কূর্মপুরাণে সন্ন্যাস আশ্রম সম্পর্কে বলতে গিয়ে ব্যাসদেব বলেছেন, যখন সকল কিছুতেই বিতৃষ্ণা জন্ম নিবে, তখনই সন্ন্যাস অবলম্বন করবে। অর্থাৎ বিষয়ভোগে যখন বৈরাগ্য দেখা দিবে তখনই সন্ন্যাস অবলম্বন করতে হবে। সনাতন চতুরাশ্রম ব্যবস্থায় প্রত্যেক মানুষকেই জীবনের শেষ পাদে অর্থাৎ পঁচাত্তর বছর পরবর্তীতে সন্ন্যাস গ্রহণ করতে হয়।ভোগের প্রতি বিতৃষ্ণা চলে আসলেই গায়ে গৈরিক কাষায়বস্ত্র ধারণ করে সন্ন্যাস নেয়া উচিত। কূর্মপুরাণ বলেছে, সন্ন্যাসী তিনপ্রকারের। প্রথম প্রকার হলেন জ্ঞান সন্ন্যাসী। তারা সকল প্রকারের আসক্তি পরিত্যাগ করে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করেন। দ্বিতীয় প্রকার হলেন তারা, যারা সর্বদা মানুষের মাঝে পরমেশ্বরের বাণী বেদের প্রচার প্রসার করেন, তাদের বেদ সন্ন্যাসী বলে। বেদ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান গ্রন্থ। বেদের উপরেই সনাতন ধর্ম,সংস্কৃতি এবং সভ্যতা সংস্থাপিত। তাই সর্বত্র বেদের প্রচারের জন্যে শাস্ত্রে বেদ সন্ন্যাসীর নির্দেশনা করা হয়েছে। যাতে তারা, সংসারের সকল বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে এ জগতকেই স্বদেশ মনে করে সকল মানবের মাঝে আমৃত্যু বেদের প্রচার করে যেতে পারেন। তৃতীয় প্রকারের সন্ন্যাসী হলেন কর্মসন্ন্যাসী। তারা সংসার ত্যাগী সন্ন্যাসী হলেও, কর্মের মাধ্যমেই তারা জগতের লোককল্যাণ করেন।
যদা মনসি সঞ্জাতং বৈতৃষ্ণং সর্ব্ববন্তষু।
তদা সন্ন্যাসমিচ্ছন্তি পতিতঃ স্যাদ্বিপর্য্যয়ে।।
প্রাজাপত্যাং নিরূপ্যেষ্টিমাগ্নেয়ীমথবা পুনঃ।
দান্তঃ পক্বঃ কষয়াহসৌ ব্রহ্মাশ্রমমুপাশ্রয়েৎ।।
জ্ঞানসন্ন্যাসিনঃ কেচিদ্বেদ সন্ন্যাসিনঃ পর।
কর্মসন্ন্যাসিস্তন্যে ত্রিবিধাঃ পরিকীর্ত্তিতা।।
(কূর্মপুরাণ:উপবিভাগ,২৮, ৩-৫)
"যখন সকল কিছুতেই বিতৃষ্ণা জন্ম নিবে, তখনই সন্ন্যাস অবলম্বন করবে। এর বিপরীত হলে পতিত হতে হয়। ইন্দ্রিয়দমনশীল ও পরিপক্ব হয়ে প্রাজাপত্য অথবা আগ্নেয় যাগ করে কাষায়বস্ত্র পরিধান পূর্বক সন্ন্যাস আশ্রম গ্রহণ করবে। সন্ন্যাস তিন প্রকারের। জ্ঞান সন্ন্যাস, বেদসন্ন্যাস, কর্মসন্ন্যাস।"
মহাভারতের অনুশাসন পর্বের ১৪১ অধ্যায়ে আরও চারপ্রকারের সন্ন্যাসীর বর্ণনা রয়েছে। সে অধ্যায়ে ভগবান শিব দেবী পার্বতীকে সন্ন্যাসধর্মের বিস্তৃত বর্ণনা করেছেন।
হংসঃ পরমহংসশ্চ কটীচকো বহুদকঃ।
ইতি চতুর্বিধাঃ প্রোক্তাঃ ন্যাসিনস্তু বিবেকিভিঃ।।
বিবেকীরা হংস, পরমহংস, কুটীচক ও বহুদক- বৈরাগ্যের তারতম্য অনুসারে চারপ্রকার সন্ন্যাসের বিধান দিয়েছেন। এ সন্ন্যাসীরা হলেন :'হংস', 'পরমহংস', 'কুটীচক' ও 'বহুদক'। যে তীব্র বৈরাগ্যবান সন্ন্যাসীর শরীর তীর্থযাত্রাদি করতে অসর্মথ হলে তিনি তখন নিজ কুটিরে বাস করে সাধন ভজন করেন, তাঁকে 'কুটীচক-সন্ন্যাসী' বলে। ঐরূপ বৈরাগ্যবান্ পুরুষ যাঁর তীর্থপর্যটনাদির সামর্থ্য আছে, তাঁকে 'বহুদক সন্ন্যাসী' বলে। তীব্রতর বৈরাগ্যবান্ পুরুষকে 'হংস সন্ন্যাসী' বলে। প্রত্যগাত্মজ্ঞান লাভ করতে তিনগুণের পরিণামরুপ ইহলৌকিক ও পরলৌকিক সর্ববিষয়ে যিনি তৃষ্ণারহিত্যরূপ পরবৈরাগ্য লাভ করেছেন তাঁকে 'পরমহংস সন্ন্যাসী' বলে।এ চতুর্বিধ সন্ন্যাসীদের পক্ষে দশটি সাধারণ ব্রত আবশ্য পালনীয়। যথা- অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য, অপরিগ্রহ, অক্রোধ,গুরুশুশ্রুষা, শৌচ,নিষিদ্ধ আহার পরিত্যাগ এবং কায়মনোবাক্যদ্বারা প্রমাদবর্জন।
বর্তমানে অনেক সন্ন্যাসীদের নামের পূর্বে 'ত্রিদণ্ডী' শব্দটি পাওয়া যায়। আমরা অনেকেই সন্ন্যাসীদের নামের পূর্বে ত্রিদণ্ডী শব্দটি ব্যবহারের কারণ জানি না। যিনি কথাবার্তায় অত্যন্ত সংযমী; দেহ ও মন সহ সকল ইন্দ্রিয় যার নিয়ন্ত্রিত; যিনি ইন্দ্রিয়কে অকারণে প্রশ্রয় দেন না, দমনের মাধ্যমে যার নিয়ন্ত্রিত ইন্দ্রিয়ে সত্ত্বগুণ সমৃদ্ধ বুদ্ধি বিরাজ করে; তাঁকেই ত্রিদণ্ডী সন্ন্যাসী বলা হয়। কিন্তু সন্ন্যাসীদের ত্রিদণ্ডী সন্ন্যাসী নামে অবিহিত করার কারণ; সাধারণ মানুষ জানে না। এমনকি অনেক সময়ে দেখা যায় অনেক সন্ন্যাসীগণ জানেনরা। সন্ন্যাসী সর্বদাই পরমশ্রদ্ধেয়। চতুর্দশ ইন্দ্রিয়কে দমন করে সত্ত্বগুণে স্থিত হয়ে মুক্তির পথে অগ্রসর হওয়াই সন্ন্যাসীর লক্ষ্য। সকল সন্ন্যাসীদেরই ইন্দ্রিয়দমন বাধ্যতামূলক। কিন্তু এর মধ্যে, ত্রিদণ্ডী সন্ন্যাসীরা হাতে ত্রিদণ্ড ধারণের সাথে সাথে, ইন্দ্রিয় দমনের প্রতীক হিসেবে নামের সাথে ত্রিদণ্ডী শব্দটিও ব্যবহার করেন। দণ্ড শব্দের অর্থ লাটি। তাই ত্রিদণ্ডী শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হলো, হাতে তিনটি দণ্ড বা লাঠি ধারণ।
বাগ্দণ্ডঽথ মনোদণ্ডঃ কায়দগুস্তথৈব চ।
যসৈাতে নিহিতা বুদ্ধৌ ত্ৰিদণ্ডীতি স উচ্যতে॥
ত্রিদণ্ডমেতন্নিক্ষিপ্য সৰ্বভূতেষু মানবঃ।
কামক্রোধৌ তু সংযম্য ততঃ সিদ্ধিং নিযচ্ছতি॥
(মনুসংহিতা:১২.১০-১১)
"যার বাক্য, মন এবং দেহের ইন্দ্রিয়দের দমনরূপ বুদ্ধিতে যে অবস্থান করে, তাঁকে ত্রিদণ্ডী বলা হয়।
এ ত্রিদণ্ড সর্বভূতে নিক্ষেপ করে কাম, ক্রোধকে সংযত করে মানুষ সিদ্ধিলাভ করে।"
বৈষ্ণব সন্ন্যাসীদের সাধারণত ত্রিদণ্ডী সন্ন্যাসী বলা হয়। বৈষ্ণব সন্ন্যাসীগণের মধ্যে পঞ্চসংস্কারের বিধান রয়েছে। রামানুজাচার্য, মধ্বাচার্য, বিষ্ণুস্বামী, নিম্বাকাচার্য প্রমুখরা এই বৈষ্ণব সন্ন্যাসী ত্রিদণ্ডী সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন। ত্রিদণ্ডী ধারণের অর্থ হলো- দেহ, মন, বাক্যকে দণ্ড দেওয়া। শ্রীরূপ গোস্বামীও 'উপদেশামৃত' গ্রন্থের প্রথম শ্লোকে কায়মনোবাক্যে দণ্ড দানের কথা বলেছেন:
বাচো বেগং মনসঃ ক্রোধবেগং
জিহ্বাবেগমুদরপস্থোবেগম্ ।
এতান্ বেগান্ যো বিষহেত ধীরঃ
সর্বামপীমাং পৃথিবীং স শিষ্যাৎ।।
"যিনি বাক্যের বেগ, মনের বেগ, ক্রোধের বেগ ও জিহ্বা, উদর, উপস্থ ইত্যাদি ইন্দ্রিয়ের বেগ যে জ্ঞানী ব্যক্তির নিয়ন্ত্রিত; সমগ্র পৃথিবীবাসী শিষ্য হয়ে তাঁর থেকে শিক্ষা নিতে পারে।"
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।