আত্মতত্ত্বের পথটি অত্যন্ত কঠিন। এ পথের সবাই সন্ধান পায় না। আবার সন্ধান পেলেও সেই পথে চলতে পারে না। এর জন্যে জন্মজন্মান্তরের সুকৃতি প্রয়োজন। যিনি নিজেকে জেনেছেন, সেই আত্মতত্ত্বজ্ঞ ব্রহ্মজ্ঞ আচার্যের কাছে গিয়ে মুক্তির সম্যক জ্ঞান লাভ করতে বেদে বলা হয়েছে। বেদ অনুসারে এ অধ্যাত্মবোধের পথটি অত্যন্ত কঠিন। এ সুকঠিন পথে প্রথমে অধিকারী হতে হয়। মনে চাইলাম, সন্ন্যাস নিলাম এবং মুক্ত হলাম। বিষয়টি এমন সরলরৈখিক নয়। অত্যন্ত কঠিন।তাই ক্ষুরের তীক্ষ্ণ অগ্রভাগ যেমন দুরতিক্রমনীয়, এর উপর দিয়ে সহজে হেটে যাওয়া যায় না, পা কেটে রক্তপাত হয়। তেমনি আত্মবোধ লাভের পথও অত্যন্ত ক্ষুরধার এবং দুর্গম।
উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্ নিবোধত।
ক্ষুরস্যধারা নিশিতা দুরত্যয়া
দুর্গং পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি।।
(কঠ উপনিষদ: ১.৩.১৪)
"তোমরা ওঠ, মোহ নিদ্রা ত্যাগ করে জাগ্রত হও,শ্রেষ্ঠ আচার্যের নিকট গমন করে আত্মতত্বের সম্যক জ্ঞান লাভ কর।বিবেকবান ব্যক্তিগণ বলেন, ক্ষুরের তীক্ষ্ণ অগ্রভাগ যেমন দুরতিক্রমনীয়, আত্মজ্ঞান লাভের পথও সেইরূপ ক্ষুরধারের মত দুর্গম।"
শ্রীশঙ্করাচার্য তাঁর বেদান্তের বিখ্যাত প্রকরণ গ্রন্থ বিবেকচূড়ামণি' গ্রন্থের শুরুতেই বলেছেন, জগতে মনু্ষ্যদেহে জন্ম লাভ করে মনুষ্যত্ব অর্জন সুদুর্লভ। শাস্ত্রে বলা হয়েছে, চুরাশি লক্ষ জন্মের পরে একটি জীব সুকৃতির পরে মনুষ্যজন্ম লাভ করে। কিন্তু এরপরেও আমরা এই মনুষ্য জন্মকে কাজে লাগাতে পারি না। আমাদের উচিত মনুষ্যত্ব অর্জন করে মনুষ্যোত্তর এবং মনুষ্যতম হওয়া। কিন্তু পক্ষান্তরে দেখা যায়, আমরা মনুষ্যোত্তর, মনুষ্যতম না হয়ে বিপরীতে অন্ধকার পথে ধাবিত হচ্ছি। আমরা মনুষ্যত্ব অর্জন না করে পশুত্ব অর্জনের দিকে ধাবিত হচ্ছি।পশুত্বে পৌঁছে সেই পশুত্বেও আমরা সীমাবদ্ধ থাকছি না। আমরা আরও নিচে অন্ধকারে তলিয়ে পশুত্ব থেকে পশুত্তম পথে চলে যাচ্ছি। এই কারণেই মানুষকে উদ্দেশ্য করে মধ্যযুগের খ্যাতিমান সাধক কবি শ্রীরামপ্রসাদ সেন দুঃখ করে বলেছেন:
"মন রে কৃষি কাজ জান না।
এমন মানব-জমিন রইলো পতিত,
আবাদ করলে ফলতো সোনা।।
কালীর নামে দেও রে বেড়া,
ফসলে তছরুপ হবে না।
সে যে মুক্তকেশীর (মন রে আমার) শক্ত বেড়া,
তার কাছেতে যম ঘেঁসে না।।"
রামপ্রসাদ সেন মনুষ্য জন্মকে সার্থক করতে মানবজমিনের কৃষিক্ষেত্রে ভক্তির বীজ রোপন করতে বলেছেন। অর্থাৎ হেলায় হেলায় মনুষ্য জন্মকে যেন আমরা কাটিয়ে না দেই। তবে বিষয়টি এমন নয় যে জীব মনুষ্য জন্মতেই শুধু মুক্তি লাভ করবে। মনুষ্য সহ প্রাণীকুলের সকল জীবই যথাযথ কর্মানুযায়ী মুক্তি লাভ করবে। কিন্তু শাস্ত্রে মনুষ্যদেহের কথা বারবার বলা হয়েছে, এই কারণে যে- মনুষ্যদেহে মুক্তিলাভ করা সহজ হয়।মুক্তির ক্ষেত্রে মনুষ্য জন্মের সাথে সাথে আরেকটি বিষয় হলো, সংসারবন্ধন থেকে তীব্র মুক্তির ইচ্ছা। নিজের মধ্যে এই সুতীব্র মুক্তির ইচ্ছা না জাগলে জীব মুক্তিলাভের দুর্গম পথে অগ্রসর হতে পারে না। ফলশ্রুতিতে মুক্তিলাভও করতে পারে না। তাই মুক্তি লাভের জন্যে সর্বাগ্রে প্রয়োজন শয়নে, স্বপনে, জাগরণে সর্বদা মুক্তির ইচ্ছা।মনু্ষ্য-জন্ম লাভ, সংসারবন্ধন থেকে মুক্তির ইচ্ছা এ দুটি বিষয়ের সাথে আরেকটি বিষয় অত্যন্ত আবশ্যিক। সেই আবশ্যিক বিষয়টি হলো মহাপুরুষের সান্নিধ্য। এই সিদ্ধ মহাপুরুষদেরই পথ অনুসরণ করে, তাদের ভজনা করে লালন সাঁই সোনার মানুষ হতে বলেছেন।
"মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।
মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই মূল হারাবি।।
এই মানুষে মানুষ গাথা
গাছে যেমন আলকলতা।"
ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষের সঙ্গ মানুষের জীবনে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ কারণেই বলা হয়, সৎসঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎসঙ্গে সর্বনাশ।চন্দনের বনে থাকতে থাকতে বনের প্রায় সকল গাছ থেকেই চন্দনের সৌরভ পাওয়া যায়। একটি অপরিচিত বুনো গাছও চন্দনের সৌরভ পাওয়া যায় শুধুমাত্র চন্দন গাছের সান্নিধ্যের কারণে। সৎসঙ্গ ঠিক তেমনি, এই সৎসঙ্গে থেকে অনেকে অসাধু চোরও সাধু হয়ে যায়। আবার পক্ষান্তরে অসৎসংসরর্গে থেকে অনেক সাধুও অসাধু হয়ে যায়। অসৎসঙ্গে থেকে সর্বদা সৎ থাকবে- এমন যদি কেউ চিন্তা করে তবে সে বোকার স্বর্গে বাস করে। তাই এ তিনটি বিষয়ই জগতে দুর্লভ। কেউ যদি দুর্লভ মনুষ্যজন্ম ও বেদান্তে পারদর্শিতা লাভ করেও যে নিজের মুক্তির জন্যে যত্ন করে না, সেই আত্মঘাতী পুরুষ মূঢ়। সে নিজেকেই নিজে সজ্ঞানে বিনষ্ট করে।
দুর্লভং ত্রয়মেবৈতদ্দেবানুগ্রহহেতুকম্ ।
মনুষ্যত্বং মুমুক্ষুত্বং মহাপুরুষসংশ্রয়ঃ ॥
লব্ধ্বা কথঞ্চিন্নরজন্ম দুর্লভং
তত্রাপি পুংস্ত্বং শ্রুতিপারদর্শনম্ ।
যস্ত্বাত্মমুক্তৌ ন য়তেত মূঢধীঃ
স হ্যাত্মহা স্বং বিনিহন্ত্যসদ্গ্রহাত্ ॥
ইতঃ কো ন্বস্তি মূঢাত্মা যস্তু স্বার্থে প্রমাদ্যতি ।
দুর্লভং মানুষং দেহং প্রাপ্য তত্রাপি পৌরুষম্ ॥
(বিবেকচূড়ামণি: ৩-৫)
"মনু্ষ্য-জন্ম লাভ করে মনুষ্যত্ব, সংসারবন্ধন থেকে মুক্তির ইচ্ছা ও ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের সঙ্গ, এই তিনটি এ জগতে দুর্লভ। ঈশ্বরের বিশেষ অনুগ্রহ হলে তবে এগুলি পাওয়া যায়। কোনও রকমে দুর্লভ নরজন্ম আর সেই জন্মে পুরুষশরীর ও বেদান্তবিচারে পারদর্শিতা লাভ করেও যে মূঢ়বুদ্ধির মানুষ নিজের মুক্তির জন্যে যত্ন করে না, সেই আত্মঘাতী পুরুষ অসৎ-বস্তু গ্রহণের ফলে নিজেকেই বিনষ্ট করে।দুর্লভ মনুষ্যদেহ, তার ওপর আবার পুরুষশরীর পেয়েও যে নিজের স্বার্থ বুঝতে ভুল করে বসে তার থেকে বেশী নির্বোধ আর কে আছে?"
অসৎসঙ্গে থেকে কেউ সৎ থাকবে, এই আশা যদি কেউ পোষণ করে, তবে এটা তাদের আশা নয়; শুধুই দুরাশা। আমরা পুরাণের সৌভরি মুনির উপাখ্যান সকলেই জানি। শুধুমাত্র সঙ্গদোষেই সৌভরি মুনির সকল তপস্যা শেষ হতে বসেছিলো।সৌভরি মুনির সাধনা ছিলো পরম অদ্ভুত। তিনি জলের মধ্যে বসে ধ্যান করতেন।বাইরের কোলাহল থেকে মুক্ত জলের অভ্যন্তরে তপস্যা করতেন।যা কোন সাধারণ মানুষের কর্ম নয়।দীর্ঘকাল নিরবচ্ছিন্ন তপস্যা করতে করতে তিনি মুক্তির প্রায় দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেলেন। জলের মধ্যে বাস করে যোগ সাধনার ফলে, তাঁর গায়ে পুরু শ্যাওলার আবরণ তৈরি হয়। বহুকাল পৃথিবীর মানুষ, পশুপাখি, গাছপালা প্রভৃতির সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্কই নেই। এইভাবে দীর্ঘ বারো বছর বসে তিনি তপস্যা করছেন জলের মধ্যে। হঠাৎ সৌভরি মুনির দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো একটি বৃহৎ মাছ এবং তার পরিবারের প্রতি। তিনি দেখলেন সস্ত্রীক বৃহৎ মাছটি অসংখ্য সন্তানসন্ততি নিয়ে সুখে পরিভ্রমণ করে বেড়াচ্ছে। সৌভরি মুনি সস্ত্রীক মাছটির এমন সুখের সংসার দেখে, আকস্মিক সিদ্ধান্ত নিলেন তিনিও মাছটির মত সংসারি হবেন।এই ভেবে তিনি তপস্যা পরিত্যাগ করে জল থেকে উঠে পড়লেন। এতদিন জলের মধ্যে বাস করায় তাঁর মাথায় বিশাল জটা হয়ে গেছে, বৃহৎ গোঁফ মুখকে ঢেকে ফেলেছে, মুখের দাড়ি বৃহৎ আকার ধারণ করে দেহের বিশাল অংশকে ঢেকে ফেলেছে, গায়ে জলের শ্যাওলা জমেছে ইত্যাদি। কিন্তু দেহের দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই সৌভরি মুনির।তিনি রাজা মান্ধাতার কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন।সৌভরি মুনিকে দেখে রাজা অত্যন্ত প্রসন্ন হলেন। তিনি আসন, পাদ্য-অর্ঘ্যে মুনিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় সমাদর করলেন। রাজা মান্ধাতার জিজ্ঞাসায় সৌভরি মুনি কঠিন তপস্যা পরিত্যাগ করে রাজার কাছে তাঁর আগমনের কারণ বর্ণনা করলেন। মুনি বিবাহ করে সংসার করার জন্যে রাজার একটি কন্যাকে প্রার্থনা করলেন। মুনি যোগবলে দৈবীদেহ ধারণ করায় রাজার সকল কন্যারাই তাঁকে বিয়ে করতে চাইলো। মুনিও রাজার সকল কন্যাকে বিয়ে করে সুখে সংসার করতে লাগলেন। পরবর্তীতে একদিন সৌভরি মুনির হৃদয়ে দিব্যজ্ঞান জন্মায়। তিনি তখন বুঝতে পারলেন যে তিনি সাধনা থেকে বিচ্যুত হয়ে সংসারের মোহে আবদ্ধ হয়ে আছেন।তখন সৌভরি মুনি আক্ষেপ করে বলতে লাগলেন–"হায়, এ আমি কি করলাম, ভয়ানক মোহে আমি মগ্ন হয়েছি"। তিনি বুঝতে পারলেন সামান্য একটি মাছের সঙ্গ তাঁর সাধন জগতের কতটা ক্ষতি করেছে। তিনি বুঝতে পারলেন, কুসঙ্গ দোষেতে এভাবেই মনুষ্য অধঃপতনে নিপতিত হয়। তাঁর বোধদয় হলো, তিনি আবার পুনরায় সেই তপস্যায় মননিবেশ করলেন। কিন্তু এর মধ্যে সঙ্গদোষে তাঁর সাধনার পথে যা ক্ষতি হওয়ার, তা হয়েই গেলো। তাঁকে আবার নতুনকরে পুনরায় তপস্যা শুরু করতে হলো। এ কারণেই বলা হয়, সঙ্গদোষে জলে ভেসে থাকা সোলাও যেমন জলে ডুবে যায়; তেমনি আবার লোহাও জলে ভেসে থাকতে পারে। লোহা এবং সোলার ডুবে যাওয়া বা ভেসে থাকার বিষয়টি হয়ত অবিশ্বাস্য। কিন্তু এই অবিশ্বাস্য বিষটির অন্তর্নিহিত শিক্ষাটি শাশ্বত। সেই শাশ্বত শিক্ষাটি হলো, সঙ্গদোষে এবং সঙ্গগুণে মানুষ ভালো-মন্দে পরিবর্তিত হয়। একারণেই
বৈষ্ণবশাস্ত্রে বারংবার সাধুসঙ্গের প্রতি জোর দেয়া হয়েছে।
সাধুসঙ্গ সাধুসঙ্গ সর্বশাস্ত্রে কয়।
লবমাত্র সাধুসঙ্গে সর্বসিদ্ধি হয়।।
(চৈতন্যচরিতামৃত: মধ্য,২২.৫৪)
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।