-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের, 'বাবু' প্রবন্ধে সেকালের বাবুচরিত্র।

বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোক বোঝাতে বর্তমানে 'বাবু' শব্দটি বহুল প্রচারিত। বর্তমানে অনেক নব্য ধনী ব্যক্তিরা আছেন, তাদের নামের সাথে যদি বাবু শব্দটি ব্যবহৃত না হয়, তারা ভয়ংকর ক্ষুব্ধ হয়ে যান। এই ভূখণ্ডের শাশ্বত সংস্কৃতির চিহ্ন হিসেবে নামের সাথে প্রাচীনকাল থেকেই লক্ষ্মী, সমৃদ্ধি এবং সৌন্দর্যবাচক 'শ্রী' শব্দটি ব্যবহৃত। কিন্তু সেই শ্রী শব্দটিকে পাশ কাটিয়ে কেন এবং কিভাবে বাবু শব্দটি বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠলো, এ বিষয়টি অত্যন্ত রহস্যজনক। বাবু শব্দটি সম্ভবত তুর্কি ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় এসেছে। শব্দটি এ দেশীয় হিন্দু সংস্কৃতির সাথে যুক্ত নয়। এরপরেও বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোক বা সম্মানিত ব্যাক্তি, হিন্দু পরিবারের কর্তা বা বয়স্ক পুরুষদের ক্ষেত্রে শব্দটি ব্যবহৃত হয়। কিন্তু বর্তমানে শব্দটি তার পূর্বের অর্থ ছাপিয়ে প্রেমিক-প্রেমিকা বা স্বামী-স্ত্রীর একে অন্যের প্রেমপূর্ণ সম্বোধনবাচক শব্দে রূপান্তরিত হয়েছে। এবং সেই প্রেমপূর্ণ সম্বোধনবাচক শব্দে রূপান্তরিত হয়ে শব্দটি বর্তমানে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে গেছে। বিশেষ করে তরুণ-তরুণী এবং যুবক- যুবতীদের মাঝে। তবে সবথেকে মজার ব্যাপার হল, গত কয়েক শতাব্দীতে বাবু শব্দটি বিভিন্ন প্রকারের অর্থ প্রদান করেছে। তবে বর্তমানে শব্দটি তরুণ -তরুণীদের প্রেমপূর্ণ সম্বোধনবাচক শব্দে রূপান্তরিত হয়ে তার  পূর্বের অর্থেই প্রত্যাবর্তন করেছে। শব্দটি অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রাথমিক অর্থে কোলকাতা এবং এর আশেপাশের লম্পট এবং অত্যন্ত ভোগী পুরুষ অর্থেই ব্যবহৃত হত। যারা হাতে বেলিফুলের মালা নিয়ে বাইজীবাড়ি বা নিজের নিজের বাগানবাড়িতে বাজারের নারীদের নিয়ে ফুর্তি করে বেড়াত। বাবু শব্দটি একটি নেতিবাচক শব্দ, যার সাথে কামুক পুরুষের সম্পর্ক।  আধুনিক বাংলা সাহিত্যের শুরু থেকেই বিভিন্ন সাহিত্যে বাবু সংস্কৃতিতে অত্যন্ত রূঢ় ভাষায় কটাক্ষ করা হয়েছে। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও বাবু সংস্কৃতি অপছন্দ করতেন। তার রচনায় বিষয়টির প্রমাণ পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি ক্ষুদ্র প্রবন্ধ আছে 'বাবু' নামে। সেখানে তিনি অত্যন্ত সরস ভাষায় বাবু সংস্কৃতিতে কটাক্ষ করেছেন।মহাভারতের কলিযুগ, জনমেজয় এবং বৈশম্পায়ন চরিত্রগুলোকে নিয়ে এসে,  মহাভারতের বর্ণনা রীতিতে তিনি এই বাবুদের কীর্তিকলাপ বর্ণনা করেছেন। প্রবন্ধের শুরুতেই তিনি বাবুদের বর্ণনা দিয়েছেন যে, বাবু কারা?  "বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে নরবর! আমি সেই বিচিত্রবুদ্ধি, আহারনিদ্রাকুশলী বাবুগণকে আখ্যাত করিব, আপনি শ্রবণ করুন। আমি সেই চসমাঅলঙ্কৃত উদরচরিত্র, বহুভাষী, সন্দেশপ্রিয় বাবুদিগের চরিত্র কীর্ত্তিত করিতেছি, আপনি শ্রবণ করুন। হে রাজন, যাঁহারা চিত্রবসনাবৃত, বেত্রহস্ত, রঞ্জিতকুম্ভল, এবং মহাপাদুক, তাঁহারাই বাবু। যাঁহারা বাক্যে অজেয়, পরভাষাপারদর্শী, মাতৃভাষাবিরোধী, তাহারাই বাবু। মহারাজ। এমন অনেক মহাবুদ্ধিসম্পন্ন বাবু জন্মিবেন যে, তাহারা মাতৃভাষায় বাক্যালাপে অসমর্থ হইবেন। যাঁহাদিগের দশেন্দ্রিয় প্রকৃতিস্থ, অতএব অপরিশুদ্ধ, যাঁহাদিগের কেবল রসনেন্দ্রিয় পরজাতিনিষ্ঠীবনে পবিত্র, তাঁহারাই বাবু। যাঁহাদিগের চরণ মাংসাস্থিবিহীন শুষ্ক কাষ্ঠের ন্যায় হইলেও পলায়নে সক্ষম; হস্ত দুর্ব্বল হইলেও লেখনীধারণে এবং বেতনগ্রহণে সুপটু ;-চৰ্ম্ম কোমল হইলেও সাগরপারনিৰ্ম্মিত দ্রব্যবিশেষের প্রহারসহিষ্ণু ; যাঁহাদিগের ইন্দ্রিয়মাত্রেরই ঐরূপ প্রশংসা করা যাইতে পারে, তাঁহারাই বাবু। যাঁহারা বিনা উদ্দেশ্যে সঞ্চয় করিবেন, সঞ্চয়ের জন্য উপার্জ্জন করিবেন, উপার্জনের জন্য বিদ্যাধ্যয়ন করিবেন, বিদ্যাধ্যয়নের জন্য প্রশ্ন চুরি করিবেন, তাঁহারাই বাবু।" (সুবোধ চক্রবর্তী ১৯৯১: ১১) বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেন বাবু শব্দ বিবিধ অর্থের। প্রথমত ইংরেজের কেরানী বা রাজকর্মচারী, কিছুটা ধনী বা নব্যধনী ব্যক্তি এবং ভৃত্যের কাছে প্রভু হলেন বাবু।  "বাবু শব্দ নানার্থ হইবে। যাঁহারা কলিযুগে ভারতবর্ষে রাজ্যাভিষিক্ত হইয়া, ইংরাজ নামে খ্যাত হইবেন, তাহাদিগের নিকট 'বাবু' অর্থে কেরাণী বা বাজার সরকার বুঝাইবে। নির্ধনদিগের নিকটে 'বাবু' শব্দে অপেক্ষাকৃত ধনী বুঝাইবে। ভৃত্যের নিকট 'বাবু' অর্থে প্রভু বুঝাইবে।" (সুবোধ চক্রবর্তী ১৯৯১: ১১) বাবু নামে কারা খ্যাত, এটা বলে পরবর্তীতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাবুদের আচার আচরণের পরিচয় দিলেন। তাদের হাতে এবং মুখে তামাক এবং চুরুট থাকবে। মদনের কামের আগুনে যারা জর্জরিত হয়ে থাকবে। বারবিলাসিনী বা বেশ্যা যাদের নিত্যসঙ্গী তারাই বাবু। "স্ফটিক পাত্র ইঁহাদিগের গণ্ডুষ। অগ্নি ইহাদিগের আজ্ঞাবহ হইবেন—“তামাকু” এবং “চুরুট” নামক দুইটি অভিনব খাণ্ডবকে আশ্রয় করিয়া রাত্রি দিন ইহাদিগের মুখে লাগিয়া থাকিবেন। ইহাদিগের যেমন মুখে অগ্নি, তেমনি জঠরেও অগ্নি জ্বলিবেন। এবং রাত্রি তৃতীয় প্রহর পর্য্যন্ত ইহাদিগের রথস্থ যুগল প্রদীপে জ্বলিবেন। ইহাদিগের আলোচিত সঙ্গীতে এবং কাব্যেও অগ্নিদেব থাকিবেন। তথায় তিনি “মদন আগুন” এবং “মনাণ্ডন" রূপে পরিণত হইবেন। বারবিলাসিনীদিগের মতে ইহাদিগের কপালেও অগ্নিদেব বিরাজ করিবেন।" (সুবোধ চক্রবর্তী ১৯৯১: ১১) ভগবান বিষ্ণুর দশ লীলা অবতারের ন্যায় বাবুদেরও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দশপ্রকার রূপে বিভক্ত করেছেন। কেরাণীবাবু রূপে তারা উচ্চ পর্যায়ের ব্রিটিশ অফিসারদের গালি নিঃশব্দে হজম করে এর শোধ নেন কেরানীর অধস্তন এদেশীয় অসহায় গরিব দপ্তরীর উপরে।মাষ্টারবাবু রূপে তারা ছাত্রদের উপরে ঝাপিয়ে পড়েন, তাদের শিক্ষক রূপের সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রদর্শন করেন। স্টেশন মাস্টারবাবু রূপে টিকিট বিহীন যাত্রীকে শিকার করেন।ব্রাহ্মবাবু রূপে গরীব পুরোহিতদের  পেশায় হাত দেন। মুৎসুদ্দীবাবু রূপে ব্যবসায়ী ইংরেজদের ব্যবসাকে বিবিধ প্রকারের কৌশলে ক্ষতিগ্রস্ত করেন। ডাক্তারবাবু রূপে রোগিদের পকেট খালি করেন। উকিলবাবু রূপে মক্কেলের পকেট খালি করেন। হাকিমবাবু রূপে বিচার প্রার্থীকে বধ করেন। জমিদারবাবু রূপে প্রজা সাধারণকে অত্যাচার করেন।, পত্রিকার সম্পাদকবাবু রূপে ভদ্রলোককে নাজেহাল করেন।  নিষ্কর্ম্মাবাবু রূপে সারাদিন বসে পুকুরের মাছ শিকার করে মাছেদের জীবন দুর্বিষহ করেন। "যিনি কাব্যরসাদিতে বঞ্চিত, সঙ্গীতে দগ্ধ কোকিলাহারী, যাঁহার পাণ্ডিত্য শৈশবাভ্যস্ত গ্রন্থগত, যিনি আপনাকে অনস্তজ্ঞানী বিবেচনা করিবেন, তিনিই বাবু। যিনি কাব্যের কিছুই বুঝিবেন না, অথচ কাব্যপাঠে এবং সমালোচনায় প্রবৃত্ত, যিনি বারযোষিতের চীৎকার মাত্রকেই সঙ্গীত বিবেচনা করিবেন, যিনি আপনাকে অভ্রান্ত বলিয়া জানিবেন, তিনিই বাবু। যিনি রূপে কার্ত্তিকেয়ের কনিষ্ঠ, গুণে নিৰ্গুণ পদার্থ, কৰ্ম্মে জড় ভরত, এবং বাক্যে সরস্বতী, তিনিই বাবু। যিনি উৎসবার্থ দুর্গাপূজা করিবেন, গৃহিণীর অনুরোধে লক্ষ্মীপূজা করিবেন, উপগৃহিণীর অনুরোধে সরস্বতীপূজা করিবেন, এবং পাটার লোভে গঙ্গাপূজা করিবেন, তিনিই বাবু। যাঁহার গমন বিচিত্র রথে, শয়ন সাধারণ গৃহে, পান দ্রাক্ষারস, এবং আহার কদলী দগ্ধ, তিনিই বাবু। যিনি মহাদেবের তুল্য মাদকপ্রিয়, ব্রহ্মার তুল্য প্রজাসিসৃন্ধু, এবং বিষ্ণুর তুল্য লীলা-পটু, তিনিই বাবু। হে কুরুকুলভূষণ। বিষ্ণুর সহিত এই বাবুদিগের বিশেষ সাদৃশ্য হইবে। বিষ্ণুর ন্যায় ইহাদের লক্ষ্মী এবং সরস্বতী উভয়ই থাকিবেন। বিষ্ণুর ন্যায় ইঁহারাও 'অনন্তশয্যাশায়ী হইবেন। বিষ্ণুর ন্যায় ইহাদিগেরও দশ অবতার—যথা, কেরাণী, মাষ্টার, ব্রাহ্ম, মুৎসুদ্দী, ডাক্তার, উকিল, হাকিম, জমিদার, সম্বাদপত্রসম্পাদক এবং নিষ্কর্ম্মা। বিষ্ণুর ন্যায় ইহারা সকল অবতারেই অমিতবলপরাক্রম অসুরগণকে বধ করিবেন। কেরাণী অবতারে বধ্য অসুর দপ্তরী; মাষ্টার অবতারে বধ্য ছাত্র ; ষ্টেশ্যন মাষ্টার অবতারে বধ্য টিকেটহীন পথিক ; ব্রাহ্মাবতারে বধ্য চালকলাপ্রত্যাশী পুরোহিত ; মুৎসুদ্দী অবতারে বধ্য বণিক্ ইংরাজ ; ডাক্তার অবতারে বধ্য রোগী ; উকিল অবতারে বধ্য মোয়াক্কল ; হাকিম অবতারে বধ্য বিচারার্থী ; জমিদার অবতারে বধ্য প্রজা ; সম্পাদক অবতারে বধ্য ভদ্রলোক এবং নিষ্কর্ম্মাবতারে বধ্য পুষ্করিণীর মৎস্য।" (সুবোধ চক্রবর্তী ১৯৯১: ১১-১২) বাবুদের কথা ও কাজের মধ্যে কোন সামঞ্জস্য নেই। তাদের প্রয়োজনে এবং কার্যক্ষেত্রে যাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। এই বাবুগণ ইংরেজকে তাদের ইষ্টদেবতার মত মনে করে, ইংরেজের প্রসন্নতার জন্য তাদের  প্রচেষ্টার অন্ত থাকে না। ব্রাহ্মধর্ম প্রচারকদের তারা গুরুর মত মানে। সংবাদপত্রকে যারা বেদের মত অনুসরণ করে এবং ন্যাশনাল থিয়েটার তাদের কাছে তীর্থের মত।এই বাবুরা নিজগৃহে জল খেলেও, বন্ধুগৃহে বা বাগানবাড়িতে তারা মদপান করেন। বেশ্যাগৃহে সুন্দরী বেশ্যাদের গালি খেতেও তাদের আপত্তি নেই। তারা তাদের ইষ্টদেবতা ইংরেজের গলাধাক্কা খেয়েও, সদা তাদের পায়ে দাসানুদাস হয়ে পরে থাকতে আপত্তি নেই। এই বাবুগণ কালো চামড়ার ইংরেজ হতে গিয়ে  হাত দিয়ে ভাতসহ খাবার খাওয়াকে অসম্মানজনক মনে করে ইংরেজের মত চামচ দিয়ে সকল খাবার গ্রহণ করেন। বাবুগিরির ঘাটতি হবে বলে, এই বাবুদের অনেকেই নিজের মাতৃভাষা বাংলাতেও কথা বলতে অনিচ্ছুক। সাজগোছ করে লোকদেখানো কেতাদুরস্ত ভাবই তাদের অন্যতম সম্বল।  "যাঁহার বাক্য মনোমধ্যে এক, কথনে দশ, লিখনে শত এবং কলহে সহস্র, তিনিই বাবু। যাঁহার বল হস্তে একগুণ, মুখে দশগুণ, পৃষ্ঠে শতগুণ এবং কার্য্যকালে অদৃশ্য, তিনিই বাবু। যাঁহার বুদ্ধি বাল্যে পুস্তকমধ্যে, যৌবনে বোতলমধ্যে, বার্দ্ধক্যে গৃহিণীর অঞ্চলে, তিনিই বাবু। যাঁহার ইষ্টদেবতা ইংরাজ, গুরু ব্রাহ্মধৰ্ম্মবেত্তা, বেদ দেশী সম্বাদপত্র এবং তীর্থ “ন্যাশনল থিয়েটার”, তিনিই বাবু। যিনি মিসনরির নিকট খ্রীষ্টিয়ান, কেশবচন্দ্রের নিকট ব্রাহ্ম, পিতার নিকট হিন্দু, এবং ভিক্ষুক ব্রাহ্মণের নিকট নাস্তিক, তিনিই বাবু। যিনি নিজগৃহে জল খান, বন্ধুগৃহে মদ খান, বেশ্যাগৃহে গালি খান, এবং মুনিব সাহেবের গৃহে গলাধাক্কা খান, তিনিই বাবু। যাঁহার স্নানকালে তৈলে ঘৃণা, আহারকালে আপন অঙ্গুলিকে ঘৃণা এবং কথোপকথনকালে মাতৃভাষাকে ঘৃণা, তিনিই বাবু। যাঁহার যত্ন কেবল পরিচ্ছদে, তৎপরতা কেবল উমেদারিতে, ভক্তি কেবল গৃহিণী বা উপগৃহিণীতে, এবং রাগ কেবল সদগ্রন্থের উপর, নিঃসন্দেহ তিনিই বাবু।" (সুবোধ চক্রবর্তী ১৯৯১: ১২) ইংরেজের মত হতে গিয়ে বাবুরা এই ভূখণ্ডের নিজ ধর্ম ও সংস্কৃতিতে অকারণে অবহেলা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। এই বাবুগণ আত্মঘাতী, লম্পট এবং স্বার্থপর একটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠী। যারা জ্ঞানত বা অজ্ঞানত নিজের মুখে থুতু ছিটিয়ে নিজেকেই কলঙ্কিত করে। তাই বাবু নাম বাবু সংস্কৃতি কোন গৌরবের বিষয় নয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রায় দেড়শত বছর পূর্বে বাবুদের প্রসঙ্গে এত কথা লিখে যাওয়ার পরেও, আমরা বেহুশ হয়ে আজও নামের পূর্বে বাবু শব্দটি প্রতিনিয়ত ব্যবহার করে চলছি। বিষয়টি অত্যন্ত লজ্জা এবং পরিতাপের। তথ্য সহায়তা: ১. সুবোধ চক্রবর্তী (সম্পাদিত), বঙ্কিম রচনাবলী (২য় খণ্ড), কলকাতা: কামিনী প্রকাশনী, ১৯৯১ শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোক বোঝাতে বর্তমানে 'বাবু' শব্দটি বহুল প্রচারিত। বর্তমানে অনেক নব্য ধনী ব্যক্তিরা আছেন, তাদের নামের সাথে যদি বাবু শব্দটি ব্যবহৃত না হয়, তারা ভয়ংকর ক্ষুব্ধ হয়ে যান। এই ভূখণ্ডের শাশ্বত সংস্কৃতির চিহ্ন হিসেবে নামের সাথে প্রাচীনকাল থেকেই লক্ষ্মী, সমৃদ্ধি এবং সৌন্দর্যবাচক 'শ্রী' শব্দটি ব্যবহৃত। কিন্তু সেই শ্রী শব্দটিকে পাশ কাটিয়ে কেন এবং কিভাবে বাবু শব্দটি বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠলো, এ বিষয়টি অত্যন্ত রহস্যজনক। বাবু শব্দটি সম্ভবত তুর্কি ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় এসেছে। শব্দটি এ দেশীয় হিন্দু সংস্কৃতির সাথে যুক্ত নয়। এরপরেও বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোক বা সম্মানিত ব্যাক্তি, হিন্দু পরিবারের কর্তা বা বয়স্ক পুরুষদের ক্ষেত্রে শব্দটি ব্যবহৃত হয়। কিন্তু বর্তমানে শব্দটি তার পূর্বের অর্থ ছাপিয়ে প্রেমিক-প্রেমিকা বা স্বামী-স্ত্রীর একে অন্যের প্রেমপূর্ণ সম্বোধনবাচক শব্দে রূপান্তরিত হয়েছে। এবং সেই প্রেমপূর্ণ সম্বোধনবাচক শব্দে রূপান্তরিত হয়ে শব্দটি বর্তমানে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে গেছে। বিশেষ করে তরুণ-তরুণী এবং যুবক- যুবতীদের মাঝে। তবে সবথেকে মজার ব্যাপার হল, গত কয়েক শতাব্দীতে বাবু শব্দটি বিভিন্ন প্রকারের অর্থ প্রদান করেছে। তবে বর্তমানে শব্দটি তরুণ -তরুণীদের প্রেমপূর্ণ সম্বোধনবাচক শব্দে রূপান্তরিত হয়ে তার পূর্বের অর্থেই প্রত্যাবর্তন করেছে। শব্দটি অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রাথমিক অর্থে কোলকাতা এবং এর আশেপাশের লম্পট এবং অত্যন্ত ভোগী পুরুষ অর্থেই ব্যবহৃত হত। যারা হাতে বেলিফুলের মালা নিয়ে বাইজীবাড়ি বা নিজের নিজের বাগানবাড়িতে বাজারের নারীদের নিয়ে ফুর্তি করে বেড়াত। বাবু শব্দটি একটি নেতিবাচক শব্দ, যার সাথে কামুক পুরুষের সম্পর্ক।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের শুরু থেকেই বিভিন্ন সাহিত্যে বাবু সংস্কৃতিতে অত্যন্ত রূঢ় ভাষায় কটাক্ষ করা হয়েছে। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও বাবু সংস্কৃতি অপছন্দ করতেন। তার রচনায় বিষয়টির প্রমাণ পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি ক্ষুদ্র প্রবন্ধ আছে 'বাবু' নামে। সেখানে তিনি অত্যন্ত সরস ভাষায় বাবু সংস্কৃতিতে কটাক্ষ করেছেন।মহাভারতের কলিযুগ, জনমেজয় এবং বৈশম্পায়ন চরিত্রগুলোকে নিয়ে এসে, মহাভারতের বর্ণনা রীতিতে তিনি এই বাবুদের কীর্তিকলাপ বর্ণনা করেছেন। প্রবন্ধের শুরুতেই তিনি বাবুদের বর্ণনা দিয়েছেন যে, বাবু কারা?
"বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে নরবর! আমি সেই বিচিত্রবুদ্ধি, আহারনিদ্রাকুশলী বাবুগণকে আখ্যাত করিব, আপনি শ্রবণ করুন। আমি সেই চসমাঅলঙ্কৃত উদরচরিত্র, বহুভাষী, সন্দেশপ্রিয় বাবুদিগের চরিত্র কীর্ত্তিত করিতেছি, আপনি শ্রবণ করুন। হে রাজন, যাঁহারা চিত্রবসনাবৃত, বেত্রহস্ত, রঞ্জিতকুম্ভল, এবং মহাপাদুক, তাঁহারাই বাবু। যাঁহারা বাক্যে অজেয়, পরভাষাপারদর্শী, মাতৃভাষাবিরোধী, তাহারাই বাবু। মহারাজ। এমন অনেক মহাবুদ্ধিসম্পন্ন বাবু জন্মিবেন যে, তাহারা মাতৃভাষায় বাক্যালাপে অসমর্থ হইবেন। যাঁহাদিগের দশেন্দ্রিয় প্রকৃতিস্থ, অতএব অপরিশুদ্ধ, যাঁহাদিগের কেবল রসনেন্দ্রিয় পরজাতিনিষ্ঠীবনে পবিত্র, তাঁহারাই বাবু। যাঁহাদিগের চরণ মাংসাস্থিবিহীন শুষ্ক কাষ্ঠের ন্যায় হইলেও পলায়নে সক্ষম; হস্ত দুর্ব্বল হইলেও লেখনীধারণে এবং বেতনগ্রহণে সুপটু ;-চৰ্ম্ম কোমল হইলেও সাগরপারনিৰ্ম্মিত দ্রব্যবিশেষের প্রহারসহিষ্ণু ; যাঁহাদিগের ইন্দ্রিয়মাত্রেরই ঐরূপ প্রশংসা করা যাইতে পারে, তাঁহারাই বাবু। যাঁহারা বিনা উদ্দেশ্যে সঞ্চয় করিবেন, সঞ্চয়ের জন্য উপার্জ্জন করিবেন, উপার্জনের জন্য বিদ্যাধ্যয়ন করিবেন, বিদ্যাধ্যয়নের জন্য প্রশ্ন চুরি করিবেন, তাঁহারাই বাবু।"
(সুবোধ চক্রবর্তী ১৯৯১: ১১)
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেন বাবু শব্দ বিবিধ অর্থের। প্রথমত ইংরেজের কেরানী বা রাজকর্মচারী, কিছুটা ধনী বা নব্যধনী ব্যক্তি এবং ভৃত্যের কাছে প্রভু হলেন বাবু।
"বাবু শব্দ নানার্থ হইবে। যাঁহারা কলিযুগে ভারতবর্ষে রাজ্যাভিষিক্ত হইয়া, ইংরাজ নামে খ্যাত হইবেন, তাহাদিগের নিকট 'বাবু' অর্থে কেরাণী বা বাজার সরকার বুঝাইবে। নির্ধনদিগের নিকটে 'বাবু' শব্দে অপেক্ষাকৃত ধনী বুঝাইবে। ভৃত্যের নিকট 'বাবু' অর্থে প্রভু বুঝাইবে।"
(সুবোধ চক্রবর্তী ১৯৯১: ১১)
বাবু নামে কারা খ্যাত, এটা বলে পরবর্তীতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাবুদের আচার আচরণের পরিচয় দিলেন। তাদের হাতে এবং মুখে তামাক এবং চুরুট থাকবে। মদনের কামের আগুনে যারা জর্জরিত হয়ে থাকবে। বারবিলাসিনী বা বেশ্যা যাদের নিত্যসঙ্গী তারাই বাবু।
"স্ফটিক পাত্র ইঁহাদিগের গণ্ডুষ। অগ্নি ইহাদিগের আজ্ঞাবহ হইবেন—“তামাকু” এবং “চুরুট” নামক দুইটি অভিনব খাণ্ডবকে আশ্রয় করিয়া রাত্রি দিন ইহাদিগের মুখে লাগিয়া থাকিবেন। ইহাদিগের যেমন মুখে অগ্নি, তেমনি জঠরেও অগ্নি জ্বলিবেন। এবং রাত্রি তৃতীয় প্রহর পর্য্যন্ত ইহাদিগের রথস্থ যুগল প্রদীপে জ্বলিবেন। ইহাদিগের আলোচিত সঙ্গীতে এবং কাব্যেও অগ্নিদেব থাকিবেন। তথায় তিনি “মদন আগুন” এবং “মনাণ্ডন" রূপে পরিণত হইবেন। বারবিলাসিনীদিগের মতে ইহাদিগের কপালেও অগ্নিদেব বিরাজ করিবেন।"
(সুবোধ চক্রবর্তী ১৯৯১: ১১)
ভগবান বিষ্ণুর দশ লীলা অবতারের ন্যায় বাবুদেরও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দশপ্রকার রূপে বিভক্ত করেছেন। কেরাণীবাবু রূপে তারা উচ্চ পর্যায়ের ব্রিটিশ অফিসারদের গালি নিঃশব্দে হজম করে এর শোধ নেন কেরানীর অধস্তন এদেশীয় অসহায় গরিব দপ্তরীর উপরে।মাষ্টারবাবু রূপে তারা ছাত্রদের উপরে ঝাপিয়ে পড়েন, তাদের শিক্ষক রূপের সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রদর্শন করেন। স্টেশন মাস্টারবাবু রূপে টিকিট বিহীন যাত্রীকে শিকার করেন।ব্রাহ্মবাবু রূপে গরীব পুরোহিতদের পেশায় হাত দেন। মুৎসুদ্দীবাবু রূপে ব্যবসায়ী ইংরেজদের ব্যবসাকে বিবিধ প্রকারের কৌশলে ক্ষতিগ্রস্ত করেন। ডাক্তারবাবু রূপে রোগিদের পকেট খালি করেন। উকিলবাবু রূপে মক্কেলের পকেট খালি করেন। হাকিমবাবু রূপে বিচার প্রার্থীকে বধ করেন। জমিদারবাবু রূপে প্রজা সাধারণকে অত্যাচার করেন।, পত্রিকার সম্পাদকবাবু রূপে ভদ্রলোককে নাজেহাল করেন। নিষ্কর্ম্মাবাবু রূপে সারাদিন বসে পুকুরের মাছ শিকার করে মাছেদের জীবন দুর্বিষহ করেন।
"যিনি কাব্যরসাদিতে বঞ্চিত, সঙ্গীতে দগ্ধ কোকিলাহারী, যাঁহার পাণ্ডিত্য শৈশবাভ্যস্ত গ্রন্থগত, যিনি আপনাকে অনস্তজ্ঞানী বিবেচনা করিবেন, তিনিই বাবু। যিনি কাব্যের কিছুই বুঝিবেন না, অথচ কাব্যপাঠে এবং সমালোচনায় প্রবৃত্ত, যিনি বারযোষিতের চীৎকার মাত্রকেই সঙ্গীত বিবেচনা করিবেন, যিনি আপনাকে অভ্রান্ত বলিয়া জানিবেন, তিনিই বাবু। যিনি রূপে কার্ত্তিকেয়ের কনিষ্ঠ, গুণে নিৰ্গুণ পদার্থ, কৰ্ম্মে জড় ভরত, এবং বাক্যে সরস্বতী, তিনিই বাবু। যিনি উৎসবার্থ দুর্গাপূজা করিবেন, গৃহিণীর অনুরোধে লক্ষ্মীপূজা করিবেন, উপগৃহিণীর অনুরোধে সরস্বতীপূজা করিবেন, এবং পাটার লোভে গঙ্গাপূজা করিবেন, তিনিই বাবু। যাঁহার গমন বিচিত্র রথে, শয়ন সাধারণ গৃহে, পান দ্রাক্ষারস, এবং আহার কদলী দগ্ধ, তিনিই বাবু। যিনি মহাদেবের তুল্য মাদকপ্রিয়, ব্রহ্মার তুল্য প্রজাসিসৃন্ধু, এবং বিষ্ণুর তুল্য লীলা-পটু, তিনিই বাবু। হে কুরুকুলভূষণ। বিষ্ণুর সহিত এই বাবুদিগের বিশেষ সাদৃশ্য হইবে। বিষ্ণুর ন্যায় ইহাদের লক্ষ্মী এবং সরস্বতী উভয়ই থাকিবেন। বিষ্ণুর ন্যায় ইঁহারাও 'অনন্তশয্যাশায়ী হইবেন। বিষ্ণুর ন্যায় ইহাদিগেরও দশ অবতার—যথা, কেরাণী, মাষ্টার, ব্রাহ্ম, মুৎসুদ্দী, ডাক্তার, উকিল, হাকিম, জমিদার, সম্বাদপত্রসম্পাদক এবং নিষ্কর্ম্মা। বিষ্ণুর ন্যায় ইহারা সকল অবতারেই অমিতবলপরাক্রম অসুরগণকে বধ করিবেন। কেরাণী অবতারে বধ্য অসুর দপ্তরী; মাষ্টার অবতারে বধ্য ছাত্র ; ষ্টেশ্যন মাষ্টার অবতারে বধ্য টিকেটহীন পথিক ; ব্রাহ্মাবতারে বধ্য চালকলাপ্রত্যাশী পুরোহিত ; মুৎসুদ্দী অবতারে বধ্য বণিক্ ইংরাজ ; ডাক্তার অবতারে বধ্য রোগী ; উকিল অবতারে বধ্য মোয়াক্কল ; হাকিম অবতারে বধ্য বিচারার্থী ; জমিদার অবতারে বধ্য প্রজা ; সম্পাদক অবতারে বধ্য ভদ্রলোক এবং নিষ্কর্ম্মাবতারে বধ্য পুষ্করিণীর মৎস্য।"
(সুবোধ চক্রবর্তী ১৯৯১: ১১-১২)
বাবুদের কথা ও কাজের মধ্যে কোন সামঞ্জস্য নেই। তাদের প্রয়োজনে এবং কার্যক্ষেত্রে যাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। এই বাবুগণ ইংরেজকে তাদের ইষ্টদেবতার মত মনে করে, ইংরেজের প্রসন্নতার জন্য তাদের প্রচেষ্টার অন্ত থাকে না। ব্রাহ্মধর্ম প্রচারকদের তারা গুরুর মত মানে। সংবাদপত্রকে যারা বেদের মত অনুসরণ করে এবং ন্যাশনাল থিয়েটার তাদের কাছে তীর্থের মত।এই বাবুরা নিজগৃহে জল খেলেও, বন্ধুগৃহে বা বাগানবাড়িতে তারা মদপান করেন। বেশ্যাগৃহে সুন্দরী বেশ্যাদের গালি খেতেও তাদের আপত্তি নেই। তারা তাদের ইষ্টদেবতা ইংরেজের গলাধাক্কা খেয়েও, সদা তাদের পায়ে দাসানুদাস হয়ে পরে থাকতে আপত্তি নেই। এই বাবুগণ কালো চামড়ার ইংরেজ হতে গিয়ে হাত দিয়ে ভাতসহ খাবার খাওয়াকে অসম্মানজনক মনে করে ইংরেজের মত চামচ দিয়ে সকল খাবার গ্রহণ করেন। বাবুগিরির ঘাটতি হবে বলে, এই বাবুদের অনেকেই নিজের মাতৃভাষা বাংলাতেও কথা বলতে অনিচ্ছুক। সাজগোছ করে লোকদেখানো কেতাদুরস্ত ভাবই তাদের অন্যতম সম্বল।
"যাঁহার বাক্য মনোমধ্যে এক, কথনে দশ, লিখনে শত এবং কলহে সহস্র, তিনিই বাবু। যাঁহার বল হস্তে একগুণ, মুখে দশগুণ, পৃষ্ঠে শতগুণ এবং কার্য্যকালে অদৃশ্য, তিনিই বাবু। যাঁহার বুদ্ধি বাল্যে পুস্তকমধ্যে, যৌবনে বোতলমধ্যে, বার্দ্ধক্যে গৃহিণীর অঞ্চলে, তিনিই বাবু। যাঁহার ইষ্টদেবতা ইংরাজ, গুরু ব্রাহ্মধৰ্ম্মবেত্তা, বেদ দেশী সম্বাদপত্র এবং তীর্থ “ন্যাশনল থিয়েটার”, তিনিই বাবু। যিনি মিসনরির নিকট খ্রীষ্টিয়ান, কেশবচন্দ্রের নিকট ব্রাহ্ম, পিতার নিকট হিন্দু, এবং ভিক্ষুক ব্রাহ্মণের নিকট নাস্তিক, তিনিই বাবু। যিনি নিজগৃহে জল খান, বন্ধুগৃহে মদ খান, বেশ্যাগৃহে গালি খান, এবং মুনিব সাহেবের গৃহে গলাধাক্কা খান, তিনিই বাবু। যাঁহার স্নানকালে তৈলে ঘৃণা, আহারকালে আপন অঙ্গুলিকে ঘৃণা এবং কথোপকথনকালে মাতৃভাষাকে ঘৃণা, তিনিই বাবু। যাঁহার যত্ন কেবল পরিচ্ছদে, তৎপরতা কেবল উমেদারিতে, ভক্তি কেবল গৃহিণী বা উপগৃহিণীতে, এবং রাগ কেবল সদগ্রন্থের উপর, নিঃসন্দেহ তিনিই বাবু।"
(সুবোধ চক্রবর্তী ১৯৯১: ১২)
ইংরেজের মত হতে গিয়ে বাবুরা এই ভূখণ্ডের নিজ ধর্ম ও সংস্কৃতিতে অকারণে অবহেলা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। এই বাবুগণ আত্মঘাতী, লম্পট এবং স্বার্থপর একটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠী। যারা জ্ঞানত বা অজ্ঞানত নিজের মুখে থুতু ছিটিয়ে নিজেকেই কলঙ্কিত করে। তাই বাবু নাম বাবু সংস্কৃতি কোন গৌরবের বিষয় নয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রায় দেড়শত বছর পূর্বে বাবুদের প্রসঙ্গে এত কথা লিখে যাওয়ার পরেও, আমরা বেহুশ হয়ে আজও নামের পূর্বে বাবু শব্দটি প্রতিনিয়ত ব্যবহার করে চলছি। বিষয়টি অত্যন্ত লজ্জা এবং পরিতাপের।
তথ্য সহায়তা:
১. সুবোধ চক্রবর্তী (সম্পাদিত), বঙ্কিম রচনাবলী (২য় খণ্ড), কলকাতা: কামিনী প্রকাশনী, ১৯৯১
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁