করোনা একটি ভয়ংকর বৈশ্বিক মহামারী। এর অভিঘাতে ২০২০ সালটি অধিকাংশ মানুষের জীবনে দুর্বিষহ স্মৃতিবহ হয়ে থাকবে। করোনার থাবায় পরিবার-পরিজনদের হারানোয় অনেকের কাছেই একটি অভিশপ্ত বছর হয়ে ২০২০ সালটি বিদায় নিয়েছে। করোনারা প্রথমদিকে কয়েকমাস অধিকাংশ অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। ফলশ্রুতিতে অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টি হয়; এ অর্থনৈতিক মন্দা বা অর্থনৈতিক চাপ কাটিয়ে উঠতে বৈশ্বিকভাবেই অনেক সময় লাগবে। ক্ষুদ্র এবং মাঝারি ধরণের অনেক ব্যবসায়ীরা সেই চাপ হয়ত কোনদিনই কাটিয়ে উঠতে পারবে না।উৎপাদন হ্রাসের কারণে গার্মেন্টস শিল্প সহ বিভিন্ন শিল্পকারখানায় ধ্বস নেমেছে। যা এক অনাগত অস্থির অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়।আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে সাময়িক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। অর্থনৈতিক মন্দার পরম্পরায় বৈশ্বিক রাজনীতিতে শুরু হয়েছে এক নতুন সমীকরণ, নতুন ইস্যু এবং নতুন দ্বন্দ্ব।
করোনায় অধিকাংশ নেতিবাচকতার মধ্যেও একটি বিশেষ দিক আছে, তা হল মানুষের মাঝে কিছুটা হলেও পরিস্কার পরিচ্ছন্নতাবোধ তৈরি হয়েছে। সরকারি স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় এবং গুরুত্ব বাড়বে । ফলশ্রুতিতে তৃণমূল পর্যায়ে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়বে ।প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি মানুষের যত্ন বাড়বে।বন্যপ্রাণী ও জীবজন্তু হত্যা কমবে। প্রকৃতির জল-মাটি-বায়ু কিছুটা হলেও তাদের পূর্বের সজীবতা এবং বিশুদ্ধতা ফিরে পাবে। প্রকৃতির উষ্ণায়ন অনেকটাই কমবে।
করোনায় কারণে বৈশ্বিকভাবে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর আমূল পরিবর্তন ঘটবে। . বিশ্ব রাজনীতিতে এক নতুন ধরণের আধিপত্যবাদের প্রতিযোগিতা শুরু হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সহ পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রনেতাই করোনাকে চাইনিজ ভাইরাস বলে অভিহিত করে চিনের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তাদের কথার রেশ ধরে বলতে হয়, করোনা যদি মানুষের ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা কোন কৃত্রিম জীবাণু হয়; তবে তা পৃথিবীর জন্যে এক ভয়ংকর অশনিসংকেত। করোনা যদি মানবসৃষ্ট কৃত্রিম ভাইরাস হয়, তবে এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে বলা যায়, আগামীতে পৃথিবীর শক্তিধর বিভিন্ন দেশের মধ্যে জীবাণু অস্ত্রের তৈরির ভয়ংকর ইঁদুরদৌড় শুরু হবে।
দীর্ঘ ছুটির কারণে শিক্ষাখাতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, যার রেশ বহুদিন থাকবে। কোমলমতি শিশুদের ঘন্টার পর ঘন্টা অনলাইন ক্লাস করায় তাদের শারীরিক ক্ষতি সহ মানসিক হতে পারে। কারো কারো ক্ষেত্রে এ শারীরিক মানসিক অবসাদ দীর্ঘমেয়াদেও হতে পারে। পড়াশোনায় অতিরিক্ত প্রযুক্তির ব্যবহারে পড়াশোনা গতি বৃদ্ধি পাবে এটা সত্য; কিন্তু সাথে সাথে একাগ্রতা এবং গভীরতা কমিয়ে দিবে।
করোনার প্রথম পর্যায়ে কয়েকমাস মানুষ মানবিক দিক থেকে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে লোকদেখানো হলেও একে অন্যকে সাহায্য সহযোগিতা করেছে। কিন্তু বর্তমানে সেই সাহায্যের বিষয়টি অনেকটাই নিস্প্রভ। অধিকাংশ মানুষেরই "চাচা আপন প্রাণ বাঁচা" অবস্থা। ব্যক্তিগতভাবে অসংখ্য মানুষের ঘরে নিরব দুর্ভিক্ষ চলছে। কিন্তু মুখ ফুঁটে বলার উপক্রম নেই। বিলাসবহুল জীবনযাপন করায় অধিকাংশ ধনাঢ্য উচ্চবিত্ত পরিবারের লোকজন যেমন করোনার শিকার বেশি হয়েছে। তেমনি অনেক দরিদ্র মানুষকে করোনা ঘায়েল করতে না পারলেও, ক্ষুধা মৃত্যুরূপ ধারণ করে তাদের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। এভাবে দীর্ঘদিন করোনাকাল থাকলে এক তীব্রতর খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হতে পারে বিশ্ব।
মানুষের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে যাওয়ায় মানুষ ধীরে ধীরে আরও দরিদ্র হবে । এ দারিদ্রতার শিকার বেশি হবে বা হচ্ছে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যুদ্ধের অস্থিরতায় সুযোগে একশ্রেণীর মিশনারী ধর্মব্যবসায়ীরা বরিশাল, খুলনা, দক্ষিণাঞ্চল সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে সাহায্য সহযোগিতা করার নামে প্রতারণার ফাঁদ পেতে ধর্মান্তরিত করেছে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমরা এই করোনাকালীন সময়েও দেখতে পাচ্ছি।জীবন বাঁচাতে বা বেঁচে থাকতে অনেকেই ধর্মান্তরিত হওয়ার ফাঁদে আটকে গিয়ে পরিশেষে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য হচ্ছে। হিন্দু সম্প্রদায়কে ধর্মান্তরিত করার অপচেষ্টা করোনাকালীন সময়ে ভয়াবহরূপ নিয়েছে। কারণ বিষয়টি নিয়ে দেখার কেউ নেই। এ সময়ে বিভিন্ন ছলেবলে কৌশলের ফাঁদ পেতে যে পরিমাণে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে ; এমন ধর্মান্তরিত গত ১০ বছরেও সম্ভবত করা হয়নি। এর প্রধান কারণ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের অসচেতনতা এবং সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি মানবিক দৃষ্টিহীনতা।
দেশের অধিকাংশ হিন্দু সম্প্রদায়ের ছাত্রছাত্রীরা জেলা-বিভাগ-রাজধানীর শহর এলাকায় পড়াশোনা করে। তারা টিউশন করে, টিউশনির সামান্য টাকাতেই পড়াশোনা সহ থাকা-খাওয়ার ব্যয়ভার নির্বাহ করে। কিন্তু করোনাকালীন সময়ে সেই ছাত্রছাত্রীদের অধিকাংশই নিজ নিজ বাড়িতে অনেক দিন থেকেই অবস্থান করছে। দিনের পরে দিন বাড়িতে থাকায়, করোনাকালের অবস্থাকে বিবেচনায় না নিয়ে তাদের মা-বাবা সহ পরিবারের লোকজন অধিকাংশ সময়েই সামান্য ছুতাতেই অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করছে। এ কাছের আত্মীয়পরিজনের মানসিক নির্যাতন মেনে নিতে না পেরে মানসিক অবসাদে ভুগে অনেকেই আত্মহত্যা করছে। তাই করোনাকালীন সময়ে আত্মহত্যার প্রবণতা ভয়ংকরভাবে বাড়ছে। অনেকে আবার বিভিন্ন ইসলামি দাওয়াতি গ্রপের ফাঁদে পরে ধর্মান্তরিত হচ্ছে। হিন্দু সম্প্রদায়কে ধর্মান্তরিত করতে বিভিন্ন দাওয়াতি গ্রুপ আদাজল খেয়ে নেমেছে। তারা হিন্দু সম্প্রদায়কে ধর্মান্তরিত করতে তিনমাস, ছয়মাস, একবছরের দাওয়াতি কোর্স পর্যন্ত চালু করেছে। বিষয়টির সত্যতার জন্য বেশিদূর যেতে হবে না; শুধু ফেসবুকের নিউজফিডের দিকে একটু সচেতন দৃষ্টি দিলেই বিষয়টির দৃষ্টান্ত এবং সত্যতা হারে হারে টের পাওয়া যায়। কারো হয়তো চলার খরচ নেই, বাসাভাড়া দিতে পারছে না ; যেহেতু করোনার কারণে টিউশনি বা কোন খণ্ডকালীন কাজ বন্ধ। এ বাস্তবতায় কোন ধর্মান্তরিত গ্রুপ বলেছে, যদি তুমি ধর্মান্তরিত হয়ে যাও, তবে তোমাকে আমরা এক বছরের চলার খরচ দিব ইত্যাদি বিবিধ প্রকারের প্রলোভন। ঠিক এভাবে সকলের চোখের সামনেই অবাধে চলছে ধর্মান্তরকারীদের প্রতিনিয়ত ধর্মব্যবসা। এ ধর্মব্যবসায়ীদের হাতে আজ অনেক টাকা। আগে তাদের টার্গেট ছিল গরীব হিন্দু সম্প্রদায়, এখন সুনির্দিষ্ট টার্গেট হিন্দু সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল শিক্ষিত তরুণ-তরুণী। মানুষ করোনাকালে দেখেছে, মানুষের অন্তর্নিহিত আত্মকেন্দ্রিকতা।তাই শাস্ত্রে বহুপূর্বেই বলা হয়েছে, আপদকালীন সময়ে ধর্মানুমোদিত শৌচাচার কিছুই আপাতত চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। বিপদের সময়ে যে কোন উপায়ে আগে নিজেকে উদ্ধার করতে হবে। বিপদ চলে গেলে পরবর্তীতে স্বয়ং সুস্থ হয়ে ধর্মানুষ্ঠান সহ সকল কাজে যুক্ত হতে হবে।
দেশভঙ্গে,প্রবাসে বা ব্যাধিষু ব্যাসনেষ্বপি।
রক্ষেদেব স্বদেহাদি পশ্চার্দ্ধর্ম্মং সমাচরেৎ।।
যেন কেন চ ধর্ম্মেণ মৃদুনা দারুণেন চ।
উদ্ধরেদ্দীনমাত্মাং সমর্থো ধর্মমাচরেৎ।।
আপৎকালে তু সম্প্রাপ্তে শৌচাচারং ন চিন্তয়েৎ।
স্বয়ং সমুদ্ধরেৎ পশ্চাৎ স্বস্থো ধর্ম্মং সমাচরেৎ।।
(পরাশর সংহিতা:৭ অধ্যায়,৪১-৪৩)
"দেশভঙ্গে, প্রবাসে, বিপদের সময়, শরীর পীড়াক্রান্ত হলে, তখন যেকোন উপায়ে আগে নিজের দেহকে রক্ষা করতে হবে । এরপরে সুস্থ হয়ে সকল ধর্মাচরণ করবে। স্বয়ং বিপন্ন হলে, অল্প কিংবা কঠিন, যে কোন উপায়ে আগে নিজের দীনাত্মাকে উদ্ধার করবে, তৎপরে সমর্থ হয়ে ধর্মাচরণ করবে। বিপদের সময়ে ধর্মানুমোদিত শৌচাচার কিছুই চিন্তা করবে না। তখন যে কোন উপায়ে আপনাকে উদ্ধার করবে; বিপদ চলে গেলে স্বয়ং সুস্থ হয়ে ধর্মানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হবে।"
বর্তমানে করোনা মহামারীকালে আমাদের ১৯৭১ সালের মতই আপদধর্মকাল চলছে। করোনা থেকে বাঁচতে সবাইকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সবাইকে ঘরে থাকতে বলা হচ্ছে। ১৯৭১ সালে শত্রু যারা ছিল, আমরা তাদের চিনতাম, তাদের সম্পর্কে জানতাম, তাদের গতিবিধিও জানতাম এবং সাথে তাদের দোসর এদেশীয় দালালদেরও চিনতাম। কিন্তু বর্তমান করোনাযুদ্ধে আমরা শত্রুমিত্র গুলিয়ে ফেলেছি। আপনজনই শত্রু হয়ে যাচ্ছে। এক বিচিত্র অদৃশ্য শত্রু, যাকে দেখা যায় না। সারাক্ষণ এক অদৃশ্য শত্রুর ভয়।সুকুমার রায়ের 'ছায়াবাজি' কবিতার সেই বিচিত্র ছায়া খুঁজে বেড়ানো ব্যক্তিটির মত অবস্থা হয়েছে আমাদের। অদৃশ্য ছায়াশত্রুর সাথে যুদ্ধ করে আমাদের সর্বাঙ্গে ব্যথা হয়ে যাচ্ছে।কবিতাটি হাসির হলেও, একটি স্থির হয়ে ভাবলে উপলব্ধি করা যায় এর তাৎপর্য নিগূঢ়।
"আজগুবি নয়, আজগুবি নয়, সত্যিকারের কথা—
ছায়ার সাথে কুস্তি করে গাত্র হল ব্যথা!"
করোনা মহামারীর পরিস্থিতিতে সবাইকে সর্বাগ্রে যে কোন ভাবে, নিজেকে সুরক্ষিত রেখে পরিবার এবং পরিজনকে সুরক্ষিত রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন। কারণ, বর্তমানে করোনা নামক এক ভয়াবহ অভিশপ্ত কাল অতিবাহিত করছি।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।