শ্রীরামচন্দ্র নির্মল প্রভাতে পূর্বাহ্ন কালোচিত সন্ধ্যা- বন্দনা ইত্যাদি নিত্য কর্ম করে রাজধর্ম পালন প্রজাগণের বিবাদের মীমাংসা করার জন্য বেদবেত্তা ব্রাহ্মণগণ, পুরোহিত বশিষ্ঠ এবং কশ্যপ মুনির সঙ্গে রাজসভায় উপস্থিত হয়ে ন্যায়ের আসনে বিরাজমান হলেন।শ্রীরামচন্দ্রের রাজসভা জ্ঞানী মন্ত্রিগণ, ধর্মশাস্ত্রে অত্যন্ত অভিজ্ঞ বিদ্বানগণ এবং নীতিজ্ঞ দ্বারা পূর্ণ ছিলো। সেই ধর্মসভায় শ্রীরামচন্দ্র ইন্দ্র, যম এবং বরুণের মত শোভমান ছিলেন। সেই রাজসভায় বসে শ্রীরামচন্দ্র শুভ লক্ষ্মণসম্পন্ন লক্ষ্মণকে বললেন– "বাইরে গিয়ে দেখো কারা বিচারের আশায় উপস্থিত হয়েছে, তাদের এক এক করে আসতে বলো"। শ্রীরামের আদেশ শুনে শুভলক্ষণ লক্ষ্মণ দ্বারে এসে নিজেই আগন্তুকদের ডাকলেন কিন্তু কেউই কোন অভিযোগের কথা জানাতে সেখানে উপস্থিত ছিল না।
নাধয়ো ব্যাধয়শ্চৈব রামে রাজাং প্রশাসতি।
পক্কসস্যা বসুমতী সর্বৌষধিসমন্বিতা॥
ন বালো প্রিয়তে তত্র ন যুবা ন চ মধ্যমঃ ।।
ধর্মেণ শাসিতং সর্বং ন চ বাধা বিধীয়তে৷৷
দৃশ্যতে ন চ কার্যার্থী রামে রাজ্যং প্রশাসতি।
প্রাঞ্জলির্ভূত্বা রামায়ৈবং নাবেদয়ৎ।
অথ রামঃ প্রসন্নাত্মা সৌমিত্রিমিদমব্রবীৎ।
ভূয় এব তু গচ্ছ ত্বং কার্যিণঃ প্রবিচারয়।।
সম্যক্ প্রণীতয়া নীত্যা নাধর্মো বিদ্যতে ক্বচিৎ।
তন্মাদ্ রাজভয়াৎ সর্বে রক্ষন্তীহ পরম্পরম্ ।।
(রামায়ণ: উত্তরকাণ্ড, প্রক্ষিপ্ত সর্গ, ১.৮-১২)
"শ্রীরামের রাজ্য শাসন কালে কারো কোনো শারীরিক রোগ হত না এবং মানসিক চিন্তাও কষ্ট দিত না। পৃথিবীতে সর্বপ্রকার ওষধি (অন্ন-ফল ইত্যাদি) উৎপন্ন হতো এবং পক্ক শস্য ক্ষেতে শোভা পেত।
শ্রীরামের রাজ্যে কোনো বালকের, যুবকের বা মধ্য বয়স্ক পুরুষের (অকালে) মৃত্যু হত না। সকলের প্রতিই ন্যায় করা হত। কারো কখনও কোনো অসুবিধা হত না।
শ্রীরামের রাজ্য শাসনকালে দরবারে কখনও কোনো অভিযোগকারী ছিল না। লক্ষ্মণ হাত জোড় করে শ্রীরামচন্দ্রকে রাজ্যের এই অবস্থা অবগত করালেন।
তারপর প্রসন্নচিত্তে শ্রীরাম সুমিত্রাকুমারকে পুনর্বার বলেন – ‘লক্ষ্মণ ! তুমি আবার যাও এবং ভালো করে সন্ধান করো।"
লক্ষ্মণ রাজভবনের বাইরে সাহায্য প্রার্থী কাউকেই দেখতে পেলেন না। শুধু একটি কুকুরকে দেখতে পেলেন। কুকুরটি তাঁর দিকে তাকিয়ে ডাকছে। কুকুরের ডাক শুনে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে লক্ষ্মণ কুকুরটিকে জিজ্ঞাসা করলেন তার কি হয়েছে?
উত্তরে কুকুরটি বললো, আমি মহারাজ শ্রীরামচন্দ্রের সামনেই বলতে চাই। তখন লক্ষ্মণ রাজসভায় প্রবেশ করে শ্রীরামচন্দ্রকে বিষয়টি অবহিত করলেন। লক্ষ্মণের কথা শুনে শ্রীরামচন্দ্র বললেন, "কুকুর হোক বা মানুষ, রাজদরবারে সাক্ষাৎপ্রার্থী যেই হোক; তাকে ভিতরে নিয়ে আসো।আমরা শ্রীরামচন্দ্রের সুশাসনের জাজ্জ্বল্যমান দৃষ্টান্ত পাই এই ঘটনাটিতে। দুটি বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়। প্রথমত সুশাসনের কারণে, শান্তি, সম্প্রীতির সাথে বসবাসের কারণে কোন ঝগড়া বিবাদ ছিলো না। তাই রাজদরবারে বিচারপ্রার্থী শূণ্য ছিলো। দ্বিতীয়ত মানুষ তো বটেই, অধম যোনির জীব কুকুরদের পর্যন্ত যেতে পারতো রামরাজ্যের রাজদরবারে।
শ্রীরামচন্দ্রের নির্দেশ অনুসারে লক্ষ্মণ কুকুরকে রাজদরবারে নিয়ে আসলেন। কুকুরটির দিকে তাকিয়ে শ্রীরামচন্দ্র বললেন, "তোমার যা বলার আছে তা নির্ভয়ে বল"। কুকুরটির মাথা ফেটে গিয়েছিল। সেখান থেকে রক্ত ঝরছিল। সেই রক্তাক্ত কুকুরটি রাজসভায় বসে মহারাজ শ্রীরামের দিকে তাকিয়ে বললো:
রাজৈব কর্তা ভূতানাং রাজা চৈব বিনায়কঃ।
রাজা সুপ্তেষু জাগর্তি রাজা পালয়তি প্ৰজাঃ৷৷
নীত্যা সুনীতয়া রাজা ধর্মং রক্ষতি রক্ষিতা।
যদা ন পালয়ে রাজা ক্ষিপ্ৰং নশ্যন্তি বৈ প্ৰজাঃ ॥
রাজা কর্তা চ গোপ্তা চ সর্বস্য জগতঃ পিতা।
রাজা কালো যুগং চৈব রাজা সর্বমিদং জগৎ ॥
ধারণাদ্ ধর্মমিত্যাহুর্ধর্মেণ, বিধৃতাঃ প্রজাঃ।
যম্মাদ ধারয়তে সর্বং ত্রৈলোক্যং সচরাচরম্।।
ধারণাদ্ বিদ্বিষাং চৈব ধর্মেণারঞ্জয়ন্ প্রজাঃ। তস্মাদ্ ধারণমিত্যুক্তং স ধর্ম ইতি নিশ্চয়ঃ॥
এষ রাজন্ পরো ধর্মঃ ফলবান্ প্রেত্য রাঘব।
নহি ধর্মাদ্ ভবেৎ কিঞ্চিদ্ দুষ্প্রাপমিতি মে মতিঃ৷৷
দানং দয়া সতাং পূঞ্জা ব্যবহারেষু চার্জবম্।
এষ রাম পরো ধর্মো রক্ষণাৎ প্রেতা চেহ চ ৷৷
ত্বং প্রমাণ প্রমাণানামসি রাঘব সুব্রত।
বিদিতশ্চৈব তে ধর্মঃ সদ্ভিরাচরিত বৈ৷৷
ধর্মাণং ত্বং পরং ধাম গুণানাং সাগরোপমঃ।
অজ্ঞানাচ্চ ময়া রাজন্নুক্তস্ত্বং রাজসত্তম।
(রামায়ণ: উত্তরকাণ্ড, প্রক্ষিপ্ত সর্গ, ২.৪-১২)
"রাজাই সমস্ত প্রাণীদের উৎপাদক ও নায়ক। সকলে ঘুমিয়ে পড়লেও রাজা জেগে থাকেন এবং প্রজাদের পালন যথাসম্ভব করেন।
রাজা সকলের রক্ষক। তিনি উত্তম নীতি প্রয়োগ করে সকলের রক্ষা করেন। রাজা যদি প্রজাপালন না করেন, তাহলে সকল প্রজা নষ্ট-ভ্রষ্ট হয়ে যায়।
রাজা কর্তা, তিনি রক্ষক ও সম্পূর্ণ জগতের পিতা। রাজা হলেন কাল ও যুগ। রাজাই এই সম্পূর্ণ জগৎ।
ধর্ম সম্পূর্ণ জগৎ ধারণ করে, তাই তার নাম ধর্ম। ধর্মই সমস্ত প্রজাকে ধারণ করে রেখেছে ; কারণ ধর্মই হলো চরাচর প্রাণীসহ সমস্ত ত্রিলোকের আধার।
রাজা তার দ্রোহিদেরও ধারণ করেন অথবা তিনি ধর্ম দুষ্টদেরও মর্যাদাতে স্থাপন করেন। ধর্মের দ্বারা ইদ প্রজাদের প্রসন্ন রাখেন; তাই তাঁর শাসনরূপ কর্মকে ধারণ বলা হয়। ধারণই ধর্ম, এই হল শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত।
রঘুনন্দন ! এই প্রজাপালনরূপ পরম ধর্ম রাজাকে পরলোকে উত্তম ফল প্রদান করে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, ধর্মের দ্বারা কিছুই সুদুর্লভ নয়।
শ্রীরাম ! দান, দয়া, সৎপুরুষদের সম্মান ও ব্যবহারে সারল্য – এই হল পরম ধর্ম। প্রজারক্ষার দ্বারা উৎপন্ন উৎকৃষ্ট ধর্ম ইহলোক ও পরলোকেও সুখপ্রদান করে।
উত্তব্রত পালনকারী রঘুনন্দন । আপনি সমস্ত প্রমাণেরও প্রমাণ। সৎ পুরুষেরা যে ধর্মের আচরণ করেছেন, আপনি তা ভালোভাবে অবগত আছেন।
রাজন্ ! আপনি ধর্মের পরম ধাম এবং গুণের সাগর। নৃপশ্রেষ্ঠ! আমি অজ্ঞানতাবশতঃই আপনার সামনে ধর্মের ব্যাখ্যা করেছি।"
শ্রীরামচন্দ্রের শাসন এতটা মহত্তম ছিলো যে অধম যোনির সামান্য কুকুরও রাজধর্ম জ্ঞাত ছিলো। শ্রীরামচন্দ্রের অসংখ্য মহত্তম শিক্ষার মধ্যে এটিও একটি শিক্ষা যে সামান্য কুকুরেরও কথা মনযোগ দিয়ে শোনা উচিত। এবং কুকুর থেকেও শিক্ষা লাভ করা যায়। মুকবধির জীবজন্তুর ভাষা সকলেই বুঝতে পারে না। কিন্তু শ্রীরাম এবং লক্ষ্মণ যেহেতু অবতার পুরুষ, তাই তাঁরা সকলের ভাষাই বুঝতেন।কুকুরের কথা শুনে শ্রীরামচন্দ্র বললেন, "তুমি নির্ভয়ে বলো। আমি তোমার ইচ্ছা পূর্ণ করব। প্রয়োজন জানাতে বিলম্ব করো না"। শ্রীরামের কথা শুনে কুকুর বললো:
ধর্মেণ রাষ্ট্রং বিন্দেত ধর্মেণৈবানুপালয়েৎ।
ধর্মাচ্ছরণ্যতাং যাতি সৰ্বভয়াপহঃ৷৷
ইদং বিজ্ঞায় যৎ কৃত্যং শ্রূয়তাং মম রাঘব।
ভিক্ষুঃ সর্বার্থসিদ্ধশ্চ ব্রাহ্মণাবসথে বসন্।।
তেন দত্তঃ প্রহারো নিষ্কারণমনাগসঃ।
(রামায়ণ: উত্তরকাণ্ড, প্রক্ষিপ্ত সর্গ, ২.১৫-১৭)
"রঘুনন্দন ! রাজা ধর্মের দ্বারাই রাজ্য প্রাপ্ত হন এবং ধর্মের দ্বারা তার নিরন্তর পালন করেন। ধর্মের দ্বারাই রাজা সকলকে শরণ দান করেন এবং ভয় দূর করেন। একথা জেনে আপনি আমার কাজের কথা শুনুন।
প্রভো! সর্বার্থসিদ্ধ নামে একজন প্রসিদ্ধ ভিক্ষু আছেন, যিনি ব্রাহ্মণদের গৃহে বাস করেন। তিনি আজ আমাকে অকারণে প্রহার করেছেন। আমি তার কোনো অপরাধ করিনি।”
আহত কুকুরের কথা শুনে শ্রীরাম তখনই এক দ্বারপালকে পাঠিয়ে সেই সর্বার্থসিদ্ধ নামক বিদ্বান ভিক্ষুক (সন্ন্যাসী) রাজদরবারে ডেকে পাঠালেন।সেই সর্বার্থসিদ্ধ নামক সন্ন্যাসী রাজদরবারে শ্রীরামচন্দ্রকে তাঁকে ডেকে আনার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তখন শ্রীরামচন্দ্র বললেন, "হে সর্বার্থসিদ্ধ আপনি অকারণে এই কুকুরের মাথায় লাঠি দিয়ে প্রহার করার কারণ কি?" উত্তরে ভিক্ষু সর্বার্থসিদ্ধ বলেন:
" ভিক্ষার সময় অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ায় আমি প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত ছিলাম। আমি ভিক্ষার জন্যে নগরের দ্বারে দ্বারে ঘুরছিলাম। এই কুকুরটি তখন পথের মধ্যে দাঁড়িয়েছিলো। তাকে বারবার রাস্তা থেকে সরে যেতে বলার পরেও, সে রাস্তার মধ্যে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলো। আমি তখন প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত ছিলাম। তাই ক্ষুধার্ত অবস্থায় আমার ক্রোধ বেড়ে যায়। তাই ক্রোধে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে আমি কুকুরটির মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করেছি। আমি জানি আমি অপরাধী। আপনি আমাকে যে শাস্তি দিবেন, তাই আমি মাথা পেতে নিব। আপনার হাতে শাস্তি পেলে আমার আর নরকের ভয় থাকবে না।"
ভিক্ষু সর্বার্থসিদ্ধর কথা শুনে শ্রীরামচন্দ্র তখন সভাসদদের জিজ্ঞাসা করলেন যে, তাকে কি শাস্তি প্রদান করা যায়। তখন বিচারপ্রার্থী কুকুরটি বললো, "হে মহারাজ রামচন্দ্র আপনি যদি আমার প্রতি সন্তুষ্ট হন, তবে আপনি এই ভিক্ষু সর্বার্থসিদ্ধকে কালঞ্জরে এক মঠ রয়েছে, সেই মঠের কুলপতি (মহন্ত) করে দিন"।
কুকুরটির ইচ্ছা শুনে শ্রীরামচন্দ্র তথাস্তু বলে তাতে সায় দিলেন। রাজসভাতেই সেই ভিক্ষু সর্বার্থসিদ্ধকে মোহান্ত পদে অভিষিক্ত করায়, সে অত্যন্ত আনন্দিত মনে হাতির পিঠে চড়ে কালঞ্জর মঠের কুলপতি (মহন্ত) হলেন। ঘটনায় বিস্মিত হয়ে শ্রীরামচন্দ্রের মন্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন, " অপরাধের শাস্তির বদলে ভিক্ষু সর্বার্থসিদ্ধকে তো বরদান দিয়ে পুরষ্কৃত করা হলো"। মন্ত্রীর কথায় শ্রীরামচন্দ্র বললেন -"কোন কর্মের কি পরিণাম হয় বা তাতে জীবের কি গতি হয়, এ তত্ত্ব তোমাদের জানা নেই। এই ভিক্ষু সর্বার্থসিদ্ধকে কেন মঠের মোহান্ত করা হলো, তার কারণ এই কুকুরটি খুব ভালো করে জানে"।তখন কুকুরটি বলে:
"হে রঘুনন্দন! আমি গত জন্মে কালঞ্জরের মঠের কুলপতি ছিলাম।সেখানে প্রতিদিন যজ্ঞ করে, তবেই যজ্ঞাবশেষ অন্ন ভোজন করতাম। দেবতা ও ব্রাহ্মণদের সেবায় সর্বদা তৎপর থাকতাম। দাস-দাসীদের সাথে কখনো অন্যায় আচরণ করতাম না; তাদের ন্যায়োচিত ভাগ দিতাম। সর্বদা শুভ-কর্মে অনুরক্ত থাকতাম এবং দৈবসম্পত্তি রক্ষা করতাম। বিনয় ও শীলসম্পন্ন হয়ে সমস্ত প্রাণীর হিতসাধনে ব্যস্ত থাকতাম। মৃত্যুর পরে কোন অজানা কারণে আমার এই ভয়ানক অবস্থা এবং অধম গতি প্রাপ্ত হয়। সর্বদা শুভ এবং দৈবকর্ম করার পরেও, আমার যদি এই অধম যোনি প্রাপ্ত হয়; তবে এমন ক্রোধী, ধর্ম পরিত্যাগী, অন্যের অহিতে ব্যাপ্ত এবং ক্রুর, কঠোর মূর্খ এবং অধর্মী, সেই ভিক্ষু সর্বার্থসিদ্ধ মঠাধীশ হয়ে নিজের সঙ্গে তাঁর পূর্বের পরের সাতপুরুষকে নরকে পতিত করবে। তাই কোন অবস্থাতেই মঠের কুলপতি (মোহান্ত) পদ গ্রহণ করা উচিত নয়।যাকে পুত্র, পশু এবং বন্ধু-বান্ধবসহ নরকে নিমজ্জিত করার ইচ্ছা, তাকেই কুলপতি করুন"।
মহাতেজস্বী সেই কুকুরের কথা শুনে সভাসদ সকলেই ধর্মের সূক্ষ্ম গতি বিবেচনা করে বিস্মিত হয়ে গেলেন। কুকুরটিও যেদিক থেকে এসেছিলো, সেদিকে আবার চলে গেলো। কুকুরটি পরবর্তীতে গঙ্গার তীরে বারাণসী শিবক্ষেত্রে গিয়ে অন্নজল পরিত্যাগ করে প্রায়োপবেশন করে প্রাণ ত্যাগ করে। রামায়ণের উত্তরকাণ্ডের এই দুটি সর্গ সকল রামায়ণের পাণ্ডুলিপিতে পাওয়া যায় না। তাই এ স্বর্গদুটিকে প্রক্ষিপ্ত স্বর্গ বলে। আমি তাই গ্রহণযোগ্য রামায়ণের পাঠ হিসেবে গোরক্ষপুর গীতাপ্রেসের সংস্করণটি এই লেখায় ব্যবহার করেছি।তবে এই অংশটি মূল রামায়ণের অংশ হোক অথবা প্রক্ষিপ্ত হোক; দুটোর যেকোন একটি হবে।
কিন্তু কুকুরের এই কাহিনীটিতে যে শিক্ষা দেয়া আছে তা বর্তমানের সাধু-সন্ন্যাসীদের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এখানে বলা হয়েছে কোন অবস্থাতেই মঠের কুলপতি (মোহান্ত) পদ গ্রহণ করা উচিত নয়। অথচ আমরা দেখতে পাই কুলপতি, মঠের অধ্যক্ষ, মোহান্ত পদের জন্যে আশ্রম এবং মঠগুলোর মধ্যে কি পরিমাণে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলে। গৃহীদের ক্ষেত্রে এ প্রতিযোগিতা হতে পারে, কিন্তু সাধু, সন্ন্যাসীদের ক্ষেত্রে বিষয়টি একদমই দৃষ্টিকটু। অনেকেই কোন আশ্রম বা মঠের মোহান্ত হতে গিয়ে মোহান্ধ হয়ে যায়। মোহান্ধ হয়ে সাধুর অভিনয় করতে থাকেন।
তাই রামায়ণে মহাতেজস্বী ধার্মিক কুকুরটি তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে শিক্ষা দিয়েছেন। সতর্ক করেছেন এই বলে যে, কাউকে যদি পুত্র, পশু এবং বন্ধু-বান্ধবসহ নরকে নিমজ্জিত করার ইচ্ছা; তবে তাকেই মঠের কুলপতি বা মোহান্ত করুন। অথচ এই মোহান্ত পদের জন্য সাধন ভজন বাদ দিয়ে মামলা পর্যন্ত লড়তে হয়। ভিক্ষু সর্বার্থসিদ্ধকে মোহান্ত পদে অভিষিক্ত করায়, সে যেমন অত্যন্ত আনন্দিত মনে হাতির পিঠে চড়ে কালঞ্জর মঠের কুলপতি (মহন্ত) হয়ে গেলেন। কিন্তু সে হয়তো বুঝতে পারেনি যে তাঁর জন্য মৃত্যু পরবর্তীতে আগামীতে কি অপেক্ষা করছে। আজকের আনন্দই হয়তো তার, বন্ধনের কারণ হবে। তখন এই কুলপতি (মোহান্ত) পদের আনন্দকেই বিষের মত মনে হবে।
তথ্য সহায়তা:
মহর্ষি বাল্মিকী, রামায়ণ, গীতাপ্রেস, গোরক্ষপুর: প্রথম বাংলা সংস্করণ, ২০১৯