পরমেশ্বর এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সকল প্রাণীকুলের জন্যে মধুময় করে তৈরি করেছেন। ঋগ্বেদে বলা হয়েছে, সত্যময় পরমেশ্বরই ইচ্ছাতেই বায়ু প্রবাহ সচল হয়ে মধুময় হচ্ছে। অর্থাৎ বিশুদ্ধ বাতাসে নিশ্বাস নিয়ে জীবজগত বেঁচে আছে। দিকেদিকে নদীসমূহ প্রবাহিত হয়ে মানব সভ্যতাকে সচল করছে। জলের অপর নাম জীবন। বিশুদ্ধ জলে সেই জীবন যখন প্রাণচাঞ্চল্যময় হয়, তখনই জলের আধার নদী এবং সমুদ্রও মধুময় হয়ে উঠে। ধানগাছ, গমগাছ, কলাগাছ সহ যে সকল উদ্ভিদ একবার ফল দিয়েই মরে যায় তাদের ওষধী গাছ বলে। এই ওষধি গাছের শস্য এবং ফলমূল খেয়ে মানুষ বেঁচে থাকে। তাই বৈদিক ঋষিরা প্রার্থনা করেছেন, এই বেঁচে থাকার আধার ওষধী সমূহ যেন মধুময় হয়। অর্থাৎ এই ধান, গম ইত্যাদি শষ্য যেন বিষাক্ত হয়ে না যায়। কিন্তু বর্তমানে প্রচুর বিষাক্ত কীটনাশকসহ কৃত্রিম বিভিন্ন চাষাবাদের ফলে আমরা নিজেরাই নিজেদের বেঁচে থাকার অবলম্বনদের প্রতিনিয়ত বিষাক্ত করে ফেলছি। সেই বিষাক্ত খাদ্যশস্য আমরা জ্ঞাত অথবা অজ্ঞাতসারে প্রতিনিয়ত বোধহীন ভাবে খেয়ে চলছি। এ সকলই হচ্ছে আধুনিকতার নামে, নগরায়নের নামে শিল্পায়নের নামে।কিন্তু এভাবে প্রকৃতি পরিবেশকে বিষাক্ত করে চলাটা মানব সভ্যতার জন্যে ভয়াবহ ক্ষতিকর।
তাই আমাদের উচিত পরমেশ্বরের সৃষ্ট এই মধুময় প্রকৃতিতে, আবার পূর্বের মত মধুময় করে তোলার। এর জন্যে প্রয়োজন প্রকৃতির প্রতি সচেতনতা এবং সহমর্মিতা। বিভিন্ন শহরে বাণিজ্যিক কল কারখানা থেকে কার্বনডাইঅক্সাইড সহ এত বেশি বিষাক্ত গ্যাস প্রতিনিয়ত নিঃসরণ হচ্ছে এতে আমরা বিশুদ্ধ বাতাস এবং বিশুদ্ধ পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। অথচ বৈদিক ঋষিদের প্রার্থনা ছিলো, একটি বিশুদ্ধ মধুময় সকাল থেকে একটি বিশুদ্ধ মধুময় আমাদের রাত্রির। কিন্তু প্রকৃতির বিশুদ্ধতার এ কথাগুলো আমরা বক্তব্য সেমিনারে বললেও, অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজেরাই পালন করি না। বর্তমানে দেখা যায়, দেশের ক্ষমতাবান সম্পদশালী মন্ত্রী বা সাংসদ অধিকাংশই ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশরই সত্ত্বাধিকারী এই ক্ষমতাবান সম্পদশালী ব্যক্তিবর্গ। তাই পরিবেশ দূষণকারী বাণিজ্যক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে দেশে শক্ত আইন থাকলেও, সেই আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ হয় না। বৈদিক ঋষিরা চেয়েছেন, এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মনুষ্য সহ সকল প্রাণীকুল তো বটেই, পৃথিবীর সমস্ত ধূলিকণা পর্যন্ত বিশুদ্ধ হয়ে মধুময় হোক। যা খেয়ে মানুষ বেঁচে থাকে সেই অন্ন পর্যন্ত মধুময় পুষ্টিকারী হোক। ভূলোক থেকে দ্যুলােক সকল লোকই মধুময় হোক।বনের পতি বলে পরিগণিত বট, অশ্বত্থ প্রভৃতি অতি বিশাল বৃক্ষ, যে বৃক্ষে ফল হয় কিন্তু ফুল হয় না, তাদের বনস্পতি বলে। এই বনস্পতি যেন মধুময় হয় এই প্রার্থনা ছিলো ঋষিদের। এই বনস্পতি থেকে মানুষের জীবন রক্ষাকারী প্রচুর অক্সিজেন পাওয়া যায়। তাই এই প্রকৃতির অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বনস্পতি বৃক্ষের মধুরতার প্রার্থনা করা হয়েছে। যেন এই বৃক্ষগুলো পত্র-পল্লবে সজীব থাকে। সূর্যের বিশুদ্ধ আলো কোন বাঁধাপ্রাপ্ত না হয়ে সর্বত্র যেন পৌঁছে যেতে পারে, এই প্রার্থনা বৈদিক ঋষিদের কণ্ঠে সর্বদাই ছিলো। দুগ্ধ দানকারী ধেনুসকল যেন রক্ষা পায়। তারা যেন মধুময় হয়ে বেড়ে উঠে মধুময় দুগ্ধ দান করে এই প্রার্থনা বৈদিক ঋষিদের ছিলো। অর্থাৎ প্রকৃতির এবং প্রাণীকুলের সাথে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ছিলো তাদের।
মধু বাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ।
মাধ্বীর্ন সন্ত্বোষধীঃ৷।
মধু নক্তমুতােষসাে মধুমৎ পার্থিবং রজঃ।
মধু দ্যৌরস্তু নঃ পিতা ৷৷
মধুমান্নো বনস্পতির্মধুমাঁ অস্তু সূর্য্যঃ।
মাধ্বীর্গাবাে ভবন্তু নঃ।।
(ঋগ্বেদ সংহিতা:১.৯০.৬-৮)
"সত্যময় পুরুষের জন্য বায়ু ও নদীসমূহ মধু বর্ষণ করছে। আমাদের প্রতি ওষধী সমূহ মধুময় হোক।
আমাদের রাত্রি ও ঊষাকাল মধুময় হোক। পৃথিবীর ধূলিকণা মধুময় হোক, বর্ষণশীল পুষ্টিকারী দ্যুলােক মধুময় হোক।বনস্পতি আমাদের প্রতি মধুর হোক, সূর্য মধুর হোক, ধেনুসকল মধুর হোক।"
পরমেশ্বর সৃষ্ট এ প্রাণীকুল বিশেষ করে মানুষেরা বিষে ভরিয়ে তুলে বিষাক্ত করে তুলছে পরিবেশকে। জগতের মানুষ কখনো সচেতনভাবে অথবা কখনো অসচেতনভাবে এ কাজগুলো করছে।নগরায়ণের নামে প্রকৃতিতে প্রতিনিয়ত ধ্বংস করছে। তাই প্রকৃতিও মাঝেমধ্যে কখনো ভয়ংকর মহাকালের রূপ ধারণ করে মানুষকে শাসন করে। প্রকৃতির এ শাসনে মানুষ কিছুটা সচেতন হয়। সে বুঝতে পারে যে প্রকৃতিকে সে ভোগের নামে প্রতিনিয়ত ধ্বংস করে চলছে, সেই প্রকৃতির কাছে সে কতটা অসহায়। কিন্তু মানুষ ভাবে, সে সৃষ্টির সেরা জীব। এটাই তার চরম মূর্খতা। মানুষের বুদ্ধি সুপরিণত বলে মানুষ নিজেরা নিজেদের সম্পর্কে এগুলো ভেবে বসে থাকে। সে নিজেকে নিজে শ্রেষ্ঠ মনে করে অভিমান করে থাকে। কিন্তু বিষয়টি কিছুটা সত্য হলেও, সত্য নয়। মানুষ প্রকৃতির কাছে অত্যন্ত অসহায়। তাই মানুষ প্রকৃতি এবং পরিবেশকে যদি রক্ষা করে, তবেই সে নিজেও রক্ষা পাবে। বিপরীতে প্রকৃতিতে ধ্বংস করলে, বিষাক্ত করলে সে নিজেও ধ্বংস হয়ে যাবে। বিষয়টি একটি অন্যের পরিপূরক। ঋগ্বেদ সংহিতায় যেমন বৈদিক ঋষিগণ প্রকৃতিকে মধুময় হতে প্রার্থনা করেছেন। ঠিক তেমনি যজুর্বেদের শান্তিমন্ত্রে প্রকৃতি পরিবেশের সর্বত্র শান্তির উপস্থিতি কামনা করা হয়েছে। বিষয়টি প্রায় একই। শান্তিময় হলেই, তবে তা মধুময় হয়ে যায়।
ওঁ দৌঃ শান্তিরন্তরিক্ষং শান্তিঃ
পৃথিবী শান্তিরাপঃ শান্তিঃ ওষধয়ঃ শান্তিঃ।
বনস্পতয়ঃ শান্তিঃ বিশ্বে দেবাঃ শান্তিঃ
ব্রহ্ম শান্তিঃ সর্বং শান্তিঃ
শান্তিরের শান্তিঃ সা মা শান্তিরেধি॥
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ॥
(শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতা:৩৬.১৭)
"দ্যুলোকে শান্তিময় হোক, অন্তরিক্ষলোক শান্তিময় হোক, পৃথিবী শান্তিময় হোক,নদী সমুদ্র সহ সকল জলাধার শান্তিময় হোক, ওষধি সকল শান্তিময় হোক, বনস্পতি সকল শান্তিময় হোক। পরমব্রহ্ম সহ সকল দেবগণ শান্তি লাভ করুক। জগতের সর্বত্র শান্তি বিরাজ করুক। শান্তি শান্তি লাভ করে, সেই অনন্ত শান্তি আমার কাছে এসে আমাকে স্পর্শ করুক। জগতে শারীরিক মানসিক এবং দৈবদুর্বিপাক সহ ত্রিতাপ জ্বালা থেকে সকলে শান্তি পাক।"
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।