-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

ঈশ্বরই একমাত্র সদগুরু, আমার চরণ ধরিস না, আচরণ ধর -(বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী)।

সিদ্ধ পুরুষ বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী  লোকনাথ ব্রহ্মচারী সম্পর্কে সংক্ষেপে যদি কিছু কথা বলতে চাই, তবে আমি প্রথমেই লোকনাথ ব্রহ্মচারীর একটি বাণীকে অনুসরণ করেই আমাদের আলোচনা শুরু করব। লোকনাথ ব্রহ্মচারী বলেছেন যে "ঈশ্বরই একমাত্র সদগুরু, আমার চরণ ধরিস না; আচরণ ধর"। বহুল প্রচলিত বাণীটিকে গভীরভাবে লক্ষ্য করলে, দেখতে পাবেন লোকনাথ ব্রহ্মচারী সদগুরুরূপ ঈশ্বরকেই সদা অনুসরণ করতে বলেছেন; এবং সদগুরু ঈশ্বরের পথে চলা তাঁর আচরণ ধরতে বলেছেন। আমরা যদি চিন্তা করি, লোকনাথ ব্রহ্মচারীকে অনুসরণ করতে তাঁর আচরণটা কেমন হবে বা যে কিভাবে আমরা তার সেই আচরণকে ধরতে পারব? তবে আমাদের প্রথমেই জানতে হবে, আচরণ ধরার পদ্ধতিগুলো কি এবং সেই পদ্ধতিগুলো জেনেই আমরা তাঁকে অনুসরণ করতে পারব। তাই আগে সেই আচরণ ধরার পদ্ধতিগুলো ভাল করে আত্মস্থ করা প্রয়োজন। যদি আমরা পদ্ধতিগুলো ভাল করে না জানি, তবে কিভাবে তার আচরণকে ধরে সে পথে অগ্রসর হব?সেই পথ সদগুরুরূপ ঈশ্বরের পথ। বিষয়গুলো পরিপূর্ণ জানতে হলে, লোকনাথ ব্রহ্মচারী এবং তাঁর দর্শনকে বুঝতে হবে। লোকনাথ ব্রহ্মচারী শুধু একজন সিদ্ধ ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ ছিলেন না, তিনি ছিলেন আমাদের সাধন দর্শনের মূর্ত বিগ্রহ। বৈদিক পরম্পরায় উদ্ভূত যে ছয়টি দর্শন; এ দর্শনকে আমরা ভারতীয় দর্শন বা ষড়দর্শন বলে অভিহিত করি। বেদকে প্রামাণ্যগ্রন্থ হিসেবে স্বীকার করার জন্যে এ ষড়দর্শনকে আস্তিক দর্শনও বলে। আস্তিকদর্শনের এ ছয়টি দর্শন হল: ন্যায়, বৈশেষিক, সাংখ্য, যোগ, পূর্বমীমংসা বা মীমাংসা এবং উত্তরমীমাংসা বা বেদান্ত। এ ষড়দর্শনের প্রধান দুটি দর্শন হল যোগ এবং বেদান্ত। এ দর্শনদুটির উপরে সনাতন ধর্ম দর্শনের সাধনজগত সংস্থাপিত। বেদান্ত এবং যোগদর্শনের বইতে যে কথাগুলো বলা আছে, সেই সকল দার্শনিক কথাগুলো আমরা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর জীবনে হুবহু ফলিত অবস্থায় পাই। লোকনাথ ব্রহ্মচারীর জীবন হল বেদান্ত এবং যোগদর্শনের জীবন্ত বিগ্রহ। আমরা প্রশ্ন করতে পারি, লোকনাথ ব্রহ্মচারী কি করে সিদ্ধযোগী লোকনাথ হলেন? আমাদের বেদান্তে আছে যে একটি জীব লক্ষ লক্ষ জন্মের কর্মফলে বা শাস্ত্রে আছে চুরাশিলক্ষবার জন্মের ফলে মনুষ্যরূপে জন্মগ্রহণ করে। সেই জীব অনেক পুণ্যের ফলে মনুষ্য শরীরে জন্মগ্রহণ করে মনুষ্য দেহ পায়।সেই মনুষ্য অনেক গুণকর্মফলে মুক্তির পথে অগ্রসর হয়। আমরা যেহেতু জন্মান্তরে বিশ্বাস করি, সনাতন ধর্মানুসারে প্রত্যেকটি জীব মুক্তিলাভ করবে। মুক্তিলাভ না করা পর্যন্ত তার চলার পথে বিরাম নেই।কেউ হয়ত এক জন্মে মুক্তিলাভ করবে, কেউ দশজন্মে,কেউ হয়ত শতজন্মে,কেউ হাজার জন্মে, আবার কেউ একলক্ষ জন্মে।প্রত্যেকটি জীব যে মুক্তি লাভ করবে এবং সেই জীবের যে অগ্রযাত্রা এবং জীব আস্তে আস্তে যে সাধনজগতে অগ্রসর হয় তা আমরা সবিস্তারে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর জীবনে রূপায়িত দেখি। শ্রীমদ্ভগবদগীতাতে বলা আছে, কোন যোগী যদি মুক্তির একেবারে শেষপ্রান্তে গিয়ে মুক্তিলাভ না করে, মুক্তির আগেই তিনি দেহত্যাগ করেন; তবে তিনি পরবর্তী জন্মে এক জ্ঞানবান যোগীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। জন্ম থেকেই মুক্তির পথে অগ্রসর হন। এ ঘটনাটি আমরা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর জীবনেও দেখি।  অথবা যোগিনামেব কুলে ভবতি ধীমতাম্।   এতদ্ধি দুর্লভতরং লোকে জন্ম যদীদৃশম্।।   (গীতা:৬.৪২)  "যোগভ্রষ্ট ব্যক্তি সেই সকল লোকাদিতে না গিয়ে, জ্ঞানবান যোগীর কুলে জন্মগ্রহণ করেন। এইরূপ জন্ম জগতে অত্যন্ত দুর্লভতম। "  লোকনাথ ব্রহ্মচারীর পূর্ববর্তী জীবনে নাম ছিল সীতানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। এ সীতানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় দেহ অবস্থাতেই তিনি সাধনার একেবারে শেষ প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন। কিন্তু সে জন্মে সাধনার শেষপ্রান্তে পৌঁছে যাওয়ার পরেও, মুক্তির আগেই হয়ত তিনি দেহত্যাগ করেন। তাই তাঁকে মুক্তির জন্যে লোকনাথ ঘোষাল নামে আরেকবার জন্মগ্রহণ করতে হয়। লোকনাথ ঘোষাল নামে তাঁর জন্ম হয় ১৭৩০ সালের ১৮ ভাদ্র বারাসাতে,চব্বিশ পরগণার কচুয়া গ্রামে।এই লোকনাথ ঘোষাল রূপে তিনি জন্মগ্রহণ করে বাল্যকাল থেকেই তাঁর মধ্যে মুক্তির প্রবল ভাব দেখা যায়। মাত্র ১১ বছর বয়সে তাঁর উপনয়ন সংস্কার হয়। তাঁর উপনয়ন সংস্কারের সাথে সাথেই গুরু ভগবান গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতেই তাঁর পিতামাতা তাঁকে সমর্পণ করে দেয়। লোকনাথ ব্রহ্মচারীর যেদিন উপনয়ন সংস্কার হয়, তখন সাথে তাঁর প্রতিবেশী বন্ধু বেণীমাধবেরও উপনয়ন সংস্কার হয়। শিশু লোকনাথ, বেণীমাধব গুরু ভগবান গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত ধরে একসাথে গৃহত্যাগ করে। আসন্ন ব্রহ্মচর্যের প্রস্তুতি নিতে প্রথমে আসে তাঁরা দেবীতীর্থ কালীঘাটে। কালীঘাটে এসে সাধনার জগতে আস্তে আস্তে তাঁরা অগ্রসর হতে থাকেন।সেই সাধনা কিন্তু প্রথম অবস্থায় খুব সহজ ছিল। ধীরেধীরে সেই সহজ সাধন পদ্ধতিই কঠিন থেকে কঠিনতম হয়ে উঠে।  ‌কখনো একদিন একরাত্রি না খেয়ে থাকা,এর পরে এক সপ্তাহ,এর পরে এক মাস। কল্পনা করা যায় না কতটা কঠিন এ সাধনা। টানা এক মাস না খেয়ে থাকার পরে একদিন শুধু খাবার গ্রহণ করতে পারবে ; তাও আবার ঘি মিশ্রিত হবিষান্ন। লোকনাথ ব্রহ্মচারীর গুরু ভগবান গঙ্গোপাধ্যায়ে এমনভাবে তাদের দুজনকে সাধনা জগতে উদ্দীপ্ত করেছিলেন। লোকনাথ ব্রহ্মচারী এবং বেণীমাধব তারা দুজন যখন ধ্যানস্থ থাকত, সাধনায় থাকত তখন তারা দেহের সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে নির্বিকার থাকতেন। মানুষের দেহের যতরকমের মল-মূত্র ত্যাগ সহ জৈবিক বিষয়াদি আছে, সে সময়ে পর্যন্ত আসন ত্যাগ করে সাধনভঙ্গ করতেন না। নিজ আসনেই মল-মূত্র ত্যাগ করতেন। তখন গুরু ভগবান গঙ্গোপাধ্যায় মলমূত্রাদি পরিষ্কার করে আবার তাদের পাশের স্থানে বসিয়ে দিতেন। ভাবা যায় না কত কঠিন এ সাধনা। যখনই তাঁরা সাধনা করতে ধ্যান করতে বসতেন, সাথেসাথেই সেখানে অসংখ্য পিঁপড়া এসে উপস্থিত হত। পিঁপড়াদের কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে একদিন গুরুদেবকে বিষয়টি লোকনাথ ব্রহ্মচারী বললেন, "গুরুদেব আমাদের অন্যস্থানে ধ্যান করা দরকার যেখানে কোন পিঁপড়া বা অন্যকিছু নেই।"তাঁর পিঁপড়ার কামড়ের কথাগুলো শুনে গুরুদেব ভগবান গঙ্গোপাধ্যায় মৃদু হাসলেন। উত্তরে কিছুই বললেন না। পরবর্তীতে একটা সময় লোকনাথ ব্রহ্মচারী লক্ষ্য করলেন, তাদের দুজনকে ধ্যানে বসিয়ে গুরুদেব বিভিন্ন রকমের চিনি সহ মিষ্টিদ্রব্য আশেপাশে দিচ্ছেন। যাতে আরও বেশী করে পিঁপড়া আসে। পরীক্ষা করে দেখতেন তাদের ধ্যানের একাগ্রতা কতখানি।  পিঁপড়া বা সাধারণ জগত থেকে যেন আপনাকে ধ্যানের জগতে কোন প্রকারের বিরক্ত করতে না পারে।  এরকমই কঠিন সাধনার একটা পর্যায়ে তাঁর মধ্যে পূর্বজীবনের স্মৃতি চলে আসে। তাঁর পূর্বজন্মের স্মৃতি যখন আসে, তখন ধীরেধীরে সে সাধনার অনেক দৈবী উপলব্ধি করতে থাকে। তখনই লোকনাথ ব্রহ্মচারী জানতে পারেন, যে তার পূর্ববর্তী জন্মে নাম ছিল সীতানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। আস্তে আস্তে তার সকল বিষয়গুলো মনে হতে থাকে। ছবির মত ভেসে উঠে তাঁর স্মৃতিতে। লোকনাথ ব্রহ্মচারীর প্রথম জীবনীকার 'সিদ্ধজীবনী' গ্রন্থের রচয়িতা ব্রহ্মানন্দ ভারতী তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন ,"বাবা এই সীতানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে তুমি যখন লোকনাথ ঘোষাল রূপে জন্মগ্রহণ করলে এই মাঝখানের সময়টাতে তুমি কোথায় ছিলে"? সিদ্ধজীবনী গ্রন্থে লোকনাথ ব্রহ্মচারী উত্তরে বললেন, "ওরে আমার শুধু এতটুকুন মনে আছে যে, আমি অনেক আনন্দে ছিলাম"।ব্রহ্মানন্দ ভারতী আবার প্রশ্ন করেছেন,"এই আনন্দটা কি স্বর্গ"?তখন লোকনাথ ব্রহ্মচারী বলেছিলেন, "আমি এত বিস্তৃত বলতে পারবো না, কিন্তু আমি যে অনেক আনন্দে ছিলাম এটা আমার স্মৃতিতে আছে"।  এভাবেই লোকনাথ ব্রহ্মচারী ধীরেধীরে সাধনার একটা পর্যায়ে পৌঁছে জীবন্মুক্ত হয়ে যান। মানুষকে কল্যাণের মানসিকতা থেকে বিভিন্ন দেশ তিনি পর্যটন শুরু করেন। ভারতবর্ষের সীমানা পাড়ি দিয়ে আফগানিস্তান এবং পরবর্তীতে ইরানে যান। ইরান থেকে ইরাক হয়ে এরপরে তিনি সৌদি আরবে যান। আরব ভূখণ্ড থেকে এরপরে আরও পশ্চিমে ইউরোপের ফ্রান্সে উপস্থিত হন। পরবর্তীতে ইউরোপের বহুস্থানে যান। বিভিন্ন দেশ পর্যটনের একটা পর্যায়ে তিনি বৃহত্তর চীনে উপস্থিত হন।লোকনাথ ব্রহ্মচারীর জীবনী অনুসারে, তিনি যখন চীন পরিভ্রমণে যান ; তখন চীনের রাজা তখন তাকে বন্দী করে কারাগারে পাঠায়। পরবর্তীকালে অবশ্য লোকনাথ ব্রহ্মচারী অলৌকিক শক্তি দিয়ে চীনরাজার নেতিবাচক মানসিকতাকে দূরীকরণ করেন।  যখন লোকনাথ ব্রহ্মচারী আফগানিস্তান পরিভ্রমণে যান, তখন শেখ সাদী নামে একজন মুসলিম লোকের কাছে তিনি আরবি ভাষা শেখার যথাসাধ্য চেষ্টা করে। লোকনাথ ব্রহ্মচারীকে যখন এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল ,"বাবা তুমি কেন আরবি ভাষা শিখেছিলে?"। উত্তরে তিনি বলেছিলেন,"আমি দেখতে চাচ্ছিলাম মুক্তি সম্পর্কে ওদের ধর্মে কি বলা আছে।শুধু এই কৌতুহল থেকেই আমি এই বিষয়গুলো জানার চেষ্টা করেছি"। তাছাড়া তিনি যখন সৌদি আরবে ছিলেন তখন আব্দুল গফুরের সাথে তাঁর পরিচয় হয়। আব্দুল গফুর লোকনাথ ব্রহ্মচারীকে প্রশ্ন করেছিলেন,"তুমি কয়দিনের লোক"? প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে লোকনাথ ব্রহ্মচারী উত্তরে বলেছিলেন,"আমি দুই দিনের লোক। আপনি কয়দিনের"? লোকনাথ ব্রহ্মচারীর প্রশ্নে আব্দুল গফুর বলেন,"আমি চারিদিনের মনুষ্য। অর্থাৎ আমার চারি জন্মের কথা স্মরণ আছে"। লোকনাথ ব্রহ্মচারীর সাথে আব্দুল গফুরের এরপরে বিস্তারিত আলাপ হয়। এ আলাপচারিতায় আব্দুল গফুর জানান, পূর্ববর্তী জন্মে তাঁর দক্ষিণ ভারতের এক ক্ষত্রিয়ের ঘরে জন্ম হয়েছিল।  এমন অনেক বর্ণাঢ্য ঘটনা আছে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর জীবনে। লোকনাথ ব্রহ্মচারী উত্তর দিকে যেতে যেতে উপস্থিত হন মানস সরোবরে।তাঁর প্রথম জীবনীকার ব্রহ্মানন্দ ভারতী যখন জিজ্ঞেস করে, " আমি তোমার কথা দ্বারা বুঝিলাম যে, তোমরা তিব্বত দেশ পার হইয়া বহু দূরে গিয়াছ; কিন্তু মানস সরোবর যে তিব্বত দেশের মধ্যে"? উত্তরে লোকনাথ ব্রহ্মচারী বলেন,  "ওরে, তোদের মানস সরোবর যে ঘরের কোণে"।তখন ব্রহ্মানন্দ ভারতী শাস্ত্র ঘেটে দেখলেন যে, শাস্ত্রে মানস সরোবর দুইটি ; একটি মানস সরোবর আরেকটি উত্তর মানস সরোবর।পৃথিবীর একেবারে উত্তর মেরুতে অবস্থিত উত্তর মানস সরোবর। লোকনাথ ব্রহ্মচারী, বেণীমাধব ব্রহ্মচারী এবং হিতলাল মিশ্র এ তিনজনে মিলে পৃথিবীর সর্ব উত্তরে উপস্থিত হন। সে স্থানের সকলই অন্ধকার। সেই অন্ধকারের মাঝে দেড় ফিটের উচ্চতার মত মানুষ বসবাস করে।আমরা বর্তমানে এমন মানুষ বা পৃথিবীর এমন স্থানের বর্ণনা পাইনা। সেস্থানে ছয় মাস দিন এবং ছয় মাস রাত্রি। লোকনাথ ব্রহ্মচারী বর্ণিত এ স্থানগুলো বর্তমানেও অনেকটা অনাবিষ্কৃত ।লোকনাথ ব্রহ্মচারী যেহেতু ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ,আমাদের ধারণা বা বিশ্বাস যে তাঁর কথাগুলো মিথ্যা নয়।কারণ তিনি যেভাবে সে স্থানের সম্পূর্ণ ভৌগলিক বর্ণনা দিয়েছেন, তা কাল্পনিক হওয়া সম্ভব নয়। বিষয়টি নিয়ে ব্রহ্মানন্দ ভারতী লোকনাথ ব্রহ্মচারীকে প্রশ্ন করে, তখন উত্তরে ব্রহ্মচারী বাবা বলেন,"সাহেবরা অনুমান করিয়া এ সকল লিখিয়াছেন, তাহা প্রকৃত অবস্থা নহে, আমি সাহেবদিগের নিকট প্রশ্ন করিয়া এরূপ অবগত হইয়াছি"। তবে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উত্তর মেরু ভ্রমণের বর্ণনা পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের সাথে না মিললেও, হিন্দুশাস্ত্রের সাথে মেলে।  লোকনাথ ব্রহ্মচারী তাঁর শিষ্যদের কাছে নিয়মিত চিঠি লিখতেন।লোকনাথ ব্রহ্মচারীর সেই হাতে লেখা চিঠির, কয়েকটি চিঠি এখনো পাওয়া যায়।এ চিঠিগুলোর মধ্যেই আছে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর বিখ্যাত সেই বাণীটি, "রণে, বনে, জলে, জঙ্গলে যেখানেই বিপদে পড়িবে আমাকে স্মরণ করিবে,আমিই রক্ষা করিবো"। আমরা অনেকেই হয়ত জানিনা এই কথাটি লোকনাথ ব্রহ্মচারী কোথায় এবং কার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন? লোকনাথ ব্রহ্মচারীর প্রিয় শিষ্য তৎকালীন নারায়ণগঞ্জের জমিদার আনন্দকান্ত নাগকে সমূহ বিপদ থেকে রক্ষার্থে; তাকে আশ্বস্ত করে লোকনাথ ব্রহ্মচারী একটা চিঠিতে লিখেছিলেন।বাণীটি জমিদার আনন্দকান্ত নাগকে লেখা চিঠিতেই ছিল। পরবর্তীতে বাণীটি সামান্য পরিবর্তিত হয়ে জনপ্রিয় হয়। শিষ্য আনন্দকান্ত নাগকে তাঁর দেয়া চিঠির উত্তরে লোকনাথ ব্রহ্মচারী লিখলেন,   "রণে বনে জলে জঙ্গলে, আমাকে স্মরণ করিবা, কোন বিঘ্ন হইবেক না"।  চিঠিটি হরিপদ ভৌমিকের সম্পাদিত 'শ্রীশ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারীর অপ্রকাশিত পত্রাবলী ও বাণী' গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে।  লোকনাথ ব্রহ্মচারীর শতবছর পূর্বের জীবনীগ্রন্থগুলো নিয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে আমাদের গবেষণা করা অত্যন্ত প্রয়োজন।এতে আমরা আরও নতুন নতুন অনেক তথ্য পাবো।বেদান্ত এবং যোগদর্শনের সাথে তাঁর জীবনকেও ভাল করে মিলিয়ে নিতে পারব। বেদান্তে প্রথমেই বলা আছে, অধিকারী হতে। যিনি অধিকারী তিনি শত বাঁধা অতিক্রম করেও সাধন জগতে অগ্রসর হবে। লোকনাথ ব্রহ্মচারী জন্মের মাত্র এগারো বছরের মধ্যেই মুক্তি লাভের পথে অগ্রসর হয়েছে। কারণ তিনি যোগ্য অধিকারী ছিলেন। তিনি জন্মের এগারো বছরের মধ্যেই মুক্তির পথে অগ্রসর হলেন, তবে আমি কেন হচ্ছি না?এই কেন হচ্ছি না প্রশ্নের একমাত্র উত্তর হল, অধিকারী। তাই গুরু শিষ্যকে জ্ঞানদানের পূর্বে অধিকারী নিরুপণ করে নিতে হয়। অধিকারী সম্পর্কে শাস্ত্রে বলা আছে :    অধিকারী তু বিধিবৎ-অধীতবেদবেদাঙ্গত্বেন আপাততঃ অধিগত-অখিল-বেদার্থঃ অস্মিন্ জন্মনি জন্মান্তরে বা কাম্যনিষিদ্ধবর্জনপুরঃসরং নিত্য-নিমিত্তিক-প্রায়শ্চিত্ত-উপাসনা-অনুষ্ঠানেন নির্গত-নিখিল-কল্মষতয়া নিতান্ত-নির্মল-স্বান্তঃ, সাধনচতুষ্টয়সম্পন্নঃ প্রমাতা।  (বেদান্তসার:৬)    "বেদান্তের অধিকারী তাঁকেই বলা হয়, যিনি এজন্মে বা আগেকার পূর্ববর্তী জন্মে বিধিপূর্বক বেদবেদান্ত পাঠ করে মোটামুটি অর্থ বুঝেছেন, কাম্য-কর্ম ও শাস্ত্র-নিষিদ্ধ কর্ম ত্যাগ করে নিত্য নৈমিত্তিক, প্রায়শ্চিত্ত ও উপাসনা করে সকল পাপ দূর করে অত্যন্ত নির্মল চিত্তের অধিকারী হয়ে চারটি সাধনকে অবলম্বন করেছেন।"  অধিকারীর ব্রহ্ম বা বেদান্তের প্রতি আগ্রহ তখনই জন্মাবে, যখন ভাল করে তিনি বেদ-বেদান্তের মাহাত্ম্য নিজ অন্তরে উপলব্ধি করবেন। প্রথমেই বেদ-বেদান্ত সবকিছু আপনার ভাল করে পড়তে হবে,জানতে হবে।এর পরবর্তীতে নিত্য নৈমিত্তিক যে দায়িত্ব তা নিষ্ঠার সাথে পালন করতে হবে। নিত্যকর্ম হল প্রতিদিনের সন্ধ্যাবন্দনা। এর সাথে নৈমিত্তিক বিভিন্ন কর্মও করতে হবে। কোন নিমিত্ত উপলক্ষে যে কর্ম করতে হয়, তাকে নৈমিত্তিক কর্ম বলে। যেমন: দুর্গাপূজা, শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী ইত্যাদি বাৎসরিক পূজাকে নৈমিত্তিক কর্ম বা নৈমিত্তিক পূজা বলে।এর সাথে থাকবে প্রায়শ্চিত্ত এবং উপাসনা। অধিকারীর এ সকল বৈশিষ্ট্য ধারণ করার ফলে, অধিকারীর মনের মধ্যে ব্রহ্মের প্রতি একটি সুতীব্র আকর্ষণ জন্মাবে। এতে সাধক আস্তে আস্তে ব্রহ্মের পথে অগ্রসর হবেন।সকল বাঁধা অতিক্রম করে সাধক যখন অগ্রসর হবেন, তখনই ব্রহ্মকে জেনে জীবন্মুক্ত হতে পারবেন।ব্রহ্মের পথে সাধক কিভাবে চলবে, এর সকল প্রক্রিয়া বেদান্তে এবং যোগদর্শনের সাধন পদ্ধতিগুলোর মধ্যে দেয়া আছে।যোগদর্শনের মধ্যে একজন যোগীর সাধনজগতের পথে চলতে করণীয় সম্পূর্ণ পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে। যোগদর্শনে যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধ্যান,ধারণা সমাধি -যোগের এ আটটি অঙ্গের কথা বিস্তৃতভাবে বলা হয়েছে বিভিন্ন সূত্রে। যোগদর্শনের প্রত্যেকটি সূত্রের যদি দৃষ্টান্ত হিসেবে কাউকে গ্রহণ করতে হয়; তবে লোকনাথ ব্রহ্মচারীই চোখের সামনে আমাদের এক জ্বাজ্জল্যমান দৃষ্টান্ত। লোকনাথ ব্রহ্মচারীর সম্পূর্ণ সাধনজীবন যোগসূত্র এবং বেদান্তসূত্রের সকল সূত্রের সাথে মিলে যায়। বিষয়টি নিয়ে আরও গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।    যম-নিয়মাসন-প্রাণায়াম-প্রত্যাহার-ধারণা-ধ্যানসমাধয়োঽষ্টাবঙ্গানি।।  (পাতঞ্জলযোগসূত্র: সাধনপাদ, ২৯)  ‌"যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি-এই আটটি যোগের অঙ্গসরূপ।"  ‌অহিংসা সত্যাস্তেয়-ব্রহ্মচর্যাপরিগ্রহা যমাঃ।  ‌(পাতঞ্জলযোগসূত্র: সাধনপাদ, ৩০)  ‌"অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য ও অপরিগ্রহ-এইগুলিকে যম বলে।"  ‌শৌচ-সন্তোষ-তপঃ-স্বাধ্যায়েশ্বরপ্রণিধানানি নিয়মাঃ।  ‌(পাতঞ্জলযোগসূত্র: সাধনপাদ, ৩২)  ‌"শৌচ, সন্তোষ, তপ, স্বাধ্যায় ও ঈশ্বর-প্রণিধান-এইগুলি নিয়ম।"  ‌স্থিরসুখমাসনম্।  ‌(পাতঞ্জলযোগসূত্র:সাধনপাদ, ৪৬)  ‌"যে অবস্থায় অনেকক্ষণ স্থিরভাবে ও সুখে বসা যায়, তাহার নাম আসন।"  ‌তস্মিন্ সতি শ্বাসপ্রশ্বাসয়োর্গতিবিচ্ছেদঃ প্রাণায়ামঃ।  ‌(পাতঞ্জলযোগসূত্র: সাধনপাদ, ৪৯)  ‌"আসন জয়ের পর শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি সংযম করাকে প্রাণয়াম বলে।"  ‌স্বস্ববিষয়াসম্প্রয়োগে চিত্ত-স্বরূপানুকার ইবেন্দ্রিয়াণাং প্রত্যাহারঃ।  ‌(পাতঞ্জলযোগসূত্র: সাধনপাদ, ৫৪)  ‌"ইন্দ্রিয়গুলি যখন নিজ নিজ বিষয় ত্যাগ করিয়া চিত্তের স্বরূপ গ্রহণ করে তখন তাহাকে প্রত্যাহার বলে।"  ‌দেশবন্ধশ্চিত্তস্য ধারণা।  ‌(পাতঞ্জলযোগসূত্র: বিভূতিপাদ, ১)  ‌"চিত্তকে কোন বিশেষ বস্তুতে সংলগ্ন রাখাকে 'ধারণা' বলে।"  ‌তত্র প্রত্যয়ৈকতানতা ধ্যানম্।  ‌(পাতঞ্জলযোগসূত্র: বিভূতিপাদ, ২)  ‌"সেই বস্তুবিষয়ক জ্ঞান সর্বদা একইভাবে প্রবাহিত হইলে তাহাকে 'ধ্যান' বলে।"  ‌তদেবার্থমাত্রনির্ভাসং স্বরূপশূন্যমিব সমাধিঃ।  ‌(পাতঞ্জলযোগসূত্র: বিভূতিপাদ, ৩)  ‌"ধ্যানের দ্বারা বাহ্য উপাধি পরিত্যাগপূর্বক কেবলমাত্র অর্থ প্রকাশিত হইলে তাহাকে "সমাধি' বলে।"  লোকনাথ ব্রহ্মচারীর প্রাচীন জীবনীগ্রন্থগুলো পড়লে দেখা যায় প্রচারবিমুখ নিষ্কপট ছিলেন তিনি। ব্রহ্মানন্দ ভারতী লিখিত প্রথম জীবনীগ্রন্থ সিদ্ধজীবনী শুরুতেই দেখা যায়, তাঁর যখন জীবনী লেখা হচ্ছিল তখন তিনি ব্রহ্মানন্দ ভারতীকে তীব্র আপত্তি জানিয়ে বলেছিলেন:  "আমার আবার একটা জীবনী! "রামায়ণ" রয়েছে, "মহাভারত" রয়েছে, তাতে চলে না?  ......যা যা রেখে দে তোর দোয়াত কলম, আমার জীবনী লিখতে হবে না"।  রামায়ণ,মহাভারত যদি আমরা ভাল করে পড়ি তাহলে বাবা লোকনাথকে জানতে পারবো। তিনি বলেছেন তাঁর জীবনী না লিখে রামায়ণ মহাভারত ভাল করে মর্মার্থ সহকারে পড়তে। তিনি বলেছেন আগে মানুষ হতে। রামায়ণ,মহাভারত পড়ে কয়জন মানুষ আমরা রাম-লক্ষ্মণ বা যুধিষ্ঠিরের মত শুদ্ধ হতে পেরেছে।  ব্রহ্মচারী গীতা পড়ার চাইতে গীতা হতে বলেছেন।গীতা হতে কেন বলেছেন?কেননা আমরা যদি গীতাকে উপলব্ধি করতে পারি,গীতার জ্ঞানকে ধারণ করতে পারি ; তবে সাধনতত্ত্বের অধিকাংশই যথাসম্ভব বুঝতে পারব।লোকনাথ ব্রহ্মচারীর একটি বাণীর মধ্যে আছে যে,"আমি তোর হরির মুখে প্রস্রাব করি।" জীবনীগ্রন্থে আছে ঘটনাটি। এ বাণীটি দেখিয়ে অনেকেই বলে থাকেন, "বাবা লোকনাথ একজন সিদ্ধযোগী হয়ে হরির মুখে প্রস্রাব করার কথা কি করে বলতে পারলেন?" কিন্তু তারা একবারও চিন্তা করে দেখেন না যে, এই জগত যদি ব্রহ্মময় হয়; সেই ব্রহ্ম যদি সর্বভূতে বিরাজ করেন, তবে এই কথাটিতে সমস্যা কোথায়? জগতের প্রত্যেকটি অণুতে পরমাণুতে , যেখানেই চোখ যায় ; সেখানেই শ্রীহরির অবস্থান। বৈষ্ণব কবিরা বিষয়টি অত্যন্ত সুন্দর ভাষায় বলেছেন। জগতের সকল স্থানেই যদি শ্রীহরির স্ফুরিত হয়, জগতের প্রত্যেকটি স্থানেই যদি তাঁর চোখ, মুখ সহ সকল অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিরাজ করে ; তবে আপনি যেখানেই প্রস্রাব করবেন শ্রীহরি সেখানেও আছে। প্রত্যেকটি জীবের মধ্যেই তিনি আছেন।এই জগতে সৃষ্ট দুটি কারণের কারণ তিনি। প্রথমত নিমিত্ত কারণ;এ জগত যে বুদ্ধিসত্ত্বা দিয়ে পরিচালিত হয়, তাকে নিমিত্ত কারণ বলে। অন্যটি হল উপাদান কারণ; এ জগতের জড় চেতন প্রত্যেকটা উপাদানে তিনি বিরাজমান এটা উপাদান কারণ।  লোকনাথ ব্রহ্মচারীর জীবনী খুব ভাল করে পড়লে উপলব্ধি করা যায় যে, তিনি ঠিক কি চেয়েছেন।তিনি চেয়েছেন আমরা যেন সত্যিকারভাবে বেদ-বেদান্তের পথে অগ্রসর হতে পারি এবং বেদান্তে যে মুক্তির বাণী দেয়া আছে, এর মাধ্যমে সাধন জগতে অগ্রসর হতে পারি।লোকনাথ ব্রহ্মচারীর বাণীগুলা সম্যক উপলব্ধি করতে পারলে, ধীরেধীরে আপনার এক বেদান্ত বোধ জন্মাবে। আপনি নিজেকে জানতে পারবে, এরপরে নিজেকে জানার মাধ্যমে ব্রহ্মকে জানার পথে অগ্রসর হতে পারবেন। ব্রহ্মকে জানতে পারলে আপনার সমস্ত বন্ধন কেটে যাবে। লোকনাথ ব্রহ্মচারী উত্তর মেরুতে ছিলেন, তিনি মানস সরোবরে ছিলেন,তিনি পাহাড়ে পাহাড়ে ছিলেন, তিনি কেন এই হিংসা-বিদ্বেষময় লোকালয়ে আসলেন? তিনি এসেছেন লোকশিক্ষার জন্যে, সাধারণ মানুষকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য।  কারণ হিমালয় থেকে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর মত কিছু যোগীপুরুষ যদি মাঝেমধ্যে লোকালয়ে না আসত, তবে আমরা সাধন পথের গ্রন্থগুলোতে যে কথাগুলো বলা আছে ; এর চোখের সামনে দৃষ্টান্ত পেতাম না। যোগী এবং তাঁদের পবিত্র জীবন শুধু গ্রন্থেই সীমাবদ্ধ থাকত। তখন নিজেদের সীমাবদ্ধতা থেকে আমরা তাদের জীবনকে অবিশ্বাস করতাম। দিনের পর দিন মাসার্হ ব্রত করলে যে পূর্বজন্মের স্মৃতি অবগত হওয়া যায়।কথাটি আমাদের শাস্ত্রে আছে।কিন্তু, দৃষ্টান্ত হয়ে কে দেখিয়ে দিয়েছেন আমাদের? লোকনাথ ব্রহ্মচারী দেখিয়ে দিয়েছেন।ঠিক একইভাবে এ যোগীপুরুষরা আসেন,আমাদের হিতার্থে।এই কথা লোকনাথ ব্রহ্মচারীও বলেছেন, "সাধকানাং হিতার্থায় ব্রহ্মণো রূপকল্পনম।ইহা ত জান"। ঈশ্বর এক অদ্বিতীয় সাধকের কল্যাণে অরূপের রূপকল্পনা হয়। তিনি বহু নন, বহুরূপ সাধকের হিতার্থের জন্য; আপনার, আমার আমাদের জন্য বিভিন্ন রূপ।আমাদের অনেকে সমালোচনা করে যে আমরা বহু ঈশ্বর পূজা করি। কথাটি সত্য নয়, লোকনাথ ব্রহ্মচারীও বিভিন্ন সময়ে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন।অনেকে বলে আমরা মূর্তিপূজা করি; আমরা কোন মূর্তিপূজা করি না।আমরা মূর্তিকে প্রতিমায় রূপান্তরিত করে পরমেশ্বরের উপাসনা করি। বিভিন্ন রূপে আমরা এক পরমেশ্বরই উপাসনা করি। বেদের বিভিন্ন মন্ত্রে অত্যন্ত সুন্দর এবং স্পষ্ট করে বিষয়টা বলা আছে:  ইন্দ্রং মিত্রং বরুণমগ্নি-মাহু রথো  দিব্যঃ স সুপর্ণো গরুত্মান্।  একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি  অগ্নি যমং মাতরিশ্বানমাহুঃ।।  (ঋগ্বেদ: ১.১৬৪.৪৬)  "সেই সদ্বস্তু অর্থাৎ পরব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয়। কিন্তু জ্ঞানীগণ তাঁকেই ইন্দ্র, মিত্র, বরুণ, অগ্নি, দিব্য (সূর্য্য), সুপর্ণ, গরুড়, যম, বায়ু ইত্যাদি বিভিন্ন নামে অভিহিত করে থাকেন।"  ন দ্বিতীয়ো ন তৃতীয়শ্চতুর্থো নাপুচ্যতে।  ন পঞ্চমো ন ষষ্ঠঃ সপ্তমো নাপুচ্যতে।  নাষ্টমো ন নবমো দশমো নাপুচ্যতে।  য এতং দেবমেক বৃতং বেদ।।  (অথর্ববেদ:১৩.৪.২)  "পরমাত্মা এক, তিনি ছাড়া কেহই দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম বা দশম ঈশ্বর বলে অভিহিত হয় না। যিনি তাঁহাকে শুধু এক বলে জানেন একমাত্র তিনিই তাঁকে প্রাপ্ত হন।"  সেই এক অদ্বিতীয় পরমেশ্বরকেই বহু বলে হলেও, তিনি কিন্তু বহু নয়।এ বিষয়গুলো আমাদেরকে উপলব্ধি করা প্রয়োজন।আমরা বর্তমানে লোকনাথ কাছে শুধুই জাগতিক সিদ্ধি চাচ্ছি। লোকনাথ ব্রহ্মচারী সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, "আমার চরণ ধরিস না, আচরণ ধর।" কিন্তু আমরা শুধু চরণ ধরার ব্যবস্থাই করছি। তাঁর আচরণ কেউ ধরতে চাচ্ছি না; আচরণ ধরতে তো অনেক কষ্ট। আমরা শুধু বলছি বাবা এটা দাও,ওটা দাও,সেটা দাও ; যদি বাবা মনবাসনা পূর্ণ করেন তবেই আমরা আমাদের প্রকৃত স্বরূপ দেখিয়ে দেই। তখন বলে বেড়াই, বাবা লোকনাথকে মানি না, তাঁর কোন শক্তি নেই ইত্যাদি।সিদ্ধযোগী লোকনাথ ব্রহ্মচারীর যে শক্তি; সেই শক্তিটা আদতে ব্রহ্মের শক্তি। বিষয়টি বেদের উপনিষদে সুন্দর করে বলা আছে। সাধক সাধনার একটা পর্যায়ে অযাচিতভাবে অণিমা, মহিমা, লঘিমা, প্রাপ্তি, প্রাকাম্য,ঈশিত্ব,বশিত্ব এবং কামাবসায়িত্ব এ অষ্টসিদ্ধি লাভ করে।  মানুষ গাছ লাগায় ফল পাওয়ার জন্য। কিন্তু সেই ফলগাছে অযাচিতভাবে অক্সিজেন এবং ছায়াও পেয়ে যায়।ঠিক একইভাবে সাধক পুরুষ মুক্তিলাভের জন্য সাধনা করেন, কিন্তু অযাচিতভাবে তিনি অষ্টসিদ্ধি পায়, এ অষ্টসিদ্ধিকে বাজেসিদ্ধিও বলা হয়।সে চাইলে অন্যের মনের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে,মনের কথা জানতে পারে,বাতাসের মত হালকা হয়ে যেতে পারে,পাহাড়ের মত ভারী হয়ে যেতে পারে।এই সকল বিষয়গুলো কিন্তু সাধনজগতে আছে।আপনি আমি চাইলে, যদি সাধন জগতে অগ্রসর হতে পারি তবে এ অষ্টসিদ্ধি পেতে পারি; এটা সম্ভব।প্রচেষ্টা থাকলে আমরা প্রত্যেকেই সাধনজগতে অগ্রসর হতে পারি এবং সত্যিকারের জ্ঞান পেতে পারি।আমরা বেদান্ত এবং যোগদর্শনে জীবের মুক্তি লাভের যে তত্ত্ব পেয়েছি তার বাস্তব প্রতিমূর্তি ছিলেন বাবা লোকনাথ। তাই বাবার সেই দেখানো পথে আমাদের প্রত্যেকেরই লক্ষ্য হওয়া উচিত মুক্তির পথে অগ্রসর হতে তাঁর পথ এবং বাক্যানুসরণ।  আমরা অনেকেই ব্যক্তি গুরুর কথা অন্ধের মত অনুসরণ করি। একবার ভেবেও দেখি না গুরুর কথা কতটা বেদান্তবাক্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু লোকনাথ ব্রহ্মচারী বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের সুন্দর সমাধান দিয়েছেন। তনি বলেছেন, "গুরুবাক্য পাইলে, এখন বেদান্তবাক্যের সঙ্গে মেলাও। এর দ্বারা নিদিধ্যাসন পযর্ন্ত করতে পারবে"। অর্থাৎ অন্ধের মত গুরুকে অনুসরণ নয়, গুরুর বাক্য যদি বেদান্তবাক্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তবেই গুরুকে অনুসরণ করতে হবে, নচেৎ নয়।তিনি মাটির মত সর্বংসহা হতে বলেছেন। চাইলেই আগে সোনা হওয়া সম্ভব নয়, আগে মাটির মত হতে হয় "সোনা হবি তো, আগে মাটি হ"। নিজের যোগ্যতাতেই নিজের বড় হতে প্রেরণা দিয়েছেন লোকনাথ ব্রহ্মচারী। জগতের প্রত্যেকটি জীবের মধ্যেই অনন্ত শক্তি আছে, আমরা সেই আত্মশক্তি জাগরিত করতে পারিনা বলে হীনমন্যতা আমাদের গ্রাস করে। এ বিষয়টি নিয়ে লোকনাথ ব্রহ্মচারী বলেন,"স্বনাম পুরুষ ধন্য, তুই ত তোর নিজের নামেই ধন্য রে। তবে তুই আমার নাম করে বড় হতে চাস কেন"?  একইভাবে আমরা দেখতে পাই, লোকনাথ ব্রহ্মচারী শুধু মুক্তির পথ নয়, বাস্তব জগতে বর্তমান কালের জন্যেও তাঁর অমৃতময় বাণী অনেক বেশী প্রাসঙ্গিক। লোকনাথ ব্রহ্মচারী ঈশ্বরকেই গুরু বলে যেমন চরম আধ্যাত্মিক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, সাথে সাথে জাগতিক মানুষ গুরুদের সম্পর্কে তাঁর নির্দেশনা অত্যন্ত গুরুত্ববহ। তিনি বলেছেন:"গুরু কে? ঠেকা।যে যে স্থানে ঠেকে,সে সেই স্থানেই শিক্ষা পায়।যার আদেশ তুমি অনুসরণ কর তিনিই তোমার গুরু।" আমাদের অনেক গুরুরাই নিজেরা সত্যকে অনুভব না করে অন্যদের শেখাতে যায়, কিছুকিছু ক্ষেত্রে জোর করেও শিখাতে যায়। এ বিষয়ে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর মতামত হল, "তুমি যা অনুভব করতে পারনি, তা কাউকে বলো না"। তিনি আরও বলেছেন, "আমি যোগী, নিজে প্রত্যক্ষ ভিন্ন অন্য কিছুই মানি না।যা আমার গোচর নয়,তা আছে বলে তোমাদের মতো ধারনা আমার নেই"। আমরা অনেকেই শুধু অন্যকে জ্ঞান দেই, যা নিজের জীবনে প্রয়োগ করি না। তিনি সবাইকে উপদেশ কম দিয়ে কাজ করতে বলেছেন, "বসা উপদেশ দেওয়া এক প্রকার কথা বিক্রি। সেটা আমার মিঠা লাগে না। কাজ চাই, কাজটা আমার ইষ্ট,তাই পেয়ারা"।কথাগুলো অনেক বেশী বাস্তবসম্মত এবং সময়োপযোগী। এ মহামূল্যবান কথাগুলোকে যদি আমরা আমাদের জীবনে প্রয়োগ করতে পারি, তবেই আমরা সত্যিকারের লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আচরণ ধরতে পারব। এবং সেই পথে সাধনজগতে অগ্রসর হয়ে মুক্তির পথে যেতে পারব।সিদ্ধযোগী লোকনাথ ব্রহ্মচারী বলেছেন, তাঁর আচরণ ধরতে।কিন্তু আমরা 'আচরণ' থেকে 'আ' উপসর্গটি বাদ দিয়ে চরণ ধরা নিয়েই সদাব্যস্ত। এতে জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক উভয়কূলই দিনশেষে হারাতে হয়।আমরা যদি আমাদের ভিতর লুকিয়ে থাকা অনন্তশক্তিকে জাগিয়ে তুলতে পার; তবেই দুর্লভ মনুষ্যজন্ম আমাদের সার্থক হবে।   শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ। দেখুন ইউটিউবে ঃ
সিদ্ধ পুরুষ বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী

লোকনাথ ব্রহ্মচারী সম্পর্কে সংক্ষেপে যদি কিছু কথা বলতে চাই, তবে আমি প্রথমেই লোকনাথ ব্রহ্মচারীর একটি বাণীকে অনুসরণ করেই আমাদের আলোচনা শুরু করব। লোকনাথ ব্রহ্মচারী বলেছেন যে "ঈশ্বরই একমাত্র সদগুরু, আমার চরণ ধরিস না; আচরণ ধর"। বহুল প্রচলিত বাণীটিকে গভীরভাবে লক্ষ্য করলে, দেখতে পাবেন লোকনাথ ব্রহ্মচারী সদগুরুরূপ ঈশ্বরকেই সদা অনুসরণ করতে বলেছেন; এবং সদগুরু ঈশ্বরের পথে চলা তাঁর আচরণ ধরতে বলেছেন। আমরা যদি চিন্তা করি, লোকনাথ ব্রহ্মচারীকে অনুসরণ করতে তাঁর আচরণটা কেমন হবে বা যে কিভাবে আমরা তার সেই আচরণকে ধরতে পারব? তবে আমাদের প্রথমেই জানতে হবে, আচরণ ধরার পদ্ধতিগুলো কি এবং সেই পদ্ধতিগুলো জেনেই আমরা তাঁকে অনুসরণ করতে পারব। তাই আগে সেই আচরণ ধরার পদ্ধতিগুলো ভাল করে আত্মস্থ করা প্রয়োজন। যদি আমরা পদ্ধতিগুলো ভাল করে না জানি, তবে কিভাবে তার আচরণকে ধরে সে পথে অগ্রসর হব?সেই পথ সদগুরুরূপ ঈশ্বরের পথ। বিষয়গুলো পরিপূর্ণ জানতে হলে, লোকনাথ ব্রহ্মচারী এবং তাঁর দর্শনকে বুঝতে হবে।

লোকনাথ ব্রহ্মচারী শুধু একজন সিদ্ধ ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ ছিলেন না, তিনি ছিলেন আমাদের সাধন দর্শনের মূর্ত বিগ্রহ। বৈদিক পরম্পরায় উদ্ভূত যে ছয়টি দর্শন; এ দর্শনকে আমরা ভারতীয় দর্শন বা ষড়দর্শন বলে অভিহিত করি। বেদকে প্রামাণ্যগ্রন্থ হিসেবে স্বীকার করার জন্যে এ ষড়দর্শনকে আস্তিক দর্শনও বলে। আস্তিকদর্শনের এ ছয়টি দর্শন হল: ন্যায়, বৈশেষিক, সাংখ্য, যোগ, পূর্বমীমংসা বা মীমাংসা এবং উত্তরমীমাংসা বা বেদান্ত। এ ষড়দর্শনের প্রধান দুটি দর্শন হল যোগ এবং বেদান্ত। এ দর্শনদুটির উপরে সনাতন ধর্ম দর্শনের সাধনজগত সংস্থাপিত। বেদান্ত এবং যোগদর্শনের বইতে যে কথাগুলো বলা আছে, সেই সকল দার্শনিক কথাগুলো আমরা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর জীবনে হুবহু ফলিত অবস্থায় পাই। লোকনাথ ব্রহ্মচারীর জীবন হল বেদান্ত এবং যোগদর্শনের জীবন্ত বিগ্রহ। আমরা প্রশ্ন করতে পারি, লোকনাথ ব্রহ্মচারী কি করে সিদ্ধযোগী লোকনাথ হলেন? আমাদের বেদান্তে আছে যে একটি জীব লক্ষ লক্ষ জন্মের কর্মফলে বা শাস্ত্রে আছে চুরাশিলক্ষবার জন্মের ফলে মনুষ্যরূপে জন্মগ্রহণ করে। সেই জীব অনেক পুণ্যের ফলে মনুষ্য শরীরে জন্মগ্রহণ করে মনুষ্য দেহ পায়।সেই মনুষ্য অনেক গুণকর্মফলে মুক্তির পথে অগ্রসর হয়।

আমরা যেহেতু জন্মান্তরে বিশ্বাস করি, সনাতন ধর্মানুসারে প্রত্যেকটি জীব মুক্তিলাভ করবে। মুক্তিলাভ না করা পর্যন্ত তার চলার পথে বিরাম নেই।কেউ হয়ত এক জন্মে মুক্তিলাভ করবে, কেউ দশজন্মে,কেউ হয়ত শতজন্মে,কেউ হাজার জন্মে, আবার কেউ একলক্ষ জন্মে।প্রত্যেকটি জীব যে মুক্তি লাভ করবে এবং সেই জীবের যে অগ্রযাত্রা এবং জীব আস্তে আস্তে যে সাধনজগতে অগ্রসর হয় তা আমরা সবিস্তারে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর জীবনে রূপায়িত দেখি। শ্রীমদ্ভগবদগীতাতে বলা আছে, কোন যোগী যদি মুক্তির একেবারে শেষপ্রান্তে গিয়ে মুক্তিলাভ না করে, মুক্তির আগেই তিনি দেহত্যাগ করেন; তবে তিনি পরবর্তী জন্মে এক জ্ঞানবান যোগীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। জন্ম থেকেই মুক্তির পথে অগ্রসর হন। এ ঘটনাটি আমরা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর জীবনেও দেখি।

অথবা যোগিনামেব কুলে ভবতি ধীমতাম্।

 এতদ্ধি দুর্লভতরং লোকে জন্ম যদীদৃশম্।।

 (গীতা:৬.৪২)

"যোগভ্রষ্ট ব্যক্তি সেই সকল লোকাদিতে না গিয়ে, জ্ঞানবান যোগীর কুলে জন্মগ্রহণ করেন। এইরূপ জন্ম জগতে অত্যন্ত দুর্লভতম। "

লোকনাথ ব্রহ্মচারীর পূর্ববর্তী জীবনে নাম ছিল সীতানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। এ সীতানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় দেহ অবস্থাতেই তিনি সাধনার একেবারে শেষ প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন। কিন্তু সে জন্মে সাধনার শেষপ্রান্তে পৌঁছে যাওয়ার পরেও, মুক্তির আগেই হয়ত তিনি দেহত্যাগ করেন। তাই তাঁকে মুক্তির জন্যে লোকনাথ ঘোষাল নামে আরেকবার জন্মগ্রহণ করতে হয়। লোকনাথ ঘোষাল নামে তাঁর জন্ম হয় ১৭৩০ সালের ১৮ ভাদ্র বারাসাতে,চব্বিশ পরগণার কচুয়া গ্রামে।এই লোকনাথ ঘোষাল রূপে তিনি জন্মগ্রহণ করে বাল্যকাল থেকেই তাঁর মধ্যে মুক্তির প্রবল ভাব দেখা যায়। মাত্র ১১ বছর বয়সে তাঁর উপনয়ন সংস্কার হয়। তাঁর উপনয়ন সংস্কারের সাথে সাথেই গুরু ভগবান গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতেই তাঁর পিতামাতা তাঁকে সমর্পণ করে দেয়। লোকনাথ ব্রহ্মচারীর যেদিন উপনয়ন সংস্কার হয়, তখন সাথে তাঁর প্রতিবেশী বন্ধু বেণীমাধবেরও উপনয়ন সংস্কার হয়। শিশু লোকনাথ, বেণীমাধব গুরু ভগবান গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত ধরে একসাথে গৃহত্যাগ করে। আসন্ন ব্রহ্মচর্যের প্রস্তুতি নিতে প্রথমে আসে তাঁরা দেবীতীর্থ কালীঘাটে। কালীঘাটে এসে সাধনার জগতে আস্তে আস্তে তাঁরা অগ্রসর হতে থাকেন।সেই সাধনা কিন্তু প্রথম অবস্থায় খুব সহজ ছিল। ধীরেধীরে সেই সহজ সাধন পদ্ধতিই কঠিন থেকে কঠিনতম হয়ে উঠে।

‌কখনো একদিন একরাত্রি না খেয়ে থাকা,এর পরে এক সপ্তাহ,এর পরে এক মাস। কল্পনা করা যায় না কতটা কঠিন এ সাধনা। টানা এক মাস না খেয়ে থাকার পরে একদিন শুধু খাবার গ্রহণ করতে পারবে ; তাও আবার ঘি মিশ্রিত হবিষান্ন। লোকনাথ ব্রহ্মচারীর গুরু ভগবান গঙ্গোপাধ্যায়ে এমনভাবে তাদের দুজনকে সাধনা জগতে উদ্দীপ্ত করেছিলেন। লোকনাথ ব্রহ্মচারী এবং বেণীমাধব তারা দুজন যখন ধ্যানস্থ থাকত, সাধনায় থাকত তখন তারা দেহের সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে নির্বিকার থাকতেন। মানুষের দেহের যতরকমের মল-মূত্র ত্যাগ সহ জৈবিক বিষয়াদি আছে, সে সময়ে পর্যন্ত আসন ত্যাগ করে সাধনভঙ্গ করতেন না। নিজ আসনেই মল-মূত্র ত্যাগ করতেন। তখন গুরু ভগবান গঙ্গোপাধ্যায় মলমূত্রাদি পরিষ্কার করে আবার তাদের পাশের স্থানে বসিয়ে দিতেন। ভাবা যায় না কত কঠিন এ সাধনা। যখনই তাঁরা সাধনা করতে ধ্যান করতে বসতেন, সাথেসাথেই সেখানে অসংখ্য পিঁপড়া এসে উপস্থিত হত। পিঁপড়াদের কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে একদিন গুরুদেবকে বিষয়টি লোকনাথ ব্রহ্মচারী বললেন, "গুরুদেব আমাদের অন্যস্থানে ধ্যান করা দরকার যেখানে কোন পিঁপড়া বা অন্যকিছু নেই।"তাঁর পিঁপড়ার কামড়ের কথাগুলো শুনে গুরুদেব ভগবান গঙ্গোপাধ্যায় মৃদু হাসলেন। উত্তরে কিছুই বললেন না। পরবর্তীতে একটা সময় লোকনাথ ব্রহ্মচারী লক্ষ্য করলেন, তাদের দুজনকে ধ্যানে বসিয়ে গুরুদেব বিভিন্ন রকমের চিনি সহ মিষ্টিদ্রব্য আশেপাশে দিচ্ছেন। যাতে আরও বেশী করে পিঁপড়া আসে। পরীক্ষা করে দেখতেন তাদের ধ্যানের একাগ্রতা কতখানি। পিঁপড়া বা সাধারণ জগত থেকে যেন আপনাকে ধ্যানের জগতে কোন প্রকারের বিরক্ত করতে না পারে।

এরকমই কঠিন সাধনার একটা পর্যায়ে তাঁর মধ্যে পূর্বজীবনের স্মৃতি চলে আসে। তাঁর পূর্বজন্মের স্মৃতি যখন আসে, তখন ধীরেধীরে সে সাধনার অনেক দৈবী উপলব্ধি করতে থাকে। তখনই লোকনাথ ব্রহ্মচারী জানতে পারেন, যে তার পূর্ববর্তী জন্মে নাম ছিল সীতানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। আস্তে আস্তে তার সকল বিষয়গুলো মনে হতে থাকে। ছবির মত ভেসে উঠে তাঁর স্মৃতিতে। লোকনাথ ব্রহ্মচারীর প্রথম জীবনীকার 'সিদ্ধজীবনী' গ্রন্থের রচয়িতা ব্রহ্মানন্দ ভারতী তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন ,"বাবা এই সীতানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে তুমি যখন লোকনাথ ঘোষাল রূপে জন্মগ্রহণ করলে এই মাঝখানের সময়টাতে তুমি কোথায় ছিলে"? সিদ্ধজীবনী গ্রন্থে লোকনাথ ব্রহ্মচারী উত্তরে বললেন, "ওরে আমার শুধু এতটুকুন মনে আছে যে, আমি অনেক আনন্দে ছিলাম"।ব্রহ্মানন্দ ভারতী আবার প্রশ্ন করেছেন,"এই আনন্দটা কি স্বর্গ"?তখন লোকনাথ ব্রহ্মচারী বলেছিলেন, "আমি এত বিস্তৃত বলতে পারবো না, কিন্তু আমি যে অনেক আনন্দে ছিলাম এটা আমার স্মৃতিতে আছে"।

এভাবেই লোকনাথ ব্রহ্মচারী ধীরেধীরে সাধনার একটা পর্যায়ে পৌঁছে জীবন্মুক্ত হয়ে যান। মানুষকে কল্যাণের মানসিকতা থেকে বিভিন্ন দেশ তিনি পর্যটন শুরু করেন। ভারতবর্ষের সীমানা পাড়ি দিয়ে আফগানিস্তান এবং পরবর্তীতে ইরানে যান। ইরান থেকে ইরাক হয়ে এরপরে তিনি সৌদি আরবে যান। আরব ভূখণ্ড থেকে এরপরে আরও পশ্চিমে ইউরোপের ফ্রান্সে উপস্থিত হন। পরবর্তীতে ইউরোপের বহুস্থানে যান। বিভিন্ন দেশ পর্যটনের একটা পর্যায়ে তিনি বৃহত্তর চীনে উপস্থিত হন।লোকনাথ ব্রহ্মচারীর জীবনী অনুসারে, তিনি যখন চীন পরিভ্রমণে যান ; তখন চীনের রাজা তখন তাকে বন্দী করে কারাগারে পাঠায়। পরবর্তীকালে অবশ্য লোকনাথ ব্রহ্মচারী অলৌকিক শক্তি দিয়ে চীনরাজার নেতিবাচক মানসিকতাকে দূরীকরণ করেন।

যখন লোকনাথ ব্রহ্মচারী আফগানিস্তান পরিভ্রমণে যান, তখন শেখ সাদী নামে একজন মুসলিম লোকের কাছে তিনি আরবি ভাষা শেখার যথাসাধ্য চেষ্টা করে। লোকনাথ ব্রহ্মচারীকে যখন এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল ,"বাবা তুমি কেন আরবি ভাষা শিখেছিলে?"। উত্তরে তিনি বলেছিলেন,"আমি দেখতে চাচ্ছিলাম মুক্তি সম্পর্কে ওদের ধর্মে কি বলা আছে।শুধু এই কৌতুহল থেকেই আমি এই বিষয়গুলো জানার চেষ্টা করেছি"। তাছাড়া তিনি যখন সৌদি আরবে ছিলেন তখন আব্দুল গফুরের সাথে তাঁর পরিচয় হয়। আব্দুল গফুর লোকনাথ ব্রহ্মচারীকে প্রশ্ন করেছিলেন,"তুমি কয়দিনের লোক"? প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে লোকনাথ ব্রহ্মচারী উত্তরে বলেছিলেন,"আমি দুই দিনের লোক। আপনি কয়দিনের"? লোকনাথ ব্রহ্মচারীর প্রশ্নে আব্দুল গফুর বলেন,"আমি চারিদিনের মনুষ্য। অর্থাৎ আমার চারি জন্মের কথা স্মরণ আছে"। লোকনাথ ব্রহ্মচারীর সাথে আব্দুল গফুরের এরপরে বিস্তারিত আলাপ হয়। এ আলাপচারিতায় আব্দুল গফুর জানান, পূর্ববর্তী জন্মে তাঁর দক্ষিণ ভারতের এক ক্ষত্রিয়ের ঘরে জন্ম হয়েছিল।

এমন অনেক বর্ণাঢ্য ঘটনা আছে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর জীবনে। লোকনাথ ব্রহ্মচারী উত্তর দিকে যেতে যেতে উপস্থিত হন মানস সরোবরে।তাঁর প্রথম জীবনীকার ব্রহ্মানন্দ ভারতী যখন জিজ্ঞেস করে, " আমি তোমার কথা দ্বারা বুঝিলাম যে, তোমরা তিব্বত দেশ পার হইয়া বহু দূরে গিয়াছ; কিন্তু মানস সরোবর যে তিব্বত দেশের মধ্যে"? উত্তরে লোকনাথ ব্রহ্মচারী বলেন,

"ওরে, তোদের মানস সরোবর যে ঘরের কোণে"।তখন ব্রহ্মানন্দ ভারতী শাস্ত্র ঘেটে দেখলেন যে, শাস্ত্রে মানস সরোবর দুইটি ; একটি মানস সরোবর আরেকটি উত্তর মানস সরোবর।পৃথিবীর একেবারে উত্তর মেরুতে অবস্থিত উত্তর মানস সরোবর। লোকনাথ ব্রহ্মচারী, বেণীমাধব ব্রহ্মচারী এবং হিতলাল মিশ্র এ তিনজনে মিলে পৃথিবীর সর্ব উত্তরে উপস্থিত হন। সে স্থানের সকলই অন্ধকার। সেই অন্ধকারের মাঝে দেড় ফিটের উচ্চতার মত মানুষ বসবাস করে।আমরা বর্তমানে এমন মানুষ বা পৃথিবীর এমন স্থানের বর্ণনা পাইনা। সেস্থানে ছয় মাস দিন এবং ছয় মাস রাত্রি। লোকনাথ ব্রহ্মচারী বর্ণিত এ স্থানগুলো বর্তমানেও অনেকটা অনাবিষ্কৃত ।লোকনাথ ব্রহ্মচারী যেহেতু ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ,আমাদের ধারণা বা বিশ্বাস যে তাঁর কথাগুলো মিথ্যা নয়।কারণ তিনি যেভাবে সে স্থানের সম্পূর্ণ ভৌগলিক বর্ণনা দিয়েছেন, তা কাল্পনিক হওয়া সম্ভব নয়। বিষয়টি নিয়ে ব্রহ্মানন্দ ভারতী লোকনাথ ব্রহ্মচারীকে প্রশ্ন করে, তখন উত্তরে ব্রহ্মচারী বাবা বলেন,"সাহেবরা অনুমান করিয়া এ সকল লিখিয়াছেন, তাহা প্রকৃত অবস্থা নহে, আমি সাহেবদিগের নিকট প্রশ্ন করিয়া এরূপ অবগত হইয়াছি"। তবে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উত্তর মেরু ভ্রমণের বর্ণনা পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের সাথে না মিললেও, হিন্দুশাস্ত্রের সাথে মেলে।

লোকনাথ ব্রহ্মচারী তাঁর শিষ্যদের কাছে নিয়মিত চিঠি লিখতেন।লোকনাথ ব্রহ্মচারীর সেই হাতে লেখা চিঠির, কয়েকটি চিঠি এখনো পাওয়া যায়।এ চিঠিগুলোর মধ্যেই আছে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর বিখ্যাত সেই বাণীটি, "রণে, বনে, জলে, জঙ্গলে যেখানেই বিপদে পড়িবে আমাকে স্মরণ করিবে,আমিই রক্ষা করিবো"। আমরা অনেকেই হয়ত জানিনা এই কথাটি লোকনাথ ব্রহ্মচারী কোথায় এবং কার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন? লোকনাথ ব্রহ্মচারীর প্রিয় শিষ্য তৎকালীন নারায়ণগঞ্জের জমিদার আনন্দকান্ত নাগকে সমূহ বিপদ থেকে রক্ষার্থে; তাকে আশ্বস্ত করে লোকনাথ ব্রহ্মচারী একটা চিঠিতে লিখেছিলেন।বাণীটি জমিদার আনন্দকান্ত নাগকে লেখা চিঠিতেই ছিল। পরবর্তীতে বাণীটি সামান্য পরিবর্তিত হয়ে জনপ্রিয় হয়। শিষ্য আনন্দকান্ত নাগকে তাঁর দেয়া চিঠির উত্তরে লোকনাথ ব্রহ্মচারী লিখলেন, 

"রণে বনে জলে জঙ্গলে, আমাকে স্মরণ করিবা, কোন বিঘ্ন হইবেক না"।

চিঠিটি হরিপদ ভৌমিকের সম্পাদিত 'শ্রীশ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারীর অপ্রকাশিত পত্রাবলী ও বাণী' গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে। লোকনাথ ব্রহ্মচারীর শতবছর পূর্বের জীবনীগ্রন্থগুলো নিয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে আমাদের গবেষণা করা অত্যন্ত প্রয়োজন।এতে আমরা আরও নতুন নতুন অনেক তথ্য পাবো।বেদান্ত এবং যোগদর্শনের সাথে তাঁর জীবনকেও ভাল করে মিলিয়ে নিতে পারব। বেদান্তে প্রথমেই বলা আছে, অধিকারী হতে। যিনি অধিকারী তিনি শত বাঁধা অতিক্রম করেও সাধন জগতে অগ্রসর হবে। লোকনাথ ব্রহ্মচারী জন্মের মাত্র এগারো বছরের মধ্যেই মুক্তি লাভের পথে অগ্রসর হয়েছে। কারণ তিনি যোগ্য অধিকারী ছিলেন। তিনি জন্মের এগারো বছরের মধ্যেই মুক্তির পথে অগ্রসর হলেন, তবে আমি কেন হচ্ছি না?এই কেন হচ্ছি না প্রশ্নের একমাত্র উত্তর হল, অধিকারী। তাই গুরু শিষ্যকে জ্ঞানদানের পূর্বে অধিকারী নিরুপণ করে নিতে হয়। অধিকারী সম্পর্কে শাস্ত্রে বলা আছে :


অধিকারী তু বিধিবৎ-অধীতবেদবেদাঙ্গত্বেন আপাততঃ অধিগত-অখিল-বেদার্থঃ অস্মিন্ জন্মনি জন্মান্তরে বা কাম্যনিষিদ্ধবর্জনপুরঃসরং নিত্য-নিমিত্তিক-প্রায়শ্চিত্ত-উপাসনা-অনুষ্ঠানেন নির্গত-নিখিল-কল্মষতয়া নিতান্ত-নির্মল-স্বান্তঃ, সাধনচতুষ্টয়সম্পন্নঃ প্রমাতা।

(বেদান্তসার:৬)

"বেদান্তের অধিকারী তাঁকেই বলা হয়, যিনি এজন্মে বা আগেকার পূর্ববর্তী জন্মে বিধিপূর্বক বেদবেদান্ত পাঠ করে মোটামুটি অর্থ বুঝেছেন, কাম্য-কর্ম ও শাস্ত্র-নিষিদ্ধ কর্ম ত্যাগ করে নিত্য নৈমিত্তিক, প্রায়শ্চিত্ত ও উপাসনা করে সকল পাপ দূর করে অত্যন্ত নির্মল চিত্তের অধিকারী হয়ে চারটি সাধনকে অবলম্বন করেছেন।"

অধিকারীর ব্রহ্ম বা বেদান্তের প্রতি আগ্রহ তখনই জন্মাবে, যখন ভাল করে তিনি বেদ-বেদান্তের মাহাত্ম্য নিজ অন্তরে উপলব্ধি করবেন। প্রথমেই বেদ-বেদান্ত সবকিছু আপনার ভাল করে পড়তে হবে,জানতে হবে।এর পরবর্তীতে নিত্য নৈমিত্তিক যে দায়িত্ব তা নিষ্ঠার সাথে পালন করতে হবে। নিত্যকর্ম হল প্রতিদিনের সন্ধ্যাবন্দনা। এর সাথে নৈমিত্তিক বিভিন্ন কর্মও করতে হবে। কোন নিমিত্ত উপলক্ষে যে কর্ম করতে হয়, তাকে নৈমিত্তিক কর্ম বলে। যেমন: দুর্গাপূজা, শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী ইত্যাদি বাৎসরিক পূজাকে নৈমিত্তিক কর্ম বা নৈমিত্তিক পূজা বলে।এর সাথে থাকবে প্রায়শ্চিত্ত এবং উপাসনা। অধিকারীর এ সকল বৈশিষ্ট্য ধারণ করার ফলে, অধিকারীর মনের মধ্যে ব্রহ্মের প্রতি একটি সুতীব্র আকর্ষণ জন্মাবে। এতে সাধক আস্তে আস্তে ব্রহ্মের পথে অগ্রসর হবেন।সকল বাঁধা অতিক্রম করে সাধক যখন অগ্রসর হবেন, তখনই ব্রহ্মকে জেনে জীবন্মুক্ত হতে পারবেন।ব্রহ্মের পথে সাধক কিভাবে চলবে, এর সকল প্রক্রিয়া বেদান্তে এবং যোগদর্শনের সাধন পদ্ধতিগুলোর মধ্যে দেয়া আছে।যোগদর্শনের মধ্যে একজন যোগীর সাধনজগতের পথে চলতে করণীয় সম্পূর্ণ পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে। যোগদর্শনে যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধ্যান,ধারণা সমাধি -যোগের এ আটটি অঙ্গের কথা বিস্তৃতভাবে বলা হয়েছে বিভিন্ন সূত্রে। যোগদর্শনের প্রত্যেকটি সূত্রের যদি দৃষ্টান্ত হিসেবে কাউকে গ্রহণ করতে হয়; তবে লোকনাথ ব্রহ্মচারীই চোখের সামনে আমাদের এক জ্বাজ্জল্যমান দৃষ্টান্ত। লোকনাথ ব্রহ্মচারীর সম্পূর্ণ সাধনজীবন যোগসূত্র এবং বেদান্তসূত্রের সকল সূত্রের সাথে মিলে যায়। বিষয়টি নিয়ে আরও গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।


যম-নিয়মাসন-প্রাণায়াম-প্রত্যাহার-ধারণা-ধ্যানসমাধয়োঽষ্টাবঙ্গানি।।

(পাতঞ্জলযোগসূত্র: সাধনপাদ, ২৯)

‌"যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি-এই আটটি যোগের অঙ্গসরূপ।"

‌অহিংসা সত্যাস্তেয়-ব্রহ্মচর্যাপরিগ্রহা যমাঃ।

‌(পাতঞ্জলযোগসূত্র: সাধনপাদ, ৩০)

‌"অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য ও অপরিগ্রহ-এইগুলিকে যম বলে।"

‌শৌচ-সন্তোষ-তপঃ-স্বাধ্যায়েশ্বরপ্রণিধানানি নিয়মাঃ।

‌(পাতঞ্জলযোগসূত্র: সাধনপাদ, ৩২)

‌"শৌচ, সন্তোষ, তপ, স্বাধ্যায় ও ঈশ্বর-প্রণিধান-এইগুলি নিয়ম।"

স্থিরসুখমাসনম্।

‌(পাতঞ্জলযোগসূত্র:সাধনপাদ, ৪৬)

‌"যে অবস্থায় অনেকক্ষণ স্থিরভাবে ও সুখে বসা যায়, তাহার নাম আসন।"

‌তস্মিন্ সতি শ্বাসপ্রশ্বাসয়োর্গতিবিচ্ছেদঃ প্রাণায়ামঃ।

‌(পাতঞ্জলযোগসূত্র: সাধনপাদ, ৪৯)

‌"আসন জয়ের পর শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি সংযম করাকে প্রাণয়াম বলে।"

‌স্বস্ববিষয়াসম্প্রয়োগে চিত্ত-স্বরূপানুকার ইবেন্দ্রিয়াণাং প্রত্যাহারঃ।

‌(পাতঞ্জলযোগসূত্র: সাধনপাদ, ৫৪)

‌"ইন্দ্রিয়গুলি যখন নিজ নিজ বিষয় ত্যাগ করিয়া চিত্তের স্বরূপ গ্রহণ করে তখন তাহাকে প্রত্যাহার বলে।"

‌দেশবন্ধশ্চিত্তস্য ধারণা।

‌(পাতঞ্জলযোগসূত্র: বিভূতিপাদ, ১)

‌"চিত্তকে কোন বিশেষ বস্তুতে সংলগ্ন রাখাকে 'ধারণা' বলে।"

‌তত্র প্রত্যয়ৈকতানতা ধ্যানম্।

‌(পাতঞ্জলযোগসূত্র: বিভূতিপাদ, ২)

‌"সেই বস্তুবিষয়ক জ্ঞান সর্বদা একইভাবে প্রবাহিত হইলে তাহাকে 'ধ্যান' বলে।"

‌তদেবার্থমাত্রনির্ভাসং স্বরূপশূন্যমিব সমাধিঃ।

‌(পাতঞ্জলযোগসূত্র: বিভূতিপাদ, ৩)

‌"ধ্যানের দ্বারা বাহ্য উপাধি পরিত্যাগপূর্বক কেবলমাত্র অর্থ প্রকাশিত হইলে তাহাকে "সমাধি' বলে।"

লোকনাথ ব্রহ্মচারীর প্রাচীন জীবনীগ্রন্থগুলো পড়লে দেখা যায় প্রচারবিমুখ নিষ্কপট ছিলেন তিনি। ব্রহ্মানন্দ ভারতী লিখিত প্রথম জীবনীগ্রন্থ সিদ্ধজীবনী শুরুতেই দেখা যায়, তাঁর যখন জীবনী লেখা হচ্ছিল তখন তিনি ব্রহ্মানন্দ ভারতীকে তীব্র আপত্তি জানিয়ে বলেছিলেন:

"আমার আবার একটা জীবনী! "রামায়ণ" রয়েছে, "মহাভারত" রয়েছে, তাতে চলে না?

......যা যা রেখে দে তোর দোয়াত কলম, আমার জীবনী লিখতে হবে না"।

রামায়ণ,মহাভারত যদি আমরা ভাল করে পড়ি তাহলে বাবা লোকনাথকে জানতে পারবো। তিনি বলেছেন তাঁর জীবনী না লিখে রামায়ণ মহাভারত ভাল করে মর্মার্থ সহকারে পড়তে। তিনি বলেছেন আগে মানুষ হতে। রামায়ণ,মহাভারত পড়ে কয়জন মানুষ আমরা রাম-লক্ষ্মণ বা যুধিষ্ঠিরের মত শুদ্ধ হতে পেরেছে।

ব্রহ্মচারী গীতা পড়ার চাইতে গীতা হতে বলেছেন।গীতা হতে কেন বলেছেন?কেননা আমরা যদি গীতাকে উপলব্ধি করতে পারি,গীতার জ্ঞানকে ধারণ করতে পারি ; তবে সাধনতত্ত্বের অধিকাংশই যথাসম্ভব বুঝতে পারব।লোকনাথ ব্রহ্মচারীর একটি বাণীর মধ্যে আছে যে,"আমি তোর হরির মুখে প্রস্রাব করি।" জীবনীগ্রন্থে আছে ঘটনাটি। এ বাণীটি দেখিয়ে অনেকেই বলে থাকেন, "বাবা লোকনাথ একজন সিদ্ধযোগী হয়ে হরির মুখে প্রস্রাব করার কথা কি করে বলতে পারলেন?" কিন্তু তারা একবারও চিন্তা করে দেখেন না যে, এই জগত যদি ব্রহ্মময় হয়; সেই ব্রহ্ম যদি সর্বভূতে বিরাজ করেন, তবে এই কথাটিতে সমস্যা কোথায়? জগতের প্রত্যেকটি অণুতে পরমাণুতে , যেখানেই চোখ যায় ; সেখানেই শ্রীহরির অবস্থান। বৈষ্ণব কবিরা বিষয়টি অত্যন্ত সুন্দর ভাষায় বলেছেন। জগতের সকল স্থানেই যদি শ্রীহরির স্ফুরিত হয়, জগতের প্রত্যেকটি স্থানেই যদি তাঁর চোখ, মুখ সহ সকল অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিরাজ করে ; তবে আপনি যেখানেই প্রস্রাব করবেন শ্রীহরি সেখানেও আছে। প্রত্যেকটি জীবের মধ্যেই তিনি আছেন।এই জগতে সৃষ্ট দুটি কারণের কারণ তিনি। প্রথমত নিমিত্ত কারণ;এ জগত যে বুদ্ধিসত্ত্বা দিয়ে পরিচালিত হয়, তাকে নিমিত্ত কারণ বলে। অন্যটি হল উপাদান কারণ; এ জগতের জড় চেতন প্রত্যেকটা উপাদানে তিনি বিরাজমান এটা উপাদান কারণ।

লোকনাথ ব্রহ্মচারীর জীবনী খুব ভাল করে পড়লে উপলব্ধি করা যায় যে, তিনি ঠিক কি চেয়েছেন।তিনি চেয়েছেন আমরা যেন সত্যিকারভাবে বেদ-বেদান্তের পথে অগ্রসর হতে পারি এবং বেদান্তে যে মুক্তির বাণী দেয়া আছে, এর মাধ্যমে সাধন জগতে অগ্রসর হতে পারি।লোকনাথ ব্রহ্মচারীর বাণীগুলা সম্যক উপলব্ধি করতে পারলে, ধীরেধীরে আপনার এক বেদান্ত বোধ জন্মাবে। আপনি নিজেকে জানতে পারবে, এরপরে নিজেকে জানার মাধ্যমে ব্রহ্মকে জানার পথে অগ্রসর হতে পারবেন। ব্রহ্মকে জানতে পারলে আপনার সমস্ত বন্ধন কেটে যাবে। লোকনাথ ব্রহ্মচারী উত্তর মেরুতে ছিলেন, তিনি মানস সরোবরে ছিলেন,তিনি পাহাড়ে পাহাড়ে ছিলেন, তিনি কেন এই হিংসা-বিদ্বেষময় লোকালয়ে আসলেন? তিনি এসেছেন লোকশিক্ষার জন্যে, সাধারণ মানুষকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য।

কারণ হিমালয় থেকে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর মত কিছু যোগীপুরুষ যদি মাঝেমধ্যে লোকালয়ে না আসত, তবে আমরা সাধন পথের গ্রন্থগুলোতে যে কথাগুলো বলা আছে ; এর চোখের সামনে দৃষ্টান্ত পেতাম না। যোগী এবং তাঁদের পবিত্র জীবন শুধু গ্রন্থেই সীমাবদ্ধ থাকত। তখন নিজেদের সীমাবদ্ধতা থেকে আমরা তাদের জীবনকে অবিশ্বাস করতাম। দিনের পর দিন মাসার্হ ব্রত করলে যে পূর্বজন্মের স্মৃতি অবগত হওয়া যায়।কথাটি আমাদের শাস্ত্রে আছে।কিন্তু, দৃষ্টান্ত হয়ে কে দেখিয়ে দিয়েছেন আমাদের? লোকনাথ ব্রহ্মচারী দেখিয়ে দিয়েছেন।ঠিক একইভাবে এ যোগীপুরুষরা আসেন,আমাদের হিতার্থে।এই কথা লোকনাথ ব্রহ্মচারীও বলেছেন, "সাধকানাং হিতার্থায় ব্রহ্মণো রূপকল্পনম।ইহা ত জান"। ঈশ্বর এক অদ্বিতীয় সাধকের কল্যাণে অরূপের রূপকল্পনা হয়। তিনি বহু নন, বহুরূপ সাধকের হিতার্থের জন্য; আপনার, আমার আমাদের জন্য বিভিন্ন রূপ।আমাদের অনেকে সমালোচনা করে যে আমরা বহু ঈশ্বর পূজা করি। কথাটি সত্য নয়, লোকনাথ ব্রহ্মচারীও বিভিন্ন সময়ে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন।অনেকে বলে আমরা মূর্তিপূজা করি; আমরা কোন মূর্তিপূজা করি না।আমরা মূর্তিকে প্রতিমায় রূপান্তরিত করে পরমেশ্বরের উপাসনা করি। বিভিন্ন রূপে আমরা এক পরমেশ্বরই উপাসনা করি। বেদের বিভিন্ন মন্ত্রে অত্যন্ত সুন্দর এবং স্পষ্ট করে বিষয়টা বলা আছে:

ইন্দ্রং মিত্রং বরুণমগ্নি-মাহু রথো

দিব্যঃ স সুপর্ণো গরুত্মান্।

একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি

অগ্নি যমং মাতরিশ্বানমাহুঃ।।

(ঋগ্বেদ: ১.১৬৪.৪৬)

"সেই সদ্বস্তু অর্থাৎ পরব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয়। কিন্তু জ্ঞানীগণ তাঁকেই ইন্দ্র, মিত্র, বরুণ, অগ্নি, দিব্য (সূর্য্য), সুপর্ণ, গরুড়, যম, বায়ু ইত্যাদি বিভিন্ন নামে অভিহিত করে থাকেন।"

ন দ্বিতীয়ো ন তৃতীয়শ্চতুর্থো নাপুচ্যতে।

ন পঞ্চমো ন ষষ্ঠঃ সপ্তমো নাপুচ্যতে।

নাষ্টমো ন নবমো দশমো নাপুচ্যতে।

য এতং দেবমেক বৃতং বেদ।।

(অথর্ববেদ:১৩.৪.২)

"পরমাত্মা এক, তিনি ছাড়া কেহই দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম বা দশম ঈশ্বর বলে অভিহিত হয় না। যিনি তাঁহাকে শুধু এক বলে জানেন একমাত্র তিনিই তাঁকে প্রাপ্ত হন।"

সেই এক অদ্বিতীয় পরমেশ্বরকেই বহু বলে হলেও, তিনি কিন্তু বহু নয়।এ বিষয়গুলো আমাদেরকে উপলব্ধি করা প্রয়োজন।আমরা বর্তমানে লোকনাথ কাছে শুধুই জাগতিক সিদ্ধি চাচ্ছি। লোকনাথ ব্রহ্মচারী সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, "আমার চরণ ধরিস না, আচরণ ধর।" কিন্তু আমরা শুধু চরণ ধরার ব্যবস্থাই করছি। তাঁর আচরণ কেউ ধরতে চাচ্ছি না; আচরণ ধরতে তো অনেক কষ্ট। আমরা শুধু বলছি বাবা এটা দাও,ওটা দাও,সেটা দাও ; যদি বাবা মনবাসনা পূর্ণ করেন তবেই আমরা আমাদের প্রকৃত স্বরূপ দেখিয়ে দেই। তখন বলে বেড়াই, বাবা লোকনাথকে মানি না, তাঁর কোন শক্তি নেই ইত্যাদি।সিদ্ধযোগী লোকনাথ ব্রহ্মচারীর যে শক্তি; সেই শক্তিটা আদতে ব্রহ্মের শক্তি। বিষয়টি বেদের উপনিষদে সুন্দর করে বলা আছে। সাধক সাধনার একটা পর্যায়ে অযাচিতভাবে অণিমা, মহিমা, লঘিমা, প্রাপ্তি, প্রাকাম্য,ঈশিত্ব,বশিত্ব এবং কামাবসায়িত্ব এ অষ্টসিদ্ধি লাভ করে।

মানুষ গাছ লাগায় ফল পাওয়ার জন্য। কিন্তু সেই ফলগাছে অযাচিতভাবে অক্সিজেন এবং ছায়াও পেয়ে যায়।ঠিক একইভাবে সাধক পুরুষ মুক্তিলাভের জন্য সাধনা করেন, কিন্তু অযাচিতভাবে তিনি অষ্টসিদ্ধি পায়, এ অষ্টসিদ্ধিকে বাজেসিদ্ধিও বলা হয়।সে চাইলে অন্যের মনের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে,মনের কথা জানতে পারে,বাতাসের মত হালকা হয়ে যেতে পারে,পাহাড়ের মত ভারী হয়ে যেতে পারে।এই সকল বিষয়গুলো কিন্তু সাধনজগতে আছে।আপনি আমি চাইলে, যদি সাধন জগতে অগ্রসর হতে পারি তবে এ অষ্টসিদ্ধি পেতে পারি; এটা সম্ভব।প্রচেষ্টা থাকলে আমরা প্রত্যেকেই সাধনজগতে অগ্রসর হতে পারি এবং সত্যিকারের জ্ঞান পেতে পারি।আমরা বেদান্ত এবং যোগদর্শনে জীবের মুক্তি লাভের যে তত্ত্ব পেয়েছি তার বাস্তব প্রতিমূর্তি ছিলেন বাবা লোকনাথ। তাই বাবার সেই দেখানো পথে আমাদের প্রত্যেকেরই লক্ষ্য হওয়া উচিত মুক্তির পথে অগ্রসর হতে তাঁর পথ এবং বাক্যানুসরণ।

আমরা অনেকেই ব্যক্তি গুরুর কথা অন্ধের মত অনুসরণ করি। একবার ভেবেও দেখি না গুরুর কথা কতটা বেদান্তবাক্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু লোকনাথ ব্রহ্মচারী বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের সুন্দর সমাধান দিয়েছেন। তনি বলেছেন, "গুরুবাক্য পাইলে, এখন বেদান্তবাক্যের সঙ্গে মেলাও। এর দ্বারা নিদিধ্যাসন পযর্ন্ত করতে পারবে"। অর্থাৎ অন্ধের মত গুরুকে অনুসরণ নয়, গুরুর বাক্য যদি বেদান্তবাক্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তবেই গুরুকে অনুসরণ করতে হবে, নচেৎ নয়।তিনি মাটির মত সর্বংসহা হতে বলেছেন। চাইলেই আগে সোনা হওয়া সম্ভব নয়, আগে মাটির মত হতে হয় "সোনা হবি তো, আগে মাটি হ"। নিজের যোগ্যতাতেই নিজের বড় হতে প্রেরণা দিয়েছেন লোকনাথ ব্রহ্মচারী। জগতের প্রত্যেকটি জীবের মধ্যেই অনন্ত শক্তি আছে, আমরা সেই আত্মশক্তি জাগরিত করতে পারিনা বলে হীনমন্যতা আমাদের গ্রাস করে। এ বিষয়টি নিয়ে লোকনাথ ব্রহ্মচারী বলেন,"স্বনাম পুরুষ ধন্য, তুই ত তোর নিজের নামেই ধন্য রে। তবে তুই আমার নাম করে বড় হতে চাস কেন"?

একইভাবে আমরা দেখতে পাই, লোকনাথ ব্রহ্মচারী শুধু মুক্তির পথ নয়, বাস্তব জগতে বর্তমান কালের জন্যেও তাঁর অমৃতময় বাণী অনেক বেশী প্রাসঙ্গিক। লোকনাথ ব্রহ্মচারী ঈশ্বরকেই গুরু বলে যেমন চরম আধ্যাত্মিক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, সাথে সাথে জাগতিক মানুষ গুরুদের সম্পর্কে তাঁর নির্দেশনা অত্যন্ত গুরুত্ববহ। তিনি বলেছেন:"গুরু কে? ঠেকা।যে যে স্থানে ঠেকে,সে সেই স্থানেই শিক্ষা পায়।যার আদেশ তুমি অনুসরণ কর তিনিই তোমার গুরু।" আমাদের অনেক গুরুরাই নিজেরা সত্যকে অনুভব না করে অন্যদের শেখাতে যায়, কিছুকিছু ক্ষেত্রে জোর করেও শিখাতে যায়। এ বিষয়ে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর মতামত হল, "তুমি যা অনুভব করতে পারনি, তা কাউকে বলো না"। তিনি আরও বলেছেন, "আমি যোগী, নিজে প্রত্যক্ষ ভিন্ন অন্য কিছুই মানি না।যা আমার গোচর নয়,তা আছে বলে তোমাদের মতো ধারনা আমার নেই"। আমরা অনেকেই শুধু অন্যকে জ্ঞান দেই, যা নিজের জীবনে প্রয়োগ করি না। তিনি সবাইকে উপদেশ কম দিয়ে কাজ করতে বলেছেন, "বসা উপদেশ দেওয়া এক প্রকার কথা বিক্রি। সেটা আমার মিঠা লাগে না। কাজ চাই, কাজটা আমার ইষ্ট,তাই পেয়ারা"।কথাগুলো অনেক বেশী বাস্তবসম্মত এবং সময়োপযোগী। এ মহামূল্যবান কথাগুলোকে যদি আমরা আমাদের জীবনে প্রয়োগ করতে পারি, তবেই আমরা সত্যিকারের লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আচরণ ধরতে পারব। এবং সেই পথে সাধনজগতে অগ্রসর হয়ে মুক্তির পথে যেতে পারব।সিদ্ধযোগী লোকনাথ ব্রহ্মচারী বলেছেন, তাঁর আচরণ ধরতে।কিন্তু আমরা 'আচরণ' থেকে 'আ' উপসর্গটি বাদ দিয়ে চরণ ধরা নিয়েই সদাব্যস্ত। এতে জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক উভয়কূলই দিনশেষে হারাতে হয়।আমরা যদি আমাদের ভিতর লুকিয়ে থাকা অনন্তশক্তিকে জাগিয়ে তুলতে পার; তবেই দুর্লভ মনুষ্যজন্ম আমাদের সার্থক হবে। 

সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
দেখুন ইউটিউবে ঃ 




মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁