বর্তমানে দলিত প্রসঙ্গটি ভারতবর্ষে বহুল আলোচিত একটি বিষয়। কারণ এই বিষয়টির সাথে সরাসরি রাজনীতি সংযুক্ত হয়ে গেলে। ভোট এবং ভোটব্যাংকের সাথে সম্পর্কিত হয়ে গেছে। মানুষকে ছোট করার মত মহাপাপ আর নেই। জন্মসূত্রে কেউ বড়ছোট হয়। সনাতন ধর্মে বিশেষ করে বেদে জাতপাত নেই। মানুষের মধ্যে কোন অসাম্যতাই কথা নেই। কিন সমাজে এই জাতপাতটি আছে। তবে ভারতের বিহার উত্তর প্রদেশের কয়েকটি স্থানকে ভারতবর্ষের অন্যান্য স্থানে এ জাতপাতের আধিক্য নেই। জাতপাত মানবতা বিরুদ্ধ। এ নিয়ে সংশয় নেই। শুধু হিন্দু সম্প্রদায় নয়; ভারতবর্ষের প্রায় সকল জাতির মধ্যেই বিভিন্ন নামে, বিভিন্ন রূপে এ জাতপাত রয়েছে। ভারতবর্ষের মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যেও জাতপাতের বৈষম্য রয়েছে। এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা বিবিসি বাংলা ৩১ মে ২০১৮ একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদনটির শিরোনাম হলো, "ভারতে মুসলমানদের অনেকেই অচ্ছুত"।
এ গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী যদিও ভারতে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে অস্পৃশ্যতা রয়েছে।কিন্তু রহস্যময় ভাবে এ বিষয়টি নিয়ে সভা সমাবেশে আলোচনা করা হয় না। বিষয়টির আলোচনা তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যেই আবদ্ধ থাকে।সামাজিক-চর্চায় অস্পৃশ্যতার বিষয়টি বিরাজমান থাকলেও এর বিরুদ্ধে মুসলিম সমাজ থেকে তেমন কোন উচ্চ বাচ্য শোনা যায় না।
২০১৪ এর অক্টোবর থেকে ২০১৫ এর এপ্রিল পর্যন্ত ভারতের উত্তর প্রদেশে এই গবেষণার তথ্য সংগ্রহ করা হয়।গবেষক হিসেবে ছিলেন, প্রশান্ত কে ত্রিবেদী, শ্রীনিবাস গোলি, ফাহিমুদ্দিন ও সুরিন্দর কুমার মিলে ভারতের ১৪টি জেলার মোট সাত হাজারের বেশি বাড়িতে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেন।ভারতে বর্তমানে প্রায় ১৪ কোটি মুসলিম নাগরিক আছে। এদের একটি বিশাল অংশ মুসলিম দলিত।কেবল হিন্দু সম্প্রদায়েই নয়, ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যেও যে 'অস্পৃশ্য' বা 'দলিত' মুসলিম আছে— সেই তথ্যই উঠে এসেছে দেশটিতে পরিচালিত সাম্প্রতিক এক গবেষণায়।
অত্যন্ত মর্মস্পর্শী সে তথ্যগুলো হলো:
১.এলাকার ধনী প্রতিবেশীদের বাড়িতে কোনো বিয়ে-সাদীর অনুষ্ঠানে দলিত মুসলিমদের নিমন্ত্রণ করা হয় না।কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে দলিত মুসলিমদের নিমন্ত্রণ করা হলেও তাদেরকে বসানো হয় আলাদা এবং তাদেরকে খাবার পরিবেশন করা হয় উচ্চবর্ণের মুসলিমদের খাওয়া শেষে। এমনকি কোনো-কোনো জায়গায় দলিত মুসলিমদেরকে ভিন্ন ধরণের প্লেটে খাবার পরিবেশন করা হয় বলেও উল্লেখ করেছেন গবেষণায় অংশ নেয়া অনেক দলিত।
২.গবেষণায় অংশ নেয়াদের মধ্যে অন্তত ৮ ভাগ দলিত মুসলিম জানিয়েছেন যে, তাদের শিশু সন্তানদেরকেও উচ্চবর্ণের শিশুদের চেয়ে আলাদা সারিতে বসানো হয়। এমনকি স্কুলেও দুপুরের খাবার গ্রহণের সময় তাদের সন্তানেরা আলাদা সারিতেই বসে।
৩.উচ্চবর্ণের মুসলিমদের জন্য যে গোরস্থান রয়েছে সেখানে দলিতদের সাধারণত কবর দিতে দেয়া হয় না বলে উঠে এসেছে এই গবেষণায়। তাদের জন্য রয়েছে আলাদা কবরস্থান। আর যদি কোনো দলিত কাউকে উচ্চবর্ণের কবরস্থানে গোর দেয়া হয় তবে সেই লাশের জায়গা হয় একেবারে কোন একটা কোণায়।
৪.বেশিরভাগ মুসলিম একই মসজিদে নামাজ আদায় করলেও দলিত মুসলিমদের অনেকেই বলছেন যে তারা প্রায় সময়ই বোধ করেন তাদের প্রতি অন্যদের এক ধরণের উপেক্ষা বা বৈষম্য।
৫.সাধারণত নিচু জাতের সব কাজ করাই দলিত মুসলিমদের কাজ বলেও মনে করা হয়।
৬.গবেষণায় অংশ নেয়া অন্তত ১৩ ভাগ দলিত মুসলিম জানিয়েছে যে, উচ্চ বর্ণের কোনো মুসলমানের বাড়িতে যদি তাদেরকে খাবার বা পানীয় জল দেয়া হয় তবে তা পরিবেশন করা হয় ভিন্ন পাত্রে। গবেষণার তথ্য মতে এর পরিমাণ শতকরা ৪৬ ভাগ।
৭.এছাড়া দলিত মুসলিমদের সাথে উচ্চবর্ণের মুসলিম ও হিন্দু কোনো সম্প্রদায়ের মানুষই মিশতে চায় না এবং তারা দলিত মুসলিমদের সাথে এক ধরণের দূরত্ব বজায় রেখে চলে বলেও উঠে এসেছে গবেষণায়।
শুধু ভারতীয় হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায় নয় এমনকি শিখদের মধ্যেও বর্ণ-ভেদ দেখা যায়। তবে, পার্সি সম্প্রদায় কিছুটা ব্যতিক্রম। ভারতবর্ষের মুসলিম সম্প্রদায় দুটি ভাগে বিভক্ত:আশরাফ এবং আতরাফ। এ আশরাফ এবং আতরাফের মধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্যের বিষয়টি হান্টার কমিশনের কাছে নবাব আবদুল লতিফ লিখিত প্রস্তাবেও সুস্পষ্টভাবে পাওয়া যায়। ১৮৮২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি লর্ড রিপন কর্তৃক গঠিত শিক্ষা কমিশনে (হান্টার কমিশন) ‘মুসলিম রাজনীতিক’ নবাব আবদুল লতিফ লিখিত প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে মুসলিম উচ্চ শ্রেণির (তাদের ভাষায় ‘আশরাফ’) ছাত্ররা ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় লেখাপড়া শিখবে, আর নিম্ন শ্রেণির (তাদের ভাষায় ‘আতরাফ’) মুসলিম ছাত্ররা, যারা জাতিগতভাবে হিন্দুদের থেকে পৃথক নয়, তারা প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলা শিখতে পারে। ( বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, অখণ্ড, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা: ১৯৯৯, পৃ. ৫২)
আশরাফ এবং আতরাফ প্রসঙ্গে অধ্যাপক
আনিসুজ্জামানের লেখাতেও পাওয়া যায়। তিনি ‘বাংলার মুসলমানদের পরিচয়-বৈচিত্র' গ্রন্থে (পৃ. ৯, ১৩, ১৫) বলেছেন:
"আশরাফ (আরবি শরিফ শব্দের বহুবচন) অর্থাৎ অভিজাত ও আজলাফ বা আরো প্রচলিত আতরাফ (আরবি আতরাফ-উন-নাস থেকে) অর্থাৎ নিম্ন শ্রেণির মানুষ। উচ্চ শ্রেণিতে থাকতেন সৈয়দ, মোগল ও পাঠানরা।
আতরাফ সমাজ গঠিত হয়েছিল দেশীয়—অর্থাৎ ধর্মান্তরিত মুসলমানদের দ্বারা। পেশায় এরা ছিল কারিগর, নাবিক, কৃষক প্রভৃতি।
উচ্চ শ্রেণির মুসলমানদের মধ্যে সুরা পান ছিল সাধারণ ব্যাপার, বহুবিবাহ ছিল প্রকট।
সমাজে এক শ্রেণির লোক বাংলা ভাষাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করত এবং তারা ছিল ওই আশরাফ সম্প্রদায়ভুক্ত।"
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।