-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

"যত্র যোগেশ্বরঃ কৃষ্ণো যত্র পার্থো ধনুর্ধরঃ"; আজন্মকাল থেকেই হিন্দু শক্তির উপাসক

 

অর্জুন; কৃষ্ণ; অর্জুন কৃষ্ণ; কৃষ্ণ অর্জুন; arjuna; arjun; pandav putra arjun; krishna arjun; hare krishna;


শ্রীমদ্ভগবদগীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কথা বলা শুরু করেছেন দ্বিতীয় অধ্যায় সাংখ্যযোগের দ্বিতীয় শ্লোক থেকে, এই শ্লোকে ভগবান অর্জুনকে অনার্য জনোচিত, স্বর্গহানিকর, অকীর্তিকর মোহ ত্যাগ করতে বলেছেন। এর ঠিক পরের তৃতীয় শ্লোকেই ভগবান দৃঢ়কন্ঠে ঘোষণা করেছেন, হৃদয়ের ক্ষুদ্র দুর্বলতা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াতে। আমরা যদি যদি হৃদয়ের ভয় এবং জড়তাকে পরিত্যাগ করতে না পারি, তবে ভয় এবং জড়তা আজীবন আমাদের পিছনে ধাওয়া করে গ্রাস করতে থাকবে। যেমন সাপ দেখে আমরা বিচারও করি না যে, সাপটি বিষাক্ত কি বিষাক্ত নয়। সাপের বিষাক্ততা বিচার না করেই রাস্তায় সাপ দেখলে আমরা সাপের ভয়ে প্রাণ বাঁচাতে আপ্রাণ দৌড়াতে থাকি। আমরা যতই দোড়াতে থাকি সাপ ততই আমাদের পিছনে পিছনে ধাওয়া করতে থাকে। কিন্তু আমরা যদি একবার দাঁড়িয়ে দিয়ে হাতে লাঠি নিতে পারি। তবে সেই লাঠির ভয়ে প্রাণ বাঁচাতে সাপ উল্টো দৌড়ে পালায়। তাই সাপ দেখলে লাঠি নিয়ে যে যে অবস্থানেই আছি, সেই সেই অবস্থান থেকেই দৃঢ় মনোবল নিয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হবে। তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে, তবেই সাপ ছোবল দেয়া ভুলে উল্টো মরণত্রাসে পালাবে। কিন্তু যদি আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারি, তবে আমি চাই বা না চাই আমাকে বিষাক্ত সাপের ভয়ে দিনরাত্রি পালিয়ে বেড়াতেই হবে। মনে রাখতে হবে, সকল বিষয়েরই একটি পরিসমাপ্তি রয়েছে। দিনের পরেও রাত আসে, আবার রাতের অন্ধকারের পরেই দিনের আলো আসে। মানুষ যেমন বিষাক্ত সাপকে ভয় পায়, তেমনি বিষাক্ত সাপও সাহসী মানুষকে প্রচণ্ড ভয় পায়। তাই শ্রীমদভগবদগীতায় দার্শনিক তত্ত্বের শুরুতেই অর্জুনকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দুর্বলতা এবং ক্লীবতা সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করতে বলেছেন।আমরা যদি দুর্বলতা এবং ক্লীবতা সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করতে না পারি, তবে কখনই আমারা ভগবান শ্রীষ্ণের প্রকৃত অনুসারী হতে পারবো না।


ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পার্থ নৈতৎ ত্বয়্যুপপদ্যতে।
ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্য ত্যক্ত্বোত্তিষ্ঠ পরন্তপ।।

(শ্রীমদ্ভগবদগীতা: ০২.০৩)


"হে অর্জুন হৃদয়ের ক্ষুদ্র দুর্বলতা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াও; এমন ক্লীবতা কাপুরুষতা তোমার শোভা পায় না।"


মনে রাখতে হবে,"বীরভোগ্যা বসুন্ধরা"। কোন দুর্বল চিত্তের, ক্লীব স্বভাবের ব্যক্তি নয়; শুধু অকুতোভয় বীর স্বভাবের ব্যক্তিরাই এ বৈচিত্র্যময় বসুন্ধরাকে যথাযথ ভোগ করতে পারে। তাঁরা যতদিন বেঁচে থাকেন, জগত তাদের মুঠোয় থাকে। মৃত্যুর পরেও তাঁদের বীরত্বের কীর্তি যুগযুগান্তর ধরে অবিনশ্বর থাকে। শ্রীমদ্ভগবদগীতা হতে যথাযথ জ্ঞান লাভ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জ্জুনকে দৃঢ়চিত্তে যুদ্ধে অগ্রসর হয়ে অধর্মকে বিনাশ করতে বললেন। তিনি স্মরণ করিয়ে দিলেন, এই ধর্মযুদ্ধে যদি মৃত্যু হয়, তবে অক্ষয় স্বর্গ লাভ হবে এবং যুদ্ধে জয়ী হলে পৃথিবী ভোগ করতে পারবে। ভগবান যখন অবতাররূপে আসেন, তখন ধর্ম রক্ষা করতে তিনি নিজেও অস্ত্রধারণ পাপিদের বিনাশ করেন। শ্রীমদ্ভগবদগীতায় শ্রীকৃষ্ণের মুখে বলা প্রথম শ্লোকগুলি এবং সঞ্জয়ের মুখে বলা গীতার শেষ শ্লোকটি খুবই তাৎপর্যময়, মাহাত্ম্যপূর্ণ এবং ইঙ্গিতবহ। কথাগুলি বর্তমান হিন্দুজাতির জন্যে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। শেষ শ্লোকে বলা হয়েছে যে শুধুমাত্র ধর্ম ধর্ম করলেই হবে না; ধর্মকে রক্ষাকারী সক্রিয় ধনুর্ধারী পার্থ অপরিহার্য। যদি আমরা ধর্মকে যথাযথ রক্ষা করি, তবে শাশ্বত ধর্মই সকলদিক থেকে আমাদের রক্ষা করবে। তাই আমাদের সর্বদা ধর্মের আশ্রয়েই থেকে ধর্মকে রক্ষা করা প্রয়োজন।


যত্র যোগেশ্বরঃ কৃষ্ণো যত্র পার্থো ধনুর্ধরঃ।
তত্র শ্রীর্বিজয়ো ভূতিধ্রুর্বা নীতির্মতির্মম।।

(শ্রীমদ্ভগবদগীতা:১৮.৭৮)


"যেখানেই যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং ধনুর্ধারী রক্ষাকারী পার্থ থাকবে; সেখানেই সর্বদা শ্রী, বিজয়, উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি এবং ঐক্যবদ্ধতার অখণ্ডিত রাজনৈতিক নীতি সর্বদাই বিরাজ করবে।"


হিন্দু আজন্মকাল থেকেই শক্তির উপাসক। তাদের দেবদেবীদের মূর্তি পরিকল্পনাই এর সাক্ষ্য দেয়। সকল দেবদেবীর হাতের অসুর বিনাশে অস্ত্রসস্ত্রসজ্জিত। যিনি প্রেমের দেবতা তাঁরও হাতে বাণ। শ্রীচণ্ডীর উত্তরচরিত্রে অষ্টভুজা যে দেবী সরস্বতীর ধ্যানমন্ত্র বর্ণনা করা হয়েছে, সেই ধ্যানমন্ত্রেও দেবী অস্ত্রসস্ত্রসজ্জিতা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের হাতের সুমধুর মোহনবাশীর সাথে সাথে সুদর্শন চক্রও রয়েছে। এ চক্রটি ভগবান শ্রীবিষ্ণু এবং তাঁর অবতার শ্রীকৃষ্ণের প্রতীক। তাই আজও পুরীর জগন্নাথ মন্দির সহ প্রত্যেকটি বৈষ্ণব মন্দিরের চূড়ায় সুদর্শন চক্রকে স্থাপিত করা হয়। এ প্রসঙ্গে স্বামী প্রণবানন্দ মহারাজের একটি তেজদীপ্ত বাণী রয়েছে। তিনি বর্তমানের ভীত আত্মকেন্দ্রিক হিন্দু সম্প্রদায়কে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, হিন্দু একমাত্র শক্তির পূজক এবং শক্তির উপাসক। নিজেদের প্রকৃত স্বরূপ না চেনার কারণেই আমরা আজ আমাদের পুরনো হৃতগৌরব ফিরিয়ে আনতে পারছি না। মহাশক্তির সাধনা করে কোন মানুষ কখনো দুর্বল হতে পারে না।


“হিন্দু! তুমি কি জান না-তুমি শক্তির পূজক, শক্তির উপাসক ? তােমার সেই শক্তির সাধনা কোথায় ? শিবের হাতে ত্রিশূল, তাহা দেখিয়া তুমি কী চিন্তা করিবে? শ্রীকৃষ্ণের হাতে সুদর্শন, তাহা দেখিয়া তুমি কী ভাবনা ভাবিবে ? কালীর হাতে রক্তাক্ত খড়গ, দুর্গার হাতে দশপ্রহরণ, তাহা দেখিয়া তুমি কি শিক্ষা লাভ করিবে ? এই মহাশক্তির সাধনা করিয়া মানুষ দুর্বল হইতে পারে কি ? একবার ধীর স্থির হইয়া চিন্তা কর।"


স্বামী প্রণবানন্দ মহারাজের মত একই প্রকারের কথা কাজী নজরুল ইসলামের লেখাতেও পাওয়া যায়। তিনি দ্বিভুজে পরব্রক্ষ্মময়ী আদ্যাশক্তির শক্তি কামনা করেছেন। শক্তির উপাসনাতেই শক্তি লাভ হয়। তাই শক্তি পূজা করে শুধুই ভক্তি নয়, বিশ্বজয়ী হওয়া প্রয়োজন। যদি শক্তিপূজা করেও শক্তি লাভ না হয়, বিশ্বজয়ী হওয়া না যায়; তবে সেই শক্তিপূজা নিছক বিলাসতা মাত্র। সে পূজায় কোন লাভ হয় না, শুধুই কালক্ষেপণ।


"যে মহাশক্তির হয় না বিসর্জন
অন্তরে বাহিরে প্রকাশ যার অনুক্ষণ
মন্দিরে দুর্গে রহে না যে বন্দী
সেই দুর্গারে দেশ চায়।

আমাদের দ্বিভুজে দশভুজা শক্তি
দে পরব্রক্ষ্মময়ী
শক্তি পূজার ফল ভক্তি কি পাব শুধু
হব না কি বিশ্বজয়ী?

এ পূজা বিলাস সংহার কর
যদি পুত্র শক্তি নাহি পায়।"


ধর্মাধর্মের সকল নির্দেশনা হিন্দু ধর্মশাস্ত্রে দেয়া আছে। পাষণ্ড, দুর্জন, পৈশাচিক ভাবাপন্নদের সমূলে বিনাশ করতে বলা হয়েছে। তারা জগতের জন্যে অকল্যাণকর, বিশ্বসভ্যতার জন্যে অকল্যাণকর। বর্তমানে শ্রীমদ্ভগবদগীতার অনুসারীদের চেনা যায় না। তাদের অধিকাংশের একটা আত্মকেন্দ্রিক ক্লীব ভাব দেখা যায়। তারা সুধুই নিজদের সাধন, ভজন এবং ধর্মীয় আচরণ নিয়েই ব্যতিব্যস্ত। দেশ, জাতি এবং ধর্ম রক্ষার্থে তাদের খুব একটি মাথাব্যথা নেই। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। তবে বিষয়টির ব্যতিক্রমও আছে। তুর্কি, পাঠান, ব্রিটিশ সহ বিভিন্ন বিদেশি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অনেক স্বদেশীয় ক্রান্তিকারীরা দেশ-জাতির ক্রান্তিলগ্নে গীতায় বর্ণিত অবিনাশী আত্মার তত্ত্বে বিশ্বাস স্থাপন করে নির্ভীক চিত্তে আমৃত্যু সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে গিয়েছেন। 

সারা পৃথিবীতে বিস্তৃত ব্রিটিশের সাম্রাজ্যের সূর্যাস্ত হত না, সেই ব্রিটিশ শুধু ক্ষুদিরাম, সূর্যসেনের মত বিপ্লবীদের কাছে অসহায় হয়ে যায় ; শুধু তাঁদের মনবলের কারণে। মানুষের শক্তি তার দেহে যতটা দৃশ্যমান ; অদৃশ্য হয়ে মনজগতে ততটাই বিস্তৃত। শুধু সাহস নিয়ে দাড়িয়ে গেলেই হয়। বিপ্লবীরা যখন উপলব্ধি করেছে, আত্মা অবিনাশী, দেহের মৃত্যুতেও আত্মার বিনাশ হয় না; তখন তাঁরা সামনে যতবড়ই ভয়ংকর সাম্রাজ্যবাদী হানাদার হোক, সাহস নিয়ে এগিয়ে গিয়েছে। এর পরিণামেই সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশেরা এ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। ঘরে বসে চরকায় সুতা কেটে ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়নি, হয়েছে ক্ষুদিরামদের মত অসংখ্য বিপ্লবীদের আত্মত্যাগে। শ্রীমদ্ভগবদগীতাই তাঁদের শিখিয়েছে, প্রত্যেকটি মানুষের অন্তঃস্থিত আত্মাকে শস্ত্রের দ্বারা ছেদন করা যায় না, অগ্নিতে দগ্ধ করা যায় না, জলে ভেজানো যায় না এবং বায়ু তাকে শুষ্ক করতে পারে না। আত্মাকে যেহেতু কোনভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত করা যায় না, তবে কিসের মৃত্যুভয়?হিন্দু আজন্মকাল থেকেই শক্তির উপাসক। তাদের উপাস্য সশস্ত্র দেবদেবীরাই এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তাই ধনুর্ধারী পার্থ বা শক্তির উপাসনাতেই সে পুনরায় আবার জাগবে।প্রদীপের টিমটিমে সলতের মত যারা বাঁচতে চায়, তারা বাঁচতে পারে না; পক্ষান্তরে যারা বাঁচা-মরাকে তোয়াক্কা করেনা, তারাই অমর হয়ে বেঁচে থাকে। তাই ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের শিখিয়েছেন :

"সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান।
 সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ।
মুক্ত করো ভয়,  আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, 
নিজেরে করো জয়।"

সম্মুখে সঙ্কটের কল্পনাতে বিহ্বল না হয়ে নিজের  অধিকার নিজেকেই আদায় করে নিতে হবে। কেউ অধিকার ভিক্ষা দিবে না। আবার ভিক্ষায় পাওয়া অধিকারে গৌরবও থাকে না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদ্ভগবদগীতায় এ শিক্ষাটিই দিয়েছেন যে নিষ্ঠার মাধ্যমে যারা যার দায়িত্ব কর্তব্য নিষ্কামভাবে পালন করে যাওয়া। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির অসংখ্য প্রচেষ্টা করেও আপস বা শান্তির দ্বারা তাঁর হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার করতে পারলেন না। বিনিময়ে পেলেন নিজবংশের দুর্জনের সীমাহীন অত্যাচার এবং বঞ্চনা। সকল শান্তির পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায়  যুধিষ্ঠিরকে ভয়াবহ যুদ্ধ করে হলেও নিজভূমি পুনরুদ্ধার করতে হয়েছে। 

মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁