নারায়ণহিতি প্রাসাদের ত্রিভুবনসদনে এক আকস্মিক আক্রমণে ১ জুন ২০০১, মহারাণী ঐশ্বরিয়াসহ স্বপরিবারে নিহত হন নেপালের সর্বশ্রেষ্ঠ যশস্বীরাজা পঞ্চশ্রী মহারাজ শ্রীবীরেন্দ্রবীরবিক্রম শাহদেব। পৃথিবীর সর্বশেষ সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের হিন্দুরাজা। তিনি ছিলেন অত্যন্ত লোকপ্রিয়। তাঁর জন্ম ২৮ ডিসেম্বর ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে। নেপালের জনপ্রিয় মহারাজ বীরেন্দ্র ১৯৭২ সালে তাঁর পিতা তৎকালীন রাজা মহেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেবের মৃত্যুর কারণে শাহ রাজপরিবারের দশম রাজা হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। এরপর থেকে ২০০১ সালের নেপালের রাজপরিবারে অনাকাঙ্ক্ষিত গণহত্যার পূর্ব পর্যন্ত ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন তিনি। তিনি গণতান্ত্রিক মনোভাবের পরিচয় দিয়ে নেপালে বহুদলীয় পদ্ধতিতে সরকার পরিচালনা ব্যবস্থার রূপকার ছিলেন। আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে ও আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে সুপরিচিত রাজা ছিলেন তিনি। ১৯৮০ সালে তিনি ব্রিটিশ ফিল্ড মার্শাল হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। তাঁর স্ত্রীর নাম মহারাণী ঐশ্বরিয়া রাজ্যলক্ষ্মী দেবী শাহ। তাঁর সন্তানদের নাম যুবরাজ দীপেন্দ্র, প্রিন্সেস শ্রুতি,প্রিন্স নিরাজন।মাত্র ৫৫ বছরের আয়ুর স্বল্পায়ুতে তিনি নেপালি ছাড়াও অসংখ্য মানুষের হৃদয়দেবতায় পরিণত হয়ে যান।সকল প্রজারাই তাঁকে কামনা করে। যে রাজা প্রজাসাধারণের হৃদয়দেবতায় পরিণত হয়, তার দ্বারা রাষ্ট্র কখনো ভ্রষ্ট পতিত না হয়।এ প্রসঙ্গে ঋগ্বেদ সংহিতায় বলা হয়েছে:
আ ত্বাহার্ষমন্তরেধি ধ্রুবস্তিষ্ঠা বিচাচলিঃ।
বিশস্ত্বা সর্বা বাঞ্ছতু মা ত্বদ্ৰাষ্ট্ৰমধিভ্ৰশৎ॥
(ঋগ্বেদ সংহিতা:১০.১৭৩.১)
"হে রাজন! তোমাকে আমরাই অনেছি, তুমি আমাদের মধ্যে এস, স্থির থাক, চঞ্চল কখনো হয়ে যেও না। তোমাকে সকল প্রজারাই কামনা করে। তোমার দ্বারা রাষ্ট্র যেন পতিত না হয়।"
ঠাকুরদাদা মহারাজা ত্রিভুবনের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে বাবা রাজা মহেন্দ্রের মৃত্যুতে তাঁর রাজ্যাভিষেক ঘটে। রাজা মহেন্দ্র কর্তৃক ১৯৬০ সালে নির্বাচিত সংসদের বিলুপ্তি ও ১৯৬২ সালের সংবিধান মোতাবেক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার পর স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পর রাজা বীরেন্দ্রও পূর্বেকার সনাতনী ধারা অব্যাহত রাখেন এবং স্থানীয় ও আঞ্চলিক সংস্থা হিসেবে পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় দেশ পরিচালনা করেন। তিনি নেপালের মত গরীব এবং অনুন্নত দেশকে নেপালে গণতান্ত্রিক ধারা প্রচলিত করে নেপালকে বৈশ্বিক স্তরে পরিচিত করে তুলে পৃথিবীর স্বল্প কয়েকজন অনন্য রাজাদের পরিমণ্ডলে বিরাজ করেন ।
তিনি নেপালের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ভারত, চীন এবং রাশিয়ার ব্যাপক চাপ থেকে মুক্ত রাখতে সমর্থ হন। তাঁর শাসনামলে নেপালের পর্যটন শিল্প অসম্ভব গতিতে বিকশিত হয়। ১৯৯০ এর দশকের শুরুতে গণতন্ত্রের দাবীতে আন্দোলন চাঙ্গা হয়ে উঠলেও সৈনিক এবং পুলিশের রক্তাক্ত সংঘর্ষে তা প্রশমিত হয়। তারপরও অনেকগুলো হরতাল, দাঙ্গা-হাঙ্গামাসহ ক্রমবর্ধমান চাপ ও দাবী আসতে থাকে। ফলে, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংবিধান সংশোধন কমিশন গঠন করেন এবং রাজনৈতিক পূণর্গঠনের জন্য সচেষ্ট হন। কমিশন প্রস্তাবিত সংবিধানের খসড়া ১০ সেপ্টেম্বর, ১৯৯০ তারিখে উপস্থাপন করে। এরফলে তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন ও বহুদলীয় গণতন্ত্রভিত্তিক নতুন সংবিধানে তাকে নেপালের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে তাকে রাজা হিসেবে পরিচয় করানো হয়। অবশেষে খসড়া সংবিধানটি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কে.পি. ভট্টরাই ও তাঁর সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হয় ৯ নভেম্বর, ১৯৯০ তারিখে। এছাড়াও, তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র, ক্ষমতার পৃথকায়ণ এবং মানবাধিকার সমুন্নত রাখার আপ্রাণ প্রয়াস চালান।
এক অভিশপ্ত ১ জুন ২০০১ তারিখে রাত্রি ৯.১৫ রাজা বীরেন্দ্র তাঁর নারায়ণহিতি প্রাসাদের ত্রিভুবনসদনে রাতের খাবার গ্রহণ অবস্থায় আকস্মিকভাবে তাঁর সন্তান যুবরাজ দীপেন্দ্র কর্তৃক স্বপরিবার নিহত হন । দীপেন্দ্রের গুলিতে রাজা বীরেন্দ্র ঘটনাস্থলেই মারা যান। তাঁর সাথে মহারাণী ঐশ্বরিয়া, প্রিন্স নিরাজন, প্রিন্সেস শ্রুতি এবং রাজপরিবারের আরও পাঁচজন সদস্য নিহত হন। এ রহস্যময় কথিত আক্রমণের পর যুবরাজ দীপেন্দ্রও আত্মঘাতী হয়ে গুরুতরভাবে আহত হয়ে তিনদিন মৃত্যুর সাথে লড়াই করে মৃত্যুবরণ করেন। শুধুমাত্র বীরেন্দ্রের ভাই জ্ঞানেন্দ্র ছাড়া রাজপরিবারের সকলেই মৃত্যুবরণ করেন। ব্যাপকভাবে জনশ্রুতি হলো দীপেন্দ্র নেশাসক্ত ছিলেন এবং ভারতের সিন্ধিয়া রাজপরিবারের আত্মীয় এবং নেপালি রাণা বংশের মেয়ে দেবযানী নামক তার প্রেমিকাকে রাজপরিবার কোনক্রমেই মেনে নিতে পারছিলেন না। বিক্ষুব্ধ রাজা বীরেন্দ্রে তাই তাঁর ভাই জ্ঞানেন্দ্রকে পরবর্তীকালে উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করার পথে চলছিলেন ;তাই হয়ত এ রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ড।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি কেশব প্রসাদ উপাধ্যায় ও প্রতিনিধি সভার স্পিকার তারানাথ রানাভাট-কে নিয়ে গঠিত দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি দীপেন্দ্রকেই দোষী সাব্যস্ত করে, কারণ হত্যাকাণ্ডের সময়ে দীপেন্দ্রই ছিলেন একমাত্র বন্দুকধারী। বিস্তারিত তদন্ত কার্য সম্পন্ন করা যায়নি কেননা গণহত্যার স্থান নারায়ণহিতি প্রাসাদের ত্রিভুবনসদন রাজা জ্ঞানেন্দ্রের শাসনামলে ধ্বংস করে ফেলা হয়। তাই এই শতাব্দীর সর্বশেষ সার্থক হিন্দুরাজা এবং তাঁর পরিবারের করুণ ইতিহাস আজও রহস্যময় হয়ে আছে। জানিনা এ রহস্যের পর্দা সত্যিকারভাবে কবে উন্মোচিত হবে!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে আমার অনেক নেপালি বন্ধুই বুয়েটের রশিদ হলে থাকত। তাঁদের রুমের দরজার উপরে দেখতাম মহারাণী সহ স্বর্গত মহারাজ বীরেন্দ্রের ছবি টানানো। মনে পরে একটি রুমে নেপালি কিছু মুসলিম ছেলেরা থাকতো, তাদের রুমেও একইরকম দরজার উপরে মহারাজের ছবি টানানো। তারাও দেখেছি দেবতাজ্ঞানে মহারাজাকে ভক্তি করত। বুয়েটের নেপালি বন্ধুদের কথার সাথে বাংলাদেশী পত্রিকাগুলোর কথার কোন মিল পেতাম না। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে নেপালের রাজাকে খলনায়কের চরিত্রে রূপায়িত করতে সদা ব্যস্ত ছিল। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে জানা যায়, রাজার মৃত্যু পরবর্তীতে, এর পরের দেড় দশকে নেপাল হয়ে উঠেছে পাকিস্তানী আইএসআই এর ট্রানজিট রুট। এই রুট ব্যবহার করে তারা তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত করতো।অবশ্য নরেন্দ্র মোদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবার পরে পরিস্থিতি কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে।
কমিউনিস্ট পুষ্পকমল দাহাল যাকে আমরা প্রচণ্ড নামেই চিনি, তার বিভিন্ন আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে প্রকৃতির অপূর্ব লীলাভূমি নেপাল আজ হতচ্ছাড়া এবং লক্ষ্মীছাড়া হয়ে যাচ্ছে। নেপাল পৃথিবীর একমাত্র হিন্দুরাষ্ট্র থেকে আজ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। রাজার মৃত্যুর পরে অসংখ্য প্রধানমন্ত্রী প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হতে হতে নেপালে আজ পর্যন্ত একটি স্থিতিশীল সরকার পর্যন্ত গঠিত হতে পারলো না; যা সত্যি বেদনাদায়ক। আজ এই কথাগুলো যখন লিখছি, তখন ভাবছি আমরা কি ইতিহাস থেকে কোনদিনও শিক্ষা নিবনা?
ধর্ম, সংস্কৃতি এবং ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে পৃথিবীর বুকে নেপালীদের একটি স্বতন্ত্র মর্যাদা, সৌন্দর্য ছিল।শুধু রাজনৈতিক কারণে নেপাল আজ ছন্নছাড়া!
২০০৮ সালের ২৮ মে নেপালের নবনির্বাচিত সাংবিধানিক পরিষদে রাজতন্ত্র বিলোপ এবং প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠিত হয় প্রধানমন্ত্রী গিরিজা প্রসাদ কৈরালার সময়ে । সেই সাথে সাথেই নিভে যায় নেপালের প্রায় আড়াইশ বছর ধরে জ্বলতে থাকা রাজতন্ত্রের উজ্জ্বল প্রদীপটি এবং পৃথিবীর রাজনৈতিক মানচিত্র থেকে মুছে যায় বিশ্বের একমাত্র সাংবিধানিক হিন্দুরাষ্ট্রের নাম। অবশ্য বর্তমানে হিমালয় কন্যা নেপাল রাষ্ট্রটিতে হিন্দু রাষ্ট্রের মর্যাদাকে পুনরায় ফিরিয়ে নিয়ে আসার দাবি তীব্রতর হচ্ছে। নেপালের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায় তো বটেই, মুসলিম বিভিন্ন সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকেও দেশের ব্যাপক সুশাসন ব্যবস্থার জন্যে হিন্দু রাষ্ট্রের দাবি বারবার উত্থাপন করা হচ্ছে। যদিও নেপালের সর্বশেষ রাজা হলেন জ্ঞানেন্দ্র বীরবিক্রম শাহ দেব। কিন্তু তিনি শুধুমাত্র নামেই রাজা ছিলেন। তাই লোকপ্রিয় এবং সার্থক শেষ হিন্দুরাজা হিসেবে পঞ্চশ্রী মহারাজ বীরেন্দ্র বীরবিক্রম শাহ দেবকেই আমরা এই শতাব্দীর শেষ হিন্দুরাজা বলে উল্লেখ করে তাঁর পুণ্যস্মৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্যসুমন অর্পণ করলাম।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।