বই একটি খোলা বারান্দার মত, যে বারান্দায় দাড়ালে মন প্রসারিত হয়ে যায়, সকল সংকীর্ণতা চলে গিয়ে দৃষ্টি সুদূরপ্রসারী হয়ে যায়। তাই আমাদের প্রতিদিন সময় করে সে বারান্দাতে একবারটি হলেও এসে দাড়ানো উচিৎ। এ জ্ঞানরাজ্যের বারান্দাতে এলে আমাদের অনুভব হয় আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কথা। যখন সামান্য সামান্য জ্ঞান আমাদের মাঝে আসে, তখনই আমাদের শরীরে ছটফটে ভাব চলে আসে, অহংকার চলে আসে।আমরা তখন সবাইকে শুধুই শেখাতে চাই।সচারাচর শিখতে কেউ চাই না। নিরবচ্ছিন্ন বই পড়া এ থেকে আমাদের মুক্তি দিতে পারে । বই পড়া হল জ্ঞানার্জনের আরোহ একটি পদ্ধতি, এ পদ্ধতিতে ধীরেধীরে আমাদের জ্ঞানরাজ্যে উত্তরণ ঘটে।মগজের বন্ধ তালাগুলো আস্তেধীরে খুলে যেতে থাকে। তাইতো বলা হয়:
"রুটি-মদ ফুরিয়ে যাবে,প্রিয়ার কালো চোঁখ ঘোলাটে হয়ে যাবে ;কিন্তু বই অনন্ত যৌবনা।"
বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থে জ্ঞান এবং জ্ঞানচর্চার অত্যন্ত প্রশংসা করা হয়েছে। জ্ঞানই পারে কোন মানুষকে অজ্ঞানের অন্ধকার থেকে, অজ্ঞানের বন্ধ্যাত্ব থেকে মুক্তি দিতে। তাই শ্রীমদ্ভগবদগীতায় বলা হয়েছে, পৃথিবীতে জ্ঞানের থেকে শ্রেষ্ঠ আর কিছুই নেই।
নহি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে৷তৎ স্বয়ং যোগসংসিদ্ধঃ কালেনাত্মনি বিন্দতি৷৷
(শ্রীমদ্ভগবদগীতা:৪.৩৮)
"নিঃসন্দেহে এই জগতে জ্ঞানের চেয়ে পবিত্র আর কিছুই নেই। দীর্ঘকাল প্রযত্ন দ্বারা কর্মযোগে চিত্ত শুদ্ধ হলে, সাধক যথাসময়ে স্বয়ং নিজের মধ্যেই সেই জ্ঞান লাভ করেন।"
জ্ঞানচর্চাকে উৎসাহিত করতে আন্তর্জাতিকভাবে ইউনেস্কোর উদ্যোগে ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতিবছর ২৩ এপ্রিল দিনটিকে বিশ্ব বই দিবস পালন করা হয়। দিবসটির প্রধান উদ্দেশ্যই হলো, বই পড়া, বই ছাপানো, বইয়ের কপিরাইট সংরক্ষণ করা ইত্যাদি বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়ানো।১৬১৬ সালের ২৩ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন স্পেনের বিখ্যাত লেখক মিগেল দে থের্ভান্তেস। তিনি তার লেখনি শক্তি দিয়ে অসংখ্য লেখকদের প্রভাবিত করেন। তাদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন লেখক আন্দ্রেস।
সাহিত্যিক আন্দ্রেস তার প্রিয় লেখক মিগেল দে থের্ভান্তেসকে স্মরণীয় এবং অমর করে রাখতেই তার মৃত্যু দিনটি ১৯২৩ সালে ২৩ এপ্রিল থেকে স্পেনে পালন করা শুরু করেন বিশ্ব বই দিবস। এর পক্ষে তিনি ব্যাপক প্রচার প্রচারণাও শুরু করে দেন।ব্যাপক প্রচার প্রচারণার ফলশ্রুতিতে অবশেষে ১৯৯৫ সালে ইউনেস্কো দিনটিকে বিশ্ব বই দিবস হিসেবে এক সর্বজনীন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দান করে পালন শুরু করে দেয়।এর পরে থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিবছর ২৩ এপ্রিল বিশ্ব বই দিবস হিসেবে বর্ণাঢ্যভাবে পালিত হয়ে আসছে। উল্লেখ্য যে, এ দিনেই ১৬১৬ খ্রিস্টাব্দে উয়িলিয়াম শেক্সপিয়র এবং ১৯৯২ সালে কিংবদন্তী পরিচালক সত্যজিৎ রায় কোলকাতায় মারা যান।
আমাদের মধ্যে অনেকেই আছে যে কিনা সারাদিন বই পড়ে। এমনকি বিছানায় শুয়ে শুয়েও বই পড়ে। এদের বিছানাতে বই ছড়ানো ছিটানো থাকে।এই বিছানায় শুয়ে শুয়ে বই পড়া বই পাগল ব্যক্তিদের বলে Librocubicularist. এ শব্দটি এসেছে ল্যাটিন দুটি শব্দ 'liber' (বই) এবং 'Cubiculum '( বেডরুম) থেকে।
বই পড়াকে অভ্যাসে পরিণত করার ক্ষেত্রে বিছানায় শুয়ে শুয়ে পড়া অত্যন্ত কার্যকরী। সমাজে কিছু ব্যক্তিদের পাওয়া যায় যাদের নেশাই থাকে বই সংগ্রহ করা। এরা যে সংগ্রহ করা সকল বই নিজেরা পড়ে তা নয়।কেউ কেউ সংগ্রহীত সকল বই নিজেরা পড়ে এবং আবার কেউ পড়ার সময়ও পায় না। কিন্তু সংগ্রহীত সকল বই নিজেরা পড়তে না পারলেও সংগ্রহ করাটা তাদের একটি নেশা। এই বই সংগ্রাহক ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকে পুরনো বই সংগ্রহ করতে খুব ভালোবাসে। পুরনো বইয়ের গন্ধ তাদের অত্যন্ত প্রিয়, এ বিষয়টিকে বলে 'Bibliosmia'. প্রেমিক-প্রেমিকার মত অনেকে বই ছাড়া এক মূহুর্তের জন্যে থাকতে পারে না, সর্বদাই তাদের হাতে বই থাকে। এই বিষয়টিকে বলে 'Book bosomed'. পৃথিবীর ইতিহাসে দেখি বিভিন্ন সময়ে অনেক জাতি বর্বরোচিতভাবে ইচ্ছাকৃতভাবে বই এবং বইয়ের গ্রন্থাগার ধ্বংস করে দিয়েছে। দ্বাদশ শতাব্দীর শুরুতেই বখতিয়ার খিলজির নেতৃত্বে নালন্দা বিশ্বাবিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের সকল বইকে আগুনে ভস্মীভূত করে বিশ্ব মানব সভ্যতার এক কলঙ্কিত ইতিহাস রচনা করেছে।ইচ্ছাকৃতভাবে এভাবে বই নষ্ট করাকে 'Biblioclasm' বলে। বই পড়তে পড়তে আমরা কোন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকলে, সেই তথটির পৃষ্ঠাটি যেন পরবর্তীতে সহজেই খুঁজে পাই, তাই বইয়ে পাতার ওপরের দিকের কোণাটা ভাঁজ দিয়ে বুকমার্ক করে রাখি। এই পৃষ্ঠাটিকে মার্ক করে রাখাকেই ইংরেজিতে 'Dog's Ear' বলে।
পাঠকের মনজগত সর্বদা একইপ্রকারের থাকে না। বয়স এবং স্থান, কাল পাত্র ভেদে পরিবর্তিত হয়। জীবনে কখনো এমনও হয় যে, বয়ঃসন্ধি এবং যৌবনকালে একটি প্রেমের বই কেউ সেসময়ে পাগলের মত গোগ্রাসে পড়েছে। পৌঢ় বয়সে গিয়ে সেই একই বই পড়তে গিয়ে বইটি পড়া আর শেষ করতে পারেনি। বরং পুনরায় বইটি পড়তে গিয়ে হাসি পেয়েছে, বিরক্ত লেগেছে। এভাবে একই ব্যক্তির জীবনে বহুবার পাঠকের জন্ম হয় এবং পাঠকের মৃত্যু নয়। পরিবর্তনশীলিতাই মানুষের জীবন, তাই মানুষ পরিবর্তিত হয়। সাথে পরিবর্তিত হয় রুচিবোধ। এই রুচির পরিবর্তনের কারণে সর্বদা একই বই পড়তে যেমন ভালো লাগে না; তেমনি সর্বদা বই পড়তেও ভালো লাগে না। বই পড়ার জন্যে প্রয়োজন অলস সময়, যে সময় কর্মব্যস্ততার কারণে সকলের থাকে না।
'বই' এবং 'বউ' বাংলা এ দুটি শব্দের ধ্বনিগত সাদৃশ্য থাকলেও, এদের মধ্যে ব্যবধান বিস্তর। এ কারণেই অনেকে মজা করে বলে, "বইকে বউ বানালে তবে আর সত্যি সত্যি বউ জুটবে না"। পৃথিবীর সকল জাতির কথা বলতে পারি না, বাঙালি বউয়েরা স্বামীর বইকে অনেকটা সতিনের মতই মনে করে বলে ভুক্তভোগী অনেকের মুখে শুনেছি। তবে হয়তো বিষয়টির ব্যতিক্রমও আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বিখ্যাত 'সোনার তরী' কাব্যগ্রন্থের 'পুরস্কার' কাব্যে এমনি অর্থের পিছনে না দৌড়ানো এক কবির গল্প লিখেছেন। কবির স্ত্রী কবিকে তিরস্কার করে বলছেন-মিল দিয়ে রাশি রাশি কবিতা লিখে, বড় বড় পুঁথি বানিয়ে হ্রস্ব, দীর্ঘ ছন্দের মাথা-মুণ্ড, ছাই-ভস্ম লিখে কি হাতি ঘোড়া কিছু কপালে জুটবে? না, জুটবে না, শস্যকণাও জুটবে না।
"সেদিন বরষা ঝরঝর ঝরে,
কহিল কবির স্ত্রী-
'রাশি রাশি মিল করিয়াছ জড়ো,
রচিতেছ বসি পুঁথি বড়ো বড়ো,
মাথার উপরে বাড়ি পড়ো-পড়ো
তার খোঁজ রাখ কি!
গাঁথিছ ছন্দ দীর্ঘ হ্রস্ব-
মাথা ও মুণ্ড, ছাই ও ভস্ম ;
মিলিবে কি তাহে হস্তী অশ্ব,
না মিলে শস্যকণা।"
বইপ্রেমী সাহিত্যপ্রেমীদের বোধহয় এমনিই হয় জীবনে। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এক শিক্ষক রসিকতা করে প্রায়ই বলেন। তার স্ত্রী ঘরে আদেশ জারি করেছে যে, ঘরে আর একটি বই আনা যাবে না। ঘরে বইয়ের কাকগুলো পূর্ণ হয়ে গেছে। স্ত্রীর আদেশ পাছে লঙ্ঘন হয়ে যায়, তাই স্ত্রীর আদেশ শিরোধার্য করে স্যারের বইকেনা বন্ধ। কথাগুলো হয়তো স্যার আমাদের মজা করে বলতেন। কিন্তু এই কথাগুলো বলার সময়ে স্যারের মুখের দিকে তাকালে বোঝা যায়, এই হাসির কথার মধ্যেও একটি বেদনা আছে। হুমায়ুন আজাদের 'বই' নামক একটি বিখ্যাত কবিতা আছে।কবিতাটিতে কবি হুমায়ুন আজাদ শিশুদের মনে লোভ ভয়ের সংস্কৃতি বিদূরিত করে শুধু চিন্তার সূর্যকে উদিত করতে চেয়েছেন, যুক্তির গোলাপকে প্রস্ফুটিত করতে চেয়েছেন, চিন্তার ভিন্ন আলো জালাতে চেয়েছেন, মানুষের মধ্যে কোন বিভেদের জাল না বুনে সকলকে ভালবাসতে চেয়েছেন।এর বিপরীতে যে বই মানুষকে ভয় দেখায়, অন্ধ করে, চিন্তাকে বন্দী করে সেই বই থেকে দূরে থাকতে বলেছেন।
"যে-বই জুড়ে সূর্য ওঠে
পাতায় পাতায় গোলাপ ফোটে
সে-বই তুমি পড়বে।
যে-বই জ্বালে ভিন্ন আলো
তোমায় শেখায় বাসতে ভালো
সে-বই তুমি পড়বে।
যে-বই তোমায় দেখায় ভয়
সেগুলো কোন বই-ই নয়
সে-বই তুমি পড়বে না।
যে-বই তোমায় অন্ধ করে
যে-বই তোমায় বন্দী করে
সে-বই তুমি ছুঁবেই না।"
প্রযুক্তির জয়জয়কার যখন শুরু হলো ইন্টারনেটের ব্যবহার ব্যপকভাবে ছড়িয়ে পরে সার পৃথিবীতে। তখন অনেকেই বলা শুরু করলো যে, ভবিষ্যতে আগামীতে ছাপানো বইয়ের আর প্রয়োজন হবে না। মানুষ অনলাইনের মাধ্যমে ডিজিটাল বা পিডিএফ বই সংগ্রহ করেই পড়বে। এটা সত্য যে ডিজিটাল বা পিডিএফ বই আমাদের বইয়ের চাহিদাকে সহজলভ্য করেছে। কিন্তু একথা সত্য যে, প্রেসে ছাপানো বই এখনো স্বমহিমায় বর্তমান। ডিজিটাল বা পিডিএফ বই প্রেসে ছাপানো বইকে সামান্য প্রতিযোগিতায় ফেলেছিলো সত্য। কিন্তু বইকে ম্লান করতে পারে নি। ব ই বইয়ের স্থানেই আছে এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে পিডিএফ বই তার স্থানেই আছে। কেউ কারো স্থান নিতে পারেনি। এখনো অনেক পাঠকেরা আছে, যারা বইয়ের দোকানে গিয়ে নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিতে পছন্দ করে। যারা বই নিয়ে ঘুরতে পছন্দ করে। যারা বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যায়। আবার ঘুম থেকে উঠেই বইকে স্পর্শ করে। যারা স্বপ্নেও বইকে দেখে এবং বইয়ের পাতায় পাতায় স্বপ্নের জাল বোনে।