-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

জন্মজন্মান্তরের সুকৃতি না থাকলে, কেউ ধর্মের পথে অগ্রসর হতে পারে না ।


সনাতন ধর্ম একটি সুসংবদ্ধ ধর্ম। আপাতদৃষ্টিতে মত-পথের বিভিন্ন অলিগলি দেখে, হঠাৎ বিশৃঙ্খল মনে হয়। অনেকেই না বুঝে বিভ্রান্ত হয়ে যায়। ধৈর্য ধরে একটু চিন্তার অলিগলি পাড়ি দিলেই পাওয়া যায় হিরন্ময় বৈদিক রাজপ্রাসাদ। নাটক-যাত্রাপালার কৃত্রিম রাজপ্রাসাদ দেখে মানুষ সাময়িক মুগ্ধ হলেও, তা ক্ষণস্থায়ী। এতে বসবাস করা যায় না। সনাতন সমাজের আপাতদৃষ্টিতে মত-পথের বিশৃঙ্খল অলিগলি অনেকেই না বুঝে বিভ্রান্ত হয়ে যায়। পরবর্তীতে তাদেরই অনেকে ধর্মান্তরিত হয়ে যায়। যা দুর্ভাগ্যজনক তাদের জন্যে। সনাতন ধর্ম কোন ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যক্তিপ্রবর্তিত ধর্ম নয়। সৃষ্টির শুরু থেকেই এ ধর্ম সমানতালে বহমান। মনুষ্য এবং প্রাণীকুল না থাকলেও এ ধর্ম থাকবে। কারণ, এ ধর্ম কোন সন তারিখের ইতিহাসে আবব্ধ ধর্ম নয়। তাই ধর্মের শঙ্খরবের আহ্বানে দীপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে হবে। বিষয়টি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংগীতেও স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়:

শ্রী কৃষ্ণের শঙ্খরব

"মুক্ত করো ভয়,নিজের'পরে করিতে ভর না রেখো সংশয়।
ধর্ম যবে শঙ্খরবে করিবে আহ্বান
নীরব হয়ে নম্র হয়ে পণ করিয়ো প্রাণ।
মুক্ত করো ভয়, দুরূহ কাজে নিজেরি দিয়ো কঠিন পরিচয়॥"

এ শাশ্বত ধর্মকে সংস্কার এবং জ্ঞানের অভাবে অনেকেই উপলব্ধি করতে পারে না। তারাই দিনশেষে অজ্ঞানতাকে সঙ্গী করে ধর্মান্তরিত হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে শ্রীমদ্ভগবদগীতায় বলা হয়েছে, জগতের সকলেই ধর্মের পথে, ঈশ্বরের পথে অগ্রসর হয় না। কদাচিৎ কয়েকজন হয়। সেই কদাচিৎ কয়েকজনের মধ্যে কোন একজন ভগবানকে পাবার জন্য সাধ্য-সাধনা করেন। সেই সাধনাকারীদের মধ্যে কোনও একজন ভগবানের শরণাগত হয়ে তাঁকে কিছুটা জানতে পারেন।
মনুষ্যাণাং সহস্রেষু কশ্চিৎ যততি সিদ্ধয়ে।
যততামপি সিদ্ধানাং কশ্চিন্মাং বেত্তি তত্ত্বতঃ৷৷
(শ্রীমদ্ভগবদগীতা:৭.৩)
"হাজার হাজার মানুষের মধ্যে কোন একজন আমাকে পাবার জন্য যত্ন করেন এবং সেই যত্ন কারীদের মধ্যে হয়তো কোনও একজন আমার শরণাগত হয়ে তত্ত্বতঃ আমাকে জানতে পারেন।"

সনাতন ধর্মাবলম্বী হলেও যে, ভগবানকে জানতে পারবে তা নয়।বহু জন্মান্তরের সুকৃতির ফলে তত্ত্বজ্ঞানী ব্যক্তি ‘সবকিছুই বাসুদেব’–এই জ্ঞান লাভ করে। অর্থাৎ ভগবানই যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জড় চেতন সকল কিছুর নিয়ন্তা এই জ্ঞান লাভ করে। সেই জ্ঞানের পথরেখা বেয়ে ভগবানের পথে অগ্রসর হয়ে সাধনা করে। যারা ভগবানকে কিছুটা উপলব্ধি করতে পারে ; সেই ব্যক্তিদের জ্ঞানী মহাত্মা বলা হয়। জগতে এই তত্ত্বজ্ঞানী মহাত্মাগণ অত্যন্ত সুদুর্লভ।
বহূনাং জন্মনামন্তে জ্ঞানবান্ মাং প্রপদ্যতে।
বাসুদেবঃ সর্বমিতি স মহাত্মা সুদুর্লভঃ।।
(শ্রীমদ্ভগবদগীতা:৭.১৯)
"বহু জন্মের পরে তত্ত্বজ্ঞানী ‘সবকিছুই বাসুদেব’ –এমন জ্ঞান লাভ করে আমার ভজনা করেন। জগতে এমন জ্ঞানী মহাত্মা অত্যন্ত সুদুর্লভ।"

জগতে মনুষ্য জন্মলাভ ভাগ্যের বিষয়। এবং জগতের সৃষ্টিকর্তা প্রবর্তিত সনাতন ধর্মাবলম্বী হিসেবে জন্মগ্রহণ করা পরম সৌভাগ্যের। কিন্তু এরপরেও অনেক সনাতন ধর্মাবলম্বী অভাগা ব্যক্তি এ পরমসৌভাগ্য উপলব্ধি করতে পারে না।এরা দুধ রেখে বিষাক্ত মদ খেতে চায়। বিষাক্ত মদের কার্যকারণে পরবর্তীতে তাদের বেঁচে থাকাই দায় হয়ে যায়। যতক্ষণ তাদের মদের নেশা থাকে, ততক্ষণই মাতাল হয়ে উন্মত্তের মত আচরণ করে। এরপরে যখন মদের বিষক্রিয়া বাড়তে থাকে, তখন ধীরেধীরে মৃত্যুর কোলে তারা ঢলে পরে। বিষয়টি অনেকটা আত্মহত্যার সমতুল্য। স্বেচ্ছায় এমন আত্মঘাতী হওয়া অভাগা অনেক ব্যক্তি আমাদের আশেপাশেই রয়েছে। এই অজ্ঞানতার নাগপাশে আবদ্ধ হতভাগ্য মানুষদের জন্য সত্যি করুণা হয়। কিন্তু তাদের দূরে না ঠেলে, তাদের কাছে ভগবানের শাশ্বত বাণী পৌঁছে দেয়া ককর্তব্য। তাদের কিছুটা জ্ঞানদান করা যেন তারা দুধ এবং বিষাক্ত মদের পার্থক্য সম্যকভাবে বুঝতে পারে। অমৃত এবং বিষের পার্থক্য বুঝতে পারে। আবার সকলের পার্থক্য বোঝার যোগ্যতাও থাকে না। অধিকারী না হওয়ায়, তাদের সেই বোঝার মত জ্ঞান নেই, সংস্কারও নেই। সকল জ্ঞান যদি সকলেই উপলব্ধি করতে পারতো, তবে জগতের সকল মানুষই একই প্রকারের হতো। মানুষের এ বৈচিত্র্যময় ভিন্নতা থাকতো না।বেদের মধ্যে মধু প্রসঙ্গে একটি সূক্তই আছে, নাম মধুমতী সূক্ত।আয়ুর্বেদ বা চিকিৎসা শাস্ত্রে মধুকে অমৃতের সমান বলা হয়েছে। মধু অত্যন্ত সুস্বাদু এবং উপকারী খাদ্য। কিন্তু জনশ্রুতি অনুসারে কুকুর যদি মধু খায়, তবে সে যন্ত্রণায় ছটফটিয়ে মরে যায়। অর্থাৎ মনুষ্যের জন্যে যে মধু অমৃত, সেই মধুই কুকুরের জন্য জীবনঘাতী বিষতুল্য। বিশুদ্ধ ঘি কুকুরের জন্যে ক্ষতিকর। ঘি খেলে মানুষের শরীর সুস্থ সবল এবং পরিপুষ্ট হয়। দেহে লাবণ্য চলে আসে। অথচ ঘি খেলে কুকুরের গায়ের সকল পশম চলে যায়। পশমবিহীন কুকুরটি বিকটরূপ ধারণ করে। এ প্রসঙ্গে বাংলায় একটি প্রবাদই আছে যে, "কুকুরের পেটে ঘি সয় না"। মানুষের জন্য অত্যন্ত উপকারী মধু এবং ঘি দুটোই কুকুরের জন্য ক্ষতিকর। কুকুরের পেটে যেমন ঘি সহ্য হয় না, তেমনি মাছিও বিশুদ্ধ ঘি সহ্য করতে পারে না। মাছির প্রিয় খাবার পঁচা, বাসি, পূতিগন্ধযুক্ত খাবার এবং মলমূত্রাদি। মাছি পঁচা, আবর্জনা এবং মলমূত্রাদিতেই সদাপ্রসন্ন থাকে। মাছি কখনো বিশুদ্ধ ঘিতে বসে না বা বিশুদ্ধ ঘি খায় না।ভুল করেও যদি মাছি বিশুদ্ধ ঘিয়ের উপরে বসে, তবে ছটফটিয়ে সেখানেই মারা যায়। গরম ভাত খেতে সবাই পছন্দ করে। কিন্তু বিড়াল গরম ভাত দেখলে বিরক্ত হয়। সে খেতে পারে না। নিমগাছ অত্যন্ত উপকারী একটি গাছ।এর পাতা, ছাল, ডাল থেকে ফল সকলই আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। নিমগাছের ফলের মধ্যে ব্যাপক ঔষধীয় গুণ রয়েছে, যা বহু রোগ থেকে মুক্তি দেয়। বিভিন্ন পাখি নিমফল খেলেও কাক কখনো নিমফল খায় না। নিমগাছে বসে কাক দিনরাত্রি 'কা-কা' করে ডাকলেও নিমের উপকারিতাকে সে নিতে পারে না। নিমফল অত্যন্ত উপকারী ঔষধিগুণ যুক্ত হলেও, কাক যদি ভুলেও নিমফল খায় তবে সে মরে যাওয়ার উপক্রম হয়। পৃথিবী বড় আশ্চর্যজনক। এ পৃথিবীতে এমন অনেক অমৃত সমান উপকারী বস্তু রয়েছে। কিন্তু কিছু কিছু প্রাণীর মত মানুষও অমৃত সমান উপকারী বস্তুকে গ্রহণ করতে পারে না। সবার জন্য যা কল্যাণকর অমৃততুল্য, তাদের জন্য সেই অমৃতই বিষতুল্য। 
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁