দীর্ঘ সাধনজীবনের পরিসমাপ্তি করে লোকনাথ ব্রহ্মচারী যোগবলে দেহত্যাগের মনস্থির করলেন। সে লক্ষ্যে তিনি বিবিধ পদক্ষেপ নেয়া শুরু করলেন। তৎকালীন ঢাকার নারায়ণগঞ্জে বারদীতে অবস্থিত ছিলো লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রম। স্বেচ্ছায় তিরোধানের কিছু পূর্বে সেই আশ্রমকে লোকনাথ ব্রহ্মচারী বিবিধ সংস্কারকার্য করে আশ্রমের আমূল পরিবর্তন করে ফেললেন। আশ্রমের সকল জীর্ণতা দূর করে নতুনরূপ দিলেন। লোকনাথ ব্রহ্মচারী ১৬০ বছর জীবিত অবস্থায় ছিলেন। এত সুদীর্ঘকাল তিনি কেমন করে বেঁচে ছিলেন তা এক রহস্য। যে প্রশ্নের উত্তর সনাতন যোগসাধনার মধ্যে নিহিত। দীর্ঘজীবন এবং মৃত্যু প্রসঙ্গে তিনি তাঁর শিষ্য তারাকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, “আমি মৃত্যুর সময় অতিক্রম করিয়া বাঁচিয়া রহিয়াছি । এ অবস্থায় মোহ (নিদ্রা) আসিলেই আমার পিণ্ডপাত ঘটিবে (ব্রহ্মানন্দ ভারতী ১৩৮৯: ৩০৩)।” লোকনাথ ব্রহ্মচারীর চোখে কখনো কোন নিদ্রা ছিলো না। তিনি ঘুমাতেন না।কিন্তু রাত্রে কিছু সময়ের জন্য, বিছানায় গিয়ে একটু বিশ্রাম নিতেন। তিনি বিছানায় গিয়ে বিশ্রাম করলেও, জাগ্রত অবস্থায় থাকতেন। কোন প্রকার মোহ, তন্দ্রা, নিদ্রা, আলস্য তাঁকে সামান্যতম কখনো স্পর্শ করতে পারেনি।
উল্লেখ্য যে, তারাকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় পরবর্তীতে নাম হয় ব্রহ্মানন্দ ভারতী। তাঁকে এ নামটি লোকনাথ ব্রহ্মচারীই দিয়েছিলেন। 'ভারতী' শ্রীশঙ্করাচার্য প্রবর্তিত দশনামী সন্ন্যাসীদের একটি পবিত্র উপাধি। ভারতী শৃঙ্গেরীমঠের অন্তর্ভুক্ত সন্ন্যাসী। ভারতী সন্ন্যাসীর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে শ্রীশঙ্করাচার্যের শৃঙ্গেরীমঠান্নায়ে বলা হয়েছে:
ভারতী:
বিদ্যাভরেণ সম্পূর্ণঃ সর্বং ভারং পরিত্যজন্ ।
দুঃখভারং ন জানাতি ভারতী পরিকীর্ত্যতে ॥(শৃঙ্গেরীমঠান্নায়:৭)
"যিনি সকল ভার পরিত্যাগ করে বিদ্যাভারের দ্বারা পরিপূর্ণ; এজন্য দুঃখভারকে জানেন না, তাঁকেই 'ভারতী' বলে।"
লোকনাথ ব্রহ্মচারী যেহেতু তাঁর শিষ্যকে শ্রীশঙ্করাচার্যের প্রবর্তিত দশনামী সন্ন্যাসীর উপাধি ভারতী প্রদান করেন, এতে বোঝা যায় লোকনাথ ব্রহ্মচারীও শ্রীশঙ্করাচার্যের পরম্পরায় ছিলেন।ব্রহ্মানন্দ ভারতী লোকনাথ ব্রহ্মচারী জীবিত অবস্থাতেই তাঁর থেকে বিবিধ তথ্য সংগ্রহ করে তাঁর একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনীগ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থটির নাম 'সিদ্ধ-জীবনী'। গ্রন্থটি লোকনাথ ব্রহ্মচারীর প্রথম জীবনীগ্রন্থ। লোকনাথ ব্রহ্মচারীকে নিয়ে গবেষণার প্রধানতম প্রাথমিক উৎস, এ গ্রন্থটি। সিদ্ধ-জীবনী গ্রন্থে বলা হয়েছে, তারাকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় বা পরবর্তীতে যাঁর নাম হয় ব্রহ্মানন্দ ভারতী তিনি পূর্ববর্তী জন্মে ছিলেন লোকনাথ ব্রহ্মচারীর গুরু ভগবান গঙ্গোপাধ্যায়। ভগবান গঙ্গোপাধ্যায় শিষ্য লোকনাথের কাছে প্রতিশ্রুত ছিলেন যে, তিনি পুনরায় জন্ম নিয়ে শিষ্যের সাথে মিলিত হবেন। গুরু ভগবান গঙ্গোপাধ্যায় যে মন্ত্র শিষ্য লোকনাথকে দিয়েছিলেন, লোকনাথ ব্রহ্মচারীও পুনরায় সেই মন্ত্র প্রদান করে গুরু ভগবান গঙ্গোপাধ্যায়কে প্রদান করেছিলেন। বিষয়টি অত্যন্ত আশ্চর্যের যে, পূর্ববর্তী জন্মে যিনি গুরু ছিলেন সেই ভগবান গঙ্গোপাধ্যায় এ জন্মে তারাকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় নামে শিষ্য হয়ে এসেছেন। গুরু ভগবান গঙ্গোপাধ্যায় যে মন্ত্র লোকনাথ ব্রহ্মচারীকে প্রদান করেছিলেন, সেই 'অজপা' মন্ত্রই পুনরায় গুরু ভগবান গঙ্গোপাধ্যায়ের বর্তমান জন্ম তারাকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়কে প্রদান করেছিলেন। এতেই বোঝা যায়, গুরু শিষ্য দুজনেই কত উচ্চ স্তরের সাধক ছিলেন।
যে কারণে লোকনাথ ব্রহ্মচারী হিমালয় থেকে নিম্নভূমি বঙ্গে চলে এসেছিলেন। তিনি যখন অনুভব করলেন যে তাঁর কর্ম অনেকটাই সম্পন্ন হয়েছে। তাই তিনি এ নশ্বর দেহ ছেড়ে দেয়ার জন্য কৃতসংকল্প হলেন। যোগবলে তিরোধান প্রসঙ্গে ১২৯৭ সনের জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রারম্ভে শিষ্য তারাকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়কে বলেন, “আমি সূর্যমণ্ডল ভেদ করার জন্য দুই তিন বার উঠিলাম, প্রত্যেক বার অকৃতকার্য হইয়া, নামিয়া আসিতে বাধ্য হইলাম (ব্রহ্মানন্দ ভারতী ১৩৮৯: ৩০৩)।" এ প্রসঙ্গে তিনি বিভিন্ন সময়ে আরও বলেন, "আমি ঘর হইতে বাহির হইতে জানি, কিন্তু আমি এঘর হইতে কোন ঘরে যাইব, তাহা স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছি না (ব্রহ্মানন্দ ভারতী ১৩৮৯: ৩০৪)।” যোগ্য শিষ্য বিহীন লোকনাথ ব্রহ্মচারীর বাক্য সকলেই বুঝতে পারবে না। তাদের কাছে হেয়ালিপূর্ণ মনে হবে। তাঁর বাক্যের অন্তর্নিহিত অর্থ হলো, তিনি দেহ হতে আত্মাকে স্বেচ্ছায় বের করতে পারেন, যোগবলে দেহত্যাগ করতে পারেন। কিন্তু দেহত্যাগ পরবর্তী পুনরায় জন্মগ্রহণ অথবা মুক্তি প্রসঙ্গে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত না হয়ে দেহত্যাগ করবেন না। তিনি অতিদ্রুতই যোগবলে দেহত্যাগ করবেন, বিষয়টি যখন তাঁর শিষ্যদের মাঝে প্রচারিত হলো। তখন অতি উৎসাহী কয়েকজন শিষ্য, ভক্ত তাঁকে দেহত্যাগ পরবর্তী কোন ঘরে জন্মগ্রহণ করবেন তা নিশ্চিতভাবে বলে দেয়ার জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করে দিলেন।কিন্তু লোকনাথ ব্রহ্মচারী এইসকল অবান্তর প্রশ্নের কোন সদুত্তর দেন নি। লোকনাথ ব্রহ্মচারী একজন জীবন্মুক্ত বা শ্রীমদ্ভগবদগীতায় বর্ণিত স্থিতপ্রজ্ঞ পুরুষ।জীবন্মুক্ত পুরুষের পুনরায় জন্ম হয় না। মৃত্যুতে যখন তাঁর দেহ চলে যায়, তখন সে পরবর্তীতে বিদেহমুক্তি লাভ করে। অথচ লোকনাথ ব্রহ্মচারীর শিষ্য-ভক্তরা অনেকেই জীবন্মুক্ত পুরুষের গতিবিধি জ্ঞাত ছিলো না। তাই অজ্ঞানতাবশত তারা পুনরায় কোথায় জন্ম নিবে- এ জাতীয় অবান্তর প্রশ্ন করে লোকনাথ ব্রহ্মচারীকে বিরক্ত করেছে।
বারদীর আশ্রমের পার্শ্ববর্তী এক জমিদার প্রচণ্ড কফ-রোগে মৃত্যুপথযাত্রী। তার আত্মীয় স্বজনেরা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর কাছে এসে স্বার্থপরের মত নিষ্ঠুরভাবে তাঁকে সেই রোগ গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করে।তাদের বিশেষ পিড়াপিড়িতে লোকনাথ ব্রহ্মচারী প্রচণ্ড কফ-রোগটি সেই জমিদারের শরীর থেকে নিজদেহে গ্রহণ করেন। সেই কফ-রোগটি ললোকনাথ ব্রহ্মচারীর শরীরে তাঁর যোগবলে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ছিলো।লোকনাথ ব্রহ্মচারী দেহত্যাগের দুইএক মাস পূর্বে ঐ কফ-রোগ অতিশয় প্রবল হয়ে উঠে। স্বেচ্ছায় লোকনাথ ব্রহ্মচারীর নিজিদেহে এ ভয়ংকর কফ রোগটি গ্রহণ করার কয়েকটি কারণ হতে পারে। প্রথমত শরণাগত ভক্তকে রক্ষা করা। দ্বিতীয়ত তিনি যে অতিদ্রুত চলে যাবেন, ভক্তশিষ্যদের কাছে এর একটি সংকেত দেয়া। যাতে তারা কিছুটা পূর্ব থেকেই মানসিক প্রস্তুতি নিতে পারে। প্রচণ্ড কফ রোগে তাঁর শরীর অত্যন্ত দুর্বল হয়ে যায়। সে সময়ে তাঁর হাটাচলা করতে কষ্ট হত। এ রোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “প্রাচীন কর্তারা ত্রিপাতের মধ্যে মৃত্যু -যাতনাটা গণনা করিলেন না কেন বুঝা যায় না। বাক্যবাণ—তীব্র কটূক্তি ও মরণযন্ত্রণা এই দুইটাকে পৃথক্ দুই তাপ ধরিয়া, ত্রিতাপ স্থলে পঞ্চতাপ বলিলে ভাল হইত (ব্রহ্মানন্দ ভারতী ১৩৮৯: ৩০৪)।”
লোকনাথ ব্রহ্মচারী নিজের ইচ্ছাবলে এত দীর্ঘ জীবন অতিবাহিত করে আছেন। কফ রোগটি তাঁর অতিদ্রুত যোগবলে দেহত্যাগকে ত্বরান্বিত করে। তিনি তাঁর নিত্যসেবক জানকীনাথ চক্রবর্ত্তীর নিকট জানান যে, তিনি আগামী ১২৯৭ বঙ্গাব্দের ১৯শে জ্যৈষ্ঠ, ২ জুন ১৮৯০ দেহত্যাগ করবেন। লোকনাথ ব্রহ্মচারী মৃত্যু পরবর্তীতে তাঁর গতি সম্পর্কে জানকীনাথ চক্রবর্ত্তীসহ অন্য শিষ্যদের নিকট বলেছিলেন “যদি আমার পিণ্ডপাত সময়ে পরিষ্কার দিন থাকে, রৌদ্র হয়, তবে জানিবে আমি সূর্য ভেদ করিয়া প্রস্থান করিতে পারিলাম (ব্রহ্মানন্দ ভারতী ১৩৮৯: ৩০৫)।” ব্রহ্মজ্ঞ জীবন্মুক্ত পুরুষেরা নশ্বরদেহ ছেড়ে উত্তর-মার্গ বা দেবযান আশ্রয়ে সূর্য ভেদ করে ব্রহ্মলোকে গমন করেন। মৃত্যুর পর জীবের শুক্ল-কৃষ্ণ দুটি চিরন্তন পথ সম্পর্কে বেদাদিশাস্ত্রেই বর্ণিত হয়েছে। ঋগ্বেদ সংহিতা(১০.৮৮.১৫); বেদঙ্গগ্রন্থ যাস্কের নিরুক্ত (১৪.৯); বৃহদারণ্যক উপনিষদে (৫.১০, ৬.২.১৫); ছান্দোগ্য উপনিষদে (৫.১০); কৌষীতকি উপনিষদে(১.৩); মহাভারতের শান্তিপর্বে (১৭.১৫-১৬, ১৯.১৩-১৪); বেদান্তসূত্রে (৪.৩.১-৬) বিবিধ শাস্ত্রে প্রকাশময় শুক্ল এবং অন্ধকারময় কৃষ্ণ এ দুটি মার্গের কথা বর্ণিত হয়েছে। শ্রীমদ্ভগবদগীতাতেও সুস্পষ্টভাবে বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে:
যত্র কালে ত্বনাবৃত্তিমাবৃত্তিঞ্চৈব যোগিনঃ।
প্রয়াতা যান্তি তং কালং বক্ষ্যামি ভরতর্ষভ॥
অগ্নির্জ্যোতিরহঃ শুক্লঃ যণ্মাসা উত্তরায়ণম্ ।
তত্র প্রয়াতা গচ্ছন্তি ব্রহ্ম ব্রহ্মবিদো জনাঃ॥
ধূমো রাত্রিস্তথা কৃষ্ণঃ ষণ্মাসা দক্ষিণায়নম্।
তত্র চান্দ্রমসং জ্যোতির্যোগী প্রাপ্য নিবর্ততে।।
শুক্লকৃষ্ণে গতী হ্যেতে জগতঃ শাশ্বতে মতে।
একয়া যাত্যনাবৃতিমন্যয়াবর্ততে পুনঃ॥
(শ্রীমদ্ভগবদগীতা:২৩-২৬)
"হে ভারশ্রেষ্ঠ, যে কালে শরীর ত্যাগ করলে মার্গে যোগিগণের আর পুনরায় জন্ম হয় না এবং যে কালে শরীর ত্যাগ করলে পুনরায় জন্ম হয়; তা তোমাকে বলছি।
ব্রহ্মবিৎ পুরুষগণ অগ্নির্জোতি, দিন, শুক্লপক্ষ, উত্তরায়ণ ছয় মাস—এই সময়ে দেহত্যাগ করলে, দেবযান পথে গমন করে ব্ৰহ্মকে প্রাপ্ত হন।
ধূম, রাত্রি, কৃষ্ণপক্ষ, ছয় মাস দক্ষিণায়নকালে দেহত্যাগ করলে যোগী স্বৰ্গলোক প্রাপ্ত হয়ে চন্দ্রের মত শোভা পায়। কিন্তু স্বৰ্গলোকের সুখভোগ সাময়িক; তথায় কর্মফল ভোগ শেষ করে যোগী পুনরায় জগতে জন্মগ্রহণ করে।
বৈদিকমতে এ জগত থেকে দেহত্যাগের দুটি মার্গ রয়েছে। একটি মার্গ প্রকাশময় শুক্ল এবং অন্যটি অন্ধকারময় কৃষ্ণ। এ দুটি পথ অনাদিকাল থেকে চলছে। একটি পথে মোক্ষ লাভ হয়, অপরটি পথে পুনরায় জগতে জন্ম নিয়ে জন্মজন্মান্তরের আবর্তে আবর্তিত হতে হয়।"
কুরু পিতামহ ভীষ্ম কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধে অর্জুনের অসংখ্য তীরদ্বারা ক্ষত-বিক্ষত হয়েও দেহত্যাগের জন্য উত্তরায়ণ তিথিকেই বেছে নেন।শরশয্যাগত হয়ে উত্তরায়ণের অপেক্ষায় মাঘ মাস পর্যন্ত স্বেচ্ছায় জীবিত ছিলেন। ভীষ্মের পিতা চন্দ্রবংশীয় রাজা শান্তুনু থেকে স্বেচ্ছামৃত্যু বর পেয়েছিলেন। মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখ, জৈষ্ঠ্য এবং আষাঢ় এ ছয়মাসকে উত্তরায়ণ বলে। এ সময়ে যে সকল যোগী মৃত্যুবরণ করেন, তাঁদের আর এ জগতে জন্ম নিতে হয় না। পক্ষান্তরে শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ এবং পৌষ দক্ষিণায়নের এ ছয়মাস যারা দেহত্যাগ করবেন তারা নিম্নলোক প্রাপ্ত হয়ে পুনরায় জগতে ফিরে আসে। তাই পিতামহ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত হওয়ার পরেও শরশয্যায় তৎক্ষনাৎ দেহত্যাগ না করে ৫৮ দিন পরে পৌষ সংক্রান্তিতে উত্তরায়ণের পবিত্র দিনে স্বেচ্ছায় দেহত্যাগ করেন।
লোকনাথ ব্রহ্মচারী স্বেচ্ছায় যোগবলে চলে যাবেন। এ বিষয়ে কষ্ট বুকে চেপে রেখে শিষ্য ও ভক্তগণ সকল ধরণের মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। তারা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর কাছে জানতে চায় তিরোধান পরবর্তী তাঁর শরীরের অন্তেষ্টিক্রিয়া এবং পারলৌকিক কৃত্যাদি কি প্রকারে করবে।শিষ্য এবং ভক্তদের জিজ্ঞাসায় জীবন্মুক্তপুরুষ লোকনাথ ব্রহ্মচারী উপেক্ষার সাথে বলেন, “দেহটাকে মাঠে ফেলিয়া দিতে পার, তাহাতে শকুন গৃধিনী, শৃগাল, কক্কুরের আহার চলিতে পারিবে ; জলে ভাসাইয়া দিলে মৎস্য -কচ্ছপাদিতে খাইয়া তৃপ্ত হইবে; না হয় মৃত্তিকাতে পুতিয়া রাখিও, পিপীলিকাদি কীটদিগের প্রচুর ভোজন চলিবে। দেহ-খণ্ড লইয়া শৃগাল কুক্কুরদিগকে টানাটানি করিতে দেখিলে তোমাদের অনেকের দারুণ দুঃখ হইবে। অতএব অগ্নিতে দগ্ধ করিয়া ফেলিও (ব্রহ্মানন্দ ভারতী ১৩৮৯: ৩০৬)।”
অবশেষে এলো, অত্যন্ত বিষাদের ১৯শে জ্যৈষ্ঠ দিনটি। এ কথা সত্য যে, দিনটি অত্যন্ত বিষাদের, কারণ এ দিনটিতে লোকনাথ ব্রহ্মচারী দেহত্যাগ করেছেন। কিন্তু বিষাদের সাথে সাথে দিনটি অত্যন্ত আনন্দের। কারণ, এ দিনেই ব্রহ্মজ্ঞপুরুষ লোকনাথ ব্রহ্মচারী জীবন্মুক্ত অবস্থা থেকে, বিদেহমুক্তি লাভ করে ব্রহ্মলোকে গমন করেছেন। লোকনাথ ব্রহ্মচারী দেহত্যাগ করলে, আশ্রমের সকলেই শোকে দুঃখে কিছুই না খেয়ে অভুক্ত থাকবে। তাই খুব সকালেই লোকনাথ ব্রহ্মচারী আশ্রমবাসীদের আদেশ করলেন, সকলের ভোজন বেলা ৯টার মধ্যে শেষ করতে হবে।তিনি শুধু আদেশই করলেন না, ১০টার সময়ে তদন্ত করে দেখলেন আশ্রমের সকলেরই খাবার খেয়েছে কিনা।যখন দেখলেন আশ্রমের সকলেই খাবার গ্রহণ করেছে, তখন তিনি নিশ্চিন্ত হলেন।
সেদিন আকাশ ছিলো মেঘমুক্ত পরিষ্কার। সূর্যের তাপ জ্বলজ্বল করছিল। উপযুক্ত সময় বুঝে লোকনাথ ব্রহ্মচারী আসনে স্থির হয়ে উপবিষ্ট হলেন। বস্ত্রাদি সংযোজিত তক্তায় পীঠটি সামান্য ঠেশ দেয়া ছিলো। লোকনাথ ব্রহ্মচারী যোগ অবলম্বনে নশ্বর দেহটিকে ধীরেধীরে পরিত্যাগ করলেন। তাঁর নশ্বর দেহটি কাণ্ডারীবিহীন পুরাতন জীর্ণশীর্ণ নৌকার মত সংসার সমুদ্রের তরঙ্গে ভাসতে লাগলো। এভাবে কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পরে শিষ্য, ভক্তরা উপলব্ধি করতে পারলেন লোকনাথ ব্রহ্মচারী দেহটিকে পরিত্যাগ করেছেন। কিন্তু দেহটি যোগাসনে তখনও বসা অবস্থায়। সকলেই অত্যন্ত উৎকণ্ঠার সাথে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছে তিনি তখনও দেখছেন।লোকনাথ ব্রহ্মচারীর চোখ সর্বদা নির্নিমেষ থাকত। তাঁর চোখে কখনো পলক পড়তো না। মৃত্যুর কোন চিহ্ন নেই দেহে। মনে হচ্ছে অন্যদিনের মত তিনি ধ্যানমগ্ন আছেন। পাছে ধ্যান ভঙ্গ হয় এই আশঙ্কাতে কেউ গায়ে স্পর্শ করতে সাহস করেনি। পরিশেষে বেলা সাড়ে এগারটার পরে সকলে পরামর্শ করে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর দেহস্পর্শ করতে কৃতসংকল্প হয়। সে অনুসারে দেহস্পর্শ করে ১১টা ৫৫ মিনিটের সময়ে আশ্রমবাসী বুঝতে পারলো মহাযোগী লোকনাথ ব্রহ্মচারী তিরোধান করেছেন। অত্যন্ত ব্যাথায় কাতর হয়ে ঘি ও চন্দন কাঠের সহকারে প্রজ্বলিত চিতায় ব্রহ্মজ্ঞপুরুষ লোকনাথ ব্রহ্মচারীর অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা হলো ।
লোকনাথ ব্রহ্মচারী তাঁর তিরোধানের জন্য বেছে নেন উত্তরায়ণের জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষ। তাঁর দেহত্যাগের সময়টি ছিলো মেঘমুক্ত রৌদ্রজ্বল। দিবাভাগের পূর্বাহ্নেই শাস্ত্রের সাথে সম্পূর্ণ মিল রেখে যোগ অবলম্বনে দেহত্যাগ করে গমন করেন ব্রহ্মলোকে। রেখে যান অগুনিত ভক্তকে। যে ভক্তের সংখ্যা আজও প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।শিষ্য আনন্দকান্ত নাগকে দেয়া একটি চিঠির উত্তরে লোকনাথ ব্রহ্মচারী বলেছিলেন, "রণে বনে জলে জঙ্গলে, আমাকে স্মরণ করিবা, কোন বিঘ্ন হইবেক না"। এ বাক্যটি কিছুটা পরিবর্তিত আকারে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর ভক্তদের মাঝে আজও অত্যন্ত জনপ্রিয়। তবে বাক্যটি অতিরঞ্জন মনে হলেও, বাক্যটি সত্য। বেদে বলা হয়েছে, ব্রহ্মের ন্যায় শুদ্ধ অপাপবিদ্ধ হতে পারলে, যোগী ব্রহ্মস্বরূপ হয়ে ব্রহ্মের সাথে অভেদ একাকার হয়ে যান।
ইতি নু কাময়মানোঽথাকাময়মানো
ষোঽকামো নিষ্বাম আপ্তকাম আত্মকামো ন
তস্য প্রাণা উৎক্রামন্তি ব্ৰহ্মৈব সন্ ব্ৰহ্মাপ্যেতি ॥
(বৃহদারণ্যক উপনিষদ:৪.৪.৬)
যোগ শব্দের অর্থ ঈশ্বরের সাথে যুক্ত হওয়া। যিনি যোগ করেন, তাঁকেই যোগী বলে। যে কোন পথেই ঈশ্বরের পথে যুক্ত হওয়া যায়। তাই সনাতন সাধনা পদ্ধতির সকল পথের সাথেই যোগ শব্দটি ব্যবহৃত। যেমন : জ্ঞানযোগ, কর্মযোগ, ভক্তিযোগ, রাজযোগ ইত্যাদি। নদী বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণ করে সমুদ্রের সাথে মিলিত হয়ে একাকার হয়ে যায়। আপ্তকাম যোগীও তেমনি সাধনার ফলে ব্রহ্মের সাথে সম্পূর্ণ মিলিত হয়ে যান।তখন তাঁর আর কোন স্বতন্ত্র সত্ত্বা থাকে না।আপ্তকাম যোগী লোকনাথ ব্রহ্মচারীও তেমনি, বিদেহমুক্তি লাভ করে ব্রহ্মের শক্তিতে ব্রহ্মময় হয়ে আজও ভক্তদের ডাক শুনতে পান। সে ডাক শুনে, আজও তিনি ভক্তদের রক্ষা করেন।
তথ্য সহায়তা:
১.ব্রহ্মানন্দ ভারতী, সিদ্ধ-জীবনী, কলিকাতা: সাহিত্যম্, ১৩৮৯ বঙ্গাব্দ
২. জগদীশচন্দ্র ঘোষ, শ্রীগীতা (অনূদিত), কলিকাতা: প্রেসিডেন্সী লাইব্রেরী, জানুয়ারি ২০০৬
৩.হরিপদ ভৌমিক, (সম্পাদিত), শ্রীশ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারীর অপ্রকাশিত পত্রাবলী ও বাণী