা।
ডাবার পর মুগুর পলে
তুমি সেইদিন গা টের পাবা;
চিরদিন ইচ্ছা মনে
আইল ডিঙ্গায়ে ঘাস খাবা।।
ইল্লতে স্বভাব হলে
পানিতে যায় রে ধুলে
খাজলতি কিসে ধুবা;
লালন বলে হিসাবকালে
সকলে ফিকির হারাবা।।"
লালন সাঁই বলেছেন, 'ইল্লতে' স্বভাব হলে, অর্থাৎ স্বভাবে ময়লা বা অপরিচ্ছন্নতা থাকলে তাকে জল দিয়েও ধুয়ে পরিষ্কার করা যায় না।স্বভাব, আচরণ, অভ্যাসের নোংরামি যাকে লালন সাঁই 'খাজলতি' বলেছেন। এ স্বভাব বা খাসলত সাবান সোডা কোন কিছু দিয়েই ধুয়ে পরিষ্কার করা যায় না।এর মালিন্য একেবারেই মানুষের অন্তর্নিহিত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে জন্মগত। এ থেকে মুক্তির উপায় শুধু নিজের কাছেই। এ খাসলত মানব জীবনকে অনেক সময় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। সুতরাং কিছু কিছু কুঅভ্যাস জীবনে পরিবর্তন করা অত্যন্ত জরুরি। তাই মন যে সকল দিকে ধাবিত হবে, সে সকল দিক থেকে মনকে প্রত্যাহৃত করে ঈশ্বর অভিমুখে মনকে চালিত করে দিতে হবে। তবেই মন স্বভাব পরিবর্তন করে, যথাযথ গন্তব্যে পৌছাবে।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।