আমাদের শাস্ত্রে বিশেষ করে স্কন্দ পুরাণের বিষ্ণুখণ্ডে সুস্পষ্টভাবে শ্রীরাম জন্মভূমি অযোধ্যার অবস্থান এবং মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। অত্যন্ত পবিত্র পুরী অযোধ্যা। এ অযোধ্যাতেই সূর্যবংশীয় ইক্ষ্বাকু, দিলিপ, রঘু, দশরথ, রাম প্রমুখ রাজারা যুগযুগ ধরে রাজত্ব করে ধর্মরাজ্যের স্থাপনা করেছেন। কিন্তু সকল রাজাদের ছাপিয়ে গিয়েছেন শ্রীরামচন্দ্র। তাই আজও তিনি মনুষ্যকুলের আদর্শ বলে মর্যাদাপুরুষোত্তম বলা হয়। মঙ্গলময় তাঁর স্বরূপ, তাই তাঁকে রামভদ্রায় বলে। ধরিত্রীর অজ্ঞানের অন্ধকারে চন্দ্রের মত তিনি শোভমান, তাই তাঁকে রামচন্দ্রায় বলে।
রামায় রামভদ্রায় রামচন্দ্রায় বেধসে।রঘুনাথায় নাথায় সীতায়াঃ পতয়ে নমঃ।।
স্কন্দ পুরাণের বিষ্ণুখণ্ডে ভারদ্বাজ প্রমুখ অমল মুনিগণ ব্যাসশিষ্য রোমহর্ষণ সূতের কাছে পবিত্র অযোধ্যা নগরীর মাহাত্ম্য সবিস্তারে জানতে চাইলেন। তাঁরা রোমহর্ষণ সূতকে বললেন, "হে মহাভাগ, মহাপুরী সতত পবিত্রা বিষ্ণুপ্রিয়া অযোধ্যাপুরীর মাহাত্ম্য সবিস্তারে আমাদের বলুন।"
তখন ব্যাসশিষ্য রোমহর্ষণ সূত সবিস্তারে অযোধ্যা মাহাত্ম্য বলতে শুরু করলেন। প্রথমেই তিনি স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, অযোধ্যা নগরী এতটা পবিত্র স্থান, যে স্থানে দুষ্কৃতকারীরা বসবাস করতে পারে না; স্বয়ং শ্রীহরি সেখানে মূর্তিমান হয়ে বিরাজ করেন। রোমহর্ষণ সূতের কথার সত্যতা আমরা ইতিহাসেও দেখি। বিভিন্ন সময়ে অনেক দুষ্কৃতকারী তাদের বিভিন্ন দুষ্কর্ম দিয়ে অযোধ্যাকে কলুষিত করতে চেয়েছে। কিন্তু তারা সর্বদাই অসফল হয়েছ। অযোধ্যা আরও বেশী সর্বগ্রাসী রূপ ধরে জ্বাজ্জল্যমান হয়েছে। দুষ্কৃতকারীরা হয়ত জানেনা, অযোধ্যাতে স্বয়ং শ্রীহরি মূর্তিমান হয়ে বিরাজমান।
অযোধ্যা সা পরা মেধ্যা পুরী পুরী দুষ্কৃতিদুর্লভা।কস্য সেব্যা চ নাযোধ্যা যস্যাং সাক্ষাদ্ধরিঃ স্বয়ম্।।সরযূতীরমাসাদ্য দিব্যা পরমশোভনা।অমরাবতীনিভা প্রায়ঃ শ্রিতা বহুতপোধনৈঃ।।(স্কন্দ পুরাণ: বিষ্ণুখণ্ড,অযোধ্যা, প্রথম অধ্যায়,৩০-৩১)
" যে স্থান অত্যন্ত পবিত্র, যে স্থানে দুষ্কৃতকারীরা বসবাস করতে পারে না; যেখানে স্বয়ং শ্রীহরি মূর্তিমান হয়ে বিরাজ করেন, এমন পবিত্র অযোধ্যা পুরীর কে না সেবা করতে চায়? স্বর্গের নগরী অমরাবতীর মত পরম শোভাশালিনী দিব্যপুরী অযোধ্যা সরযূনদীর তীরে অবস্থিত।এ পুরীর সর্বত্রই তপধনগণ সুখে বসবাস করেন।"
পবিত্র অযোধ্যা নগরী দেবরাজ ইন্দ্রের ইন্দ্রপুরীর অনুকরণে নির্মিত। ইক্ষ্বাকুপ্রমুখ সূর্যবংশের রাজাগণ এখানে জন্মগ্রহণ করে রাজত্ব করেছেন। এ নগরী পবিত্র সরযূ নদীর তীরে স্থাপিত। অত্যন্ত পবিত্র এ সরযূ নদী মানস সরোবর হতে জাত এবং ভগবান বিষ্ণুর বাম অঙ্গুষ্ঠ হতে নিঃসৃত। ভগবান শ্রীরামচন্দ্র এ নদীর সাথে মিশে আছেন। ভগবান তাঁর পুরুষোত্তম লীলা সংবরণ করে এ নদীতে ডুব দিয়েই তিনি মহাপ্রস্থান করেন। মহাপ্রস্থানের পূর্বে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র ভক্ত হনুমানকে দায়িত্ব দিয়ে যান সকল রামভক্তদের সর্বদা রক্ষা করতে। ভগবান শ্রীরামচন্দ্র বলেন,"হে বায়ুতনয়, তুমি চিরজীবী হবে, যে পর্যন্ত লোক সকল আমার কথা কীর্তন করবে, তুমি আমার প্রতিজ্ঞা পালন করতে ততকাল জীবন ধারণ করবে।" এ কারণেই আমরা আজও দেখি যেখানেই শ্রীরামচন্দ্র সেখানেই ভক্ত হনুমান। আগে ভক্ত হনুমানকে স্মরণ করেই, পরে ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের শরণ নেই আমরা।
ওঙ্কার শব্দে যেমন সৃষ্টি, স্থিতি এবং লয়ের অধিপতি ব্রহ্মা বিষ্ণু এবং রুদ্র বিরাজ করে ; তেমনি অযোধ্যা শব্দটির মধ্যেও এ ত্রিদেব বিরাজ করেন। তাই অযোধ্যা নাম স্মরণেও মহাপুণ্য হয়।অযোধ্যা শব্দের মাহাত্ম্য প্রসঙ্গে অগস্ত্য ঋষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেবকে বলেছেন:
অকারো ব্রহ্ম চ প্রোক্তং যকারো বিষ্ণুরুচ্যতে।ধকারো রুদ্ররূপশ্চ অযোধ্যানাম রাজতে।।(স্কন্দ পুরাণ: বিষ্ণুখণ্ড, অযোধ্যা, প্রথম অধ্যায়, ৬০)
"শাস্ত্র বলে, 'অ'-কার ব্রহ্ম, 'য'-কার বিষ্ণু এবং 'ধ'-কার রুদ্রের রূপ; অযোধ্যা এ বর্ণত্রয়ে ব্রহ্মা বিষ্ণু রুদ্র সতত বাস করে।"
অসংখ্য ঋষি, মুনি এবং মহাত্মারা অযোধ্যাতে সাধনা করেছেন। তাঁদের মধ্যে বেদ বেদাঙ্গে পারঙ্গম বিষ্ণুশর্মা প্রধানতম। তিনি তীর্থযাত্রা উপলক্ষে পর্যটন করতে করতে অযোধ্যার চক্রতীর্থে এসে, ইন্দ্রিয়কে সংযত করে কঠোর তপস্যা করেন। তাঁর কঠোর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে ভগবান শ্রীবিষ্ণু তাঁকে দর্শন দিয়ে বলেন, "আমার নামের আগে তোমার নাম যুক্ত হয়ে, অযোধ্যার চক্রতীর্থে আমার মূর্তি বিষ্ণুহরি নামে খ্যাত হবে এবং ভক্তদের মুক্তি দান করবে।" সেই থেকে ভগবানের বিগ্রহ অযোধ্যার চক্রতীর্থে বিষ্ণুহরি নামে সদা খ্যাত হয়ে জীবকে মুক্তি দান করছে।
পুরাকালে পিতামহ ব্রহ্মাও অযোধ্যায় চক্রতীর্থে বাস করেছিলেন। তিনি তখন নানা দেবতাদের সাথে নিয়ে এক বৃহৎ কুণ্ড নির্মাণ করে এক পবিত্র যজ্ঞ করেছিলেন। পিতামহ ব্রহ্মার দ্বারা তৈরি হওয়ায় সেই কুণ্ডের নাম হয় ব্রহ্মকুণ্ড। ভগবান ব্রহ্মা প্রতিশ্রুতি দেন তিনি সতত এ কুণ্ডে বাস করবেন। এ ব্রহ্মকুণ্ড চক্রতীর্থের পূর্বদিকে অবস্থিত।
স্কন্দ পুরাণে অগস্ত্য ঋষি কতৃক স্বর্গদ্বার এবং মুক্তিদ্বার তীর্থ সহ অযোধ্যাতে অবস্থিত অসংখ্য তীর্থের বর্ণনা এবং মাহাত্ম্য বিস্তৃতভাবে দেয়া আছে। প্রত্যেকটি তীর্থের ভৌগোলিক বর্ণনাও দেয়া আছে। তীর্থক্ষেত্রগুলো অযোধ্যা বা সরযূ নদীর কোন পাশে, কোন কোণে এবং কতটা দূরত্বে অবস্থিত; এ বিষয়ে অগস্ত্য ঋষি বিস্তারিত বলেছেন কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেবকে। অযোধ্যাতে সরযূ ও ঘর্ঘরসঙ্গমে স্নান মাহাত্ম্য অপরিসীম। এছাড়া অযোধ্যাক্ষেত্রে বিভিন্ন তীর্থ বিরাজমান। তীর্থগুলো হল:গোপ্রতার তীর্থ, ক্ষীরোদ তীর্থ , ধনযক্ষ তীর্থ , বশিষ্ঠকুণ্ড, যোগিনী কুণ্ড, ঊর্বশীকুণ্ড, ঘোষার্ককুণ্ড, রুক্মিণীকুণ্ড, বৃহস্পতিকুণ্ড, সাগর কুণ্ড, রতি কুণ্ড, কাম কুণ্ড, সুগ্রীব তীর্থ, বিভীষণ সরোবর,গয়াকূপ, ভরতকুণ্ড,ভৈরব কুণ্ড, জটাকুণ্ড, শ্রীরামজন্মস্থান প্রমুখ।
অযোধ্যাতে তিলোদকী সঙ্গমের পশ্চিমে সরযূতীরে সর্বকামদ একটি বিখাত তীর্থ রয়েছে; এ তীর্থের নাম সীতাকুণ্ড। স্বয়ং সীতাদেবী এ কুণ্ড নির্মাণ করেছিলেন।মানব এ সীতাকুণ্ডে স্নান করে নিখিল পাপ থেকে মুক্ত হয়। অত্যন্ত পবিত্র এ তীর্থ। সাধারণত একই নামে দুটি তীর্থ থাকেনা। সীতাকুণ্ড নামে চট্টগ্রামে অন্য আরেকটি তীর্থ আছে। তীর্থটি প্রধানত দেবীপীঠ। দেবীর নাম ভবানী এবং ভৈরবের নাম চন্দ্রশেখর। চট্টগ্রামে সীতাকুণ্ড তীর্থটি দেবী সীতার সাথে সম্পর্কিত কিনা এবং সীতাদেবী বনবাসকালে বঙ্গে এসেছেন কিনা ; বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বর্তমানকালে আমরা দেখতে পাই, বৃন্দাবনের রাধাকুণ্ড শ্যামকুণ্ডের অনুসরণে, ওখানকার মাটি জল নিয়ে এসে বৈষ্ণবেরা বিশেষ করে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের সাধুসন্তগণ বিভিন্ন স্থানে রাধাকুণ্ড শ্যামকুণ্ড স্থাপন করেন। বাংলাদেশের সীতাকুণ্ডে ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। কোন সাধুসন্ত হয়ত অযোধ্যার সীতাকুণ্ড থেকে মাটি জল নিয়ে এসে, চট্টগ্রামে স্থাপন করে সীতাকুণ্ড তৈরি করেছে। বিষয়টি নিয়ে নিশ্চিত করে কিছুই বলা সম্ভব নয়। সকলই অনুমান। তবে বিষয়টি নিয়ে আগামীতে বৃহত্তর পরিসরে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।
অযোধ্যার সর্বশ্রেষ্ঠ মাহাত্ম্যপূর্ণ স্থান হল শ্রীরামজন্মভূমি। এ জন্মভূমি প্রসঙ্গে স্কন্দ পুরাণের অযোধ্যামাহাত্ম্য অংশে, জন্মভূমির অবস্থানের ভৌগোলিক বর্ণনা সহ মাহাত্ম্য দেয়া আছে। সেখানে জন্মভূমির অবস্থান সম্পর্কে অগস্ত্য ঋষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেবকে বললেন:
"বিঘ্নেশের ঈশানকোনে মোক্ষাদি ফলসাধন শ্রীরামজন্মস্থান বিদ্যমান। বিঘ্নশের পূর্বে, বশিষ্ঠের উত্তর, ও লৌমশের পশ্চিমে জন্মস্থান অবস্থিত। এ স্থান দর্শনে মানবের গর্ভবাস দূর হয়। জন্মবন্ধন থেকে মানব মুক্ত হয়। জন্মভূমির দর্শন মাত্রই প্রতিদিন সহস্র সহস্র কপিলা গোদানের ফললাভ হয়ে থাকে।আশ্রমবাসী তাপসের যে পুণ্য; সহস্র রাজসূয় যজ্ঞে যে পুণ্য; প্রতি বছরে অগ্নিহোত্র যজ্ঞ করলে যে ফল লাভ হয়; মানব শুধুমাত্র নিয়ম করে শ্রীরাম জন্মভূমি দর্শন করলেই সে সকল পুণ্য লাভ করে। সাধু চরিত্র ব্যক্তি মাতা, পিতা ও গুরুজনের প্রতি ভক্তি প্রদর্শন করে যে ফল লাভ হয়, জন্মভূমির দর্শনেই সে ফল লাভ হয়। সরযূদর্শনে পিতৃগণের অক্ষয় তৃপ্তি, গয়াতে শ্রাদ্ধ হতেও, সরযূ দর্শনের ফল অধিক।"
এখানে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, বিঘ্নশ তীর্থের পূর্বে, বশিষ্ঠ কুণ্ডের উত্তরে এবং লৌমশ তীর্থের পশ্চিমে শ্রীরাম জন্মস্থান অবস্থিত। পুরাণে বর্ণিত অবস্থানে বর্তমানেও অযোধ্যা ঠিক একইভাবে আছে। অযোধ্যা একটি মন্দিরের নগরী। আজও হাজার হাজার মন্দির পরিবেষ্টিত আছে শ্রীরামজন্মভূমি। পুরাণের সাথে বর্তমান ভৌগোলিক অবস্থানের সম্পূর্ণ মিল পুরাণের সত্যতা প্রমাণ করে। অগস্ত্য ঋষি জন্মভূমির অবস্থানের বর্ণনা করে, তিনি এ জন্মভূমি দর্শনের অপরিসীম মাহাত্ম্যের কথা বারেবারে উল্লেখ করেছেন।
যে কোন মানবের জীবনে একবার হলেও এ অযোধ্যাতে অবস্থিত শ্রীরা জন্মভূমি তীর্থ দর্শন করা উচিত। স্বচক্ষে অযোধ্যাকে দর্শন করতে যদি অসম্ভব হয়, তবে ঘরে বসে হলেও পুণ্যভূমি অযোধ্যাকে স্মরণ করা উচিত। শাস্ত্রে বলা আছে, "অযোধ্যা স্মরণে শত কল্পান্তেও পুনর্জন্ম হয় না।"
যত্র কুত্র স্থিতো যস্তু হ্যযোধ্যাং মনসা স্মরেৎ।ন তস্য পুনরাবৃত্তিঃ কল্পান্তরশতৈরপি।।(স্কন্দ পুরাণ: বিষ্ণুখণ্ড, অযোধ্যা, দশম অধ্যায়, ৩৪)
" মানব যেখানেই থাকুক না কেন, মনে মনে অযোধ্যাকে স্মরণ করলেও, তার শত কল্পান্তেও পুনর্জন্ম হয় না।"
'রাম' শব্দের অর্থ আনন্দ। রাম ভগবানের আনন্দঘন স্বরূপ। রাম নামে জীব আনন্দ লাভ করে এবং মুক্ত হয়। আজ উত্তর ভারত সহ পৃথিবী জুড়ে রামনামের বন্যা। উত্তর ভারতে রামনামের বন্যা যিনি তৈরি করেছেন, তিনি হলেন আচার্য রামানন্দ এবং তাঁর কবির, রবিদাস, তুলসীদাস আদি শিষ্যরা। তাঁদের শুদ্ধ প্রচারেই ঘরে ঘরে আজ রামনাম। প্রাণীগণ নিমেষ বা নিমেষার্দ্ধকালেও যদি শ্রীরামকে স্মরণ করে, তবে তাদের সকল অজ্ঞান বিদূরিত হয়।
নিমিষং নিমিষার্দ্ধং বা প্রাণিনাং রামচিন্তনম্।সংসারকারণাজ্ঞাননাশকং জায়তে ধ্রুবম্।।(স্কন্দ পুরাণ: বিষ্ণুখণ্ড, অযোধ্যা, দশম অধ্যায়, ৩৩)
"প্রাণীগণ নিমেষ বা নিমেষার্দ্ধকাল রাম চিন্তায় সংসারের অজ্ঞান বিনাশ হয়; এ বিষয়ে কোন সংশয় নেই।"
আজ পৃথিবীর সকল রামভক্তদের কাছে মন্ত্রে পরিণত হয়েছে সাধক শ্রীলক্ষ্মণাচার্যের লেখা শ্রীরামচন্দ্রের একটি ভজন। ভজনটিতে শ্রীরামচন্দ্রকে পতিতপাবন রাজারাম বলে বন্দনা করা হয়েছে। তিনি সত্যিই পতিতপাবন, যিনি গুহক চণ্ডালকে বন্ধুর মর্যাদা দিয়েছিলেন; অহোল্যাকে পাষাণ থেকে উদ্ধার করেছিলেন; শূদ্র শবরীর মুখের ফল খেয়েছিলেন; যিনি সামান্য বানরকুলকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন; যিনি প্রজার কল্যাণের জন্যে নিজের সুখ শান্তি সকলই বিসর্জন দিয়েছিলেন; যিনি অধর্মকে নাশ করে ধর্মরাজ্য সংস্থাপিত করেছিলেন; তাই অনন্তকাল ধরে অক্ষুণ্ণ থাকবে পতিতপাবন রাজারামের মহিমা।
"রঘুপতি রাঘব রাজারাম,পতিত পাবন সীতারাম।।সুন্দর বিগ্রহ মেঘশ্যাম, গঙ্গা তুলসী শালগ্রাম।।ভদ্র গিরিশ্বর সীতারাম,ভগত-জনপ্রিয় সীতারাম।।জানকীরমণা সীতারাম, জয় জয় রাঘব সীতারাম।।"
বৃহত্তর ভারতীয় সংস্কৃতির কেন্দ্র ভগবান শ্রীরাম এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তাঁদের কর্মের বর্ণনা বর্ণিত হয়েছে, পৃথিবীর প্রাচীনতম মহাকাব্য রামায়ণ মহাভারতে। এ গ্রন্থদুটিতে ভারতবর্ষে চিরকালের ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। বিষয়টি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অত্যন্ত সুন্দর করে বলেছেন:
"রামায়ণ-মহাভারতকে কেবলমাত্র মহাকাব্য বলিলে চলিবে না, তাহা ইতিহাসও বটে; ঘটনাবলীর ইতিহাস নহে, কারণ সেরূপ ইতিহাস সময়বিশেষকে অবলম্বন করিয়া থাকে—রামায়ণ-মহাভারত ভারতবর্ষের চিরকালের ইতিহাস। অন্য ইতিহাস কালে কালে কতই পরিবর্তিত হইল, কিন্তু এ ইতিহাসের পরিবর্তন হয় নাই। ভারতবর্ষের যাহা সাধনা, যাহা আরাধনা, যাহা সংকল্প, তাহারই ইতিহাস এই দুই বিপুল কাব্যহর্ম্যের মধ্যে চিরকালের সিংহাসনে বিরাজমান।"
( দীনেশচন্দ্র সেন রচিত 'রামায়ণী কথা'র পূর্বে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ভূমিকা )
বাঙালির জীবনে শ্রীরামচন্দ্রের প্রভাব অপরিসীম। মধ্যযুগের বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্য নিদর্শন হল শ্রীরামচন্দ্রের জীবনী, কৃত্তিবাসী রামায়ণ। রামময় বাঙালির জীবন। আজও কোন বিস্ময়ের বা দুঃখের ঘটনায় আমরা বলি, হে রাম, হায় রাম ইত্যাদি। বঙ্গদেশে অসংখ্য খ্যাতিমান মানুষের নামের মাঝেই শ্রীরামচন্দ্র বিরাজিত।বৌদ্ধরাজা রামপাল থেকে শুরু করে মধ্যযুগে সাধক রামপ্রসাদ বর্তমানকালে রামকৃষ্ণ ; আজও বাঙালির নামকরণে রামনামের জয়জয়কার। রামায়ণে বিষয়টির উল্লেখ না থাকলেও কালিকা পুরাণ অবলম্বন করে শারদীয় দুর্গোৎসবের অকালবোধনের দুর্গাপূজাও শ্রীরামকে কেন্দ্র করে। জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে বাঙ্গালীর উপাস্য শ্রীরাম।রামকৃষ্ণ, সারদাদেবী, রাণী রাসমণির কূলদেবতাও রঘুবীর রাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ বাঙালি সাহিত্যিকেরা শ্রীরামচন্দ্রকে নিয়ে সাহিত্য রচনা করেছেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বিপ্লবী স্বদেশীদের কাছে মাতৃভূমি স্বাধীন করে এক আদর্শিক রাজ্যের স্বপ্ন ছিল; সে স্বপ্ন হল রামরাজ্যের স্বপ্ন। হৃদয়ের সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা, ভক্তি এবং ভালবাসা দিয়ে যদি আমরা ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের শরণাগত হতে পারি; তবে তিনিও আমাদের একান্ত আপনজন হয়ে অভয় দান করবেন। এ প্রতিশ্রুতি তিনিই আমাদের দিয়েছেন।
সকৃদেব প্রপন্নায় তবাস্মীতি চ যাচতে।অভয়ং সর্বভুতেভ্যো দদাম্যেতদ্ ব্রতং মম।।(রামায়ণ:যুদ্ধকাণ্ড, ১৮.৩৩)
"কেউ যদি শরণাগত হয়ে একবার মাত্র বলে আমি তোমার, তবে আমি তাকে অভয় দান করি। এই আমার ব্রত।"
সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ, বাংলাদেশ।।