জীবন মানেই চলা, থেমে যাওয়ার নামই মৃত্যু। তাই মানুষকে আমৃত্যু ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছাতেই হোক চলতেই হয়।আমরা চলতে চলতে হয়ত বিভিন্ন স্টেশনে সাময়িক স্বল্প সময়ের জন্যে বিরতি দেই,পরক্ষণেই আবার চলতে হয়। ঢাকা থেকে ট্রেনে চট্টগ্রাম যেতে হলে সম্পূর্ণ সময়টা ট্রেনে বসেই থাকতে হবে। ট্রেন থেকে নেমে গেলে, আর গন্তব্যে যাওয়া হবে না।মানবজীবনের এ আমৃত্যু প্রবাহমানতা নিয়ে অসংখ্য বাউল কবিরা গান তৈরি করেছেন।দেহের এ আমৃত্যু নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহমানতাকে কেউ ঘড়ির সাথে, কেউ গাড়ির সাথে, কেউ আবার মাটির প্রদীপের সাথে তুলনা করেছেন।এর মধ্যে আব্দুর রহমান বয়াতির, পরমায়ুকে চাবির সাথে তুলনা করে এবং দেহকে ঘড়ির সাথে তুলনা করে অত্যন্ত সুন্দর একটি গান আছে। দেহঘড়িটি আমৃত্যু চলতেই থাকে, এর থেমে যাওয়াকেই মৃত্যু বলে।
"একটা চাবি মাইরা দিলা ছাইড়া,
জনম ধরে চলিতে আছে,
মন আমার দেহ ঘড়ি সন্ধান করি,
কোন মিস্ত্ররী বানাইয়াছে।
মাটির একটা কেস বানাইয়া
মেশিন দিলো তার ভিতর,
ওরে, রং বেরংয়ের বার্নিশ করা
দেখতে ঘড়ি কি সুন্দর।"
ট্রেনে করে যদি আমরা গন্তব্যে যেতে চাই, তবে সম্পূর্ণ সময়টা আমাদের ট্রেনেই বসে থাকতে হবে।আধ্যাত্মিক জগতে যদি অগ্রসর হতে চাই, তাহলে মোহনিদ্রা ত্যাগ করে আমাদের জাগ্রত হয়ে আমৃত্যু সচেষ্ট হতে হবে। থেমে গেলে চলবে না। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য -এ ছয়টিকে দেহের ষড়রিপু বলে। আমাদের মনুষ্যজীবনে ষড়রিপু একটি ফাঁদের মত, তাই এ ফাঁদে না পড়ে মুক্তির পথে অগ্রসর হতে শাস্ত্রের বিভিন্ন স্থানেই বলা হয়েছে।কথাগুলো যেমন আধ্যাত্মিক জীবনের জন্যে প্রযোজ্য, ঠিক তেমনি জাগতিক জীবনেও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ঋগ্বেদীয় ঐতরেয় ব্রাহ্মণে এ কারণেই বারবার সকল বাঁধা অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে বলা হয়েছে। যে শুয়ে থাকে, তার ভাগ্যও শুয়ে থাকে।"জীবনে অদৃষ্ট যেমন আছে, তেমনি অদৃষ্টই সকল কিছুর নির্ণায়ক নয়। ঋগ্বেদের ঐতরেয় ব্রাহ্মণে ঋষি শুনঃশেপের কাহিনীতে মানব সভ্যতার নিত্য সচলতার, নিত্য প্রাগ্রসরতার একটি শাশ্বত মহামন্ত্র বলা হয়েছে। সেই প্রাগ্রসরতার মহামন্ত্র হলো, “চরৈবেতি চরৈবেতি”। অর্থাৎ এগিয়ে যাও, এগিয়ে যাও। রোহিতকে উদ্দেশ্য করে, “চরৈবেতি চরৈবেতি” বা "এগিয়ে যাও, এগিয়ে যাও" -এ নির্দেশনাটি বারবার দেয়া হয়েছে।
আস্তে ভগ আসীনস্যোর্ধ্বস্তিষ্ঠতি তিষ্ঠতঃ।
শেতে নিপদ্যমানস্য চরাতি চরতো ভগশ্চরৈবেতি।।
(ঋগ্বেদীয় ঐতরেয় ব্রাহ্মণ: ৩৩.৩)
"যে বসে থাকে, তার ভাগ্যও বসে থাকে।যে দাঁড়ায়, তার ভাগ্যও উঠে দাঁড়ায়।যে শুয়ে থাকে,তার ভাগ্যও শুয়ে থাকে।আর যে এগিয়ে যায়, তার ভাগ্যও এগিয়ে যায়। তাই এগিয়ে যাও, এগিয়ে যাও।"
কর্মহীন অদৃষ্টের আশায় বসে থাকাটা অশাস্ত্রীয়। সাধ্যমত নিষ্কাম কর্ম আমাদের প্রতিনিয়ত করে যেতে হবে। এ নিষ্কাম কর্মে মানুষের ভাগ্যের গতিপথ পরিবর্তিত হয়। তাই পূর্ববর্তী জন্মজন্মান্তরের প্রারব্ধ কর্ম, এ জন্মে নিষ্কাম কর্ম এবং দৈবানুগ্রহ ; মুখ্যত এ তিনটি বিষয়ের অধিকারী ব্যক্তিই মুক্তির পথে অগ্রসর হয়ে মুক্ত হয়।জগতে চারিপাশে আমরা যা প্রতিনিয়ত দেখি, তার সকলই সত্যি নয়, আবার যা যা দেখতে পাইনা তার সকলই মিথ্যা নয়। এ চলার পথে পাশে হয়ত কেউ নাও থাকতে পারে। কেউ সাহায্য সহযোগিতা নাই বা করতে পারে; কিন্তু এরপরেও আমাদের সাধ্যমত এগিয়ে যেতে হবে। নির্ভীক চিত্তে এগিয়ে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে, পথে নামলে পথই পথিককে একদিন না একদিন গন্তব্যে নিয়ে যায়। দুর্গম পথের ভয়ে যদি কেউ পথে না নামে তবে সে গন্তব্যে কোনদিনই পৌছতে পারে না। জগতে মানুষের অসাধ্য বলে আসলে কিছুই নেই। দৃঢ মনবল থাকলে সকল অসাধ্য সাধন করা যায়। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি সুবিখ্যাত সংগীত স্মর্তব্য। তিনি বলেছেন, কোন কল্যাণকর কর্মে সবাইকে আহ্বান করতে হবে। কিন্তু কেউ যদি সেই আহ্বানে সাড়া না দেয় তবে একাই পথে এগিয়ে যেতে হবে।
"যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।
একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো রে ॥
যদি গহন পথে যাবার কালে কেউ ফিরে না চায়-
তবে পথের কাঁটা
ও তুই রক্তমাখা চরণতলে একলা দলো রে ॥
যদি আলো না ধরে, ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি ঝড়-বাদলে আঁধার রাতে দুয়ার দেয় ঘরে--
তবে বজ্রানলে
আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে একলা জ্বলো রে।।"
আমাদের সকলকেই নির্ভীকচিত্তে যেমন এগিয়ে যেতে হবে। তেমনি যার যার নির্দিষ্ট দায়িত্ব কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করতে হবে। অলস সময় যাপন করা যাবে না। মনে রাখতে হবে, জগতে আমার অবস্থান স্বল্প সময়ের জন্য। অনেকে তাই এ জগতকে অতিথিশালা বলে। অতিথির মত স্বল্প সময়ের জন্যে আমরা জগতে আসি। আবার কিছু সময় অতিবাহিত হলে চলে যাই। কিন্তু আমরা এ বিষয়টি মাথায় রাখি না। তাই তো অসংখ্য হিংসা বিদ্বেষের জালে আমরা প্রতিনিয়ত জড়িয়ে যাচ্ছে। কখনো স্বেচ্ছায় অথবা কখনো অনিচ্ছায় জড়িয়ে যাচ্ছি। তাই আমাদের সংসারের সকল হিংসা বিদ্বেষ পরিত্যাগ করে উচিত, নিজের এবং জগতের কল্যাণের জন্য নিষ্কামভাবে কর্ম করে যাওয়া। আমি চাই বা না চাই এ কর্ম আমাকে করে যেতেই হবে। তাই কর্ম করেই এ জগতকে জয় করে, জগতের কল্যাণ করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। এ জগত এবং প্রাণীকুলের কাছে ভগবানের কোন চাওয়া পাওয়া নেই। এ সমগ্র জগত তাঁরই অনুপম সৃষ্টি। এরপরে তিনিও লোকশিক্ষায় কর্ম করেন। বিষয়টি শ্রীমদ্ভগবদগীতায় অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে ভগবান বলেছেন। এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ভগবানের কোন কর্তব্য কর্ম নেই, তিনি দ্রষ্টাপুরুষ। ভগবানের কোন চাওয়া পাওয়া বা আকাঙ্ক্ষা নেই। এরপরেও ভগবান জগত রক্ষার্থে সর্বদা কর্মে ব্যাপৃত থাকেন। তিনি যদি কর্ম না করেন, জগত স্পন্দনহীন এবং নিষ্ক্রিয় হয়ে সুপ্তাবস্থায় চলে যাবে। ভগবান যদি কর্ম ত্যাগ করেন জগতের সৃষ্টি বিনষ্ট হবে। তাই ভগবান জগতের স্রষ্টা হয়েও তাঁর সৃষ্টিকে রক্ষার্থে কর্ম করেন। ভগবানের নিরবচ্ছিন্নভাবে কর্ম করার আরেকটি কারণ হলো, মানুষ সর্বভাবে ভগবানের কর্ম এবং পথকেই অনুসরণ করে। তাই জগতের স্রষ্টা ভগবান যদি কর্ম না করেন, তবে মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে কর্মবিমুখ কর্মহীন হয়ে যাবে।ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি এবং তাঁদের আচরণকেই সর্বদা অনুসরণ করতে।
যদ্ যদাচরতি শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবেতরো জনঃ৷
স যৎপ্রমাণং কুরুতে লোকস্তদনুবর্ততে৷৷
ন মে পার্থাস্তি কর্তব্যং ত্রিষু লোকেষু কিঞ্চন।
নানবাপ্তমবাপ্তব্যং বর্ত এব চ কর্মণি৷৷
যদি হ্যহং ন বর্তেয়ং জাতু কর্মণ্যতন্দ্রিতঃ।
মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পাৰ্থ সৰ্বশঃ৷৷
(শ্রীমদ্ভগবদগীতা:৩.২১-২৩)
""শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা যে ভাবে আচরণ করেন, সাধারণ মানুষেরাও তার অনুকরণ করেন। তিনি যা প্রমাণ বলে স্বীকার করেন অন্য ব্যক্তিরা তারই অনুসরণ করে চলে।
হে পার্থ! ত্রিলোকে আমার কোন কর্তব্য কর্ম নেই এবং প্রাপ্তব্য কোনো বস্তু অপ্রাপ্ত নেই; তথাপি আমি সর্বদা কর্মে ব্যাপৃত থাকি, কর্মত্যাগ করি না।আমি যদি সাবধান হয়ে কর্মে ব্যাপৃত না থাকি, তবে জগতের ক্ষতি হবে। কারণ মানুষ সর্বভাবে আমার পথেরই অনুসরণ করে।"
তাই বলা হয়, যে শুয়ে থাকে,তার ভাগ্যও শুয়ে থাকে। সে আর জাগতে পারে না, দাঁড়াতে পারে না। কিন্তু পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি নির্ভীক চিত্তে এগিয়ে যায়, তার ভাগ্যও ঝড়েরবেগে এগিয়ে যায়। জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত স্থবিরতার মত বিনাশকারী আর নেই। কর্মহীন স্থবিরতা মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। এ কারণেই দেখা যার চাকুরিজীবীরা বিশেষ করে সরকারি চাকুরিজীবীরা অবসর গ্রহণের সাথে সাথে বিমর্ষ স্থবির হয়ে যেতে থাকে। তখন হঠাৎ করেই বিবিধ রোগব্যাধির তাদের শরীরে দেখা যায়। একটি রুটিন অনুসারে সক্রিয় প্রাণচাঞ্চল্যময় জীবন থেকে, হঠাৎই গৃহবন্দী স্থবির জীবন অনেকেই মানিয়ে নিতে পারে না। তারা মানসিক অবসাদের সাথে সাথে তাদের দেহও ক্ষয়িষ্ণু হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে চলে আসে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'স্ফুলিঙ্গ' কাব্যগ্রন্থে বলেছেন:
"আপনারে দীপ করি জ্বালো,
আপনার যাত্রাপথে
আপনিই দিতে হবে আলো।"
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।