-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

অন্নদাশঙ্কর রায়ের কবিতা, এবং বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ।

এক (০১)

"যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।
দিকে দিকে আজ অশ্রুমালা রক্তগঙ্গা বহমান
তবু নাই ভয় হবে হবে জয়, জয় মুজিবুর রহমান।"
অন্নদাশঙ্কর রায়ের কবিতা,  এবং বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শেষ পর্যায়ে, বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলেন। অন্নদাশঙ্কর রায় কবিতাটি লিখেছিলেন ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বরের কিছুদিন আগে বা পরে। এ কবিতাটি সম্পর্কে অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁর স্মৃতিচারণায় বলেছেন:
"তারিখটা ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ভারত দিয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি। আমরা কজন সাহিত্যিক যাচ্ছি সব স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধান পুরুষদের অভিনন্দন জানাতে মুজিবনগরে।...
শেখ মুজিবুর রহমান যদিও মুজিবনগর সরকারের শীর্ষে তবু তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকার মুজিবনগরে গিয়ে সম্ভব হতো না। সেদিন মুজিবনগর থেকে ফিরে আসি তাঁর জন্যে ভয় ভাবনা ও প্রার্থনা নিয়ে। যুদ্ধ তখনো শেষ হয়নি, তার সবে আরম্ভ। যুদ্ধে হেরে গেলে পাকিস্তানিরা কি শেখ সাহেবকে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে দেবে? প্রতিশোধ নেবে না? এর মাস চার-পাঁচ আগে থেকেই তাঁর প্রাণ রক্ষার জন্যে আবেদন বিশ্বময় ধ্বনিত হয়েছিল। তার জন্যে কলকাতার ময়দানে আমরা সাহিত্যিকরাও জমা হয়েছিলুম। তার কিছুদিন আগে কি পরে আমি রচনা করি যতকাল রবে...।”
(অন্নদাশঙ্কর রায়: কাঁদো প্রিয় দেশ, প্রথম বাংলাদেশ সংস্করণ, অন্বেষা, ঢাকা ২০১০, পৃষ্ঠা ৫৮-৬০)
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘাতকের বিশ্বাসঘাতকতায় নিহত হওয়ার পর কবিতাটি আরো সহস্র সহস্র অর্ঘ্যপাত্রের দীপজ্যোতি জ্বেলে অনন্য অসাধারণ হয়ে ওঠে বাংলাদেশের সকল শ্রেণি, পেশার মানুষের হৃদয়ে; এবং এই কবিটার চরণগুলির মর্মার্থ, তাৎপর্য নতুন নতুন করে পাঠকের কাছে ধরা পড়ে। বিশেষ করে, ‘ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান’ চরণটি অধিকতর বাঙ্ময় হয়ে ওঠে বাঙালী হৃদয়ে।
১৯৭৮ সালের একুশের সংকলন 'এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়' দেশের সকল মহলেই আলোড়ন সৃষ্টি করে। এতেই প্রথম প্রকাশিত হয় অন্নদাশঙ্কর রায়ের সেই চার লাইনের কবিতা আট লাইনে দীর্ঘ হয়ে। সেখানে কিছু কথা পরিবর্তিতও হয়ে যায় এবং অনেক ক্ষেত্রেই মূলের অনুষঙ্গী হয়নি।১৯৭৮ সালের এ সংকলনে প্রকাশিত পরিবর্তিত কবিতাটি ছিল নিম্নরূপ:
"যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা
গৌরী যমুনা বহমান।
ততদিন রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান।
দিকে দিকে আজ অশ্রু গঙ্গা
রক্ত গঙ্গা বহমান
নাই নাই ভয় হবে হবে জয়
জয় মুজিবুর রহমান।"
(এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়, একুশের সংকলন, ঢাকা ১৯৭৮)
দুই(০২)
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের অনন্য বিশ্বখ্যাত ভাষণটির পরে আমার দৃষ্টিতে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ হল ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশ গণপরিষদে ভাষণ। এ ভাষণে শুরুতে বঙ্গবন্ধু স্মরণ করিয়ে দেন বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য এর সাথে সাথে বাঙালীদের বিপ্লব -বিদ্রোহের স্বাভিমানের রক্তের অক্ষরে লেখা জাজ্বল্যময় ইতিহাস। তিনি স্মরণ করেন চট্টগ্রাম জালালাবাদ পাহাড়ে স্বাধীনতার নায়ক মাস্টারদাকে। তিনি স্মরণ করেন বাংলার সকল স্বদেশী, বিপ্লবীদের যাঁরা দেশমাতৃকার জন্যে হাসতে হাসতে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলে আত্মাহুতি দিয়েছেন।
৪ নভেম্বরে ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং পরিশেষে ধর্মনিরপেক্ষতাকে অসাধারণভাবে ব্যাখ্যা করেন। যে কথাগুলি দেশের সকল প্রগতিশীল বা আওয়ামী রাজনীতির সাথে যুক্ত সকলের স্মরণে, মননে এবং কর্মে থাকা উচিৎ বলে মনে করি। কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার যেমন সকল বামপন্থীদের অবশ্যপাঠ্য, ঠিক একইভাবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণগুলি বিশেষ করে ৭ মার্চ এবং ৪ নভেম্বরের এই দুটি ভাষণ দেশের বিশেষ করে প্রগতিশীল রাজনৈতিক ভাবাদর্শের সাথে যুক্ত সকলের জানা এবং ঠোটস্থ থাকা প্রয়োজন।
বর্তমানে দেশে ধর্মান্ধতা, অসহিষ্ণুতা যেভাবে জ্যামিতিক হারে বেড়ে চলছে, সেই প্রেক্ষাপটে সকল প্রগতিশীল, মুক্তবুদ্ধির মানুষদের মাঝেই এক অজানা আশঙ্কা বিরাজ করছে। তবে অশঙ্কার আচ একটু বেশীই পড়ছে সংখ্যালঘুদের মনোজগতে এবং যাপিত জীবনে। সেই প্রেক্ষাপটে, বঙ্গবন্ধুর ৪ নভেম্বরের খসড়া সংবিধান অনুমোদন উপলক্ষে ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কিত যে যুক্তি উপস্থাপন করেছেন, তা আমাদের সকলেরই জানা একান্ত প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু বলেন:
"ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবও না। ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাঁধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রের কারো নেই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কারো বাঁধা দেওয়ার ক্ষমতা নাই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খ্রীস্টানরা তাদের ধর্ম করবে, তাদের কেউ বাঁধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে না।
পঁচিশ বৎসর আমরা দেখেছি ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেঈমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, ধর্মের নামে খুন, ধর্মের নামে ব্যাভিচার- এই বাংলাদেশের মাটিতে এসব চলেছে।
ধর্ম অত্যন্ত পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলবো, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি, সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করছি। যদি কেউ বলে গণতান্ত্রিক মৌলিক অধিকার নাই, আমি বলবো সাড়ে সাতকোটি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে যদি গুটি কয়েক লোকের অধিকার হরণ করতে হয়, তাহলে তা করতেই হবে।"
এ ঐতিহাসিক ভাষণের শেষপ্রান্তে বঙ্গবন্ধু যে কথাগুলি বলেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং বর্তমান সময়ের জন্যে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেন:
"ভবিষ্যৎ বংশধররা যদি সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে শোষণহীন সমাজ গঠন করতে পারে, তাহলে আমার জীবন সার্থক, শহীদদের রক্তদান সার্থক।"
আগস্টের এই শোকাবহ মাসে শুধুমাত্র শোক নয়, বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রের প্রধান চার মূলনীতি বাস্তবায়নের আকাঙ্ক্ষিত আদর্শ আমাদের নিজ জীবন এবং জাতীয় জীবনে বাস্তবায়িত করে শোককে যেন আমরা শক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারি ;এই হোক আমাদের রক্তাক্ত আগস্টের অঙ্গীকার।
সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ, বাংলাদেশ।।
মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁