ধর্ম একটি ব্যক্তিগত আচরিত বিষয়। এ ব্যক্তিগত কল্যাণকর বিষয়কে যতই রাস্তাঘাটে টেনে আনা না হয়, ততই কল্যাণ।কিন্তু যখন ধর্ম বিষয়টি কারণে এবং অকারণে রাস্তাঘাটে চলে আসে তখন তা আর ধর্ম থাকে না। হয়ে ওঠে শুধুই রাজনীতি অথবা রাজনীতির হাতিয়ার। বর্তমানে দিনেদিনে মানবজীবনপ্রবাহ ব্যস্ত থেকে ব্যস্ততম হয়ে যাচ্ছে।প্রতিদিন মানুষ নিজস্ব বাড়িতে সাধ্যমত ধর্ম পালন করবে।শুধু তারাই প্রতিদিন সঙ্ঘবদ্ধভাবে ধর্ম তারাই পালন করতে পারবে, যারা বেকার এবং অলস জীবন যাপন করে। তাই সাধুসন্ন্যাসী ছাড়া সঙ্ঘবদ্ধভাবে ঘরের বাইরে ধর্ম পালন সকলের জন্য প্রয়োজনীয় নয়। তবে একথা সত্য যে, প্রতিদিন সঙ্ঘবদ্ধভাবে ধর্ম পালন না করলেও সপ্তাহে অন্ততপক্ষে একদিন সঙ্ঘবদ্ধ ধর্মীয় সভায় অংশগ্রহণ করা প্রয়োজন। পূর্বে প্রয়োজনীয় না হলেও বর্তমান কালের জন্যে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সেই সনাতন ধর্মীয় নিয়মিত সভার নামকরণ কি হবে? এ প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়, ধর্মসভা, ধর্ম সম্মেলন, ইষ্টগোষ্ঠী সম্মেলন ইত্যাদি বিভিন্ন নতুন নতুন নামকরণ না করে আমাদের পূর্বের থেকে প্রচলিত কোন প্রাচীন শব্দকে গ্রহণ করা প্রয়োজন। এমন একটি পরম্পরাগত প্রাচীন শব্দ হল, 'ধর্মচক্র' শব্দটি। ঋষি-মুনিরা নিয়মিত বসে যেখানে ধর্মের আলোচনা করে ধর্ম নির্ণয় করতেন। মহাভারতের শান্তিপর্বে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে উদ্দেশ্য করে সকলের পরম আশ্রয়স্বরূপ ধর্মচক্রে সর্বদা যুক্ত থাকতে বলা হয়েছে।
আদৌ প্রবৃর্ত্তিতে চক্রে তথৈবাদিপরায়ণে।
বর্ত্তস্ব পুরুষব্যাঘ্র সংবিজানামি তেঽনঘ॥
(মহাভারত: শান্তিপর্ব, ৬৩.৩৫)
"হে পুরুষ শ্রেষ্ঠ যুধিষ্ঠির! ভগবান বিধাতা সৃষ্টির প্রথমেই এইভাবে ধর্মচক্রের প্রবর্তন করেছেন । সুতরাং ধর্মচক্র সকলেরই পরম আশ্রয়স্বরূপ। অতএব তুমি সেই ধর্মচক্রেই আমৃত্যু সদা যুক্ত থেক।"
কালচক্রঞ্চ তদ্দিব্যং নিত্যমক্ষয়মব্যয়ম্ ।
ধৰ্মচক্ৰং তথা চাপি নিত্যমাস্তে যুধিষ্ঠির।।
(মহাভারত: সভাপর্ব, ১১.৩৭)
"হে যুধিষ্ঠির! দিব্য, নিত্য, অক্ষয় ও অব্যয় কালচক্র এবং ধর্মচক্র সর্বদাই সেই সভাতে রয়েছে ।"
ভীষ্মেণ ধৰ্মতো রাজন্ ! সৰ্বতঃ পরিরক্ষিতে।
বভূব রমণীয়শ্চ চৈত্যযূপশতাঙ্কিতঃ ॥
স দেশঃ পররাষ্ট্রাণি বিমৃদ্যাভিপ্ৰবৰ্দ্ধিতঃ।
ভীষ্মেণ বিহিতং রাষ্ট্রে ধৰ্মচক্ৰমবৰ্তত ॥
(মহাভারত: আদিপর্ব, ১০৩.১৩-১৪)
"মহারাজ ! ভীষ্ম ধর্ম অনুসারে সর্বপ্রকারে সেই রাজ্য রক্ষা করতে থাকলে সে দেশ অন্যান্য দেশকে জয় করে বিস্তৃত ও পরম সুন্দর হয়ে উঠেছিল। শতশত যজ্ঞশালা ও শত শত যূপকাষ্ঠ তৈরি করা হয়েছিল।ভীষ্মের বিধান অনুসারে রাজ্যের সর্বত্রই ধর্মচক্র প্রবর্তিত হয়েছিল।"
মহাভারতের আদিপর্বের চৌদ্দতম শ্লোকের 'ভারতকৌমুদী' টিকায় ধর্মচক্র শব্দের অর্থ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, "ধৰ্মচক্রং যজ্ঞাদিধৰ্মকাৰ্য্যম্"। অর্থাৎ যজ্ঞাদি ধর্মকার্যকে ধর্মচক্র বলা হয়। ধর্মচক্র এবং ধর্মকার্য একই। তাই হিন্দু সম্প্রদায়ের সকলের উচিত ঋষি-মুনির পরম্পরায় আজও নিয়মিত সাপ্তাহিক, মাসিক, বাৎসরিক ধর্মচক্রের অংশগ্রহণ ও পরিচালনা। পরমেশ্বরের প্রবর্তিত চক্র সম্পর্কে শ্রীমদভগবদগীতায় বলা হয়েছে। এই চক্রকে ধর্মচক্র, সৃষ্টিচক্র, জগচ্চক্র, কর্মচক্র ইত্যাদি যে নামেও অবিহিত করি না কেন সকলই এক। এ বিবিধ নামধারী সকল চক্রই সৃষ্টির কল্যাণার্থে পরমেশ্বরের কর্তৃক প্রবর্তিত।
কৰ্ম ব্রহ্মোদ্ভবং বিদ্ধি ব্রহ্মাক্ষরসমুদ্ভবম্।
তস্মাৎ সৰ্বগতং ব্রহ্ম নিত্যং যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিতম্।।
এবং প্রবর্ত্তিতং চক্রং নানুবর্ত্তয়তীহ যঃ।
অঘায়ুরিন্দ্রিয়ারামো মোঘং পার্থ স জীবতি।।
(শ্রীমদ্ভগবদগীতা:৩.১৫-১৬)
"বেদ হতে কর্ম উৎপন্ন এবং বেদ পরমেশ্বর হতে প্রকাশিত। অতএব সর্বব্যাপী পরমেশ্বর সর্বদাই যজ্ঞে বা কর্তব্যকর্মে নিত্য প্রতিষ্ঠিত।
হে পার্থ! যে লোক এই প্রবর্তিত চক্রের অনুবর্তন করে না সে ইন্দ্রিয়াসক্ত এবং পাপাচারী। সে ব্যক্তি বৃথাই জীবন ধারণ করে থাকে।"
ভারতের লোকসভার আদর্শ স্থির করা হয়েছে মহাভারতের "ধর্মচক্র-প্রবর্তনায়" -এ বাক্যটি। অর্থাৎ লোককল্যাণে ধর্মচক্র প্রবর্তিত হয়েছে। মহাভারত থেকেই এ ধর্মচক্রের বিষয়টি গৌতমবুদ্ধ নিয়েছেন। সারনাথের ঋষিপত্তন মৃগদাবে তাঁর পঞ্চবর্গীয় শিষ্য কৌন্ডন্য, বপ্প,ভদ্দীয়, মহানাম ও অসসজিতের কাছে তাঁর নবমত প্রচার করেন এবং ধর্ম রক্ষার্থে 'ধর্মচক্র' প্রবর্তন করেন।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।