বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত প্রতিবাদী কাব্যগ্রন্থ 'ছাড়পত্র'। এ ছাড়পত্র কাব্যগ্রন্থের 'বোধন' কবিতায় কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য সামাজিকভাবে অন্যায়কারীদের প্রতি এক সুতীব্র প্রতিশোধস্পৃহা ব্যক্ত করেছেন। ক্ষমা মহত্তম একটি গুণ। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে ক্ষমা কাপুরুষোচিত ভীরুতার লক্ষণে পর্যবসিত হয়। সর্বক্ষেত্রে ক্ষমা প্রযোজ্য নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্ষমা পাপের পর্যায়ে পরে। ক্ষমা করতে হবে তাকেই, যে ক্ষমার মর্ম বুঝে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে। কোন অত্যাচারী, প্রতারক, দখলদার, নারীদের লাঞ্ছনাকারী অপরাধীদের ক্ষমা নয়। অপরাধীদের ক্ষমা হলো মহাপাপ। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বলেছেন, নিজের প্রাণপ্রিয় প্রিয়াকে যারা কেড়ে নেয়, অসহায় মানুষের বসতবাড়ি ধ্বংস করে তাদের এই অপকর্মের কথা আমৃত্যু মনে রাখতে হবে।কখনই ভুলে যাওয়া যাবে না। সুতীব্র প্রতিশোধস্পৃহা নিয়ে সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হবে আমৃত্যু। যখন সুযোগ আসবে, তখন আদিম হিংস্র রূপ ধারণ করে স্বজনহারানো ব্যাথার চিতায় আগুনে তাদের নিক্ষিপ্ত করতে হবে। তবেই সেই খুনি ও নৃশংস অপরাধীর দল এবং তাদের পরিবার উপলব্ধি করতে পারবে স্বজন হারানোর ব্যাথার যাতনা।
"তোদের প্রাসাদে জমা হল কত মৃত মানুষের হাড়—
হিসাব কি দিবি তার?
প্রিয়াকে আমার কেড়েছিস তোরা,
ভেঙেছিস ঘরবাড়ি,
সে কথা কি আমি জীবনে মরণে
কখনো ভুলতে পারি?
আদিম হিংস্র মানবিকতার যদি আমি কেউ হই
স্বজনহারানো শ্মশানে তোদের
চিতা আমি তুলবই।"
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ১৯২৬ সালের ১৫ই আগস্ট তার মাতামহের বাড়ি কলকাতার কালীঘাটের ৪৩, মহিম হালদার স্ট্রীটের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম নিবারণ ভট্টাচার্য এবং মায়ের নাম সুনীতি দেবী। গোপালগঞ্জ যাওয়ার থেকে এক নিম্নবিত্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতৃপুরুষের বাড়ি হলো, গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার অন্তর্গত ঊনশিয়া গ্রামে।এ গ্রামটি অত্যন্ত মাহাত্ম্যপূর্ণ গ্রাম। এই গ্রামের এই ভট্টাচার্য বংশে জন্মগ্রহণ করেছেন বাঙালির শঙ্করাচার্য বলে খ্যাত মধুসূদন সরস্বতী। বাঙালিদের মধ্যে তিনিই প্রথম শ্রীমদ্ভগবদগীতার টীকা এবং ভাষ্য রচনা করেন। তাই তাঁকে বাঙালির শঙ্করাচার্য বলে অবিহিত করা হয়। সম্পূর্ণ মহাভারতের অনুবাদকার হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশের জন্মও ঊনশিয়া গ্রামের ভট্টাচার্য বংশে। অসংখ্য কৃতি ব্যক্তির জন্ম হয়েছে ঊনশিয়া গ্রামে।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তেতাল্লিশের মম্বন্তর, ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রভৃতির তাঁকে শিশু বয়সেই বিক্ষুব্ধ করে তোলে। তিনি এই সকল অসামান্য শোষণের বিরুদ্ধে আগুন ঝরানো লেখা লিখতে থাকেন। কিশোর বয়সেই তিনি শুধু কবিতা নয় গান, গল্প, নাটক এবং প্রবন্ধ লেখেন। তাঁর কবিতার মূর্তিমান হয়ে ছিলো গণমানুষের দুঃখ বেদনা কথা। ছিলো অসাম্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধের কথা। কিন্তু সময় পাননি কবি। বড় অবেলায় চলে গেলেন। তিনি চেয়েছিলেন এ বিশ্ব থেকে সকল জঞ্জাল বিদূরিত করে বাসযোগ্য করতে। একটি নতুন শিশু ভূমিষ্ঠ হয়ে যেন একটু শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতে পারে। তাঁর 'ছাড়পত্র' নবজাতকের প্রতি এ অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়েছে:
"এসেছে নতুন শিশু,তাকে ছেড়ে
দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর
ধ্বংসস্তূপ-পিঠে।
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে
আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে
যাব আমি—
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ়
অঙ্গীকার।"
একদিকে নিম্নবিত্ত পরিবারের অর্থনৈতিক দৈন্যতা। অন্যদিকে মানুষের জন্যে অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে কিশোর বয়সেই তাঁর বিভিন্ন রোগব্যাধি বাসা বাঁধে। প্রথমে ম্যালেরিয়া এবং পরে দুরারোগ্য ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৪৭ সালের ১৩ই মে মাত্র ২১ বছর বয়সে কলিকাতার ১১৯ লাউডট স্ট্রিটের রেড এড কিওর হোমে মৃত্যুবরণ করেন। সুকান্ত ভট্টাচার্য মাত্র ২১ বছরের স্বল্প সময়ের মধ্যে বাংলা সাহিত্যের জগতে একটি প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ হয়ে আছেন। আজও আমরা বিপ্লবে, বিদ্রোহে সহ সকল অসাম্যে তাঁকে স্মরণ করি। প্রায় সাতবছর মাত্র তিনি সাহিত্য সাধনা করেছেন। এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি বাংলা সাহিত্যের আকাশে তাঁর স্থান করে নিয়েছেন। তিনি যদি আরও দীর্ঘ সময় বেঁচে তাহলে তাঁর সৃষ্টি যে কোন পর্যায়ে যেত, তা কল্পনাতীত। তাঁর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টিকর্ম হলো: ছাড়পত্র (১৯৪৭), পূর্বাভাস (১৯৫০), মিঠেকড়া (১৯৫১), অভিযান (১৯৫৩), ঘুম নেই (১৯৫৪), হরতাল (১৯৬২), গীতিগুচ্ছ (১৯৬৫) প্রভৃতি। এ গণমানুষমুখি লেখার কারণে, তিনি হয়ত নোবেল পুরষ্কার পেতে পারতেন। তাঁর সৃষ্টিকর্ম পরিসরের স্বল্প হলেও, ব্যাপ্তির দিক থেকে আকাশের মত দিগন্তবিস্তৃত। তাঁর রচনায় রয়েছে সুদূরপ্রসারী এক চিরআধুনিক ভাব। যা সকল কালের জন্যে সকল যুগের জন্যে প্রযোজ্য।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।