জীবন চলতে খুব বেশি কিছুর প্রয়োজন নেই। অতিরিক্ত ভোগের আকাঙ্ক্ষা আমাদের জীবনের তৃষ্ণাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। ভোগাসক্তি একটি জাজ্জ্বল্যমান অগ্নিকুণ্ডের মত। এ কুণ্ডে যত ভোগরূপ ঘৃতের আহুতি দেয়া হবে; ততই ভোগ আকাঙ্ক্ষার অগ্নি বেড়ে চলবে হুহু করে। জীবনে প্রতিনিয়ত চাই এবং চাই। এ চাওয়া এবং পাওয়ার আপাতদৃষ্টিতে পরিসমাপ্তি নেই। কাউকে বসতে বললে শুয়ে থাকতে চায়, শুয়ে থাকতে বললে চিরস্থায়ী বসবাসের বন্দোবস্ত করতে চায়। তাই সময় থাকতেই এ চাওয়া পাওয়ার ঘোড়াকে যথাসম্ভব রাশ টেনে ধরা প্রয়োজন। কিন্ত সেই ঘোড়ার লাগামকে সময় মত অধিকাংশ মানুষই টেনে ধরতে পারে না।সর্বদা মনে রাখা প্রয়োজন, এ বিশ্বচরাচরে সকল কিছুই ভগবানের ৷ তিনিই এ জগতের পরিচালনারূপ নিমিত্ত কারণ এবং তিনিই জগতের জড় চেতন সর্বভূতে বিরাজিত উপাদান কারণ। আমাদের উচিত জীবন ধারণের জন্য যতটুকু প্রয়োজনীয়, শুধু ততটুকুই গ্রহণ করা। ঋগ্বেদ সংহিতায় দেবতা, বন্ধুকেও প্রদান করে তবে ভোজন করতে বলা হয়েছে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি স্বার্থপরের মত কেবল নিজেই শুধু ভোজন করে; সে কেবল পাপই ভোজন করে।
মোঘমন্নং বিন্দতে অপ্রচেতাঃ
সত্যং ব্রবীমি বধ ইৎস তস্য।
নার্যমণং পৃষ্যতি নো সখায়ং
কেবলাঘো ভবতি কেবলাদী ॥
(ঋগ্বেদ সংহিতা:১০.১১৭.৬)
"যার মন উদার নয়, তার মিথ্যা ভোজন করা। বলতে কি, তার ভোজন তার মৃত্যুর স্বরূপ। সে দেবতাকেও প্রদান করে না, বন্ধুকেও প্রদান করে না। যে কেবল নিজে ভোজন করে, তার কেবল পাপই ভোজন করা হয়।"
কখনই অন্যের ধনে লোভ করা উচিত নয় এবং চুরি করা উচিত নয়। অন্যের ধনে লোভ সকল সদগুণের বিনাশ ঘটায়। অন্যের ধনে লোভ মানুষকে নরকগামী করে তোলে। এ প্রসঙ্গে বিষ্ণুপুরাণের তৃতীয়াংশে বলা হয়েছে :
কিঞ্চিৎ পরস্বং ন হরেন্নাল্পমপ্যপ্রিয়ং বদেৎ ।
প্রিয়ঞ্চ নানৃতং ব্রূয়ান্নান্যদোষাসুদীরয়েৎ ॥৪
(বিষ্ণুপুরাণ: ৩.১২.৪)
"বিন্দুমাত্রও কারো পরস্ব হরণ করবে না। কাউকে অল্প মাত্রও অপ্রিয় বাক্য বলবে না, মিথ্যা প্রিয়বাক্য ব্যবহার করিবে না। অন্যের দোষ বর্ণন করবে না।"
শুক্ল যজুর্বেদে বলা হয়েছে, এ জগত ঈশ্বরের ; তাই জগতের সকল কিছুই ত্যাগের সাথে ভোগ করতে। শাস্ত্রে ভোগ করতে নিষেধ করা হয়নি। ভোগ করা যাবে শুধুই প্রয়োজন অনুসারে এবং তা হতে হবে অনাসক্তভাবে। যেমন বড় বড় হোটেলে বিবিধ প্রকারের খাবারের বুফে দেয়া থাকে। কেউ ইচ্ছা থাকলেও সে সকল খাবার গ্রহণ করতে পারে না।কারণ সেখানে বহু মানুষের খাবার থাকে। কেউ যদি লোভ এবং হিংসাবৃত্তি নিয়ে নিজে যতটুকু পেরেছে, খেয়ে অন্যের খাবার নষ্ট করে তবে তা পাপকাজ। জীবনেও ঠিক এমনভাবে ঈশ্বর খাবারের বুফে দিয়ে রেখেছেন। মনুষ্যের উচিত সেই খাবার থেকে শুধু খাবারটুকু গ্রহণ করে অন্যের জন্য রেখে দেয়া। জগতে প্রত্যেকটি জীবের জন্যই সমানভাবে খাবার বরাদ্দ আছে। মনুষ্যের উচিত সেই খাবার সুষম বণ্টন করে খাওয়া। আশেপাশের একে অন্যকে দিয়ে খাওয়া। কেউ যেন অভুক্ত না থাকে, সে বিষয়টি দেখা। কিন্তু মনুষ্য লোভে পরে, নিজে খাওয়ার সাথে সাথে অন্যের খাবারকে কুক্ষিগত করে রাখে। এতে খাবারের সুষম বণ্টন হতে পারে না, অনেকেই খাবারের অভাবে অভুক্ত থাকে। এ প্রসঙ্গে শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতায় বলা হয়েছে :
ঈশাবাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ ৷
তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্যস্বিদ্ ধনম্ ৷৷
(শক্ল যজুর্বেদ সংহিতা: ৪০.১)
"এই গতিশীল বিশ্বে যাহা কিছু চলমান বস্তু আছে তা ঈশ্বরের বাসের নিমিত্ত মনে করবে। ঈশ্বর দ্বারা জগতের বস্তুসমূহ আচ্ছাদিত মনে করবে। ত্যাগের সহত ভোগ করবে; কারো ধনে লোভ করবে না।"
কারো ধনে লোভ করা উচিত নয়। এ বিষয়টি বাংলায় শিশুশিক্ষা গ্রন্থের যিনি অন্যতম অগ্রপথিক, সেই মদনমোহন তর্কালঙ্কারের রচনাতেও অত্যন্ত ছন্দবদ্ধ ভাবে পাওয়া যায়। মদনমোহন তর্কালঙ্কার চেয়েছেন, অন্যের ধনে লোভ না করার বিষয়টি শিশুরা যেন বাল্যকাল থেকেই আত্মস্থ করতে পারে। সে লক্ষ্যে কবি তাঁর সুবিখ্যাত 'লেখাপড়া করে যেই' কবিতায় বলেছেন :
"কটু ভাষী নাহি হবে।
মিছা কথা নাহি কবে।।
পর ধন নাহি লবে।
চিরদিন সুখে রবে।।"
অপরের দ্রব্যের প্রতি লোভ করা শুধু অনুচিত নয়, অত্যন্ত অন্যায়। লোভ মানুষের একটি পরম শত্রু। লোভী মানুষের পতন অনিবার্য। তাই যারা প্রকৃত জ্ঞানী তারা অন্যের দ্রব্যের প্রতি লোভ করা দূরে থাক, তারা সামান্য ঢেলার মতই তুচ্ছজ্ঞান করে।অন্যের দ্রব্য যতই লোভনীয় হোক না কেন, পরের দ্রব্যের প্রতি জ্ঞানী ব্যক্তিগণের সামান্যতম কোন মোহের উৎপত্তি হয় না। এ প্রসঙ্গে গরুড়পুরাণে বলা হয়েছে:
মাতৃবৎ পরদারেষু পরদ্রব্যেষু লোষ্ট্রবৎ।
আত্মবৎ সর্বভূতেষু যঃ পশ্যতি স পণ্ডিতঃ ॥
(গরুড়পুরাণ: পূর্বখণ্ড, ১১১.১২)
"যিনি অপরের স্ত্রীকে জন্মদাত্রী মায়ের মত দেখেন, অপরের দ্রব্যকে মাটির ঢেলার মত দেখেন এবং যিনি সকল প্রাণির মধ্যে নিজেকেই দেখেন, তিনিই প্রকৃত পণ্ডিত।"
গরুড়পুরাণের এ শ্লোকটি চাণক্যের লেখাতেও (চাণক্য শ্লোক: ৭) পাওয়া যায়। শাস্ত্রের বিভিন্ন স্থানে পরধনে লোভ করতে নিষেধ করার পরেও মনুষ্য পরধনে লোভ ছাড়তে পারে না। পরধন আত্তীকরণ করতে তারা সমাজ সংসারে বিবিধ প্রকারের কৌশল অবলম্বন করে। এ কৌশলের মধ্যে অন্যতম হল: চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই অন্যকে বঞ্চিত করে তার সকল ধন অপহরণসহ ইত্যাদি। এ বিবিধ প্রকারের কৌশলে অন্যায় ভাবে, অন্যের ধন আত্তীকরণের বহু দৃষ্টান্ত সমাজে রয়েছে। কিন্তু সামাজিকভাবেও পরিবার পরিজনকে সাথে নিয়ে আনন্দ-ফুর্তি করে পরধন আত্তীকরণের একটি নিকৃষ্ট উপায় হল বিবাহকালে রাশিরাশি যৌতুক।যৌতুক একটি ভয়াবহ সামাজিক অশাস্ত্রীয় ব্যাধি। তবে যৌতুক এবং স্ত্রীধন এক নয়। একটি ভালোবাসার সাথে স্বেচ্ছায়, অন্যটি নিরুপায় হয়ে অনিচ্ছায়। বিবাহকালে কন্যাকে পিতার স্বেচ্ছায় প্রদত্ত স্ত্রীধনের কথা শাস্ত্রে বলা হয়েছে।কিন্তু যৌতুকের সামান্যতম সমর্থন শাস্ত্রে পাওয়া যায় না। যেমন করে হাটে-বাজারে গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ ইত্যাদি প্রাণী বিক্রি হয়। ঠিক সেভাবেই বিবাহকালে যৌতুক গ্রহণের মাধ্যমে একজন বর কন্যার পিতার কাছে অর্থের বিনিময়ে স্বেচ্ছায় বিক্রি হয়।পার্থক্য শুধু এতটুকুই-গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ ইত্যাদি প্রাণী অনিচ্ছায় বিক্রি হয় ; বিপরীতে মনুষ্য যৌতুক গ্রহণের মাধ্যমে স্বেচ্ছায় বিক্রি হয়। শাস্ত্রে কন্যার পিতার কাছে অর্থের বিনিময়ে স্বেচ্ছায় বিক্রি হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের পাতকী বলে নিন্দা করা হয়েছে।তাই কোন অবস্থাতেই অন্যের ধনে লোভ করতে নেই।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।