-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালবাসিলাম।

ইংরেজি ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ; বাংলা ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয় 'শেষলেখা' কাব্যগ্রন্থটি। এ কাব্যগ্রন্থে জীবন নাট্যমঞ্চের আলো-ছায়ায় অনেক রুঢ়সত্য, জীবন-সত্যকে কবি আমাদের অত্যন্ত নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখিয়ে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ সময়ের লেখাগুলো নিয়েই শেষলেখা কাব্যগ্রন্থটি তৈরি হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের চরম দার্শনিক উপলব্ধি ধরা আছে এ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোর মধ্যে।শান্তিনিকেতনের উদয়ন বাড়িতে বসে ১৩ মে ১৯৪১, এক গভীর রাত্রিতে (৩.১৫ মি.) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখলেন, "রূপ-নারানের কূলে জেগে উঠিলাম" কবিতাটি। কবিতাটির প্রত্যকটি ছত্রে আছে, রূঢ় বাস্তব জীবনে আপনার স্বরূপ খুঁজে নেওয়ার কথা।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

"রূপ-নারানের কূলে
জেগে উঠিলাম,
জানিলাম এ জগৎ
স্বপ্ন নয়।
রক্তের অক্ষরে দেখিলাম
আপনার রূপ,
চিনিলাম আপনারে
আঘাতে আঘাতে
বেদনায় বেদনায় ;
সত্য যে কঠিন,
কঠিনেরে ভালবাসিলাম,
সে কখনো করে না বঞ্চনা।
আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ জীবন -
সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে,
মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ ক'রে দিতে।"
জীবনের একটি পর্যায়ে গিয়ে মানুষের উপলব্ধি হয়, এ রূপ, রস, আনন্দ, নিরানন্দে জগৎ স্বপ্ন নয়। কঠিন বাস্ততা দিয়ে ঘেরা। সাময়িক মোহে স্বপ্নের মত মনে করে, মানুষ ভুলে করে ; বিভ্রান্ত হয়। যখন সে স্বপ্ন থেকে জেগে ওঠে, তখনই চিনতে পারে চারিপাশের সবাইকে। স্বপ্নের চেনা মুখগুলোকে, বাস্তবে তখন অনেক সময়েই অচেনা বোধ হয়।তখন সে রক্তের অক্ষরে লেখা আশেপাশের রূঢ় বাস্তবতাকে চিনতে পারে। জীবনের বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাতে আঘাতে বেদনায় মানুষ নিজের স্বরূপকে চিনতে পারে। বুঝতে পারে, তার জীবনের সংগ্রাম শুধুই তার। নিজ জীবন সংগ্রামের নৌকা নিজেকেই বইয়ে গন্তব্যে নিয়ে যেতে হবে। নিজের অর্জন নিজেকেই করতে হবে। নিজের কর্মফল নিজেকেই ভোগ করতে হবে।
জীবনে প্রত্যেকটি সম্পর্ক এবং ঘটনার অন্তরালে কিছু কঠিন অপ্রকাশিত সত্য লুকিয়ে থাকে; মানুষ যখন তা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে হঠাৎ জেনে যায় তখন কষ্ট পায়, হৃদয় ভেঙে যায়। কিন্তু সে যদি প্রথম থেকেই জীবনের কঠিন সত্যগুলো কিছুটা জানত ; তাহলে তার আর হঠাৎ করে হৃদয় ভেঙে যাবে না। জীবনে কারো কাছেই খুব একটা আশা করতে নেই। জগৎ-সংসার অনেকটা আমৃত্যু দুঃখের তপস্যাস্থল। আমরা যাকে সুখ বলে মনে কর, এরমধ্যেও দুঃখের বীজ নিহিত। আলোছায়ার খেলার মত আমাদের জীবনে সুখ দুঃখ পপর্যায়ক্রমে খেলা করে। মৃত্যুতেই সাময়িক পরিসমাপ্তি ঘটে দুঃখের। কর্মবন্ধনে আবার জন্ম হয়, আবার মৃত্যু হয়।এভাবেই চক্রাকারে মানুষ মুক্তির পথে অগ্রসর হয়। সত্যের যেমন দারুণ মূল্য, ঠিক তেমনি সত্য লাভের জন্যে মানুষকে দারুণ মূল্য দিতে হয়।
শ্রীশঙ্করাচার্য তাঁর মোহমুদগর গ্রন্থে অতিরিক্ত ধন,জন এবং যৌবনের গর্ব করতে নিষেধ করেছেন। তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, আমাদের এত গর্ব এত অহংকার মহাকাল নিমেষের মধ্যেই এ সকল গর্বের বস্তু হরণ করে নিয়ে যেতে পারে। তাই যতটা সম্ভব এ মায়াময় সংসারের আসক্তি ত্যাগ করাটাই উত্তম।
মা কুরু ধনজনযৌবনগর্বং,
হরতি নিমেষাৎ কালঃ সর্বম্।
মায়াময়মিদমখিলং হিত্বা,
ব্রহ্মপদং প্রবিশাশু বিদিত্বা।।
(মোহমুদগর :৩)
"হে মানব কখনো অতিরিক্ত ধন,জন এবং যৌবনের গর্ব করো না; মহাকাল নিমেষের মধ্যেই তোমার এ সকল গর্বের বস্তু হরণ করে নিয়ে যেতে পারে। তাই মায়াময় এই সংসারের সকল আসক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহৃত করে আস্তে আস্তে ব্রহ্মপদের শরণে যত্নবান হও।"
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্র এবং বিষয়কে উচ্ছিষ্ট করে দিয়েছেন। মানব ভাবজগতের প্রতিটি বিষয়ই বিস্ময়করভাবে তাঁর সৃষ্টিতে উজ্জ্বলিত-প্রতিভাসিত।তিনি ছিলেন সত্য, সুন্দরের সাথে সাথে যুগপৎ অসত্য, অসুন্দরের বিরুদ্ধে দ্রোহেরও কবি। তিনিই আমাদের শিখিয়েছেন,"অন্যায় যে করে, অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তাকে যেন তৃণসম দহে।" বাঙালির জীবনে সর্বক্ষেত্রে ভাষা দিয়েছেন তিনি।সংস্কৃত সাহিত্যে সপ্তম শতাব্দীর কবি বাণ সম্পর্কে বলা হয়- "বাণোচ্ছিষ্টং জগৎ সর্বম্।" অর্থাৎ কবি বাণ কাব্যলক্ষ্মীর প্রতিটি শাখা এবং প্রতিটি বিষয়কেই আস্বাদ করে উচ্ছিষ্ট করে দিয়েছেন। ঠিক একইভাবে বাংলা ভাষায় একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কেও উক্ত কথাটি বলা যায়।বাংলা ভাষা সাহিত্যের প্রতিটি শাখাকে যেভাবে তাঁর সৃষ্টিশীলতার জাদুর কাঠিকে স্পর্শ করে নতুন নতুন রূপদান করেছেন, তা অনন্য বিস্ময়কর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের শিখিয়েছেন, কঠিন সত্যকে ভালবাসতে। সত্য সে যত কঠিনই হোক, নিঃসঙ্কোচে মাথা পেতে মেনে নিতে। আমরা মেনে নিতে পারিনা বা তাতে অভ্যস্ত নই বলেই প্রতিনিয়ত দুঃখ পাই, হৃদয় ভেঙে যায়।
২২ শে শ্রাবণ, বিশ্বকবি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুদিবস। তাই গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজার মত, কবিগুরুর 'শেষলেখা 'কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতা দিয়েই ব্রহ্মজ্ঞ এ অনন্য সৃষ্টিশীল পুরুষের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা-তর্পণ করলাম।
সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ, বাংলাদেশ।।
মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁