-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

"মন সহজে কি সই হবা" মন বাবুইপাখির মত, নিত্য সঙ্গী খোঁজে ।

যা প্রচণ্ড শক্তিশালী, তা সবসময়ই বিপদজনক হয় যদি তাকে ঠিকমত নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনা করা না হয়। সকল কিছুই নির্ভর করে নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনার উপরে। আগুন যেমন বিপদজনক, নিমেষেই সকল কিছু পুড়িয়ে শেষ করে দিতে পারে। আবার আগুন দিয়ে রান্না করে খেয়ে মানুষ বেঁচে থাকে। তাই সতর্কতা বজায় রেখে, জীবনের প্রত্যেকটি দিন আগুনের অনিবার্য প্রয়োজনীয়তা আছে। যার ক্রিয়া আছে, তার প্রতিক্রিয়াও আছে; যার কোন প্রতিক্রিয়া নেই, বুঝতে হবে তার ক্রিয়াও নেই। ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া মুদ্রার মত একটি অন্যটির পরিপূরক।  মনের থেকে গতিশীল জগতে কিছুই নেই, সে সেকেন্ডে যেখানে যেতে চায়, সেখানেই পৌঁছে যায়। মন একটি পাগলা ঘোড়ার মত। সে কোথা থেকে যে কোথায় নিয়ে যাবে, তার ঠিক ঠিকানা নেই; যদি সারথি ঠিক না থাকে। মনের কাজ হল, সঙ্কল্পবিকল্পাত্মক। মনের চিন্তা প্রতি ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তিত হয়।এখনি যা ভাল লাগে, পরক্ষণেই তার বিষের মত মনে হয়।তাই মনের রশিকে শক্ত হাতে ধরতে হয়। এ চঞ্চল মনের কথা বিস্তৃতভাবে শ্রীমদ্ভগবদগীতাতেও বলা হয়েছে।

চঞ্চল হি মনঃ কৃষ্ণ প্রমাথি বলবৎ দৃঢম্।
তস্যাহং নিগ্রহং মন্যে বায়োরিব সুদুষ্করম্।।
(গীতা:৬.৩৪)
"হে কৃষ্ণ, মন অত্যন্ত চঞ্চল, ইন্দ্রিয়াদির বিক্ষোভকারী, দৃঢ় ও শক্তিশালী। তাই তাকে বশে রাখা, বায়ুকে নিরুদ্ধ করার মত দুষ্কর বলে মনে করি।"
এর উত্তরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, হে অর্জুন মন নিঃসন্দেহে স্বভাবতই চঞ্চল ঠিক আছে, একে নিরোধ করা দুষ্কর ; তাতে সন্দেহ নেই।কিন্তু হে কৌন্তেয়, অভ্যাস এবং বৈরাগ্যের দ্বারা চঞ্চল মনকে বশিভূত করা যায়।
"মন সহজে কি সই হবা" মন বাবুইপাখির মত, নিত্য সঙ্গী খোঁজে ।
অভ্যাস এবং বৈরাগ্যভাব দ্বারা চঞ্চল মনকে নিয়ন্ত্রিত করা গেলেও, আমরা কয়জনে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি বা চেষ্টা করছি? আমাদের মনজগত অনেকটা বাবুইপাখির মত। বাবুইপাখি এক এক মৌসুমে পাঁচ ছয়টি সঙ্গীর সাথে কাটিয়ে পরবর্তীতে এদের কারো সাথেই আর যোগাযোগ রাখে না। নিত্যনতুন সঙ্গীর পেছনে ছোটে সে। অথচ এ প্রত্যেকটি সঙ্গীকে পেতে তার অসম্ভব কষ্ট করতে হয়। সঙ্গীকে মুগ্ধ করার পরে, যখন স্ত্রী সঙ্গী ডিম দেয়, ডিম থেকে বাচ্চা ফোঁটে তখন বাবুইপাখি আবার নতুন সঙ্গীর খোঁজে চলে যায়। অনন্য সুন্দর বাসা বাঁধে বলে, বাবুইপাখিকে তাঁতি পাখি (Weaver Bird) বা শিল্পীপাখি বলে অভিহিত করা হয়। এদের বাসার গঠন বেশ জটিল এবং সুন্দর। অনেক সময়ে বাবুইপাখির বাসাগুলোতে একাধিক কক্ষবিশিষ্টও হয়।এরা মূলত বীজভোজী পাখি, সে জন্য তাদের ঠোঁটের আকৃতি বীজ ভক্ষণের উপযোগী চোঙাকার ।বাবুই পাখি সাধারণত খুঁটে খুঁটে বীজ, ধান, ভাত, পোকা, ঘাস, ছোট উদ্ভিদের পাতা, ফুলের মধু-রেণু ইত্যাদি খেয়ে জীবনধারণ করে থাকে।
আমাদের শহরে তো বটেই, গ্রাম থেকেও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে শিল্পী পাখিটি। তবে এখনো গ্রাম এলাকার তাল, নারিকেল, খেজুর, রেইনট্রি গাছে বাবুইপাখির বাসা দেখা যায়। এরা সাধারণত মানুষের সান্নিধ্যে থাকতে পছন্দ করে।বাবুইয়ের বাসা করার জন্য প্রয়োজন পরে নলখাগড়া ও হোগলার বন। অবশ্য বিভিন্ন ঘাস, নারিকেল এবং তালগাছের লম্বা পাতা চিকন করে চিরেও তারা বাসা তৈরি করে। উল্টানো কলসীর মত দেখতে বাবুই পাখির বাসা। এ বাসা বানাবার জন্য প্রচণ্ড রকমের পরিশ্রম করতে হয় পাখিটিকে।যত্ন করে পেট দিয়ে ঘষে ঘষে বাসার গোল অবয়ব মসৃণ করে তারা।বাসার শুরুতে দুটি নিম্নমুখী গর্ত থাকে। পরে একদিক বন্ধ করে দিয়ে ডিম রাখার ব্যবস্থা করে।বাসাটিকে সুন্দর করতে তার সাধ্যের মধ্যে সকল কিছুই করে। কারণ সুন্দর করে বাসা না বাঁধতে পারলে, সে সঙ্গী পাবে না। একটি কথা প্রচলিত যে, স্ত্রী সঙ্গীকে মুগ্ধ করতে বাবুইপাখি রাতের বেলায় ঘরে জোনাকি পোকা ধরে নিয়ে আসে ঘর আলোকিত করতে। সকাল হলে আবার তাদের ছেড়ে দেয়। নিজের শিল্পকর্ম এবং যতক্ষণ স্ত্রী সঙ্গীর সাথে থাকে তাকে খুশী করতে সে আপ্রাণ প্রচেষ্টা করে। কিন্তু রহস্যময় হলেও সত্যি, যার জন্যে এত প্রয়াস করে, সেই সঙ্গীর সাথে মিলনের পরে ঘরে ডিম আসলে সে, তাকেই ছেড়ে আবার নতুন বাসা বাঁধে এবং অন্য সঙ্গী খুঁজতে থাকে।
বৈশাখ জৈষ্ঠ্যমাস সাধারণত বাবুইপাখির প্রজননের সময়; এ সময়ে তারা সবচেয়ে বেশী সৃষ্টিশীল সক্রিয় থাকে।বাসা তৈরি করার পর সঙ্গী খুঁজতে যায় অন্য বাসায়।এ সময়ে তারা একটার পর একটা বাসা তৈরি করে নতুন নতুন সঙ্গীর সাথে সময় কাটায়।বাসা তৈরির কাজ অর্ধেক সমাপ্ত হলেই স্ত্রী বাবুইকে আকৃষ্ট করতে বিভিন্নভাবে ডাকতে থাকে। সে ডাকে সাড়া দিয়ে, স্ত্রী বাবুই আসলে; বাবুইপাখি তাকে তার সদ্য তৈরি কাঙ্ক্ষিত বাসা দেখায়। স্ত্রী বাবুই বাসাটি ঘুরে ঘুরে দেখে। বাসা পছন্দ হলেই স্ত্রী বাবুই পুরুষ বাবুইপাখির ভাব-ভালোবাসা গ্রহণ করে। দৈহিক সৌন্দর্যের চাইতে বাসার সৌন্দর্যই থাকে স্ত্রী বাবুই পাখির কাছে মুখ্য। তাই বাসা পছন্দ হলেই, কেবল এদের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পুরুষ বাবুইপাখি যদি স্ত্রী বাবুই পাখির সুন্দর বাসা তৈরির পরীক্ষায় পাশ করে ; তবেই দুজনে একসাথে বসবাস করা শুরু করে। অর্ধসমাপ্ত বাসাটি এরপরে দুজনে মিলে দ্রততায় চার থেকে পাঁচদিনের মধ্যে সমাপ্ত করে। একটি মৌসুমে প্রায় পাঁচ ছয়টি বাসা এবং যতটা বাসা, ঠিক ততটা স্ত্রী সঙ্গীর সাথে সময় কাটায় পুরুষ বাবুইপাখি। স্ত্রী বাবুই পাখির প্রেরণায় পুরুষ বাবুই পাখি মনের আনন্দে নিপুণভাবে বিরামহীন বাসা তৈরির কাজ শেষ করে। তবে প্রেমিক বাবুই পাখি যতই ভাব-ভালোবাসা প্রকাশ করুক না কেন, প্রেমিকা বাবুই পাখির ডিম দেওয়ার সাথে সাথেই; প্রেমিক বাবুই পাখি আবার খুঁজতে থাকে অন্য সঙ্গী। স্ত্রী বাবুই ডিমে তা দেওয়ার, দুই সপ্তাহের মধ্যে ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে বের হয়। তিন সপ্তাহ পর বাবুই বাচ্চা স্ত্রী সবাইকে ছেড়ে অন্য সঙ্গীর খোঁজে উড়ে যায়। এ এক রহস্যময় আচরণ তাদের। যে সঙ্গীকে পেতে বাসা তৈরি সহ কত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়; অথচ কয়েকদিনের মধ্যে যখন বাসাতে সন্তান আসে তখন স্ত্রী-সন্তান সকলকেই ছেড়ে অজানা গন্তব্যে চলে যায় পুরুষ বাবুইপাখি।
রহস্যময় ভাবে স্ত্রী বাবুই পাখিও এতে আপত্তি করে না। মানুষ হয়ত বাবুইপাখির মত এত ঘর পরিবর্তন করে না। মানুষের পরিবর্তন হয় মনজগতে। আজ যাকে ভাল লাগে, তাকে কাল বিষের মত লাগে। যে তাকে প্রচণ্ড ভালবাসে, তার দিকে তার নজর নেই; তার আগ্রহ নজর তার দিকেই যে তাকে ভালবাসে না, পাত্তা দেয় না। মানুষের এ রহস্যময় মনকে ঠিক করতেই লালন সাঁই, মনকে মুগুর পিটা করে ঠিক করতে চেয়েছেন। গরুছাগল জমির আল ডিঙিয়ে অন্যের জমির শস্য খেতে না পারে; এ জন্যে আমরা এদের ভাল করে বেঁধে রাখি।এমনকি মুখেও একটি ঠুশি পরিয়ে দেই, যাতে সে আর কিছুই খেতে না পারে। এরপরেও যে গরুর আল ডিঙিয়ে খাওয়ার স্বভাব তাকে শতচেষ্টাতেও নিয়ন্ত্রিত করা যায় না। আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো আমাদের শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ সহ বিভিন্ন বিষয়ে অভিহিত করে।কিন্তু এ যদি আমরা এদের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার করি, তবে তারাই আমাদের ক্ষতির কারণ হয়,ধ্বংসের কারণ হয়।
"মন সহজে কি সই হবা।
ডাবার পর মুগুর পলে
তুমি সেইদিন গা টের পাবা;
চিরদিন ইচ্ছা মনে
আইল ডিঙ্গায়ে ঘাস খাবা।।
ইল্লতে স্বভাব হলে
পানিতে যায় রে ধুলে
খাজলতি কিসে ধুবা;
লালন বলে হিসাবকালে
সকলে ফিকির হারাবা।।"
লালন সাঁই বলেছেন, 'ইল্লতে' স্বভাব হলে, অর্থাৎ স্বভাবে ময়লা বা অপরিচ্ছন্নতা থাকলে তাকে জল দিয়েও ধুয়ে পরিষ্কার করা যায় না।স্বভাব, আচরণ, অভ্যাসের নোংরামি যাকে লালন সাঁই 'খাজলতি' বলেছেন। এ স্বভাব বা খাসলত সাবান সোডা কোন কিছু দিয়েই ধুয়ে পরিষ্কার করা যায় না।এর মালিন্য একেবারেই মানুষের অন্তর্নিহিত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে জন্মগত। এ থেকে মুক্তির উপায় শুধু নিজের কাছেই। এ খাসলত মানব জীবনকে অনেক সময় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। সুতরাং কিছু কিছু কুঅভ্যাস জীবনে পরিবর্তন করা অত্যন্ত জরুরি।
সঙ্কল্পবিকল্পাত্মক মনের মত ভবঘুরে আর নেই; এ মনকে তাই যথাসাধ্য নিয়ন্ত্রিত করে রাখতে হয়। শুদ্ধ বুদ্ধিই মনকে পথ দেখায়। যতক্ষণ শুদ্ধবুদ্ধির উদয় না হয়, মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে চলতেই থাকে। কোথায় চলছে, কোথায় গন্তব্য সে জানে না ; এরপরেও চলতে থাকে। আগুনে ঘি দিলে যেমন আগুন দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে, তেমনি মন সহ ইন্দ্রিয়কে যদি আমরা নিয়ন্ত্রিত করে বশে আনতে না পারি; তবে দোদুল্যমান মন আমাদের নিয়ন্ত্রণ করবে। এর পরিনাম নিশ্চিত দুর্ঘটনা।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।

মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁