-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

জগতে যখনই দানবের প্রাদুর্ভাব হবে, দেবী তখনই আবির্ভূতা হয়ে রক্ষা করবেন।

দেবী দক্ষিনা কালী
আমরা অনেকেই সামনে বিপদ দেখলে ধৈর্যহারা হয়ে যাই। অনেক সময়ে নিজের প্রতি আবার অনেক সময়ে দেখা যায়; নিজের প্রতি বিশ্বাসহারা হয়ে ঈশ্বরের প্রতিও বিশ্বাস হারিয়ে ফেলি।কিন্তু আমরা যদি গভীরভাবে আমাদের শাস্ত্রগ্রন্থের দিকে দৃষ্টি দেই তাহলে দেখতে পাব যে, আমরা যদি সর্বদা ঈশ্বরের পথে থাকতে পারি ; তবে ঈশ্বর স্বয়ং নিজেই সর্বদা আমাদের সকল বিপদ থেকে রক্ষা করবেন এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এই প্রতিশ্রুতি যেমন বেদে আছে তেমনি শ্রীমদ্ভগবদগীতাতেও আছে, শ্রীচণ্ডীতেও আছে, রামায়ণেও আছে, মহাভারতেও আছে। ধর্মই ধার্মিককে রক্ষা করে। আমরা বেদ-পুরাণাদি শাস্ত্রে এর অসং
খ্য দৃষ্টান্ত পাই। মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত শ্রীচণ্ডীতে আছে, দেবতাদের দ্বারা স্তবস্তুতির পর দেবী মহামায়া সকল জীবকে রক্ষার্থে অভয় দান করেন। তিনি স্বয়ং প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন, ভাবিকালেও তিনি আসুরিক শক্তির বিনাশে বিভিন্ন রূপে আবির্ভূতা হবেন। আবির্ভূতা হয়ে সকল আসুরিক সঙ্কট থেকে সন্তানদের পরিত্রাণ করবেন।

বৈবস্বতেঽন্তরে প্রাপ্তে অষ্টাবিংশতিমে যুগে ।
শম্ভো নিশুম্ভশ্চৈবান্যাবুৎপৎস্যেতে মহাসুরৌ।।
নন্দগোপগৃহে জাতা যশোদাগর্ভসম্ভবা ।
ততস্তৌ নাশয়িষ্যামি বিন্ধ্যাচলনিবাসিনী ।।
পুনরপ্যতিরৌদ্রেণ রূপেণ পৃথিবীতলে ।
অবতীর্য হনিষ্যামি বৈপ্রচিত্তাংস্তু দানবান্ ।।
ভক্ষয়ন্ত্যাশ্চ তানুগ্রান্‌ বৈপ্রচিত্তান্ মহাসুরান্।
রক্তা দন্তা ভবিষ্যন্তি দাড়িমীকুসুমোপমাঃ।।
ততো মাং দেবতাঃ স্বর্গে মর্ত্যলোকে চ মানবাঃ ।
স্তবন্তো ব্যাহরিষ্যন্তি সততং রক্তদন্তিকাম্‌ ।।
ভূয়শ্চ শতবাষিক্যামনাবৃষ্ট্যামনম্ভসি ।
মুনিভিঃ সংস্তুতা ভূমৌ সম্ভবিষ্যাম্যযোনিজা ।।
ততঃ শতেন নেত্রাণাং নিরীক্ষিষ্যামি যন্মুমীন্‌ ।
কীর্ত্তয়িষ্যন্তি মনুজাঃ শতাক্ষীমিতি মাং ততঃ ।।
ততোঽহমখিলং লোকমাত্মদেহসমুদ্ভবৈঃ ।
ভবিষ্যামি সুরাঃ শাকৈরাবৃষ্টেঃ প্রাণধারকৈঃ।।
শাকম্ভরীতি বিখ্যাতিং তদা যাস্যাম্যহং ভুবি ।
তত্রৈব চ বধিষ্যামি দুর্গমাখ্যং মহাসুরম্‌ ।।
পুনশ্চাহং যদা ভীমং রূপং কৃত্বা হিমাচলে ।
রক্ষাংসি ক্ষয়য়িষ্যামি মুনীনাং ত্রাণকারণাৎ ।।
তদা মাং মুনয়ঃ সর্বে স্তোষ্যন্ত্যানম্রমূর্তয়ঃ।
ভীমাদেবীতি বিখ্যাতং তন্মে নাম ভবিষ্যতি ।।
যদারুণাখ্যস্ত্রৈলোক্যে মহাবাধাং করিষ্যতি ।
তদাহং ভ্রামরং রূপং কৃত্বাঽসঙ্খ্যেয়ষট্‌পদম্‌ ।।
ত্রৈলোক্যস্য হিতার্থায় বধিষ্যামি মহাসুরম্‌ ।
ভ্রামরীতি চ মাং লোকস্তদা স্তোষ্যন্তি সর্বতঃ ।।
(শ্রীচণ্ডী:১১.৪১-৫৪)
"দেবীর বললেন, বৈবস্বত মনুর অধিকারসময়ে ( সপ্তম মন্বন্তরে ) অষ্টাবিংশতি- সংখ্যক চতুর্যুগে ( কলি ও দ্বাপরের সন্ধিতে ) শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামক অন্য মহাসুরদ্বয় উৎপন্ন হবে। তখন নন্দগোপগৃহে যশোদার গর্ভে জন্মগ্রহণকরে বিন্ধ্যাচলে অবস্থান করে আমি সেই দুই অসুরকে সংহার করব।
পুনরায় আমি অতি ভয়ঙ্করা মূর্তিতে পৃথিবীতে আবির্ভূতা হয়ে বিপ্রচিত্তিবংশীয় দানবগণকে বধ করব। সেই সকল উগ্রভাব বিপ্রচিত্তি বংশের অসুরদের ভক্ষণ করে নাশ করার সময় আমার দন্তসকল দাড়িম্বকুসুমের মত রক্তবর্ণ হবে। এইজন্য স্বর্গে দেবতারা ও ভূলোকে মানবেরা স্তব করার সময় আমাকে সতত ‘রক্তদন্তিকা’ নামে কীর্তন করবে।
পুনরায় শতবর্ষব্যাপী অনাবৃষ্টিহেতু পৃথিবী জলশূন্যা হলে মুনিগণের স্তবে আমি অযোনিসম্ভবা হইয়া আবির্ভূতা হব। তখন স্তবকারী মুনিগণকে শতনয়নে নিরীক্ষন করব। সেইজন্য মানবগণ আমাকে শতাক্ষী বলে কীর্তন করবে । হে দেবগণ! অনন্তর আমি নিজদেহজাত জীবনধারক পত্রাদি শাক দ্বারা যতদিন না বৃষ্টি হয়, ততদিন পর্যন্ত সমগ্র জগত পালন করিব। তখন পৃথিবীতে আমি শাকম্ভরী নামে বিখ্যাত হব । আর সেই সময়ে আমি দুর্গম নামক মহাসুরকে বধ করে আমি দুর্গাদেবী নামে প্রসিদ্ধা হব।
পুনরায় যখন হিমালয়ে আমি ভীমামূর্তি ধারণপূর্বক মুনিদের রক্ষার জন্য রাক্ষস বিনাশ করব তখন মুনিরা প্রণতভাবে আমার স্তব করবেন। এই জন্য আমি ‘ভীমাদেবী’ নামে বিখ্যাত হব।
যখন অরুন নামক অসুর ত্রিভুবনের মহা বিঘ্ন উৎপন্ন করবে , তখন আমি অসংখ্য ভ্রমর বিশিষ্ট আকৃতি ধারণ করে ত্রিভুবনের মঙ্গলহেতু সেই মহাসুরকে বিনাশ করবো। এইজন্য সকলে আমাকে ভ্রামরী বলে স্তব করবে।"
শ্রীচণ্ডীর একাদশ অধ্যায়ে আগামীতে দেবী বিভিন্নরূপে আবির্ভূতা হওয়ার প্রতিশ্রুতির অন্তিমে দেবী এক শাশ্বত অভয়বাণী প্রদান করেন। এ সকল আসুরিক বাধা দূর করে ধর্ম সংস্থাপনের অভয়বাণীটি শ্রীমদ্ভগবদগীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বর্ণিত ধর্মসংস্থাপনে সাথে সম্পূর্ণভাবে মিলে যায়। গীতায় বলা হয়েছে, জগতে অধর্মের বাড়বাড়ন্ত হলেই, ধর্ম সংস্থাপনের জন্য ভগবান স্বয়ং আবির্ভূত হয়ে সাধুদের পরিত্রাণ করবেন। গীতার মত সেই রূপ শ্রীচণ্ডীতে দেবীও বলেছেন:
ইত্থুং যদা যদা বাধা দানবোত্থা ভবিষ্যতি ।
তদা তদাবতীর্য্যাহং করিষ্যাম্যরিসংক্ষয়ম্‌ ।।
(শ্রীচণ্ডী:১১.৫৪-৫৫)
"দেবী বলছেন, এই প্রকারে যখনই দানবদের প্রাদুর্ভাবে বিঘ্নবাধা উৎপন্ন হবে, তখনই আমি আবির্ভূতা হয়ে দেবশত্রু অসুরদের বিনাশ করব।"
বিভিন্নরূপে দেবী এ জগতে আবির্ভূতা হবেন সাধুদের রক্ষার্থে এবং অসুরদের বিনাশে। শ্রীচণ্ডীতেই দেবীকে মহীস্বরূপা বা পৃথিবীস্বরূপা বলা হয়েছে। জগতে বিভিন্নরূপে তিনি আসবেন। শতবর্ষব্যাপী অনাবৃষ্টির কারণে পৃথিবী জলশূন্যা হয়ে গেলে মুনিগণের স্তবে তিনি অযোনিসম্ভবা হয়ে আবির্ভূতা হয়ে স্তবকারী মুনিগণকে শতনয়নে নিরীক্ষন করবেন। শতনয়ন শব্দটি অনন্ত নয়ন অর্থে ব্যবহৃত। এ শতনয়ন রূপের জন্যে সকল মানুষ তাঁকে শতাক্ষী নামে অভিহিত করবে । এরপরে তিনি নিজদেহ থেকে জীবনধারক শাক উৎপন্ন করে যতদিন বৃষ্টি না হয়, ততদিন পর্যন্ত সমগ্র জগত পালন করে শাকম্ভরী নামে বিখ্যাত হবেন। শাক বলতে বর্তমানে আমরা কোন গাছের পাতাকে বুঝি; কিন্তু শাস্ত্রে শাক শব্দটি পত্র, মূল, কাণ্ড, ত্বক, পুষ্প ইত্যাদি দশপ্রকার। এ জগতের জড়চেতন সকল বস্তুর উপাদান কারণ যেমন দেবী; তেমনি সকল জগতকে পরিচালনার নিমিত্ত কারণও তিনি।অর্থাৎ তিনিই জগতের মধ্যে যেমন আছেন, তেমনি জগতকে পরিচালনাও করছেন। আবার দুর্ভিক্ষ অনাবৃষ্টি পীড়িত অবস্থায় নিজদেহ থেকে অন্ন উৎপন্ন করে জীবকে রক্ষা করেন। এ সকলই তাঁর মায়া, সকলই তাঁর ইচ্ছা এবং সকলই তাঁর লীলা। এক হয়েও লীলা আস্বাদিতে তিনি জগতে বহুধামূর্তিতে আবির্ভূতা হত। সে সকল বহুধা মূর্তি দেখে আমরা বিভ্রান্ত হয়ে যাই। তাঁকে বহু মনে করি। কিন্তু তিনি আদতে একজনই।
দেবীর অনন্ত নামের মধ্যে 'দুর্গা' নামটি অত্যন্ত প্রসিদ্ধ। দুর্গম নামক মহাসুরকে বধ করেই দেবী দুর্গা নামে অভিহিত হবেন। হিমালয়ে ভয়ংকর ভীমামূর্তি ধারণপূর্বক আসুরিক শক্তি হতে মুনিদের রক্ষা করার জন্য দেবী ‘ভীমাদেবী’ নামে খ্যাত হবেন। অরুণ নামক অসুর ত্রিভুবনের মহা বিঘ্ন উৎপন্ন করলে, দেবী কোটিকোটি ভ্রমরের আকৃতি ধারণ করে অরুণাসুরকে বিনাশ করবেন। কোটিকোটি ভ্রমরের রূপ ধারণ করে ত্রিভুবনকে রক্ষা করার জন্যে দেবী 'ভ্রামরী' নামে আখ্যায়িত হবেন।
শাস্ত্রে বর্ণিত প্রতিশ্রুত বিভিন্ন রূপের বাইরে আদ্যাশক্তি মহামায়া বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি শাস্ত্রীয় বর্ণনা অনুসারেই সর্বদা এসেছেন বিষয়টি ঠিক এমন নয়। এর বাইরেও তিনি সাত্ত্বিক স্বভাবের ব্যক্তিবর্গের বিপদে আবির্ভূতা হয়েছেন বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন স্থানে। শুভশক্তির প্রয়োজনে ভক্তের আকাঙ্খা তাঁকে বারেবারে অচিন্ত্য অব্যক্ত থেকে ব্যক্ত করেছে মূর্তিমান করেছেন। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। শ্রাদ্ধশান্তিকর্মে নিয়ম হল- যতক্ষণ শ্রাদ্ধকর্ম সমাধা না হয় ততক্ষণ মৃতব্যক্তির উদ্দেশ্যে যিনি পারলৌকিক কৃত্যাদি করছেন সেই শ্রাদ্ধকর্তা আসন পরিত্যাগ করতে পারেন না। তবে শ্রাদ্ধকর্ম সমাধা না হওয়া পর্যন্ত যদি কখনো এমন হয় যে, শ্রাদ্ধকর্তা শ্রাদ্ধকর্মে বসে দেখছেন; চোখের সামনে তার একমাত্র শিশু সন্তান আগুন নিয়ে খেলা করতে করতে সেই আগুনে পরে গেছে। তখন তিনি কি করবেন? শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে আসনে শ্রাদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বসে থাকবেন, নাকি দৌড়ে গিয়ে আগে সন্তানকে রক্ষা করবেন। তিনি অবশ্যই আগে সন্তানকে রক্ষা করবেন।
ঠিক একইভাবে এ জগতে দেবী অনন্তবার অনন্তরূপে আবির্ভূতা হয়েছেন, জগতকে আসুরিক শক্তির প্রাদুর্ভাব হতে রক্ষা করতে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আসুরিক শক্তি যতই ভয়ঙ্কর হোক, এর বিনাশ হবেই। শুধু ভয় পাওয়া যাবে না। আমরা ভয় পেয়ে যাই এবং ভয় পেয়ে নিজের প্রতি ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলি। এ কারণে আসুরিক শক্তি আরও শক্তিশালী হয়ে আমাদের বেশি করে গ্রাস করতে উদ্যত হয়। কিন্তু ধৈর্যহারা না হয়ে শুধু এ বিষয়টিই স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে, সর্বাবস্থায় ঐশ্বরিক শক্তি আমাদের রক্ষা করবেন।বিশ্বাসটি যদি আমাদের দৃঢ় থাকে, তবে অবশ্যই তিনি আমাদের যে কোন পরিস্থিতিতেই এসে রক্ষা করবেন। বিশ্বাসটি যদি সামান্য নড়বড়ে সুতা দিয়ে বাঁধা থাকে, যা সামান্য টানাহেঁচড়াতেই ছিঁড়ে যায় ; তবে তিনি কিভাবে আসবেন আমাদের রক্ষার্থে। বিশ্বাসের প্রদীপটি এমনভাবে প্রজ্জ্বলিত হতে হবে যে, প্রচণ্ড দমকা বাতাসেও যেন প্রদীপটি নিভে না যায়। সর্বদা মনে রাখতে হবে, ভয়ের কিছু নেই; অসুরেরা পরাজিত হবেই। আজ যাদের মনে হচ্ছে অনন্ত শক্তিশালী, একদিন তারাই তাদের এই পৈশাচিক ভাবাপন্নতার কারণে জগতে পুরাতত্ত্বে রূপান্তরিত হয়ে দৃষ্টান্তে পরিণত হবে।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ। 
মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁