মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় সত্য হলো মৃত্যু। এ মৃত্যুর হাত থেকে কেউ বাঁচতে পারবে না। কিন্তু সেই মৃত্যু যখন বিভিন্ন রূপে বিভিন্নভাবে আমাদের সামনে ধরা দেয়, তখন এর উপরে কারো হাত থাকে না। এরপরও আমরা মৃত্যু থেকে বাঁচতে চাই। যথাসাধ্য প্রচেষ্টাও করি। কিন্তু কিছু কিছু আপন পরিজনের আকস্মিক মৃত্যু সারাজীবন কাঁদিয়ে ফেরে আমাদের। ভুলতে পারেনা বা ভোলা যায়না সেই বড় কষ্টের মৃত্যুর দুর্বিষহ স্মৃতি। বিভিন্ন প্রসঙ্গে সর্বদাই তার কথা মনে পড়ে যায়। আমার জীবনে এমনি একটি মৃত্যু হলো, সোমাদির মৃত্যু। সোমাদির স্মৃতিগুলো ভুলতে পারিনি, হয়তো সারাজীবনেও ভুলতে পারবো না। মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের কথাগুলো। নিজের অজান্তেই গানের লাইনগুলো গেয়ে চলি। আর মনে মনে ভাবি, হায়রে মানুষের জীবন!
"আমার প্রাণের 'পরে চলে গেল কে
বসন্তের বাতাসটুকুর মতো।
সে যে ছুঁয়ে গেল, নুয়ে গেল রে-
ফুল ফুটিয়ে গেল শত শত।
সে চলে গেল, বলে গেল না-
সে কোথায় গেল ফিরে এল না।"
আমার দিদিদের মধ্যে অত্যন্ত প্রিয় সোমাদি। সোমাদি আমার মেঝ মাসির একমাত্র মেয়ে। সোমাদি ৬.৫.২০২১ পশ্চিমবঙ্গের 'সঞ্জিবনী' হাসপাতালে করনার চিকিৎসারত অবস্থায় আইসিইউতে বিকাল ৪.১৫ মৃত্যুবরণ করে। সোমাদির সার্টিফিকেটের নাম ছন্দা ঘোষাল। সোমাদির জন্ম ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭ বরিশাল সদর হাসপাতালে। বরিশাল ছিলো সোমাদির মামাবাড়ি। বাঙালি হিন্দু পরিবারের প্রথা, মেয়ের প্রথম সন্তান বাবার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করে।এ প্রথাটি এখনও আছে।সোমাদি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী ছিলো। সে লক্ষ্মী বাজারের সেন্ট ফ্রান্সিস গার্লস স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে। প্রথম বিভাগে ৭৯৬ নম্বর (স্টার) পেয়ে ১৯৯৫ সালে এসএসসি পাশ করে। এইচএসসি পড়াশোনার সময়ে তার পড়াশোনা বিভিন্ন কারণবশত বাধাগ্রস্ত হয়। তাই সেন্টাল উমেন্স কলেজ থেকে ১৯৯৯ দ্বিতীয় বিভাগে সে এইচএসসি পাশ করে। সোমাদির বাবা হলেন, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী মনোরঞ্জন ঘোষাল। এবং মা হলেন সন্ধ্যা ঘোষাল। তার বাবা মা দুজনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা। ছোটকাল থেকে বড় হয় পুরাণ ঢাকার নর্থব্রুক হল রোডের ৫১ নং আগের বাসায়। পরবর্তীতে চলে আসে ২১/ ১ ই টিপু সুলতান রোডে। ২০০২ সালে সোমাদির বিয়ে হয়। শশুরবাড়ি ছিলো কিশোগঞ্জের ইটনার ধারা গ্রামে।বিয়ের পরে সোমাদির প্রথম সংসার পাতে নারিন্দায় গৌড়ীয় মঠের পাশে। সেখান থেকে নারিন্দার ভুতের গলিতে কয়েকবছর থেকে ২০১৩ সালে চলে যায় মোহাম্মদপুরে মোহাম্মদি হাউজিং সোসাইটির নিজস্ব ফ্লাটে। ওয়ারির ব্রিটিশ স্টান্ডার্ট ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। বুলবুল একাডেমিতে সংগীত-নৃত্য দুটোই শিখেছিলেন সোমাদি। দক্ষতার সাথে সংগীত-নৃত্য দুটোই শিখে বিভিন্ন পুরষ্কার পেয়েছিলেন।
সর্বদা হাসিমুখে থাকত। সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলত সোমাদি। কেউ তাকে কটুকথা বললেও, খুব একটা প্রত্যুত্তর দিত না। সোমাদি দেখতে দেবী লক্ষ্মীর মত অপূর্ব সুন্দরী ছিল। কোথাও বসে থাকলে, মনে হত কোন দেবী বসে আছে। ওর সৌন্দর্যের মধ্যে কোন উগ্রতা ছিলো না। একটা দেবীর মত স্নিগ্ধতা ছিলো। একান্তই প্রয়োজনীয় ছাড়া, খুব একটা সাজগোছ করত না সোমাদি। দেবীর সাথে সাথে ওকে দেখলে অনেক সময়ে আরেকটি বিষয় মনে হত। তা হলো- সোমাদির আকর্ষণীয় ছিল বটেই, একটি মহারাণীসূলভ ভাবগাম্ভীর্য ছিল। ওর বড় টানাটানা চোখদুটি দেখে মনে হত, দক্ষিণ ভারতের চোল, পাণ্ড্য বা সাতবাহন রাজবংশের কোন মহারাণী বুঝি বঙ্গদেশে আমাদের মাঝে।
২০২০-২১ সালের করোনাকালে সমগ্র পৃথিবীসহ দেশে অসংখ্য মানুষ আকস্মিক মৃত্যুবরণ করেছে। এ মানুষগুলোর অভাব এবং করোনাকালের ভয়াবহতা হয়তো এখনো আমরা সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পারিনি। কিন্তু অভিশপ্ত দুর্বিষহ এ করোনাকাল যখন কেটে যাবে, তখন আমরা বুঝতে পারবো এর ছোবল, এর অভিঘাত কতটা ভয়ঙ্কর ছিল। আমরা পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতিভাষ্য যখন শুনি, সেই দিনগুলোর ভয়াবহ নৃশংসতার কথা শুনে আজও আমরা আৎকে উঠি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়টা জাতির জীবনে একটি বড় রেখাচিহ্ন এঁকে দিয়ে গেছে। এখনো আমরা সেই সময়ের রেখাকে ধরে সময় নির্ধারণ করি। আজও অনেকের বয়স হিসেব করার সময়ে একটু বয়সিদের -"মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে, অথবা মুক্তিযুদ্ধের পরে" বলতে শোনা যায়। আগামীতে হয়তো এ দুর্বিষহ করোনাকালকেও সময়ের রেখাচিহ্ন হিসাবে ধরা হবে। দিনেদিনে অসহ্য হয়ে যাচ্ছে দুর্বিষহ করোনাকাল। করোনার গ্রাসে অগুনিত পরিচিত মানুষ চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেলো। জলজ্যান্ত মানুষগুলো কিভাবে হারিয়ে যাচ্ছে, ভাবলে হৃদয়ের মধ্যে একবুক কষ্ট দুমরেমুচরে ওঠে।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।